বাংলা গল্প পড়ার অন্যতম ওয়েবসাইট - গল্প পড়ুন এবং গল্প বলুন

বিশেষ নোটিশঃ সুপ্রিয় গল্পেরঝুরিয়ান - আপনারা যে গল্প সাবমিট করবেন সেই গল্পের প্রথম লাইনে অবশ্যাই গল্পের আসল লেখকের নাম লেখা থাকতে হবে যেমন ~ লেখকের নামঃ আরিফ আজাদ , প্রথম লাইনে রাইটারের নাম না থাকলে গল্প পাবলিশ করা হবেনা

আপনাদের মতামত জানাতে আমাদের সাপোর্টে মেসেজ দিতে পারেন অথবা ফেসবুক পেজে মেসেজ দিতে পারেন , ধন্যবাদ

নতুন গুলাগ চ্যাপ্টার- ৩ বাকি অংশ

"সাইমুম সিরিজ" বিভাগে গল্পটি দিয়েছেন গল্পের ঝুরিয়ান রিয়েন সরকার (০ পয়েন্ট)

X আহমদ মুসা সংক্ষেপে ঘটনাটা ওদের বলল। ঘটনা শুনে ওদের চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল। বলল ফাতিমা, ‘ভাইয়া মাত্র ১২ ঘন্টার মধ্যে আপনি দ্বিতীয়বার জীবন পেলেন।’ তারপর যায়েদ ও ফাতিমা দু’জনেই হাত উপরে তুলে বলল, ‘আলহামদুলিল্লাহ। হে আল্লাহ, আমাদের ভাইয়ার বুদ্ধি, শক্তি, সাহস আরও বাড়িয়ে দিন। এ ধরনের সব বিপদেই তিনি যেন জয় করতে পারেন।’ তারা থামতেই আহমদ মুসা বলল, ‘তোমরা এখানে কি করছ? ঐ শয়তানদের একজন নেতা আজর ওয়াইজম্যান তো হোটেলে আসার কথা আমার রুমের খোঁজ খবর নেবার জন্যে!’ ‘সে এসেছিল এবং খোঁজ নিতে আপনার কক্ষেও ঢুকেছিল। সে যখন কাউন্টারে কথা বলছিল, তখন আমি কাউন্টারের পাশে ছিলাম। সব আমি শুনি এবং তাকে ফলো করি। তার ছবিও আমি নিয়েছি। যেভাবে অথরিটির সাথে সে কথা বলছিল এবং কাজ করছিল, তাতে আমার মনে হয়েছে সে ষড়যন্ত্রকারীদের একজন বড় কেউ হবেন। যাই হোক, তার কথা শুনে আমি বুঝে যে, আপনার কোন বিপদ হয়েছে। সেজন্যে হোটেলের লবিতে বসেই আমি যায়েদের অপেক্ষা করি। সে এলে তার কাছে সব শুনে গাড়ি নিয়ে আমরা হোটেল থেকে সরে এসে এখানে অপেক্ষা করি। আমাদের ভয় হচ্ছিল আপনাকে হস্তগত করার পর আমাদের কক্ষেও ওরা হানা দেবে।’ বলল ফাতিমা কামাল। ‘দিতে পারে। কারণ তারা যে জিনিস খুঁজছে তা আমার সুটকেসে পায়নি। আমার হ্যান্ডব্যাগ ও তোমাদের ব্যাগেজ দেখার জন্যে তোমাদের কক্ষেও হানা দিতে পারে।’ আহমদ মুসা বলল। ‘কি খুঁজছে ভাইয়া ওরা?’ বলল যায়েদ। ‘স্পুটনিকের গোয়েন্দারা নিউইয়র্কের টুইন (লিবার্টি ও ডেমোক্রাসি) টাওয়ার ধ্বংসের প্রকৃত ঘটনা সম্পর্কে যে দলিল দস্তাবেজ যোগাড় করেছিল, সে সবেরই কতকগুলো বা কোনটি সম্ভবত তারা খুঁজছে। লা-মন্ডের রিপোর্টে গোয়েন্দা অপহরণ করার কারণ হিসাবে এ ধরনের কিছুকেই সন্দেহ করা হয়েছিল। আজ আজর ওয়াইজম্যানের মুখেও এ ধরনের কথাই শুনেছি।’ আহমদ মুসা বলল। ‘ভাইয়া, আপনি ওদের জাল ছিঁড়ে বেরিয়ে আসার পর ওরা নিশ্চয় দারুণ ক্ষেপে গেছে। এই অবস্থায় হোটেল আপনার জন্যে আরও বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে, আমাদের জন্যেও। কি করা যায় এখন। বাড়ি একটা পেয়েছি। ভাড়া একটু বেশি হলেও আপনি যেমন চেয়েছিলেন, সেরকমই বাড়িটা। বাড়িটাতে কালকে উঠলে ভাল হয়, ‘তবে আজকেও উঠা যায়।’ বলল যায়েদ। ‘আমরা এখনি হোটেল ছেড়ে দেব। আমি ও যায়েদ গিয়ে উঠব ভাড়া করা বাড়িতে। আর ফাতিমা উঠবে আপাতত তার আত্মীয়ের বাড়িতে।’ আহমদ মুসা বলল। ম্লান হয়ে গেল ফাতিমা কামালের মুখমন্ডল। পরক্ষনেই লজ্জায় ছেয়ে গেল তার মুখ। ফুটে উঠল ঠোঁটে লজ্জা মিশ্রিত হাসি। বলল, ‘ভাইয়া, আপনার জন্যে আরও কিছু খবর আছে। কামাল সুলাইমান ভাইয়ার বাসা থেকে অল্পক্ষন আগে জানিয়েছে, আজ বাদ আসর স্ট্রাসবার্গ মসজিদ কম্যুনিটি হলে দু’পক্ষই বিয়ের আয়োজন করার ব্যাপারে রাজী। আপনার মত পেলেই এটা চূড়ান্ত হবে।’ আহমদ মুসার মুখে ফুটে উঠল মিস্টি হাসি। বলল, ‘ওয়েলকাম বোন। আমার আগের কথা বাতিল। তুমিও আজ যায়েদের সাথে ভাড়াবাড়িতে উঠবে। ওদের বলে দাও। শুভস্য শীঘ্রম।’ ‘ধন্যবাদ ভাইয়া।’ মুখ নত করে বলল ফাতিমা কামাল। আহমদ মুসার মুখে সংকোচ জড়িত এক টুকরো হাসি ফুটে উঠল। বলল, ‘ফাতিমা, যায়েদ, মনে করতে পারো আমি তোমাদের উপর অন্যায় চাপিয়ে দিয়েছি। ভাবতে পার যে, তোমাদের ইনটিগ্রিটিকে আমি সন্দেহ করছি। আমি.........’। আহমদ মুসার কথায় বাধা দিয়ে ফাতিমা কামাল বলে উঠল, ‘ভাইয়া আপনার কথা ঠিক নয়। আপনি আমাদের সত্যিকার অভিভাবকের কাজ করেছেন। আপনি আমাদের শিখিয়ে দিয়েছেন, আমরা আমাদের অল্পই জানি, স্রষ্টা জানেন সবটুকুই। সুতরাং আমাদের জন্যে তাঁর নির্দেশই চূড়ান্ত।’ ফাতিমার কন্ঠ আবেগাপ্লুত ও দৃঢ়। ‘ধন্যবাদ বোন’, বলে একটু থামল আহমদ মুসা। তারপর বলল, ‘চল হোটেলের বিল চুকিয়ে আমরা চলে আসি।’ আহমদ মুসাসহ ওরা দু’জন আবার গিয়ে গাড়িতে বসল। গাড়ি চলতে শুরু করল হোটেলের দিকে। ‘ভাইয়া, আমরা হোটেল থেকে বেরিয়ে কোথায় যাচ্ছি?’ বলল ফাতিমা কামাল। ‘বাদ আসরের অনুষ্ঠান পর্যন্ত তুমি তোমার ভাইয়া কামাল সুলাইমানের বাড়িতে থাকবে। আমি যায়েদকে নিয়ে ভাড়া বাড়িতে উঠব। যায়েদ বাসায় উঠে বাড়ি গুছাবে। আর আমি পরবর্তী অভিযানের জন্যে কিছু খোঁজ-খবর নেয়ার চেষ্টা করব।’ ‘কি অভিযান?’ জিজ্ঞেস করল ফাতিমা। ‘ও কথা এখন থাক। পরে বলব।’ বলল আহমদ মুসা। গাড়ি প্রবেশ করল হোটেলের কার পার্কিং এ। সত্যিই আহমদ মুসা যেমন চেয়েছিল, সে রকমই বাড়িটা। আহমদ মুসার কক্ষটি বেশ বড়। এটাচড বাথ। কক্ষ থেকে ফ্ল্যাটের বাইরে বেরুবার ইন্ডিপেনডেন্ট প্যাসেজ। অন্যদিকে দুটি বেডরুম আর একদিকে গেস্টরুম নিয়ে ফাতিমা যায়েদদের অংশ। আহমদ মুসার কক্ষ থেকে ডাইনিং ড্রইং এ প্রবেশের একটা দরজা রয়েছে। এই দরজা বন্ধ থাকলে ফ্ল্যাটের দুই অংশ বলা যায় আলাদাই হয়ে পড়ে। দরজাটা দুই দিক থেকেই বন্ধ করা যায়। সিদ্ধান্ত হয়েছে দরজাটা দুই দিক থেকেই বন্ধ রাখা হবে। দুই পক্ষের কারও প্রয়োজন হলে নক করে দরজা খুলতে হবে। ফ্ল্যাট থেকে বাইরে বেরুবার জন্য ফাতিমা-যায়েদদের প্যাসেজও আলাদা। নতুন দম্পতি হিসেবে ফাতিমা ও যায়েদ ফ্লাটে উঠেছে মাগরিবের নামাজের আধা ঘন্টা আগে। স্ট্রাসবার্গ মসজিদ কম্যুনিটি হলে তাদের বিয়ের অনুষ্ঠানটি হয়েছে খুবই সুন্দর, কিন্তু সংক্ষিপ্ত। স্ট্রাসবার্গের পনেরটি মুসলিম পরিবার যোগ দিয়েছিল এই বিয়ের অনুষ্ঠানে। বিয়ের পর ফাতিমা ও যায়েদের আত্মীয় স্বজনরা তাদেরকে ফ্ল্যাটে তুলে দিয়ে গেছে। রাত ১১টা। আহমদ মুসা নক করল ফাতিমা-যায়েদদের অংশে ঢোকার পার্টিশন ডোরে। খুলে গেল দরজা। দরজা খুলে দিয়েছে যায়েদ। আহমদ মুসা সালাম দিল যায়েদ ও ফাতিমা দুজনকে। ফাতিমা কামাল বসেছিল সোফায়। আহমদ মুসা দরজায় এসে সালাম দিতেই সালামের জবাব দিয়ে উঠে দাড়াল ফাতিমা। আরও বলল, ‘ওয়েলকাম ভাইয়া।’ বিয়ের পোশাকটা নেই ফাতিমা কামালের পরনে। কিন্তু যে পোশাক পরেছে তাতেও তাকে নববধুই লাগছে। ফুলহাতা কামিজ তার পা পর্যন্ত নেমেছে। মাথার রুমাল কপাল ঢেকে গলা জড়িয়ে বুক পর্যন্ত নেমে এসেছে। ফাতিমা কামালের শ্বেতাভ গোলাপী দেহে গোলাপী এই পোশাক তাকে অপরূপ করে তুলেছে। নত দৃষ্টিতে আহমদ মুসা যায়েদের সাথে গিয়ে সোফায় বসল। ফাতিমা কামালও বসল। যায়েদ গিয়ে বসেছে ফাতিমার পাশে। আর আহমদ মুসা তাদের সামনের আরেকটি সোফায়। ফাতিমার চোখে মুখে লজ্জার ছাপ। লাল হয়ে উঠেছে মুখ। যায়েদও অনেকটাই বিব্রত। প্রথম নিরবতা ভাঙল আহমদ মুসাই। বলল, ‘নতুন সংসার, কোন অসুবিধা নেই তো তোমাদের?’ ‘আলহামদুলিল্লাহ। কোন অসুবিধা নেই ভাইয়া।’ বলল যায়েদ। তার মুখে সলজ্জ হাসি। ‘ভাইয়া, আমরা তো জানি না, আপনি কি বাইরে বেরিয়েছিলেন? ফিরলেন এখন?’ বলল ফাতিমা। ‘না তো, কোথাও বের হইনি? কেন বলছ এ কথা?’ আহমদ মুসা বলল। ‘বাইরের পোশাক আপনার পরনে।’ বলল ফাতিমা। ‘ও’ বলে হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘বাইরে বের হইনি, বের হবো। সে কথাই তোমাদের বলতে এসেছি।’ আহমদ মুসা বলল। ‘এই রাত ১১টায় বাইরে বেরুবেন? কোথায়?’ বলল ফাতিমা ও যায়েদ একই সাথে। তাদের কন্ঠে বিস্ময়। ‘বলেছিলাম তো এক অভিযানে বেরুতে হবে।’ আহমদ মুসা বলল। ‘কোথায়?’ বলল যায়েদ। ‘ওদের একটা আস্তানার সন্ধান পেয়েছি। আমি যখন সংজ্ঞাহীন হওয়ার ভান করে ওদের গাড়ির মেঝেতে পড়েছিলাম, তখন ওদের কথাবার্তার মধ্য দিয়ে আমি ওদের একটা ঘাঁটির ঠিকানা পেয়ে যাই। সেখানেই যাব। দেখি, ওদের পরিচয়, পরিকল্পনা এবং অপহৃত সাতজনকে কোথায় রেখেছে-এসব ব্যাপারে কোন তথ্য উদ্ধার করা যায় কিনা।’ আহমদ মুসা বলল। ‘আজই একটা বড় ঘটনা ঘটেছে। ওরা সাংঘাতিক ক্ষেপে আছে আপনার উপর। এই অবস্থায় এত রাতে আপনার একা তাদের ঘাঁটিতে যাওয়া ঠিক হবে না।’ বলল ফাতিমা দৃঢ় প্রতিবাদের কন্ঠে। ‘না ফাতিমা। শত্রুকে আঘাত করার পর শত্রু পাল্টা আঘাত করার আগেই যদি তাকে আবার আঘাত করা যায়, তাহলে শত্রুকে তাড়াতাড়ি কাবু করা যায়। আজ ওরা যে আঘাত খেয়েছে, তার পাল্টা আঘাতের চিন্তায় ওরা এখন ব্যস্ত। নতুন আঘাত আসতে পারে এটা তারা ভাবছে না এবং আত্মরক্ষারও কোন চিন্তা তাদের মাথায় নেই। সুতরাং এটা একটা বড় সুযোগ।’ আহমদ মুসা বলল। ‘আপনার সাথে যুক্তিতে পারবো না ভাইয়া। আপনার এই যুক্তির জবাবে কি বলতে হবে আমার জানা নেই। কিন্তু আমি যেটা জানি, সেটা হলো আপনার একা ঐ শত্রুপুরীতে যাওয়া ঠিক নয়’। আহমদ ‍মুসা হাসল। বলল, ‘এসব অভিযান দল বেধে হয় না ফাতিমা। দলবল নিয়ে গেলে শত্রুদের আগাম জেনে ফেলার সম্ভাবনা থাকে। তাতে লোকক্ষয় হলেও লক্ষ্য অর্জন হয় না। এ জন্যে একা যাওয়াটাই নিরাপদ ও ফলপ্রসু’। ‘কিন্তু একা গিয়ে যদি আপনি বিপদে পড়েন, কোন সাহায্যের যদি আপনার দরকার হয়? না ভাইয়া, আপনার একা যাওয়া হবে না’। বলল ফাতিমা। হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘সবচেয়ে বড় সাহায্যদাতা যিনি, তিনি তো সাথেই আছেন। তিনিই সাহায্য করবেন ফাতিমা। আমাদের তার উপরই নির্ভর করা উচিত’। ‘আল্লাহর কথা বলছেন ভাইয়া? তিনি তো আছেনই। তিনি অবশ্যই সাহায্য করবেন। কিন্তু তিনিই তো শত্রু মোকাবিলায় আমাদের উপযুক্ত প্রস্তুতি নিতে বলেছেন। কিন্তু আপনি তা করেছেন না ভাইয়া’। বলল ফাতিমাই। ‘আমার সাধ্য যা সেভাবেই আমি প্রস্তুতি নিয়েছি ফাতিমা। বলতে পার, লোক সাথে নেই, একা যাচ্ছি। কিন্তু শত্রুর বিরুদ্ধে এমন অনেক কাজ আছে যা একা করতে হয়। আমি সে রকম একটা কাজেই যাচ্ছি। আমি গোপনে তাদের ঘাঁটিতে ঢুকব। অনুসন্ধান করব। তাদের সম্পর্কে তথ্যাদি যোগাড়ের চেষ্টা করব। এমন ধরনের কাজে একা যেতে হয়। আমি সেটাই করছি বোন’। আহমদ মুসা বলল। ‘বুঝলাম। কিন্তু ভাইয়া, এ ধরনের কাজেও তো সংঘর্ষ হয়। প্রয়োজনীয় সাহায্যের