বাংলা গল্প পড়ার অন্যতম ওয়েবসাইট - গল্প পড়ুন এবং গল্প বলুন

বিশেষ নোটিশঃ সুপ্রিয় গল্পেরঝুরিয়ান - আপনারা যে গল্প সাবমিট করবেন সেই গল্পের প্রথম লাইনে অবশ্যাই গল্পের আসল লেখকের নাম লেখা থাকতে হবে যেমন ~ লেখকের নামঃ আরিফ আজাদ , প্রথম লাইনে রাইটারের নাম না থাকলে গল্প পাবলিশ করা হবেনা

আপনাদের মতামত জানাতে আমাদের সাপোর্টে মেসেজ দিতে পারেন অথবা ফেসবুক পেজে মেসেজ দিতে পারেন , ধন্যবাদ

গুলাগ অভিযান চ্যাপ্টার- ২ বাকি অংশ

"সাইমুম সিরিজ" বিভাগে গল্পটি দিয়েছেন গল্পের ঝুরিয়ান রিয়েন সরকার (০ পয়েন্ট)

X মানচিত্র দেখতে গিয়ে ওরা নিচু স্বরে কথা বলা শুরু করেছে। আহমদ মুসা তাড়াতাড়ি পিঠের ব্যাগ থেকে সাউন্ড সেন্সর রেডিও বের করে নিল। যন্ত্রটি একটা পকেট রেডিওর মত। তাতে দুফিট লম্বা একটা এন্টেনা। এই এন্টেনাটা দুশ বর্গগজের মধ্যেকার সব শব্দ মনিটর করে আলাদা আলাদা করে ক্লাসিফাইড রেকর্ডের পর তা প্রচার করতে পারে। আহমদ মুসা এন্টেনা তুলে ‘হিউম্যান ভয়েস’ ‘কি’তে চাপ দিয়ে যন্ত্রটিকে সবার মধ্যখানে রেখে দিল। আহমদ মুসা দূরবীন দিয়ে মানচিত্রের যতটা পারা যায় দেখতে লাগল এবং শুনতে লাগল ওদের কথা রেডিও রিলে থেকে। যে কণ্ঠ তখন রিলে হচ্ছিল, সেটা এডাম এরিয়েলের কণ্ঠ। শুনেই তা বুঝতে পারল আহমদ মুসা। বলছিল এডাম এরিয়েল, ‘উচ্চভূমির চারদিকের অবস্থা বুঝলেন তো! এখন দেখুন, আহমদ মুসার যাবার এলাকা একমাত্র দক্ষিণ দিকটাই। উত্তর দিক থেকে সে পালিয়ে এসেছে, অতএব ওদিকে সে এই মুহূর্তে যাবে না। পশ্চিম দিকে ছোটভূমির পরেই বিশাল জলাভূমি। ওদিকে আহমদ মুসার কোন আশ্রয় নেই এবং সামনে এগুবার তার কোন পথ নেই। আর পূব দিকে পাহাড়। এই পাহাড়ের পথে কোন গন্তব্যে পৌছা তার পক্ষে সম্ভব নয়। অবশ্য আত্মগোপনের জায়গা এ পাহাড়ে থাকতে পারে। কিন্তু আহমদ মুসা আত্মগোপনের কথা ভাবছে না। তার লক্ষ্য কোন শহর বন্দরে পৌছা। সুতরাং দক্ষিণই তার যাবার একমাত্র পথ। দক্ষিণের পাহাড়-উপত্যকার পথ কষ্টকর হলেও এ পথে কিছুদূর সামনে এগুলে সে পাবে একটা ট্রাইবাল এরিয়া। এস্কিমো, রেড ইন্ডিয়ান বংশোদ্ভুত কিছু লোক এবং পলাতক এক শ্রেণীর অপরাধীদের উত্তর পুরুষ এই এলাকায় বাস করে। এখান থেকে দক্ষিণ ও পূর্ব উপকূলের কয়েকটি বন্দরে ও দক্ষিণের হেরোইমা শহরে যাবার পাহাড়ী পথ আছে। সুতরাং আহমদ মুসা এই আশ্রয়ের সন্ধানেই এগোবে।’ হাসল ডেভিড ডায়ার। বলল, ‘আহমদ মুসা উচ্চভূমির চারদিকের এত কিছু জানলেই না আশ্রয়ের সন্ধানে দক্ষিণে অগ্রসর হবে। তার এতসব জানার কথা নয়। সে আজ রাতে দ্বীপের বিমান বন্দরে ল্যান্ড করেছে এবং সংগে সংগেই তাড়া খেয়ে সে পালিয়ে এসেছে। আমার ধারণা এত কিছু ভেবে সে এগুতে পারবে না।’ এডাম এরিয়েলও হাসল। বলল, ‘আসলে আপনি আহমদ মুসাকে চেনেন না। সে যে দেশে বা যেখানে পা দেয় তার সবকিছুই সে আগে জেনে নেয়। আমার বিশ্বাস এই দ্বীপের কোন কিছুই তার অজানা নয়।’ ‘কিন্তু আপনি কি করে ধরে নিচ্ছেন যে, সে-ই আহমদ মুসা। আমি তো শুনলাম আজর ওয়াইজম্যানও এ ব্যাপারে নিশ্চিন্ত হতে পারেননি।’ বলল ডেভিড ডায়ার। ‘আগে তিনি নিশ্চিত না হলেও এখন তিনি নিশ্চিত হয়েছেন। এখানকার বিপর্যয়ের খবর যে মোবাইলে দিয়েছিল, সে জানায়, তারা আগে আক্রান্ত হয়নি। একটা ফাঁকা গুলী তার মাথার উপর দিয়ে চলে যায়। এই ফাঁকা গুলীর পর তারা আক্রমণ করলে পাল্টা গুলী বর্ষণ শুরু হয় আহমদ মুসার দিক থেকে। এটাই আহমদ মুসার যুদ্ধের সাধারণ কৌশল। সে শত্রুকে কোনওভাবে এলার্ট না করে আক্রমণ সাধারণত করে না। এই ঘটনা যেহেতু এখানে ঘটেছে তাই এখন নিসন্দেহে বলা যায়, এই ম্যাসাকার আহমদ মুসার দ্বারাই হয়েছে।’ ‘শত্রুকে আক্রমণের আগে এলার্ট করার আহমদ মুসার এই কৌশল কেন? কেন করে সে এটা?’ বলল ডেভিড ডায়ার। ‘সম্ভবত যুদ্ধ শুরুর দায় আহমদ মুসা তার ঘাড়ে নিতে চায় না, চাপাতে চায় শত্রুর কাঁধে। শত্রুকে এলার্ট করে সে শত্রুকে আক্রমণে নিয়ে আসে, তারপর সে তার জবাব দেয়।’ বলল এডাম এরিয়েল। ‘যুদ্ধে নেমে যুদ্ধের দায় সে নিতে চায় না কেন?’ ডেভিড ডায়ার বলল। ‘সে নিজেকে শান্তিবাদী হিসেবে দেখাতে চায়। সে দেখাতে চায় যে, সে জুলুমের বিরুদ্ধে আত্মরক্ষার লড়াই করে।’ বলল এডাম এরিয়েল। হাসল ডেভিড ডায়ার। বলল, ‘ভূতের মুখে রাম-নাম।’ হাসল এডাম এরিয়েলও। বলল, ‘থাক, এখন যা করার দ্রুত করতে হবে। আমাদের সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত আহমদ মুসাকে আর বাঁচতে দেয়া যাবে না।’ ‘বলুন, কি করতে চান? শেষ একটা অস্ত্র তো আমরা সাথে এনে..........।’ ডেভিড ডায়ারের কথা শেষ হলো না। হন্তদন্ত হয়ে একজন নেমে এল হেলিকপ্টার থেকে। উত্তেজিত কণ্ঠে বলল সে এডাম এরিয়েলকে লক্ষ্য করে, ‘স্যার, আমরা আমাদের সাউন্ড রেকর্ড থেকে রিলে গ্রহণ করতে গিয়ে দেখছি, আপনাদের কথা ডাবল রিলে হচ্ছে। তার মানে আপনাদের কথা আরও কোন জায়গা থেকে রেকর্ড ও রিলে হচ্ছে।’ শুনেই এডাম এরিয়েল ও ডেভিড ডায়ার বিদ্যুতপৃষ্টের মত চমকে উঠে সোজা হয়ে বসল। এডাম এরিয়েল চিৎকার করে উঠল, ‘ডাইরেকশন আইডেনটিফাই করেছ?’ হেলিকপ্টার থেকে নেমে আসা লোকটি বলল, ‘জি স্যার। পাহাড়ের দিক মানে পূব দিক থেকে আসছে।’ ‘তার মানে আহমদ মুসা পাহাড়েরই কোথাও লুকিয়ে আছে।’ বলল আবার চিৎকার করে এডাম এরিয়েল। ‘স্যার, আপনার একথাগুলোও ওরা শুনতে পাচ্ছে।’ কিছুটা নিচু স্বরে বলল লোকটি। কিছুটা বিব্রত কণ্ঠে এডাম এরিয়েল বলল, ‘স্যরি। ধন্যবাদ তোমাকে।’ কথাটা বলেই এডাম এরিয়েল উঠে দ্রুত ডেভিড ডায়ারের কাছে গেল। তাকে কানে কানে কি যেন বলল। ডেভিড ডায়ার সায় দিল এডাম এরিয়েলের কথায় মাথা ঝাঁকিয়ে। এরপর এডাম এরিয়েল কানে কানে কিছু বলল হেলিকপ্টার থেকে নেমে আসা লোকটিকে। শুনেই মাথা ঝাঁকিয়ে সায় দিয়ে লোকটি দ্রুত হেলিকপ্টারে উঠল। ওদিকে ডেভিড ডায়ারও হেলিকপ্টারে উঠে গেল। এডাম এরিয়েল হাত ইশারা করে ডাকল পাহারায় দাঁড়ানো লোক দুজনকে। ওরা এলে ওদের দুজনকেই কানে কানে কিছু বলল এডাম এরিয়েল। ওরাও সায় দিল এডাম এরিয়েলের কথায় মাথা নেড়ে। ওদের সাথে কথা শেষ করেই এডাম এরিয়েল উঠে গেল হেলিকপ্টারে। হেলিকপ্টারের পাখা ঘুরতে শুরু করল। গর্জন শুরু করেছে হেলিকপ্টার দুটির ইঞ্জিন। হেলিকপ্টার থেকে নামল আরও দুজন ষ্টেনগানধারী। তাদের দুজনেরই কাঁধে ঝুলানো ষ্টেনগান এবং কোমরে রিভলবার। শুধু একজনের হাতে বাড়তি বড় একটি ব্যাগ। আগের দুজনসহ চারজন ষ্টেনগানধারী দৌড়ে হেলিকপ্টারের নিচ থেকে একটু দূরে সরে গেল। হেলিকপ্টার উঠে গেল আকাশে। রুদ্ধশ্বাসে দেখছিল আহমদ মুসারা এই দৃশ্য। আহমদ মুসারা জেনেছে, তাদের মনিটরিং ধরে ফেলার সাথে সাথে আহমদ মুসাদের অবস্থানের এলাকাও তারা চিহ্নিত করেছে। এখন কি ওরা আক্রমণে আসবে? কিন্তু ষ্টেনগানধারীদের রেখে হেলিকপ্টার দুটো আকাশে উড়ল কেন? ষ্টেনগানধারীদের পাহারায় রেখে ওরা বিশেষ কোন প্রস্তুতির জন্যে উপরে উঠেছে। তাহলে