বাংলা গল্প পড়ার অন্যতম ওয়েবসাইট - গল্প পড়ুন এবং গল্প বলুন

বিশেষ নোটিশঃ সুপ্রিয় গল্পেরঝুরিয়ান - আপনারা যে গল্প সাবমিট করবেন সেই গল্পের প্রথম লাইনে অবশ্যাই গল্পের আসল লেখকের নাম লেখা থাকতে হবে যেমন ~ লেখকের নামঃ আরিফ আজাদ , প্রথম লাইনে রাইটারের নাম না থাকলে গল্প পাবলিশ করা হবেনা

আপনাদের মতামত জানাতে আমাদের সাপোর্টে মেসেজ দিতে পারেন অথবা ফেসবুক পেজে মেসেজ দিতে পারেন , ধন্যবাদ

ভুল মানুষ :: প্রথম পর্ব

"ওয়েস্টার্ন গল্প" বিভাগে গল্পটি দিয়েছেন গল্পের ঝুরিয়ান Sayemus Suhan (০ পয়েন্ট)

X অলস ভঙ্গিতে ঘোড়ার পিঠে বসে আছে রায়ান। লম্বা চওড়া দশাসই চেহারা। বিশাল বে ঘোড়াটা দুলছে চলার তালে তালে, তার সাথে তাল মিলিয়ে দুলছে ওর শরীরও। গায়ে একটা লাল জামা, অ্যালকালি ধুলোর আস্তর পড়ে এখন ধূসরপ্রায়। ময়লা ঘাম শুকিয়ে স্থায়ী দাগ পড়ে গেছে। চিবুকের নিচে গলা জড়িয়ে ঢিলেভাবে বাঁধা একটা নীল রূমাল। টেক্সাসের নিদাঘ দুপুর। রোদ যেন জিহ্বা মেলে লক লক করছে। সামনে তাকাতে গিয়ে তীব্র আঁচে চোখ কুঁচকে যাচ্ছে রায়ানের। কপাল বেয়ে চোখের কোনে ঘাম জমে জ্বালা করছে। সামনে ছোট্ট একটা শহরের আবছা অবয়ব। শহরটার নাম জানে রায়ান। বাইসন। দূর থেকে শহরটাকে জরিপ করে নিচ্ছে ও। ‘থাম বাছা,’ আস্তে করে বাহনের লাগামে টান দিল। ‘একটু দাঁড়া দেখি। অবস্থাটা আগে বুঝে নেই।’ দু’পায়ের হাঁটু দাবিয়ে চাপ দিল ঘোড়াটার পাঁজরে। একটু দোনোমনো করে থামল কান্ত ঘোড়াটা। বোঝা যাচ্ছে, অতটা পথ পাড়ি দিয়ে এসে এখন তার খাবার ও বিশ্রাম দুটোই চাই। সামনে শহরটার অস্তিত্ব ওর চোখেও পড়েছে। সুতরাং যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ওখানে না-পৌঁছে পথে সময় নষ্ট করার ইচ্ছে নেই ওর। তবে শেষ পর্যন্ত দাঁড়াল অনিচ্ছা সত্ত্বেও। একটু অবাক হয়ে মুখ ফিরিয়ে দেখতে চাইল মালিককে। বোকা নাকি লোকটা! ‘দেখ ব্যাটা,’ হাসল রায়ান। বোঝানোর ভঙ্গিতে বলল, ‘আমার দিকে ওভাবে তাকিয়ে লাভ নেই। দেখছিস তো পৌঁছে গেছি। তবে বেশি কিছু আশা করে বসিস না যেন। দেখা যাবে হয়তো শহরটায় কেউ নেই গোটা ছয়েক ইনজুন আর একটা ডাহা মাতাল ছাড়া।’ নিজের রসিকতায় হাসল সে। মাথা থেকে দুমড়ানো স্টেটসনটা সরিয়ে কপাল থেকে ঘাম ও অ্যালকালি ধুলো দুটোই মুছল। তারপর বার কয়েক ফুঁ দিল টুপির ভেতরটায়। যেন ফুঁ দিয়ে ঠাণ্ডা করতে চাইল। মিনিটকয়েক ঘোড়ার পিঠে চুপচাপ বসে রইল ও। আবার শহরটাকে দেখল জরিপের ভঙ্গিতে। দূর থেকে ঘরগুলোকে দেখাচ্ছে ঘন সন্নিবেশিত, অনেকটা ওয়েদার বোর্ডের মতো। ছবির মতো নিথর দেখাচ্ছে শহরটাকে। কোথাও কোনো নড়াচড়া চোখে পড়ছে না। মনে