বাংলা গল্প পড়ার অন্যতম ওয়েবসাইট - গল্প পড়ুন এবং গল্প বলুন

বিশেষ নোটিশঃ সুপ্রিয় গল্পেরঝুরিয়ান - আপনারা যে গল্প সাবমিট করবেন সেই গল্পের প্রথম লাইনে অবশ্যাই গল্পের আসল লেখকের নাম লেখা থাকতে হবে যেমন ~ লেখকের নামঃ আরিফ আজাদ , প্রথম লাইনে রাইটারের নাম না থাকলে গল্প পাবলিশ করা হবেনা

আপনাদের মতামত জানাতে আমাদের সাপোর্টে মেসেজ দিতে পারেন অথবা ফেসবুক পেজে মেসেজ দিতে পারেন , ধন্যবাদ

নতুন গুলাগ চ্যাপ্টার- ২

"সাইমুম সিরিজ" বিভাগে গল্পটি দিয়েছেন গল্পের ঝুরিয়ান রিয়েন সরকার (০ পয়েন্ট)

X ২ উপর থেকে দেখতে অদ্ভুত সুন্দর লাগছে স্ট্রাসবার্গ শহরকে। বিমানটি তখন চক্কর দিচ্ছে স্ট্রাসবার্গের আকাশে। সবুজ রাইন উপত্যকা। গাঢ় সবুজ উপত্যকার পশ্চিম বরাবর নেমে আসা পাহাড়ের দেয়াল। ইউরোপের প্রধান ধমনী রাইন নদী বয়ে চলেছে আকাশের রংধনুর মত এক দিগন্ত থেকে আরেক দিগন্তে। উপত্যকার সবুজ শাড়িতে রাইন যেন জীবন্ত এক রূপালী পাড়। আহমদ মুসার মুগ্ধ চোখ দু’টি রাইন উপত্যকা ঘুরে এসে নিবদ্ধ হলো স্ট্রাসবার্গের উপর। সবুজের সমুদ্রে লাল-সাদায় মেশানো সুন্দর শহর স্ট্রাসবার্গ। শহরের সবকিছু ছাড়িয়ে সবার উপরে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে ঐতিহাসিক ‘গথিক গীর্জা’। গথিক গীর্জার উপর নিবদ্ধ হলো আহমদ মুসার উৎসুক দু’টি চোখ। শহরের সবচেয়ে পুরানো অংশ এই ঐতিহাসিক গীর্জার সামনেই ‘দি রাইন ইন্টারন্যাশনাল হোটেল’। এ হোটেলে সিট বুক করা আছে আহমদ মুসার। আহমদ মুসার নজর পড়ল সুন্দর পাহাড়ী নদী ‘রাইনে’র উপর। এই নদীটি ঘিরেই গড়ে উঠেছে স্ট্রাসবার্গ নগরী। ‘রাইন’ থেকে একটা ক্যানেল গিয়ে পড়েছে রাইনে। এর ফলেই স্ট্রাসবার্গ কার্যত সমুদ্র বন্দরে পরিণত হয়েছে। স্ট্রাসবার্গ এয়ারপোর্টে নামল আহমদ মুসা। স্ট্রাসবার্গ এয়ারপোর্ট থেকে রাস্তাটা তীরের মত সোজা গিয়ে প্রবেশ করেছে স্ট্রাসবার্গে। গাড়ির রিয়ার ভিউতে দীর্ঘ পথ এবং পথে গাড়ির দীর্ঘ সারির গোটাটাই নজরে আসে। স্ট্রাসবার্গে ঢুকে বিস্মিত হলো আহমদ মুসা। খুবই প্রাচীন শহর, কিন্তু রাস্তাগুলো আধুনিক। এয়ারপোর্ট রোডের মতই রাস্তাগুলো সোজা, ছবির মত সাজানো। গাড়ি থেকে সামনে পেছনে অনেকদূর দেখা যায়। চোখ রাখা যায় অনেক দূর। ভাড়া করা ট্যাক্সির পয়সা মিটিয়ে দিয়ে আহমদ মুসা প্রবেশ করল দি রাইন ইন্টারন্যাশনাল হোটেলে। রিসেপশন কাউন্টারের সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই রিসেপশনিস্ট মেয়েটা জার্মান মিশ্রিত ফরাসী ভাষায় আহমদ মুসাকে স্বাগত জানাল। আর মেয়েটাকেও পুরো জার্মান মনে হলো না, আবার পুরো ফরাসীও নয়। ভাষা ও চেহারাগত দিকটা এই রাইন উপত্যকা এবং এর সন্নিহিত এলাকার একটা বৈশিষ্ট্য। কারণ ফ্রান্স ও জার্মান বর্ডারের এই এলাকাটা শত শত বছর ধরে ফ্রান্স-জার্মান সংঘাতের শিকার। এই অঞ্চলটা কখনও ফ্রান্সের অংশ থেকেছে, কখনওবা জার্মানীর অংশ হয়েছে। ১৫০০ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত এই এলাকা জার্মানরা শাসন করেছে। তারপর ফরাসীরা এটা দখল করে। জনগণ তাদের উপর ফরাসী পরিচয় চাপিয়ে দেয়ার বিরুদ্ধে লড়াই করে। কিন্তু এই জনগনই আবার ১৭৮৯ সালের ফরাসী বিপ্লবের পর ফরাসী হবার জন্যে পাগল হয়ে ওঠে। ১৮৭১ সালে জার্মানরা যখন এই এলাকা দখলে করে নেয়, তখন এই এলাকার মানুষ জার্মানদের প্রত্যাখ্যান করে ফ্রান্সে হিজরত করে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ফরাসীরা এই এলাকা জার্মানদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয়। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শুরুতেই জার্মান এ অঞ্চলটা আবার দখল করে নেয়। যুদ্ধের পর ফ্রান্স অঞ্চলটা আবার ফিরে পায়। রিসেপশনিস্ট মেয়েটা স্বাগত জানালে আহমদ মুসা তাকে ধন্যবাদ দিয়ে বলল, ‘আমি বিদেশী বলেই আমার কৌতূহল। আমি বুঝতে পারছি না আপনি জার্মান না ফরাসী।’ মেয়েটা হাসল। বলল, ‘আপনার কি মনে হয়?’ ‘জার্মান ও ফরাসী দুই-ই মনে হয় আমার কাছে।’ আহমদ মুসা বলল। ‘আমি ইউরোপীয়।’ বলে আবার হাসল মেয়েটি। বলল আবার আহমদ মুসাকে কথা বলবার সুযোগ না দিয়েই, ‘এটা বললাম কেন জানেন, স্ট্রাসবার্গ ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাজধানী, মানে এখানে ইউরোপীয় ইউনিয়নের হেড কোয়ার্টার।’ ‘জানি।’ আহমদ মুসা বলল। ‘আরও কি জানেন, স্ট্রাসবার্গ সম্রাট শার্লেম্যানের স্পিরিচুয়াল ক্যাপিটাল ছিল?’ হেসে বলল মেয়েটি। ‘জানি। কিন্তু শার্লেম্যানের ধর্মরাজ্যের স্পিরিচুয়াল ক্যাপিটালকে ইউরোপীয় নেতৃবৃন্দ তাদের ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাজধানী হিসেবে বেছে নিলেন কেন?’ হাসির সাথে হালকা কন্ঠেই বলল আহমদ মুসা। প্রায় ৫০ বছর আগে জার্মানী ও ফ্রান্সের দুই রাষ্ট্রপ্রধান এই স্ট্রাসবার্গে বসেই শার্লেম্যানের আদর্শে ইউরোপকে ঐক্যবদ্ধ করার নীল নক্সা করেছিলেন বলে বোধ হয়।’ ‘শার্লেম্যানের খৃষ্টীয় মৌলবাদী আদর্শে নব্য ইউরোপীয় ইউনিয়ন!’ আহমদ মুসার চোখে মুখে কৃত্রিম বিস্ময়। ‘তা জানি না।’ হেসে উঠে কথাটা বলেই মেয়েটি মুখে সিরিয়াস ভাব ফুটিয়ে তুলে বলল, ‘ওকে স্যার। এবার নিশ্চিন্ত থাকুন আমি একজন ফরাসী।’ ‘আমি আহমদ আবদুল্লাহ। সৌদি আরব থেকে একটা কক্ষ বুক করা আছে। বুকিং নাম্বার ডবল ‘এ’ ডবল ‘জিরো’ ডবল ‘নাইন’। ‘প্লিজ স্যার, বলে মেয়েটি কমপিউটার কী বোর্ডে আঙুল ঘুরিয়ে স্ক্রীনের উপর দৃষ্টি বুলিয়ে বলল, ‘ওকে স্যার। ওয়েলকাম।’ ফরমালিটিজ সেরে আহমদ মুসার হাতে চাবি তুলে দিতে গিয়ে হঠাৎ কিছু মনে পড়ায় বলে উঠল, ‘মি.আহমদ আবদুল্লাহ, একটা খবর দিতে ভুলে গেছি। আপনার দুজন বন্ধু আপনি এসেছেন কিনা, কবে আসবেন জানতে চেয়েছিলেন। কিন্তু নাম বলেননি।’ ভ্রুকুঞ্চিত হলো আহমদ মুসার। বলল, ‘আমার বন্ধু, নাম বলেনি!’ ‘স্যার, ব্যাপারটা খুবই অসৌজন্যমূলক এবং অগ্রহনযোগ্য। সেজন্যে বিষয়টার আমরা ফরমাল রেকর্ডও করিনি।’ বলল মেয়েটি। ‘মাফ করুন, বলতে পারেন কন্ঠ দুটি কি জার্মান না ফরাসী ছিল?’ ‘ওকে স্যার। জার্মান-ফরাসী কোনটিই নয়। খাঁটি বৃটিশ উচ্চারণ।’ বলল মেয়েটি। ভাবছিল আহমদ মুসা। এমন কোন বৃটিশ বন্ধু নেই যারা তার এখানে আসার কথা জানে এবং এখানে সিট বুক করার কথা জানতে পারে!আবার ভাবল, ভুলও তো ওদের হতে পারে? আবার এমনও হতে পারে মুসলিম নামে বুকিং দেখে সরকারী কোন এজেন্সী অথবা অন্য কোন মহল পরিচয় চেক করার জন্যেই টেলিফোন করতে পারে। বেদনাদায়ক হলেও এটা সত্য যে, নিউইয়র্কের লিবার্টি ও ডেমোক্রাসি টাওয়ার ধ্বংসের পর থেকে মুসলমানদেরকে ইউরোপ আমেরিকায় সন্দেহের চোখে দেখা হচ্ছে। কিন্তু সেটা হলে সব মুসলিম বোর্ডারের ব্যাপারেই খোঁজ-খবর নেয়া হবে। সেটা হচ্ছে কি? এটা চিন্তা করেই আহমদ মুসা রিসেপশনিস্ট মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করল, ‘হোটেলে কি আর কোন মুসলিম বোর্ডার আছেন?’ ‘আছেন। দু’জন। একজন জার্মান ছাত্রী ‘ফাতিমা কামাল’, অন্যজন ফরাসী ছাত্র যায়েদ ফারুক। কিন্তু কেন বলুন তো?’ ‘তাদের ব্যাপারে কেউ কি টেলিফোনে কিছু জিজ্ঞেস করেছে?’ ‘না ।’ ভ্রুকুঞ্চিত হয়ে উঠেছে মেয়েটির। বলল সে আবার, ‘মি.আহমদ আবদুল্লাহ, আপনি কিছু সন্দেহ করছেন?’ আহমদ মুসা হাসল। বলল, ‘ভাবছিলাম। বেনামী টেলিফোন তো!’ ‘মি.আহমদ আবদুল্লাহ, আপনি ইচ্ছা করলে পুলিশকে জানাতে পারেন।’ আবার হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘আপাতত থাক। ধন্যবাদ আপনাকে।’ আহমদ মুসা কক্ষের চাবি নিয়ে চলে গেল তার কক্ষে। কক্ষ পছন্দ হলো আহমদ মুসার। কক্ষের স্টাইল গথিক গীর্জার মত ট্রেডিশনাল হলেও উপকরণ সবই আধুনিক । আহমদ মুসা গোসল সেরে বিশ্রামে যেতে যেতে ভেবে নিল। কাজ শুরু করার আগে শহরটাকে ভালো করে দেখে নেবে । আজ পূর্ণ বিশ্রাম, কাল থেকে শহর দেখে শুরু। সেদিন আহমদ মুসা ফিরছিল ‘ইউরোপা’ রোড হয়ে । বিখ্যাত এই ইউরোপা রোডেই ইউরোপীয় ইউনিয়নের হেড কোয়ার্টার। আহমদ মুসা রাস্তার থার্ড লেইন ধরে গাড়ি চালাচ্ছিল। অভ্যাস বশতই রেয়ারভিউতে চোখ যাচ্ছিল তার। এক সময় বিস্মিত আহমদ মুসার চোখ দুটি আঠার মত লেগে গেল রেয়ারভিউতে। দেখল, দু’টি গাড়ি, একটা ব্রাউন, অন্যটি এ্যাশকালার, অনেক্ষণ ধরে তার পেছনে আসছে একই গতিতে। গাড়ি দুটি মাঝে মাঝেই সমান্তরালে চলে যাচ্ছে, আবার আগে পিছে চলে আসছে। তাও আবার বাই রোটেশানে একবার ব্রাউনটা আগে আসছে, পরে আবার এ্যাশকালারটা। হঠাৎ আহমদ মুসার মনে পড়ল গতকালও গাড়ি দুটিকে সে তার