দরকার হয়’। বলল ফাতিমা। ‘দোয়া কর তোমরা বোন। এই সাহায্য যেন আল্লাহ করেন, আমাকে তোমরা বাধা দিওনা। আমি এই কাজ নিয়ে একাই তো এসেছি শুধুমাত্র আল্লাহর উপর ভরসা করে। সর্বজ্ঞ আল্লাহ এটা জানেন এবং তিনিই আমাকে সাহায্য করবেন’। ফাতিমা কোন জবাব দিল না। তার অপলক দু’চোখ তাকিয়ে আছে আহমদ মুসার দিকে। যায়েদের বিস্ময় বিমুগ্ধ দু’চোখ নিবদ্ধ আহমদ মুসার মুখের উপর। আহমদ মুসা হাসল। বলল, ‘ভাই বোনরা এভাবে তাকিয়ে কেন?’ ‘ভাবছি ভাইয়া’। ফাতিমা বলল। ‘কি ভাবছ?’ বলল আহমদ মুসা। ‘ভাবছি, ভাইয়ার পরিচয় জানার ভাগ্য কি আমাদের এখনও হলো না? আমি নিশ্চিত ভাইয়া, আপনার এমন একটা পরিচয় আছে যা এত বড় যে আমরা সামান্য মানুষ হয়ে তা জানা ঠিক নয়’। ফাতিমা বলল। আহমদ মুসা ম্লান হাসল। বলল, ‘ফাতিমা, যায়েদ, গত দু’তিন দিনের পরিচয় থেকে, আমার আচরণ থেকে কি তোমাদের এই বিশ্বাসই হয়েছে?’ ‘না ভাইয়া, এ বিশ্বাস নয় বরং উল্টো বিশ্বাসই হয়েছে এবং এ কারণেই মনে কষ্ট লাগছে যে, এত আপন করে যিনি আমাদের নিয়েছেন, স্নেহ ও অভিভাবকত্বের ছত্রছায়া যিনি আমাদের পরম আকাঙ্খিত এক নতুন জীবনে নিয়ে এসেছেন, তার পরিচয় আমরা জানি না, আমাদের জন্যে এটা অবশ্যই বড় কষ্টের ভাইয়া’। বলল ফাতিমা আবেগে ভারী কন্ঠ তার। হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘তোমার কথা বুঝতে পারছি বোন। তোমাদের কাছ থেকে আমার পরিচয় গোপন করার কোন সিদ্ধান্ত আমি নেইনি। আমি এই মিশনে এখানে আসার আগে নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, আমার পরিচয় আমি কোথাও প্রকাশ করব না। তাতে আমার কাজ অনেকখানি সহজ হবে এবং শত্রুকে অনেকখানি অসতর্ক ও অপ্রস্তুত অবস্থায় পাওয়া যাবে। কিন্তু শত্রুরা আমার পরিচয় যেভাবেই হোক জেনে ফেলেছে। আমার পরিচয় আগাম জেনেই আজ সকালে ওরা আমাকে ঐভাবে আট-ঘাট বেঁধে বন্দী করতে এসেছিল। শত্রুদের কাছ থেকে আমার পরিচয় গোপন রাখার জন্যেই নিজের পরিচয় গোপন রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। শত্রুরা সেই পরিচয় যখন জেনেই ফেলেছে, তখন আর পরিচয় গোপনের প্রয়োজন দেখি না’। বলে আহমদ মুসা সামনের টি টেবিল থেকে স্লিপ পেপারের একটা পাতা ছিড়ে নিয়ে তাতে খস খস করে নিজের নাম লিখল এবং তা স্লিপ প্যাডের নিচে চাপা দিয়ে একটু হেসে বলল, ‘আমি আমার পরিচয় লিখে রাখলাম, পরে পড়ে নিও’। বলে আহমদ মুসা একটু থামল। গম্ভীর হয়ে উঠল তার মুখ। পকেট থেকে এক টুকরো কাগজ বের করে তা যায়েদের হাতে দিয়ে বলল, ‘এতে আমি যেখানে যাচ্ছি তার ঠিকানা