হচ্ছে যেন আদৌ কেউ নেই শহরটায়। ব্যাপারটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। টেক্সাসের এ-অঞ্চলে দিনের এ-সময়টায় সবচেয়ে বেশি গরম। সুতরাং পাথরফাটা এ-গরমে খুব বেশি দায়ে না-পড়লে ঘর ছেড়ে এক পাও বেরোতে চাইবে না কেউ। স্টেটসনটা আবার মাথায় চড়াল রায়ান। বে’র পেটে হাঁটুর গুঁতো লাগাল। তার দরকার ছিল না অবশ্য। এগিয়ে চলল বে। সামনের শহরটায় কোনো ঝামেলা হতে পারে কিনা কিংবা হলে সেটা ঠিক কী ধরনের হতে পারে, সে-সম্পর্কে স্পষ্ট কোনো ধারণা নেই রায়ানের। ও নির্বিরোধী মানুষ। যেচে কোনো ঝামেলায় যেতে চায় না। সম্ভব হলে পাশ কাটিয়ে চলে যাওয়ার পপাতী। বাইসনে কোনো ঝামেলা আশা করছে না ও। তেমন সম্ভাবনা থাকলে শহরটাকে দূর থেকেই পাশ কাটিয়ে চলে যেত। কিন্তু এখন ওর খাদ্য, পানীয় আর বিশ্রাম দরকার। ওর ঘোড়াটারও ঠিক তা-ই পাওনা হয়েছে। বিশেষ করে ঘোড়াটার পাওনা মিটিয়ে দিতে হবে। * * * টেক্সাসে একেবারে প্রথম দিককার সেটলারদের একজন ছিল রায়ানের দাদা। বুড়ো তার জীবনের মেয়াদ পুরোটাই কাটিয়ে গিয়েছিল। দাদার সান্নিধ্যে জীবনের বেশ কটি বছর কাটিয়েছিল রায়ান। নাতিকে ভাল বাসত বুড়ো ম্যাক রায়ান। যতদিন বেঁচেছিল, ততদিন নিজের আজীবন অভিজ্ঞতা থেকে সেরা জিনিসগুলো শেখানোর চেষ্টা করেছে। বুড়ো বারবার একটা কথা বলত রায়ানকে, ‘বাছা, একটা কথা কখনো ভুলবি না। তুই খাস না-খাস, তোর ঘোড়া আর অস্ত্রটাকে কখনো উপোস রাখবি না। তোকে হয়তো এমন জায়গায় যেতে হবে, যেখানে আইনের চেয়ে অস্ত্রের জোরই বেশি। তাছাড়া এমন এমন সময়ও আসতে পারে, যেখানে আইনের হাত পৌঁছাতে অনেক সময় লেগে যায়। সেখানে অস্ত্রই রা করবে তোকে। ‘তোকে ওদের প্রতি সম্মান দেখাতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে ঘোড়ার পেটে যেন দানাপানি আর অস্ত্রের পেটে ছোঁড়ার মতো গুলি ভরা থাকে। তুমি যদি ওদের দিকে মনোযোগ না-দাও, ওরা তোমার প্রয়োজনের সময় কাজে আসবে না।’ দাদার কথাগুলো মনের ভেতর গেঁথে নিয়েছে রায়ান। তার বাবাও ছিল একজন সাবধানী মানুষ। বাবার মুখেও এই একই কথা শুনেছে সে বহুবার। মূলত সে র্যাঞ্চার। তবে মার্শালের চাকরিও করেছে। কিন্তু বছর খানেক পরে ছেড়ে দিয়েছে ওটা। কাজটাকে উপভোগ করতে পারেনি। স্থানীয় মাইনার আর বোকাসোকা কাউবয়দের ওপর স্রেফ খবরদারি করার কাজটাকে বড্ড একঘেয়ে মনে হয়েছে। মাইনাররা শহরে এসে আকন্ঠ মদ গেলে, জুয়া খেলে। কাউবয়রাও তাই। শনিবার শহরে ওদের হৈ হৈ আর চিৎকারে কানপাতা দায়। সামান্য মতান্তর থেকে বড়জোর মারপিট পর্যন্ত চলে তাদের মধ্যে। তবে এদের সামলানো কোনো ব্যাপারই না একজন দ ল’ অফিসারের জন্যে। কিন্তু এদের প্রতি কঠোর হওয়াটা সম্ভব হয়নি ওর প।