পেছনে দেখেছে এবং এয়ারপোর্ট থেকে আসার সেই প্রথম দিনেও এই গাড়িই তার পেছনে ছিল । হতে পারে অন্যান্য দিনেও গাড়ি দুটি তার পেছনে ছিল, কিন্তু হয়তো তার চোখে পড়েনি। ভাবল আহমদ মুসা। এটা কি কোন কো-ইন্সিডেন্ট, না কেউ তাকে ফলো করছে? সিদ্ধান্ত নিল আহমদ মুসা, আগামীকালও সে এ বিষয়টি পরীক্ষা করবে। হোটেলের পার্কিং প্লেসে গাড়ি পার্ক করে গাড়ি থেকে নামল আহমদ মুসা। গাড়ি থেকে নেমেই গীর্জা ও হোটেলের মাঝের রাস্তার উপর চোখ ফেলল, না গাড়িটা এ রাস্তায় ঢোকেনি। গীর্জার মোড়ে বাঁক নিয়ে তাকে গীর্জার রাস্তায় প্রবেশ করতে হয়েছে। হতে পারে, ওরা বাঁকের আড়ালে দাঁড়িয়ে এদিকে চোখ রাখছে। আহমদ মুসা ঢুকে গেল হোটেলে। পরদিন আহমদ মুসা যাচ্ছিল ধ্বংস হয়ে যাওয়া স্পুটনিক অফিসে। সেদিন এসেই একবার গেছে। কিন্তু আরও ভালো করে দেখা প্রয়োজন। যা ভেবেছিল তাই। গাড়ি দু’টি আসছে তার পেছনে। ওরা ফলো করছে তাকে, এটা নিশ্চিত। কিন্তু ওরা কারা? ওরা কি তাকে নবাগত মুসলিম ব্যক্তিত্ব হিসেবে ফলো করছে, না তাকে আহমদ মুসা হিসেবে ফলো করছে? কিন্তু তাকে আহমদ মুসা হিসেবে চিনবে কি করে? সন্দেহ নেই, তার ফটো ইহুদী গোয়েন্দা সংস্থা ‘ইরগুন যাই লিউমি’ ও ‘মোসাদে’র কাছে আছে। কিন্তু আহমদ মুসার এই স্বাভাবিক চোহারার ফটো তাদের কাছে নেই। তাছাড়া তাকে আহমদ মুসা হিসেবে যদি চিনেই থাকে, তাহলে তাকে শুধু ফলো করবে কেন? তাকে এ কয়দিনে হত্যা বা বন্দী করার উদ্যোগ নেয়াই স্বাভাবিক ছিল। তাহলে কি ওরা আমাকে ধরার আগে আমার কন্ট্যাক্ট পয়েন্টগুলে চিহ্নিত করতে চায়? যাদেরকে তাদের দরকার হতে পারে? শুধু মুসলিম ব্যক্তিত্ববলে পরিচয় জানা বা কন্ট্যাক্ট পয়েন্টগুলোর সন্ধান করার জন্যে এভাবে কেউ পেছনে লেগে থাকতে পারে? হয়তো পারে। তবে আহমদ মুসার মন বলল, ওরা নিছক একজন মুসলিম ব্যক্তিত্বে সন্ধানে ঘুরছে না। তাহলে? তাহলে কি তারা তাকে আহমদ মুসা হিসেবে চিনতে পেরেছে, না আহমদ মুসা হিসেবে সন্দেহ করছে? গ্রীন সার্কেলে পৌঁছে গেছে আহমদ মুসা। এই গ্রীন সার্কেলেই স্পুটনিকের অফিস ছিল। গ্রীন সার্কেলটা বিশাল একটি সার্কুলার মার্কেট। বিশাল সার্কুলার মার্কেটটির মাঝখানে বিরাট গ্রীন সার্কেল, বৃত্তাকার বিরাট বাগান। বাগানটা গাছে ঠাসা। মাঝে মাঝে বসার বেঞ্চি ও বাচ্চাদের দোলনা। বৃত্তাকার বাগানটির মাঝখানে আবার ঘাসে ঢাকা বৃত্তাকারি একটি উন্মুক্ত চত্বর। বৃত্তাকার বাগান ও তার চারপাশ ঘিরে বৃত্তাকার মার্কেটটি, মাঝখান দিয়ে বৃত্তাকার একটি রাস্তা। আবার বৃত্তাকার মার্কেটটির বাইরের চারপাশ ঘিরে একটা প্রশস্ত সার্কুলার রোড। আহমদ মুসার গাড়ি প্রবেশ করল এই সার্কুলার রোডে। দিনটা রোববার। বিকেল। মার্কেট বন্ধ। সার্কুলার রোডে গাড়ি ছিল না বললেই চলে। আহমদ মুসার এক মিনিট পর অনুসরণকারী গাড়ি দুটি প্রবেশ করল সার্কুলার রোডে। আহমদ মুসা কি করবে সে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছে। যে লেন দিয়ে স্পুটনিক অফিসে প্রবেশ করতে হয়, সেই লেন দিয়ে আহমদ মুসা ধীর গতিতে প্রবেশ করল মার্কেট ও বৃত্তাকার বাগানের মাঝের ইনার সার্কুলার রোডে। গাড়ি দুটিও প্রবেশ করল। বাগানে দু’চার জন লোক দেখা যাচ্ছে। ছুটির দিনে বাগানে যে ভীর হয়, তা এখনও হয়ে ওঠেনি। আহমদ মুসা তার গাড়ির রিয়ারভিউতে দেখল, গাড়ি দুটো দুরত্ব আগের চেয়ে কমিয়ে দিয়েছে। সার্কুলার রোড হওয়ার কারণে আহমদ মুসার গাড়ি যাতে চোখের আড়ালে না যায়, সেজন্যেই এ দূরত্ব কমিয়ে দেয়া হয়েছে। পেছনের গাড়ি দুটি পাশাপাশি ড্রাইভ করে আহমদ মুসার পেছনে পেছনে আসছিল। আহমদ মুসা এক সময় চোখের পলকে তার গাড়ি ঘুরিয়ে নিয়ে তীব্র বেগে এগিয়ে গাড়ি দুটি ব্লক করে তাদের সামনে দাঁড়াল এবং তার সাথে সাথেই গাড়ি থেকে বেড়িয়ে এল আহমদ মুসা। গাড়ি দুটিও হার্ড ব্রেক কষে দাড়িয়ে পড়েছিল। প্রথমটায় তারা হচকচিয়ে গিয়েছিল। সে ভাবটা কাটিয়ে উঠে আহমদ মুসাকে সামনে দাড়িয়ে থাকতে দেখেই ওরা গাড়ির দুপাশে দুজন বেরিয়ে এল। তারা দুদিক থেকে দুজন এক পা দু’পা করে এগিয়ে আসতে লাগল। তাদের একজনের হাতে রিভলবার কোটের আড়ালে লুকানো। আরেকজনের হাতে রেশমি ফাঁস। ওরা এত তাড়াতাড়ি এগ্রেসিভ হয়ে উঠবে, আহমদ মুসা তা ভাবে