লেখা আছে। আমি যদি ভোর পর্যন্ত না ফিরি, তাহলে তোমার পরিচিত পুলিশ অফিসারকে এবং পুলিশ স্টেশনকে এই ঠিকানা জানিয়ে বলবে, স্পুটনিক যারা ধ্বংস করেছে, স্পুটনিকের ৭ গোয়েন্দাকে যারা কিডন্যাপ করেছে, তাদের একটা ঘাঁটির ঠিকানা এটা। ঠিকানাটায় আপনারা এখনি রেড করুন’। যায়েদ স্লিপটা হাত পেতে নিল। কিন্তু কোন কথা বলল না। ফাতিমাও কিছু বলল না। হঠাৎ করে তাদের দু’জনের দু’চোখ ছল ছল করে উঠেছে। উদ্বেগে-আশঙ্কায় তাদের মুখ পান্ডুর। ফাতিমার দু’চোখের অশ্রু তার দু’গন্ড বেয়ে গড়িয়ে পড়তে লাগল। আহমদ মুসা তাদের অশ্রু দেখে আরও গম্ভীর হয়ে উঠল। বলল, ‘তোমাদের এই মমতার জন্যে আমি কৃতজ্ঞ। কিন্তু তোমরা চিন্তা করো না। আল্লাহই আমাদের সহায়’। বলে উঠে দাঁড়াল আহমদ মুসা। সালাম দিয়ে ঘুরে দাড়িয়ে আহমদ মুসা ফ্ল্যাটের গেটের দিকে এগুলো। ফাতিমা ও যায়েদ দু’জনেই উঠল। তারা আহমদ মুসার পেছন পেছন গেট পর্যন্ত এগুলো। তারপর ‘ফি আমানিল্লাহ, আল্লাহ হাফেজ’ বলে বিদায় জানাল আহমদ মুসাকে। আহমদ মুসাও ‘আল্লাহ হাফেজ’ বলে লিফটের দিকে এগুলো। লিফট নেমে গেলেও ফাতিমা ও যায়েদ দু’জনেই গেটের দু’চৌকাঠে ঠেস দিয়ে সামনে শূণ্য দৃষ্টি মেলে দাঁড়িয়ে থাকল। অনেকক্ষন পর ফাতিমা একইভাবে সামনের দিকে দৃষ্টি মেলে বলে উঠল, ‘যায়েদ, ভাইয়া তো আসলেই আমাদের কেউ নন। কিন্তু মন মানছে না কেন? তার বিপদের ভয় এমন করে মনকে পীড়া দিচ্ছে কেন? এ কিসের টান যায়েদ?’ যায়েদও ঐভাবেই স্বগতোক্তির মত জবাব দিল, ‘আমিও জানি না ফাতিমা। তবে এটুকু অনুভব করি, তিনি তার অসীম মমতা দিয়ে আমাদের মন জয় করে নিয়েছেন। বলতে পার ফাতিমা, তার মত এত মমতা এত দায়িত্ববোধ, এত মধুর শাসন আর কারও কাছ থেকে কখনও আমরা পেয়েছি? ‘কিন্তু কেন তিনি এত আদর করেন, কেন তাঁর এই দায়িত্ববোধ, কেন এই মধুর শাসন যায়েদ? আমরা তো তাঁর কেউ নই’। বলল ফাতিমা উদাস কন্ঠে। ‘হতে পারে এটা এক আদর্শের সহমর্মিতা’। যায়েদ বলল। ‘কিন্তু আদর্শিক ভাইদের সাথে তো আমাদের কম দেখা হয়নি। এমন তো দেখিনি কখনও’। ‘হতে পারে খাঁটি আদর্শে গড়া এক মানুষের সন্ধান আমরা এই প্রথম পেলাম’। যায়েদ বলল। কে তাহলে আমাদের অদেখা, অচেনা অতুলনীয় এই মানুষটি? জিজ্ঞাসা ফুটে উঠল ফাতিমার কন্ঠে। ‘চল দেখি, তাঁর পরিচয়, তিনি কি লিখে গেছেন’। বলে যায়েদ সোজা হয়ে দাঁড়াল। সম্বিত ফিরে পাওয়ার মত চমকে উঠে ঘুরে দাঁড়াল ফাতিমা। ভেতর দিকে ছুটতে ছুটতে বলল, ‘ধন্যবাদ যায়েদ, তুমি স্মরণ করিয়ে দিয়েছ। এস তুমি’। ফাতিমা ছুটে গিয়ে না বসেই স্লিপ প্যাডের নিচ থেকে আহমদ মুসার রাখা কাগজটা তুলে নিল। কাগজের উপর চোখ বুলাতে বুলাতে সোজা হয়ে দাঁড়াল ফাতিমা। স্লিপে লেখা ‘আহমদ মুসা’ নাম পড়ে প্রচন্ড এক ধাক্কা খেল ফাতিমা। সমস্ত সত্তায় তার যে ধাক্কাটা ব্যঙ্ময় হয়ে উঠল তা হলোঃ ‘আহমদ মুসা। কোন আহমদ মুসা? ক্যারিবিয়ান, আমেরিকা ও সুরিনামের ঘটনায় সদ্য আলোচিত সেই আহমদ মুসা, যিনি ফ্রান্সে, সুইজারল্যান্ড, কংগো, ফিলিস্তিন, রাশিয়া, মধ্য এশিয়া, মিন্দানাওয়ের অসংখ্য সুঘটনার জনক?’ এই সব জিজ্ঞাসার মধ্যে হারিয়ে গেল ফাতিমা। কাগজের স্লিপটা তার হাতে ধরা। তার উপর আঠার মত লেগে আছে ফাতিমার চোখ। মূর্তির মত নিরব-নিশ্চল ফাতিমা। যায়েদও ফাতিমার কাছে এসে পৌছাল। বলল, ‘কি ফাতিমা, কি দেখলে? কি নাম, কি পরিচয় লিখেছেন তিনি?’ কোন কথা বলল না ফাতিমা। নির্বাক মূর্তির মত হাতের কাগজটা যায়েদের হাতে তুলে দিয়ে ধপ করে বসে পড়ল সোফায়। কাগজটিতে দ্রুত চোখ বুলাল যায়েদ। ‘আহমদ মুসা’র নাম পড়ে চমকে উঠল যায়েদ। কয়েকবার পড়ল নামটা। না তার পড়া ঠিক। এই নামটাই লেখা আছে কাগজে। কাগজ থেকে মাথা তুলে ভাবল একটু আহমদ মুসার কথা। তারপর ‘ও গড’ বলে বসে পড়ল সোফায় ফাতিমার পাশে। দু’জন পাশাপাশি বসে। দু’জনেই নিরব। দু’জনের চোখে-মুখেই বিস্ময় ও বিহবলতার ভাব। নিরবতা ভাঙল যায়েদ। বলল, ‘আমি ভাবতে পারছি না ফাতিমা। আমরা তিন দিন ধরে আহমদ মুসার সাথে আছি। ভাবলেই আমার কাছে স্বপ্ন মনে হচ্ছে যে, ঐ ঘরটিতে বিশ্ব বিখ্যাত আহমদ মুসা থাকেন, আর এইমাত্র তিনি বেরিয়ে গেলেন আমাদের সাথে কথা বলে’। ধীরে ধীরে ফাতিমা মুখ খুলল। সম্মোহিত কন্ঠে স্বগতোক্তির মত বলল, ‘বিশ্বাস হচ্ছে না আমারও, আহমদ মুসা এত সহজ, এত সরল, এত সাধারণ। আবার বিশ্বাস হচ্ছে এই কারণে যে, গত তিন দিনে তিনি যা করেছেন সেটা আহমদ মুসারই কাজ। আজকের পাশ্চাত্যের দুর্বিনীত, অহংকারী যোগ্যতাকে এভাবে ধুলায় মিশিয়ে দিতে আহমদ মুসাই পারেন, আর কেউ নয়’। আবেগে কন্ঠ ভারী হয়ে উঠেছে ফাতিমার। ‘আমার কাছে স্বপ্ন মনে হচ্ছে যে, আহমদ মুসা স্ট্রাসবার্গে এসেছেন, স্পুটনিক ধ্বংসের কেসটাকে তিনি গ্রহন করেছেন এবং মুসলামানদের এইটুকু বিপদও তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে’। আবেগে ভারী হয়ে উঠেছে যায়েদের কন্ঠও। ফাতিমার স্বগত কন্ঠ আবার, ‘বড়ত্বের প্রকাশ একটুও তাঁর মধ্যে নেই। কিন্তু স্নেহ-মমতার সিড়ি বেয়ে তিনি কখন যেন আমাদের মাথার উপর উঠে বসেছেন। তিনি যা বলেন তা করা আমাদের জন্য অমোঘ হয়ে যায়। এ ভাবেই বুঝি তিনি নেতা না হয়েও সবার নেতা’। ‘আলহামদুলিল্লাহ ফাতিমা। আমি আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞ। স্ট্রাসবার্গে আহমদ মুসার সাথী হবার জন্যে আল্লাহ আমাদেরকেই বেছে নিয়েছেন’। বলল আবেগ জড়িত কন্ঠে যায়েদ। ফাতিমা একটু ঘুরে বসে যায়েদের দু’হাত চেপে ধরে বলল, ‘তুমি ঠিক বলেছ যায়েদ। এটা আমাদের জন্যে পরম গর্বের’। থামল ফাতিমা। যায়েদ কিছু বলল না। দু’জনেই নিরব। একটু পর নিরবতা ভাঙল ফাতিমাই। বলল, ‘কিন্তু আমরা তাকে কোন সহযোগিতা করতে পারছি কই? বিপজ্জনক ও সংঘাতের সব কাজ তিনি একাই করেছেন। আজও তাই গেলেন। আজ সকালের ঘটনায় তিনি বন্দী হয়েছিলেন। ভাবতে পার, যদি তিনি মুক্ত হতে না পারতেন। তার মত এত মূল্যবান মানুষ এতটা নিরাপত্তাহীন থাকা কি ঠিক?’ ‘আমরা কি সহযোগিতা করব, আর কি সহযোগিতা তিনি নেবেন। আমরা রিভলবার চালাতে পারা ছাড়া এই লাইনে আর কোন অভিজ্ঞতাই নেই। আচ্ছা বল, এখন যে অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে তাতে আমাদের কি করণীয়?’ বলল যায়েদ। ‘আমার মাথায় একটা বুদ্ধি এসেছে’। বলল ফাতিমা। ‘কি বুদ্ধি?’ জিজ্ঞেস করল যায়েদ। ‘পরে বলছি। বুদ্ধিটা একটু পাকিয়ে নেই’। কথা শেষ করে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল ফাতিমা, ‘তার আগে একটু গড়িয়ে নেব’। যায়েদও উঠে দাড়িয়েছে। বলল, ‘আমি?’ ‘তোমার পথ তুমি দেখ? তোমার বেডরুম ওদিকে’। বলল ফাতিমা। তার ঠোঁটে হাসি। ‘কিন্তু আজ দুই পথ তো এক হয়ে গেছে।’ বলল যায়েদ। তারও মুখে হাসি। ‘তা ঠিক। কিন্তু আমরা তো যুদ্ধক্ষেত্রে।’ ফাতিমা বলল। হাসল যায়েদ। বলল, ‘যুদ্ধক্ষেত্রে নয়, বলতে পার যুদ্ধের তাঁবুতে। এক্ষেত্রে আল্লাহর রাসূলের (স.) দৃষ্টান্তই আমাদের পথ দেখাতে পারে’। হাসল যায়েদ। সলজ্জ হাসিতে রাঙা হয়ে উঠল ফাতিমার মুখ। বলল, ‘মনে থাকে যেন সব ক্ষেত্রেই আল্লাহর রাসূলের (সঃ) এর দৃষ্টান্ত এভাবে খোঁজ করা হবে’। ‘অবশ্যই’। বলে যায়েদ তার এক হাত বাড়িয়ে দিল ফাতিমার দিকে। ফাতিমার এক হাত এগিয়ে এসে ধরল যায়েদের হাত। দু’জনেই এক সাথে পা বাড়াল সামনে।


এডিট ডিলিট প্রিন্ট করুন  অভিযোগ করুন     

গল্পটি পড়েছেন ৩১২ জন


এ জাতীয় গল্প

→ নতুন গুলাগ চ্যাপ্টার-১ বাকি অংশ
→ নতুন গুলাগ চ্যাপ্টার- ২ বাকি অংশ
→ নতুন গুলাগ চ্যাপ্টার- ৪ বাকি অংশ
→ নতুন গুলাগ চ্যাপ্টার- ৫ বাকি অংশ
→ নতুন গুলাগ চ্যাপ্টার- ৬ বাকি অংশ
→ নতুন গুলাগ চ্যাপ্টার- ৬ বাকি অংশ

গল্পটির রেটিং দিনঃ-

গল্পটির বিষয়ে মন্তব্য করুন

  • গল্পটির বিষয়ে মন্তব্য করতে আপনার একাউন্টে প্রবেশ করুন ... ধন্যবাদ... Login Now