ে সবচেয়ে বড় কথা হলো খুনোখুনিটা এখন ওর ধাতে সয় না। ত্যাঁদড় কোনো আউট ল’য়ের মোকাবিলা করতে গেলে ওকে মেরে ফেলা ছাড়া অন্য কোনো পথ থাকে না। কিন্তু ব্যাপারটাকে ঘৃণা করে রায়ান। নিজের এ-পরিবর্তন হঠাৎ করেই ধরা পড়েছে ওর কাছে। ওর বউ রাইসা মারা যাওয়ার পর থেকেই। রাইসা মরে যাওয়ার সাথে সাথে ওর ভেতরও যেন কিছু একটা মরে গেছে। এমন এক শূন্যতায় ছেয়ে গেছে সারা বুক যে, কোনো কিছুতেই তা আর পূরণ হলো না। টেক্সাসের রোদে পোড়া শুকনো খটখটে মাটির মতোই যেন এখন তার ভেতরটা। অনেক কষ্টে ছোট্ট একটা র্যাঞ্চ গড়ে তুলেছিল রায়ান। ছোট্ট, কিন্তু আশা আর আনন্দে তার পরিধি ছিল অনেক বড়। র্যাঞ্চের কাজে নিজেকে উজাড় করে দিয়েছিল রাইসা। যত ছোটই হোক, র্যাঞ্চটা তাদের নিজেদের। নিজের মালিকানায় যে কোনো কিছু থাকাটা যে কেমন আনন্দের, সেটা মনে প্রাণে উপভোগ করতে শুরু করেছিল। কিন্তু এক সময় ব্যাপারটায় কেমন যেন একঘেয়েমি এসে গেল রাইসার। দিনের পর দিন কান্ত আর বিষণœ দেখাতে লাগল ওকে। তাদের কোনো বাচ্চা ছিল না। থাকলে হয়তো অন্যরকম হতে পারত। মুখে রক্ত তোলা পরিশ্রমকেই তখন মনে হতে পারত পরম সার্থকতা। র্যাঞ্চ কেনার তৃতীয় বছরেই রাইসার চোখ থেকে আনন্দের দ্যুতি নিভে যেতে দেখল রায়ান। তবে ব্যাপারটাকে খুব একটা পাত্তা দেয়নি ও। ভেবেছে এটা হয়তো সাময়িক কান্তি। যত কিছুই হোক, একজন মহিলার পে একজন পুরুষের মতো পরিশ্রম করা সম্ভব নয়। সে নিজে সারাণ ব্যস্ত থাকত র্যাঞ্চের কাজে। সকাল থেকে সন্ধে পর্যন্ত ভূতের মতো খাটত। ঘরে ফিরত সারা গায়ে ধুলোবালি আর কালিঝুলির আস্তর নিয়ে। হাত-মুখ ধুয়ে কাঠের চেয়ারটায় বসে ঠাণ্ডা খাবার গিলত গোগ্রাসে। তারপর পরদিনের কাজের পরিকল্পনা করতে বসত। শেষ কয় বছরে রাইসাকে ঠিক মতো সময় দেয়াটাও হয়ে উঠত না ওর। র্যাঞ্চিং শুরু করার আগে বছরের পর বছর ধরে বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত ছিল রায়ান। খনির কাজ, রেলরোডঅলা ও র্যাঞ্চগুলোর মাংসের যোগান দেয়ার জন্যে শিকারের কাজ, সেনাবাহিনীর গাইডের কাজ, স্টেজ কোচের গার্ড এবং মাঝে মধ্যে কাউবয়ের কাজÑকিছুই বাকি রাখেনি। কোনো কাজেই শেষ পর্যন্ত মন বসাতে পারেনি। সে চাইছিল এমন কিছু করতে, যা তাকে বুড়ো বয়সে স্থিরতা এনে দেবে। র্যাঞ্চিংটাকেই সে জন্যে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য পেশা হিসেবে নিতে চেয়েছিল। প্রথম প্রথম রাইসা নিজেও র্যাঞ্চিং নিয়ে দারুণ উত্তেজনার মধ্যে ছিল। স্বামীকে সারাদিন র্যাঞ্চের কাজে ডুবে থাকতে দেখে ভেবেছিল, ভবঘুরের মতো এখানে ওখানে না-ঘুরে