নি। আর আহমদ মুসা এভাবে এখানে রিভলভার ব্যবহার করাকেও ভাল মনে করছে না। আহমদ মুসা তার ভাবনা শেষ করে কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর আগেই সে দেখল, যার হাতে ফাসি তার ফাঁসিটা আকাশে উড়তে শুরু করেছে। সংগে সংগেই আহমদ মুসা সিদ্ধান্ত নিয়ে নিল এবং এ্যাক্রোব্যাটিক কায়দায় ‍দু’হাত প্রসারিত করে সামনে মাটির দিকে ছুঁড়ে দিয়ে পা আকাশ দিয়ে ঘুরিয়ে নিয়ে শূন্যেই শরীরটাকে একবার ঘুরিয়ে নিয়ে দু’পায়ের প্রচন্ড লাথি মারল রিভলবার হাতে নিয়ে দাড়াঁনো লোকটির মাথায়। লোকটি রিভলবার তুলেছিল এবং গুলিও করেছিল আহমদ মুসার লাথি তার মাথায় আঘাত করার সময়। কিন্তু গুলিটা ৭৫ ডিগ্রী কোণ করে আসা আহমদ মুসার দেহের অনেক নিচ দিয়ে চলে গেল। জোড়া পায়ের লাথি খেয়ে লোকটির দেহ ছিটকে পড়ে গেল গাড়ির পাশে। তার সাথে আহমদ মুসার দেহও ভূপাতিত হলো। মাটিতে পড়েই উঠে বসল আহমদ মুসা। লোকটির হাত থেকে ছিটকে পড়া রিভলবার কুড়িয়ে নিয়েছে সে। লোকটি উঠে বেসেছিল। আহমদ মুসা তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে রিভলবারের বাট দিয়ে তার মাথায় প্রচন্ড এক ঘা দিল। লোকটি সংগা হারিয়ে ফেলল। আহমদ মুসা উঁকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করল ফাঁসিওয়ালা লোকটি কোথায়। কিন্তু কাউকে দেখতে পেল না। আহমদ মুসা ক্রলিং করে গাড়ির পেছনে ঘুরে গাড়ির ওপাশটায় উকি দিল। কিন্তু কেউ নেই। ‘তাহলে কি ওপাশের গাড়ির ওপারে লুকিয়েছে?’ ভাবল আহমদ মুসা। ভাবার সংগে সংগেই আহমদ মুসা হাতে রিভলবার বাগিয়ে ধরে কয়েক লাফে ওগাড়ির পেছনে চলে গেল। তার পর মুহূর্তকাল থেমেই গাড়ির ওপাশটায় উঁকি দিল। না কেউ নেই। তাহলে কি পালিয়েছে? পরক্ষনেই তার মনে হলো, সে তো তাকে বোকা বানায়নি? সংগে সংগেই স্প্রিং এর মত উঠে দাড়িয়ে পেছন ফিরল আহমদ মুসা। কিন্তু তখন দেরী হয়ে গেছে। তার চোখের সামনে দিয়ে প্রথম গাড়িটা সাঁ করে বেড়িয়ে গেল। দেখল, যাবার সময় দ্বিতীয় লোকটি তার সংগাহীন সাথিকে তুলে নিয়ে গেছে। বুঝল আহমদ মুসা, সে যখন দু’গাড়ির এপাশ ওপাশ দেখছিল, তখন ঐ দ্বিতীয় লোকটি প্রথম গাড়ির সামনের দিকটায় গিয়ে লুকিয়েছিল। তারপর সে দ্বিতীয় গাড়ির দিকে চলে যাওয়ায় তার সুযোগ নিয়ে সাথিকে সহ পালিয়েছে। বোকার মত কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে থাকল আহমদ মুসা। তারপর রিভলবারটা পকেটে ফেলে এগুলো দ্বিতীয় গাড়িটার দিকে। টার্গেট হলো, ওদের খোঁজ পাওয়ার মত কোন কাগজপত্র ওদের গাড়িতে পাওয়া যায় কিনা। গাড়িতে লাইসেন্স, ব্লুবুক ছাড়া কাগজ জাতীয় আর কিছুই পেল না। লাইসেন্স ও ব্লুবুকের ঠিকানাগুলো টুকে নিয়ে গাড়ি থেকে বেরিয়ে এল আহমদ মুসা। আসরের নামাজের সময় তখন যায় যায় অবস্থা। আহমদ মুসা তাড়াতাড়ি বাগানে প্রবেশ করে একটা গাছের আড়াল খুঁজে নিয়ে দক্ষিণ-পশ্চিম অর্থাৎ কাবামুখী হয়ে নামাজে দাঁড়িয়ে গেল। চারটি চোখ আহমদ মুসাকে ফলো করছিল। একজন তরুনীর দুই চোখ এবং একজন তরুনের দুই চোখ। এই চার চোখ আহমদ মুসার সাথে দুই গাড়িওয়ালার সংঘাত –সংঘর্ষটাও দেখেছে। কিভাবে আহমদ মুসার গাড়িটা অনুসরণকারী দু’গাড়ির মুখোমুখি হলো, কিভাবে আহমদ মুসা একজন রিভলবারওয়ালা ও একজন ফাঁসওয়ালার মুখোমুখি হলো, কেমন দক্ষ এ্যাক্রোব্যাটিক কায়দায় আহমদ মুসা একই সাথে ফাঁস থেকে বাচল এবং রিভলবারধারীকে কুপোকাৎ করল, কিভাবে একজন গাড়িওয়ালা সংগাহীন একজন সাথীকে নিয়ে পালিয়ে বাঁচল, সবই তাদের চার চোখ অবলোকন করেছে বাগানের এক গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে। আহমদ মুসা বাগানে প্রবেশ করার পরও সে তাদের চোখের সামনেই ছিল। তাদের সে বিস্ময়ের ঘোর তখনও কাটেনি যে, একজন শান্তশিষ্ট চেহারার ও সাধারণ মাপের একজন মানুষ কিভাবে দু’জন ষন্ডামার্কা ফরাসীকে নাকে খত দিয়ে ছাড়ল!কিন্তু তারা যখন আহমদ মুসাকে নামাজ পড়তে দেখল তখন তাদের চার চোখ বিস্ময়ে ছানাবড়া হয়ে গেল। দু’জন এক সাথেই স্বগত কন্ঠে বলে উঠল, ‘লোকটি তাহলে মুসলমান।’ ধীরে ধীরে তাদের দু’জনের চোখমুখের বিস্ময় কেটে গিয়ে সেখানে আনন্দের প্রকাশ ঘটল। আহমদ মুসা মুসলমান একথা জানার পর তাদের মনে আনন্দের অন্ত রইল না। তারা ভেবে খুশি হলো যে, একজন এশিয়ান মুসলিম দু’জন বন্দুকধারী ফরাসীকে অবলীলাক্রমে পরাজিত করতে পারল। দুজনেই ধীরে ধীরে এগুলো নামাজরত আহমদ মুসার দিকে। আহমদ মুসা তখন মুনাজাত করছে। আহমদ মুসার পাশে গিয়ে থমকে দাঁড়াল ওরা। আহমদ মুসাও মুনাজাত এই সময় শেষ করেছিল। ঘাসের উপর পায়ের ক্ষীণ নরম শব্দ আহমদ মুসার কান এড়ায়নি। তাকাল আহমদ মুসা ওদের দিকে। আহমদ মুসার চোখে ছিল ক্ষীপ্র এক সতর্কতা। চোখ যখন সে ওদের দিকে ঘুরাচ্ছিল, তখন তার হাত চলে গেল গিয়েছিল রিভলবারের বাঁটে। পাশে এসে দাঁড়ানো তরুণ-তরুণীদেরও এটা চোখে পড়েছিল। আহমদ মুসার চোখ ওদের উপর পড়তেই তরুণীটি বলে উঠল, ‘আসসালামু আলাইকুম।’ ‘আসসালামু আলাইকুম।’ তরুণটিও বলে উঠল তরুণীটির কন্ঠ থামতেই। তরুণ তরুণী দু’জনের চেহারাই ইউরোপ-এশিয়ায় মেশানো। চোখ ও চুল ওদের এশিয়ান। কিন্তু গায়ের রং ইউরোপীয়, তবে তার সাথে একটা সোনালী মিশ্রণ আছে যা তাদেরকে অপরূপ করে তুলেছে। এমন এক জোড়া তরুণ-তরুণীর কাছ থেকে আকস্মিক সালাম পেয়ে আহমদ মুসা বিস্ময়ের একটা ধাক্কা খেল। সে এ সময় তার শত্রুদেরকেই আশা করেছিল। আহমদ মুসার মুহূর্তকালের নিরবতার সুযোগে তরুণীটিই আবার বলে উঠল, ‘রিভলবার হাতে রাখার দরকার নেই। আমরা আপনার বন্ধু। আপনার মারামারি আমরা দেখেছি। আপনি মুসলিম দেখে পরিচয়ের জন্যে আমরা এলাম।’ মেয়েটির মুখে মিস্টি হাসি। আহমদ মুসার মুখেও হাসি ফুটে উঠল। বলল, ‘দু’টি সংশোধনী। আপনারা আমার বন্ধু না হয়ে ভাই বোন হলে খুশি হবো। দ্বিতীয়ত, ঘটনাটা মারামারি ছিল না। ওরা আমাকে মারতে চেয়েছিল, আমি আত্মরক্ষা করেছি।’ তরুণ তরুণী দু’জনেই হাসল। আহমদ মুসার সামনে বসতে বসতে বলল, ‘ওয়েলকাম। আমরা আনন্দের সাথে ভাই-বোন হতে রাজী আছি। তবে শর্ত ‘আপনি’ সম্বোধন ‘তুমি’ তে নিয়ে আসতে হবে। দ্বিতীয়টাও আমরা মেনে নিচ্ছি। দু’গাড়িওয়ালারা আসলে, যতদূর বুঝেছি, আপনাকে ওরা ফলো করছিল এবং সেখান থেকেই ঘটনার সৃষ্টি। সুতরাং তারাই আক্রমনকারী।’ ‘কিন্তু ভাইয়া, কোন জার্মান-ফরাসীকে আমি কোনদিন এইভাবে এশিয়ানের হাতে কুপোকাত হতে দেখিনি। এই বিজয়ের জন্যে আপনাকে ধন্যবাদ এবং সেই সাথে জানাচ্ছি ওরা কিন্তু আপনাকে ছাড়বে না। আর কি ঘটনা আছে জানি না, কিন্তু ওদের আর্য অহং এ দারুণ ঘা লেগেছে।’ বলল তরুণীটি। ‘বোন, জার্মান ফরাসী ও এশিয়ান এই দৃষ্টিতে বিষয়টিকে না দেখাই ভাল। এটা যেমন ন্যায়-অন্যায়ের একটা দ্বন্দ্ব ছিল, তেমনি যখন কোন সংঘাত বাধে সেটা কোন অন্যায় থেকেই বাধে। কিছু ক্রিমিনাল ছাড়া সব জার্মান ফরাসীই ন্যায়ের পক্ষে এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে।’ বলল আহমদ মুসা। তরুণীটি আহমদ মুসার মুখের শেষ শব্দ সম্পূর্ণ হবার আগেই বলে উঠল, ‘আপনি কে জানি না। আপনার চিন্তা অবশ্যই মহৎ। কিন্তু সাধারণভাবে এটা বাস্তব নয়। পশ্চিমের যারা এশিয়া আফ্রিকা দখল করে একদিন এশিয়া আফ্রিকার মানুষকে যথেষ্ট শাসন শোষনের শিকারে পরিণত করেছিল, তারা এখনও এশিয়া আফ্রিকার মানুষকে সেই একই দৃষ্টিতে দেখে। শাসন শোষনের কৌশল শুধু তারা পাল্টেছে।’ হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘তোমার কথা আমি অস্বীকার করছি না বোন। কিন্তু একে পূব-পশ্চিমের সংঘাত বা পশ্চিমের শোষণ হিসাবে দেখো না। বেদনাদায়ক হলেও যেটা ঘটছে, সেটাই স্বাভাবিক। প্রত্যেক ব্যক্তির মত প্রতিটি জাতি গোষ্ঠীই তাদের ভাল চিন্তা করবে, স্বার্থ চিন্তা করবে এটাই স্বাভাবিক। পশ্চিম আজ ‘গণতন্ত্রের’ নামে এশিয়া আফ্রিকার বিভিন্ন দেশের রাজনীতিতে যে হস্তক্ষেপ করছে, মুক্ত অর্থনীতির নামে এশিয়া আফ্রিকার বিভিন্ন দেশের রাজনীতিকে যে কব্জা করছে, মানবাধিকারের শ্লোগান তুলে এশিয়া আফ্রিকার বিভিন্ন দেশের জাতি গঠন ও সংহতিকে যে বাধাগ্রস্থ করছে এবং তথাকথিত ‘সাসটেইনেবল ফেইথ বা ভ্যালুজে’র নামে তারা জাতীয় সংস্কৃতি ও ধর্মের উপর যে ছড়ি ঘুরাতে চাচ্ছে, সেটা পশ্চিমী বিভিন্ন রাষ্ট্র বা জাতির ‘ভাল’ বা ‘স্বার্থ’ চিন্তা করেই। প্রশ্ন হলো তাদের এই ‘ভাল’ বা ‘স্বার্থ’ চিন্তা আমাদের ক্ষতি করছে। আমাদের এই ক্ষতি তারা করতে পারছে তাদের বুদ্ধি ও শক্তির বলে। এর প্রতিকার ভিক্ষা চেয়ে পাওয়া যাবে না, কারণ ভিক্ষুকের আবেদনে তারা কিছু ভিক্ষা দিতে পারে, কিন্তু তাদের ‘ভাল’ বা ‘স্বার্থ’ যাতে, সেখান থেকে সরে দাঁড়াবে না। এর অর্থ হলো আমাদের ‘ভালো’ আমাদের ‘স্বার্থ’ আমাদের দেখতে হবে। নিশ্চিত করতে হবে।’ থামল আহমদ মুসা। আহমদ মুসা থামতেই তরুনীটি বলে উঠল, ‘আপনাকে ধন্যবাদ। আপনি চিন্তার একটা বাস্তব ও বিপ্লবাত্মক দিগন্ত উন্মোচিত করেছেন। কিন্তু এটা কিভাবে? আপনিই তো বললেন, ওরা শক্তি ও বুদ্ধির জোরে এটা করছে। শক্তি বা বুদ্ধি কোন যুদ্ধেই তো আমরা ওদের সাথে পারবো না।’ ‘না পারা পর্যন্ত মার খেতেই হবে। দুর্বলরা এভাবেই মার খায়।’ বলল আহমদ মুসা। ‘কেচ্ছার কি এখানেই শেষ? কোন পথ তাহলে নেই?’ বলল তরুনীটি। ‘আছে। ইউরোপের কাছ থেকে শিক্ষা নিতে হবে। ইউরোপ যদি তাদের স্বার্থে একক মুদ্রা, একক অর্থনীতি, একক একটি পার্লামেন্ট গড়তে পারে, তাহলে মুসলিম দেশগুলো অর্থাৎ এশিয়া আফ্রিকার দেশগুলো নিজস্ব বানিজ্য ব্যবস্থা, নিজস্ব বিনিয়োগ ব্যবস্থা ইত্যাদি গড়তে পারবে না কেন?’ আহমদ মুসা হাসল। ‘আপনার মারামারি দেখে মনে হয়েছিল, আপনি সাংঘাতিক একজন লড়াকু ব্যক্তি, কিন্তু এখন মনে হচ্ছে আপনি একজন সাংঘাতিক পলিটিশিয়ান। আসলে..........।’ তরুণীটি তরুণকে বাধা দিয়ে বলে উঠল, ‘এই প্রসঙ্গে পরে আসা যাবে, আগে বিশ্ব রাজনীতিটা শেষ হোক।’ তরুণীটি মুহূর্তের জন্যে থামল। মুখ ঘুরিয়ে তাকাল আহমদ মুসার দিকে। বলল, আপনি মুসলিম দেশ ও আফ্রো-এশীয় দেশগুলোকে যা করতে বলেছেন, তার জন্যেও তো রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক শক্তি দরকার।’ ‘সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ন্যায়কে ভালোবাসা এবং অন্যায়ের সাথে কোন সমঝোতায় না যাওয়ার শক্তি। এই শক্তি অন্যসব শক্তি সৃষ্টি করে।’ আহমদ মুসা বলল। ‘আপনি এক দূর্লভ শক্তির কথা বললেন, যার দুর্ভিক্ষ এখন সবচেয়ে প্রকট।’ আহমদ মুসা থামতেই দ্রুত কন্ঠে বলে উঠল তরুণটি। আহমদ মুসা হাসল। বলল, ‘এই দুর্ভিক্ষ প্রকট বলেই আমাদের ভোগান্তিও প্রকট।’ ‘ধন্যবাদ। রাজনীতির কথা এখন থাক। বলুন, দুই ইউরোপীয় আপনাকে তাড়া করছিল কেন? চেনেন ওদের? বলল তরুণটি। ‘ওদের চিনি না। কিন্তু তাড়া করার কারণ বোধ হয় জানি।’ আহমদ মুসা বলল। ‘কি কারণ?’ বলল তরুণীটি। আহমদ মুসা ওদের দুজনের দিকে তাকাল। বলল, ‘তার আগে তোমাদের পরিচয় জানা দরকার।’ সংগে সংগে তরুণীটি বলে উঠল, ‘আমি ফাতিমা কামাল। জার্মানীর ‘বন’ এ বাড়ি। বনের স্টেট ইউনিভার্সিটির ছাত্রী।’ তরুণীটি কথা শেষ না হতেই তরুণটি বলা শুরু করল, ‘আর আমি যায়েদ ফারুক। প্যারিসে বাড়ি। প্যারিস ইউনিভার্সিটির ছাত্র।’ বিস্ময় ও আনন্দের চিহ্ন আহমদ মুসার চোখে মুখে। তরুনটির কথা শেষ হতেই আহমদ মুসা বলল, ‘তোমরা কি দি রাইন ইন্ট্যারন্যাশনাল হোটেলে থাক?’ ‘হ্যাঁ। কি করে জানলেন?’ এক সাথে বলে উঠল তরুণ-তরুণী দু’জনেই। ‘আমিও ঐ হোটেলেই উঠেছি।’ আহমদ মুসা বলল। ‘কিন্তু আমাদের কথা জানলেন কি করে?’ বলল তরুণীটি। ‘আমি যেদিন হোটেলে আসি, সেদিনই আমি কাউন্টারে খোঁজ নিয়েছিলাম আর কোন মুসলিম এই হোটেলে আছে কিনা? তারাই আমাকে তোমাদের দু’জনের নাম বলেছিল।’ বলে একটু থেমেই আবার শুরু করল, ‘কিন্তু তোমরা তো দুই প্রান্তের দুইজন, তোমাদের পরিচয় কিভাবে? না বন্ধু ছিলে তোমরা?’ ‘না কেউ কাউকে চিনতাম না। আমি যেদিন হোটেলে আসি, সেদিন রিসেপশনে ‘হালাল’ খাবার নিয়ে আলাপ করছিলাম। এ সময় যায়েদ পাশে দাড়িয়ে ছিল। সে অযাযিতভাবেই আমাকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসে। এভাবেই আমাদের পরিচয়।’ বলল তরুণীটি। ‘তোমরা কি হালাল-হারাম মান? জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা। ঠোটে এক টুকরো হাঁসি। ‘না মানলে মুসলমানিত্ব থাকবে কি করে?’ তরুণটি বলল। আহমদ মুসার ঠোটে আরও স্পষ্ট মিস্টি হাসি ফুটে উঠল। বলল, ‘মুসলমানিত্ব রক্ষার জন্যে আর কি কর? তোমরা দুজন কি আসরের নামাজ পড়েছ?’ তরুণ-তরুণী দুজনের মুখই ম্লান হয়ে গেল। মুখ নিচু হয়ে গেল তাদের। একটু পরেই তরুনীটি মুখ তুলল। বলল, ‘স্যরি ভাইয়া। আমি নামাজ পড়ি। তবে বাইরে বেরুলে অনেক সময় অবস্থার কারণে পড়তে পারি না। কিন্তু কাজা পড়ে নেই।’ যায়েদ ফারুকের মুখ লাল। তরুনীটি মানে ফাতিমা কামাল থামতেই যায়েদ ফারুক বলে উঠল, ‘আমার জবাব দেবার কিছু নেই ভাইয়া। আমাকে কেউ কোনদিন এভাবে বলেনি। নামাজ না পড়ার অপরাধ-বোধ আমার ভেতরে আছে। আমি আজ থেকে নামাজ পড়ব ভাইয়া।’ ‘তোমাদের ধন্যবাদ।’ বলে একটু থামল আহমদ মুসা। তারপর বলল, ‘তোমরা জিজ্ঞেস করছিলে ওরা আমাকে তাড়া করার কারণ কি, তাই না? আমি স্ট্রাসবার্গ বিমানবন্দরে নামার পর থেকেই ওরা আমাকে ফলো করছে। আমি যেখানে যাচ্ছি, তারা পিছু পিছু যাচ্ছে। প্রথম দু’দিন আমি বুঝতে পারিনি। আজ সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম ওদের মুখোমুখি হবো। তাদের মুখোমুখি হতে গিয়েই এই সংঘর্ষ।’ থামল আহমদ মুসা। ফাতিমা ও যায়েদ দু’জনের চোখে মুখে বিস্ময়। আহমদ মুসা থামতেই তারা বলল, ‘সাংঘাতিক ঘটনা। কিন্তু এ শত্রুতার কারণ কি?’ ‘কারণ কি আমি জানি না। তবে আমি যেটা অনুমান করি, সেটা হলো ব্যাপারটা খুবই বড়।’ বলল আহমদ মুসা। ‘কি সেটা?’ বলল ফাতিমা কামাল। তার চোখে শংকা। আহমদ মুসার চোখে মুখে নেমে এল গাম্ভীর্য। ধীরে ধীরে বলল, ‘আমার মনে হয় ‘স্পুটনিক’ নামের গোয়েন্দা সংস্থা যারা ধ্বংস করেছে এবং এর গোয়েন্দাদের যারা কিডন্যাপ করেছে, তারা বা তাদের ভাড়া করা লোক এরা।’ আহমদ মুসা থামল। ‘স্পুটনিকে’র নাম শুনেই চমকে উঠেছে যায়েদ ও ফাতিমা দু’জনেই। আহমদ মুসা যখন তার কথা বলা শেষ করল, তখন বিস্ময় শংকায় আচ্ছন্ন হয়ে গেছে তাদের চেহারা। আহমদ মুসা থামলেও কয়েক মুহূর্ত তারা কথা বলতে পারল না। পরে ফাতিমা কামালই ধীরে ধীরে বলল, ‘আপনি স্পুটনিকের ঘটনা জানেন? কিন্তু ওরা আপনার পেছনে লাগবে কেন?’ ‘জানি। লা-মন্ডে পত্রিকায় পড়েছি।’ বলল আহমদ মুসা। ‘আর ওরা আপনার পেছনে কেন? বলল ফাতিমা কামাল। ‘ওরা বোধ হয় ধরে নিয়েছে আমি যখন স্ট্রাসবার্গে এসেছি, তখন স্পুটনিকের ব্যাপার নিয়ে নিশ্চয় আমি কিছু করব। এ জন্যেই তারা আমার গতি বিধির উপর নজর রাখছে।’ যায়েদ ও ফাতিমার বিধ্বস্ত চার চোখ আহমদ মুসার উপর নিবদ্ধ। এক সময় ফাতিমার ধীর কন্ঠ থেকে বের হয়ে এল, ‘আপনি কে ভাইয়া? আপনার কথা থেকেই প্রমাণ হচ্ছে স্পুটনিক ধ্বংসকারীরা আপনাকে চেনে এবং স্ট্রাসবার্গে এলে আপনি স্পুটনিক ঘটনার অনুসন্ধান করতে পারেন, তাও তারা জানে। কে তাহলে আপনি ভাইয়া?’ ফাতিমা থামতেই যায়েদ বলে উঠল, ‘ঠিক, আমরা এ পর্যন্ত তো আপনার কিছু জানি না। এমনকি আপনার নাম পর্যন্তও না। বলুন ভাই।’ হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘আমাকে আহমদ আবদুল্লাহ বলে ডাকাই যথেস্ট নয় কি?’ ‘আপনি কোত্থেকে এসেছেন?’ বলল ফাতিমা। ‘সৌদি আরব থেকে।’ আহমদ মুসা বলল। ‘কিন্তু আপনি এখানে এলেই স্পুটনিক ব্যাপারে অনুসন্ধান করবেন এটা তারা ভাবতে গেল কেন? আপনাকে কেমন করে ওরা চেনে?’ জিজ্ঞেস করল যায়েদ ফারুক। ‘আমি গোয়েন্দা কাজে খুব আগ্রহী। বিশেষ করে মুসলমানরা এ ধরনের কোন বিপদে পড়লে আমি সেখানে যাই।’ আহমদ মুসা বলল। ‘কিন্তু মনে হচ্ছে ওরা আপনাকে ভয় করে। সে জন্যে আপনার গতিবিধি ওরা পাহারা দিচ্ছে এবং সুযোগ পেয়েই আপনাকে আটকাবার বা মারার চেষ্টা করেছিল। এটা কেন?’ বলল ফাতিমা। ‘স্পুটনিকের ব্যাপারে কেউ খোঁজখবর নিক, কেউ এর সাথে জড়িয়ে পড়ুক তা নিশ্চয় তারা চায় না। কারণ এটাই।’ আহমদ মুসা বলল। ‘আমরাও তো এই কাজেই এসেছি এবং এ নিয়ে প্রাইভেট গোয়েন্দা সংস্থার সাথেও আলাপ করেছি। আমরা তাদের আত্মীয়। আমরা এ ঘটনায় জড়িত হয়ে পড়তেই পারি। কিন্তু আমাদের উপর তাদের চোখ পড়েনি।’ বলল ফাতিমা। ‘তোমরা তাদের আত্মীয়? কে তোমরা?’ জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা। ফাতিমাই প্রথম কথা বলে উঠল। বলল, ‘আমি স্পুটনিকের নাম্বার ওয়ান গোয়েন্দা পরিচালক কামাল সুলাইমানের ছোট বোন। আমি বনের পারিবারিক বাড়িতে থাকি। স্পুটনিকের ব্যাপারে অনুসন্ধানের জন্যেই এখানে এসেছি। শত্রু চোখ এড়াবার জন্যেই ভাইয়ার বাড়িতে উঠিনি। আর যায়েদও স্পুটনিকের দ্বিতীয় গোয়েন্দা পরিচালক আবদুল্লাহ ফারুকের ছোট ভাই। সেও একই লক্ষ্যে স্ট্রাসবার্গে এবং আমার মত একই কারণে হোটেলে উঠেছে।’ ‘তোমাদের অভিনন্দন। তাহলে আমরা একই উদ্দেশ্যে স্ট্রাসবার্গে এসেছি এবং কাকতালীয়ভাবে একই হোটেলে অবস্থান করছি। শুধু একটাই পার্থক্য। আমি স্পুটনিকের সাতজন ঐতিহাসিক পরিচালকের কারও সাথেই কোনভাবে সম্পর্কিত নই।’ আহমদ মুসা বলল। ‘আপনাকেও ধন্যবাদ। আমাদের মধ্যে আরেকটা পার্থক্য আছে। সেটা হলো আমরা এসেছি রক্তের টানে, আর আপনি এসেছেন হৃদয়ের টানে। রক্তের টানের চেয়ে হৃদয়ের টানটাই বেশি মূল্যবান।’ বলল ফাতিমা কামাল। ‘এসব কথা থাক বোন। তোমরা এবার কাজের কথায় এস। কিছুক্ষণ আগে যা ঘটল, তাতে শত্রুর লেজে পা পড়েছে। এরা দ্রুত একটা পাল্টা ছোবল মারবে।’ বলল আহমদ মুসা। যায়েদ ও ফাতিমা দু’জনেরই চোখে মুখে শংকা ফুটে উঠল। যায়েদ বলল, ‘তার মানে ওরা আক্রমন করবে?’ ‘আমার তাই বিশ্বাস।’ বলে আহমদ মুসা একটু থামল। একটু ভাবল। তারপর বলল, ‘আক্রমনকারী গাড়ি দুটির নাম্বারসহ থানায় একটা ডায়েরী করতে চাই যে, গ্রীন সার্কেলের ইনার সার্কুলার রোডে আমি আক্রান্ত হই। দু’টি গাড়িতে দু’জন লোক আমাকে কিডন্যাপ করার চেষ্টা করে। ওদের একটা গাড়ি এবং তোমরা ঘটনার সাক্ষী।’ ‘আমরা সাক্ষী হতে রাজি আছি। কিন্তু পুলিশের কাছে বিশেষ কোন সাহায্য মিলবে না।’ বলল যায়েদ। ‘আমি পুলিশের সাহায্য চাই না, আইনকে আমার পক্ষে চাই। এ জন্যেই এই ডায়েরী।’ বলল আহমদ মুসা। ‘আপনার চিন্তা ঠিক ভাইয়া। গ্রীন সার্কেলের একটু পরেই একটা থানা আছে। যাবার সময় ডায়েরী করা যাবে।’ ফাতিমা বলল। ‘যে গাড়ি ফেলে ওরা পালিয়েছে, সেই গাড়িও পুলিশের হাতে দেওয়া দরকার।’ বলল যায়েদ। ‘সার্কেল পুলিশকে ডেকে বললেই হবে।’ ফাতিমা বলল। ‘যায়েদ-ফাতিমা, ঘটনার ব্যাপারে তোমরা কি পরিমাণ এগিয়েছ?’ বলল আহমদ মুসা। ‘না ভাইয়া। আমরা কিছুই এগুতে পারিনি। আমাদের দু’জনের পরিচয় হবার পর আমরা চেষ্টা করছি ভাইয়ারা যে সব করেছেন ও করছেন তার ভিত্তিতে ভাইয়াদের শত্রুদের একটা তালিকা করার।’ ফাতিমা বলল। ‘কিভাবে করছ?’ বলল আহমদ মুসা। ‘অতীতের পত্র-পত্রিকা ঘেঁটে ও ভাইয়াদের বন্ধু-বান্ধবদের জিজ্ঞাসাবাদের মাধ্যমে।’ বলল যায়েদ। ‘আপনার কাজ কতদূর ভাইয়া?’ ফাতিমা বলল। ‘সবে আজ কাজ শুরু হলো। এ কয়দিন আমি শহর দেখে বেড়িয়েছি।’ বলল আহমদ মুসা। ‘আজ কিভাবে কাজ শুরু হলো’, ফাতিমা বলল। ‘কিছুক্ষণ আগে গ্রীন সার্কেলে ওদের আক্রমনের মাধ্যমে। শুরুটা খুবই ভাল হয়েছে।’ বলল আহমদ মুসা। ‘কিভাবে?’ যায়েদ বলল। ‘শত্রুরা আক্রমন করা মানে শত্রুর সাথে দেখা হওয়া। তার মাধ্যমে শত্রুদের পরিচয় উদ্ধারের একটা সুযোগ সৃষ্টি হলো। গাড়ি চুরি করা ও গাড়ির লাইসেন্স ও ব্লবুক ভূয়া হতে পারে, কিন্তু ওগুলোতে হাতের যে ছাপ আছে তা ভূয়া নয়। সবচেয়ে বড় কথা হলো, এই সংঘাত আরও সংঘাতের সুযোগ সৃষ্টি করেছে। সুতরাং আমি খুশি যে, আবারও তাদের দেখা পাব।’ বলল আহমদ মুসা। ফাতিমা ও যায়েদের চোখে মুখে বিস্ময়। ফাতিমা বলল, ‘ওরা আবার আক্রমন করবে। আরও সংঘাত হবে। এতে আপনি খুশি। কিন্তু আমাদের তো বুক কাঁপছে।’ ‘বুঝলাম, আপনি জাত গোয়েন্দা ভাইয়া। কিন্তু সংঘাতের রেজাল্ট পক্ষে-বিপক্ষে দুই-ই হতে পারে। বিপক্ষে যাবে সে ভয় আপনার নেই?’ বলল যায়েদ। ‘এসব ভাবলে তো এগুনো যাবে না।’ আহমদ মুসা বলল। ‘বুঝা গেল, আপনি আমাদের মত সাধারণ কেউ নন এবং এও বুঝা গেল ওরা আপনাকে ভয় করে কেন?’ বলল ফাতিমা। ‘আমরা আনন্দিত ভাইয়া। আল্লাহ আপনাকে সাহায্য করুন। আমরা যা করছি, সেটা পুলিশ যা করছে সে রকমই। কিছুই হবে না এতে।’ যায়েদ বলল। যায়েদ থামতেই ফাতিমা কামাল বলে উঠল, ‘ভাইয়া, আমাদের দু’জনকে কি আপনি সাথে নিতে পারেন?’


এডিট ডিলিট প্রিন্ট করুন  অভিযোগ করুন     

গল্পটি পড়েছেন ৩০৬ জন


এ জাতীয় গল্প

→ নতুন গুলাগ চ্যাপ্টার-১
→ নতুন গুলাগ চ্যাপ্টার-১ বাকি অংশ
→ নতুন গুলাগ চ্যাপ্টার- ২ বাকি অংশ
→ নতুন গুলাগ চ্যাপ্টার- ৩
→ নতুন গুলাগ চ্যাপ্টার- ৩ বাকি অংশ
→ নতুন গুলাগ চ্যাপ্টার- ৪
→ নতুন গুলাগ চ্যাপ্টার- ৪ বাকি অংশ
→ নতুন গুলাগ চ্যাপ্টার- ৫
→ নতুন গুলাগ চ্যাপ্টার- ৫ বাকি অংশ
→ নতুন গুলাগ চ্যাপ্টার- ৬
→ নতুন গুলাগ চ্যাপ্টার- ৬ বাকি অংশ
→ নতুন গুলাগ চ্যাপ্টার- ৬ বাকি অংশ
→ নতুন গুলাগ চ্যাপ্টার- ৭ (শেষ)

গল্পটির রেটিং দিনঃ-

গল্পটির বিষয়ে মন্তব্য করুন

  • গল্পটির বিষয়ে মন্তব্য করতে আপনার একাউন্টে প্রবেশ করুন ... ধন্যবাদ... Login Now