একটা চমৎকার কাজ করতে চাইছে লোকটা। সব চেয়ে বড় স্বস্তিতে ছিল যে, ওর স্বামী ল’ম্যান নয়। পশ্চিমে ওই পেশাটাই তখন সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ বলে ভাবা হতো। রাইসা এই পেশাটাকে ঘৃণা করত। রায়ান কাজ থেকে ফিরে এলে তারা একত্রে বসে গল্প করতÑল’ অফিসারের চাকরি এবং তাতে ভালো বেতনের কথা বললেই ঠোঁট ওল্টাত রাইসা। ঘৃণাটা মোটেই গোপন করার চেষ্টা করত না। কিন্তু তাদের সে-আনন্দ বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। র্যাঞ্চটা বড় সস্তায় পেয়েছিল রায়ান। ভেবেছিল খুব জিতে গেছে। কিন্তু আস্তে আস্তে ব্যাপারটা উপলব্ধি করতে শুরু করে সে। গ্রীষ্মে অসহনীয় গরম, আর শীতকালে টেক্সাসের প্রবল ঠাণ্ডা বাতাস তাকে বুঝিয়ে দিল যে, র্যাঞ্চ কেনার ব্যাপারে মোটেই সুবিবেচনার পরিচয় দিতে পারেনি। ওটা আসলেই একটা মরা জায়গা। পরিশ্রম করতে করতে নিজের জীবনপাত করলেও মরা গাছে ফুল ফোটানোর চেষ্টার মতো পণ্ডশ্রমই হবে শুধু। তবু কি পিছু হটত সে? মনে হয় না। রাইসা অমন অকালে চলে না-গেলে হয়তো শেষ না-দেখে ছাড়ত না। আর এখন রায়ান চলেছে লুইসিয়ানার দিকে। উদ্দেশ্য অবশ্য সে একই। আরেকটা র্যাঞ্চ করবে সে। র্যাঞ্চিং তার পছন্দের কাজ। ফসল ফলানোর মধ্যে সে খুঁজে পায় সৃষ্টির স্বাদ আর বেঁচে থাকার আনন্দ। কিন্তু টেক্সাসের রসকষহীন বন্ধ্যা মাটি তাকে দিয়েছে অপূর্ণতা আর অপ্রাপ্তির যন্ত্রণা। আর সারাণ ব্যস্ত থাকতে হয়েছে লড়াই আর সংগ্রামে। চারপাশের অসংখ্য স্বার্থপর আর নির্বোধ মানুষের সঙ্গে এক অর্থহীন লড়াই কান্ত করে ফেলেছে ওকে। ওর এ-পর্যন্ত জীবনটা যেন একটা কঠোর লড়াইয়ের অফুরন্ত অধ্যায়। টেক্সাস জায়গাটা প্রকৃতিগতভাবে রু আর কর্কশ। আর এখানকার বাসিন্দারা হলো বুনো, বেপরোয়া। রায়ান চায় একটা শান্তশিষ্ট জীবন। দিনভর কাজ আর সন্ধেয় ঘরে ফিরে প্রিয়জনের সান্নিধ্যে সময় কাটানো। তাদের নিয়ে বেঁচে থাকা। আশেপাশের মানুষদের সঙ্গে সম্পর্ক থাকবে সৎপ্রতিবেশীসূলভ। সে যেমন অন্যের ব্যাপারে নাক গলাবে না, তেমনি নিজের ব্যাপারেও আর কারো মাথা ঘামানো পছন্দ নয় ওর। কিন্তু তবু অনেক বার ওকে লড়াইয়ে নামতে হয়েছে। লড়াই স্থায়ী দাগ রেখে গেছে ওর শরীরেও। বাঁ কাঁধের গভীর তচিহ্নটা তারই স্মৃতি। বুলেটটা আরেকটু নিচু হয়ে গেলে ওর পিঠ ভেদ করে হৃৎপিণ্ডে গিয়ে লাগতে পারত। আর তাহলে এখন আর তাকে ভবঘুরের মতো টেক্সাস ছেড়ে বেরোতে হতো না নতুন আবাসের খোঁজে। রাইসার কথা এখনো ভুলতে পারে না ও। বিশেষ করে মনে পড়ে ওকে কবর দেয়ার সময়টার কথা। যে-পাদ্রী ওকে শেষ শয়ানে রেখেছিল, ওর প্রতি ক্রোধে অগ্নিশর্মা হয়ে গিয়েছিল সে। সবাই তাকে পাদ্রী ওয়াল্ট নামে ডাকত। রাইসাকে শেষ শয়ানে রাখার কাজটা খুব যতœ সহকারেই করেছিল ওয়াল্ট। কিন্তু শেষ মুহূর্তে একটা ভুল করে ফেলেছিল। এমন কিছু করেছিল, যা রায়ানকে ভীষণ ুব্ধ করে তুলেছিল। জনাতিরিশেক মানুষ ছিল অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া অনুষ্ঠানে। লাশটা কবরে শুইয়ে দিয়ে পাড়ে দাঁড়িয়ে সবাইকে নিয়ে প্রার্থনা শুরু করেছিল লোকটা। প্রার্থনা করতে গিয়ে বলেছে, ‘জেসাস, রাইসাকে তুমি তার আসল ঠিকানায় পথ দেখিয়ে নিয়ে যেয়ো। ওর এমন কাউকে দরকার ছিল যে ওর যতœ নিতে পারত। কিন্তু বেচারীকে কাটাতে হয়েছে নির্জন প্রেইরিতে প্রায় একা একা। আর ওর সে একাকিত্বের কথা তুমি নিশ্চয় অবহিত আছ। ও কেবল সারাণ অপোয় থেকেছে ওর স্বামী কখন কাজ থেকে ফিরে আসবে…’ কবর দেয়া শেষ হওয়ার পর শবযাত্রীরা সবাই চলে যাওয়া পর্যন্ত অপো করেছে রায়ান। তারপর ক্রোধে ফুঁসতে ফুঁসতে চড়াও হয়েছে লোকটার ওপর। বুকের কাছে জামা খামচে ধরে বলেছে, ‘এবার আসো, তোমাকে আচ্ছা করে একটা পিটুনি লাগাই। এটা তোমার পাওনা হয়েছে।’ আশ্চর্য ! অমন লম্বা চওড়া শক্তিশালী জওয়ান লোকটার মারমুখো ভাব দেখেও একটুও ভয় পায়নি ছোটখাট আর হালকা পাতলা গড়নের পাদ্রী। মৃদু হেসে বলেছে, ‘যে কোনো অপমানের প্রতিশোধ তুমি মারপিটের মধ্য দিয়েই নিতে চাও, তাই না?’ পাত্তা দেয়নি রায়ান। লোকটার মুখে প্রচণ্ড বেগে শক্ত হাতের দু’দুটো ঘুষি লাগিয়ে দিয়েছে। মুখের এক পাশ কেটে রক্ত গড়াতে শুরু করেছে পাদ্রীর। সে অবস্থায় বলল, ‘মি. রায়ান, তুমি আমার ওপর রাগ ঝাড়ছ, কারণ আমি তোমাকে যা বলেছি, তা সত্যি। আর সত্যিটা তুমি বুঝতে পেরেছ, কিন্তু সেটা নিজের কাছে স্বীকার করতে চাইছ না। রাইসা আমার কাছে প্রায় সময় তার নিঃসঙ্গতার কথা বলত, তোমাকে নিয়ে তার ভয়ের কথা বলত। আমার চেয়ে বেশি বলত আমার স্ত্রীর কাছে।’ রায়ানের চোখে চোখে তাকিয়ে অবলীলায় কথাগুলো বলে গেল পাদ্রী। ওর গলায় সামান্য ভয়ের আভাসও দেখল না রায়ান। এই ব্যাপারটা একটু চিন্তায় ফেলে দিল ওকে। থমকে গেল ও। কথাগুলো যেন ছুরির ফলার মতো ফালা ফালা করল তাকে। ওর মনে আছে, রাইসার মৃত্যুর পর সেই প্রথম কান্না পেয়েছিল ওর। একদম নিজেকে উজাড় করে দেয়া কান্না। এর আগে আর কখন কেঁদেছে মনে ছিল না ওর। ওর শৈশবেও কখনো এতটা কান্না কেঁদেছে বলে মনে পড়ে না। এরপর ওই পাদ্রীসহ রাইসার কবরের পাশে বসে দীর্ঘণ ধরে চোখের পানি ফেলেছে রায়ান। মন খুলে কথা বলেছে ওর সাথে। নিজে যতটা বলেছে, শুনেছে তার চেয়ে বেশি। গসপেল থেকে ওকে অনেক কথা বলেছে পাদ্রী ওয়াল্ট। বড় হওয়ার পর থেকে ওসব কিছুর সঙ্গে সম্পর্ক চুকে বুকে গিয়েছিল ওর। ও চার্চে যায় না। যায় না বলে নিজের ভেতর তেমন কোনো অস্বস্তিও বোধ করে না। মনে আছে, অনেকদিন আগে বিরাট এক সমাবেশে এক লোকের ঘণ্টার পর ঘণ্টা বক্তৃতা শুনে শেষবার চার্চে ঢুকেছিল ও। ওই লোকের দরাজ গলার বক্তৃতা এখনো ওর কানে বাজে। চারদিন ধরে চলেছিল ওই সভা। রায়ান এর পরে কখনো আর কোনো ধর্মসভায় যায়নি। রাইসার কবরের পাশে দাঁড়িয়ে নিবিষ্ট মনে পাদ্রীর কথাগুলো শুনল রায়ান। পাদ্রী যীশুর কথা বলল। বলল, কীভাবে তিনি মানুষের পাপের প্রায়শ্চিত্ত করার জন্যে পৃথিবীতে নেমে এসেছিলেন। মানুষ তাকে ভুল বুঝে শুলে চড়িয়েছিল। তাঁর পবিত্র রক্তে রঞ্জিত হয়েছিল ক্রুশকাষ্ঠ। পাদ্রী বলল, আসলে ঈশ্বর তা-ই চেয়েছিলেন এবং শেষ পর্যন্ত তার প্রতিদানও দিয়েছিলেন। ওই রক্তে মানুষের পাপ ধুয়ে মুছে গিয়ে মানবজাতিকে তার স্রষ্টার কাছে গ্রহণযোগ্য করে তুলেছিল। ‘আসলে এটা ছিল মানুষের প্রতি তার সৃষ্টিকর্তার একটা উপহার। পাপ থেকে মুক্ত হয়ে বিশুদ্ধ মন নিয়ে তার কাছে ফিরে যাওয়ার সব চেয়ে সেরা উপায়,’ পাদ্রী নিজের বিশ্বাস থেকে বলেছিল এসব কথা। ওর পরিবর্তনের মূলে সে কথাগুলো কতটা প্রভাব ফেলেছিল, সে ব্যাপারে নিশ্চিত নয় রায়ান। পাদ্রী বলেছিল, একজন মানুষকে এটা বিশ্বাস করতে হবে যে, তার নিজের পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে গিয়েই যীশু খ্রীস্টকে শুলে চড়তে হয়েছিল। এ জন্যে মানুষকে অনুতপ্ত হতে হয় আর ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করতে হয় যে, তার আত্মা যেন সর্বদা পবিত্র থাকে। রায়ান তর্ক করেছিল পাদ্রীর সঙ্গে। বলেছে, একজন মানুষের নিজেকে রা করার ব্যাপারে অটল থাকা উচিত। তাকে অন্যের স্বার্থ ব্যাহত না-করে নিজের সহায়-সম্পত্তি রা করার কাজেও দৃঢ়তা দেখাতে হবে। তার উচিত হবে না একজন খুনিকে মা করা। কারণ যারা মানুষ খুন করে, ঈশ্বরও তাদের মাফ করেন না। এটা করতে হলে রায়ানের নিজেকেও বেঁচে থাকার জন্যে একজন খারাপ মানুষের দয়া-দােিণ্যর ওপর ছেড়ে দিতে হবে। পাদ্রীর কথাগুলো মেনে নেয়া সহজ হয়নি ওর প।ে তবে ওর রাগ আস্তে আস্তে প্রশমিত হয়েছিল। ধীরে ধীরে কৌতূহল জেগে উঠেছিল মনে। তারপর পাদ্রী যখন রাইসা সম্পর্কে বলতে শুরু করল, তখন মনোযোগ দিয়ে শুনল ওর কথা। পাদ্রী বলল, রাইসা আর তার বউ একত্রে হাঁটু গেড়ে বসে তার জন্যে প্রার্থনা করত। বিশেষ করে রাইসা প্রার্থনায় স্বামীর জন্যে কী চাইত, তা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বলল। শুনতে শুনতে স্তব্ধ হয়ে গেল রায়ান। ওর ভেতরে আশ্চর্য এক অনুভূতির জন্ম নিল। রাইসার মধ্যে ধীরে ধীরে আসা পরিবর্তনগুলোর কথা মনে পড়ল রায়ানের। এক রোববারের বিকেলে রাইসা চার্চ থেকে বাড়ি ফিরল। গুন গুন করে গান গাইছিল মেয়েটা। ওকে খুব সুখী আর পরিতৃপ্ত দেখাচ্ছিল। রায়ান এর আগে আর কখনো ওর মধ্যে এমন ভাব দেখেনি। রায়ানের মনে পড়ল, রাইসা সেদিন ওর সাথে গল্প করতে গিয়ে বারবার ঈশ্বর নিয়ে কথা বলছিল। এক সময় ওকেও ওর সাথে চার্চে যেতে রাজি করানোর জন্যে পীড়াপীড়ি শুরু করেছিল। রায়ান পাত্তা দেয়নি ওকে। রাইসা আর পীড়াপীড়ি করেনি। কিন্তু এর পর থেকে রাইসার মধ্যে একটা পরিবর্তন খেয়াল করল। কোনো ব্যাপারে সে আর আগের মতো উৎসাহ দেখাচ্ছে না। রাইসাকে খুব ধর্মপরায়ণ বলে জানত রায়ান। তাতে অবশ্য তার কোনো আপত্তি ছিল না। কিন্তু তাই বলে ওকেও তাতে জড়িয়ে ফেলতে চাইবে, এতটা ভাবেনি। রাইসার পরিবর্তনটা বেশ আনন্দের সাথেই খেয়াল করল রায়ান। কোনো কিছু নিয়ে রেগে গেলে খুব বেশি চেঁচামেচি করার স্বভাব ছিল মেয়েটার। এমনকী ও কাজশেষে ঘামে গরমে অস্থির হয়ে ফিরে এসেছে মাত্র, তখনই ও শুরু করত চেঁচামেচি, রায়ানকে হাত-মুখ ধুয়ে সুস্থির হয়ে বসার সময়টুকু পর্যন্ত দিত না। কিন্তু ওই দিনের পর থেকে রাইসার সে-অভ্যাসটা যেন একেবারেই চলে গেল। এর মধ্যে সে খেয়াল করল নতুন কিছু জিনিস। যেমন রায়ানের ফেরার আভাস পাওয়া মাত্র রাইসা ঘর থেকে বেরিয়ে এসে ওকে অভ্যর্থনা জানাত, পানি এনে দিত প্রথমে হাত-মুখ ধোয়ার জন্যে। এরকম আরো কিছু ছোটখাট পরিবর্তন চোখে পড়ল। রায়ান অবাক হলো এবং রাইসার এসব পরিবর্তন উপভোগ করতে শুরু করল। পাদ্রী আরো কিছুণ থেকে চলে যাওয়ার পর রায়ান হাঁটু গেড়ে বসল রাইসার কবরের পাশে। অনেকণ বসে রইল। যখন উঠল, তখন চোখের পানিতে গাল আর চিবুক ভেসে গেছে ওর। আর নিজের বুকের ভেতর টের পেল একধরনের শূন্যতা আর উদাসীনতা। অবাক বোধ করল রায়ান। এর মানে বুঝতে পারল না। কারণ এধরনের অনুভূতির সঙ্গে আর কখনো পরিচয় হয়নি ওর। ওর ভেতরের সব রাগ আর বিদ্বেষ যেন মরে গেছেÑএবং সে প্রথম তার মনে হলো, তার টেক্সাস ছেড়ে চলে যাওয়া উচিত। কারণ টেক্সাসে থাকা মানে সারাণ দুশ্চিন্তা আর দুর্ভাবনায় থাকা। তার মানে হলো আরো লড়াই এবং খুন-জখম। এর মানে হলো সে যেমন কাউকে খুন করবে, তেমনি কারো হাতে নিজেও হয়তো একদিন খুন হয়ে যাবে। সুতরাং টেক্সাস ছেড়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়াটা ওর পে খুব বেশি কষ্টকর হলো না।


এডিট ডিলিট প্রিন্ট করুন  অভিযোগ করুন     

গল্পটি পড়েছেন ৪০২ জন


এ জাতীয় গল্প

গল্পটির রেটিং দিনঃ-

গল্পটির বিষয়ে মন্তব্য করুন

  • গল্পটির বিষয়ে মন্তব্য করতে আপনার একাউন্টে প্রবেশ করুন ... ধন্যবাদ... Login Now