কি হেলিকপ্টার নিয়ে ওরা আহমদ মুসাদের অবস্থান চিহ্নিত করার জন্যে বেরুল? এসব চিন্তা আহমদ মুসার মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগল। হেলিকপ্টার দুটো তখন আকাশে উঠে গেছে এবং পূবমুখী হয়ে উড়তে শুরু করেছে। নিচের চারজন ষ্টেনগানধারীদের একজন হেলিকপ্টার থেকে নামানো বড় ব্যাগটা খুলে ফেলল। তার ভেতর থেকে এক এক করে বের করে আনল অনেকগুলো গ্যাসমাস্ক। গ্যাসমাস্কগুলোর দিকে নজর পড়তেই চমকে উঠল আহমদ মুসা। পাশের সাউন্ড সেন্সরটা গুটিয়ে ব্যাগের মধ্যে ছুঁড়ে দিয়ে হন্তদন্ত হয়ে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, ‘হাসান তারিক, ওরা হেলিকপ্টার থেকে গ্যাস ফেলবে এখনি। তোমরা আমার সাথে এস।’ বলে আহমদ মুসা যে পথ দিয়ে উঠেছিল সেই পথে নামা শুরু করল। বলল, ‘ভয় নেই এস, ওদের গ্যাসমাস্ক আমাদের দখল করতে হবে।’ ‘ভাইয়া, আমাদের কাছে তো দু’টো গ্যাসমাস্ক আছে। ও দুটো মি. সার্গিও ও মিস ভ্যানিসাকে পরিয়ে দেই?’ চলতে চলতেই বলল হাসান তারিক। হাসান তারিক, সার্গিও ও ভ্যানিসা আহমদ মুসার পেছনে পেছনে তখন দৌড়াতে শুরু করেছে। হাসান তারিকের কথার জবাবে আহমদ মুসা দৌড়রত অবস্থায় বলল, ‘ও গ্যাসমাস্কগুলো কার্যকরী থাকে মাত্র দু’এক মিনিট মাত্র। তবুও দিতে পার।’ আহমদ মুসারা সবাই ছুটছে। কিন্তু এগুবার জন্যে যতটা কসরত হচ্ছে, ততটা এগুনো যাচ্ছে না। খাড়া পাহাড়ে ওঠা যতটা কঠিন, নামা তার চেয়েও কঠিন। তার উপর অনেকটা পথ ঘুরে তাদের আসতে হবে হেলিকপ্টার যেখানে দাঁড়িয়েছিল সেই চত্বরটায়। সার্গিও ও ভ্যানিসার মুখ উদ্বেগ উৎকণ্ঠায় আচ্ছন্ন। আহমদ মুসা এক ঝলক পেছনে তাকিয়ে ওদের লক্ষ্য করে বলল, ‘ভয়ের কিছু নেই। হেলিকপ্টারগুলো পাহাড়ের পুব অঞ্চলে গ্যাস স্প্রে করতে করতে আসছে, যাতে এর মধ্যে তাদের সব লোকরা গ্যাসমাস্ক পরে নিতে পারে।’ ‘ওরা এতবড় অমানুষ! এ গ্যাস প্রয়োগে তো অন্যান্য নিরপরাধসহ পশু-পাখিও মারা পরবে।’ বলে উঠল সার্গিও। হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘মানুষ যখন অমানুষ হয়, তখন সে পশুর চেয়েও খারাপ হয়ে যায়।’ ‘ভাইয়া, আপনি এই সময়েও এমন নির্মল হাসতে পারলেন? আপনার মুখে তো কোন উদ্বেগ দেখছি না।’ আহমদ মুসাক লক্ষ্য করে বলল ভ্যানিসা। ‘আল্লাহ যা ঘটাবেন তাই ঘটবে, চিন্তা করে লাভ কি বোন?’ বলল আহমদ মুসা। ‘তাহলে তো আমাদের চেষ্টা করে কোন লাভ নেই।’ ভ্যানিসা বলল। ‘আমরা যে চেষ্টা করছি, সর্বশক্তি দিয়েই করছি, সেটাও আল্লাহই ঘটাচ্ছেন। কিন্তু উদ্বেগ-আতংক আল্লাহ ঘটান না, কারণ ওটা কোন কাজ নয়।’ হাসল ভ্যানিসা। বলল, ‘অবিস্মরণীয় এক শিক্ষার কথা বলেছেন ভাইয়া।’ পূর্ব দিক থেকে হেলিকপ্টারের গর্জন ভেসে আসছে। দ্রুত ছুটে আসছে ওরা। আহমদ মুসা কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল। তার মনে পড়ল, তাদের একথাগুলো তো হেলিকপ্টার থেকে ওরা মনিটর করছে এবং এর মাধ্যমে সহজেই ওরা আহমদ মুসাদের অবস্থান চিহ্নিত করতে পারবে। অলরেডি ওরা তা হয়তো করেছেও। ভ্যানিসা কিছু বলতে যাচ্ছিল। আহমদ মুসা চাপা কণ্ঠে বলে উঠল, ‘নো মোর টক। ওরা আমাদের অবস্থান ধরে ফেলবে।’ আরেক ঝলক উদ্বেগ নেমে এল সার্গিও এবং ভ্যানিসার চোখে-মুখে। চত্বরের কাছাকাছি পৌছে গেছে আহমদ মুসারা। চারদিকের বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে। ওরা পূব দিক থেকে যে গ্যাস স্প্রে করতে করতে আসছে, তার প্রভাব এখানকার বাতাসেও ছড়িয়ে পড়েছে। আরও দ্রুত পা চালালো আহমদ মুসা। সে আরও একটা বিষয় ভেবে উদ্বিগ্ন হলো। গ্যাসমাস্ক ওয়ালারা চারজনই যদি গ্যাসমাস্কগুলো উচ্চভূমির ঢালে তাদের সহকর্মীদের কাছে নিয়ে গিয়ে থাকে! সে ক্ষেত্রে মুস্কিলে পড়বে তারা। গ্যাসমাস্ক সংগ্রহ তাদের পক্ষে কঠিন হয়ে যাবে। আশা-নিরাশার দোলায় দুলে আহমদ মুসা ষ্টেনগান সামনের দিকে তাক করে গিরিপথের আড়াল থেকে মুখ বাড়াল। দেখল তিনজন ষ্টেনগানধারী রয়েছে। চতুর্থজন সঙ্গীদের গ্যাসমাস্ক সরবরাহ করতে গেছে ঢালে, বুঝল আহমদ মুসা। গ্যাসমাস্কের ব্যাগটাও পড়ে আছে চত্বরে। ‘পশ্চিমমুখী হয়ে পজিশন নিয়ে বসে থাকা গ্যাসমাস্ক পরা ষ্টেনগানধারীদের অলক্ষ্যে তাদের পেছন থেকে গ্যাসমাস্কের ব্যাগ নিয়ে আসবে কিনা, ইত্যাদি নিয়ে আহমদ মুসা কোন সিদ্ধান্তে পৌছার আগেই পেছন থেকে প্রচন্ড হাঁচি দিয়ে উঠল ভ্যানিসা। বাতাস কিছুটা দুষিত হয়ে পড়ার কারণেই এটার কোন এলার্জিক প্রতিক্রিয়া হতে পারে। হাঁচির সাথে সাথেই তিনজন ষ্টেনগানধারী চোখের পলকে ঘুরে দাঁড়াল। তাদের ষ্টেনগানও উঠে আসছিল। আহমদ মুসা সংঘর্ষে যাওয়া ছাড়া গ্যাসমাস্ক দখলের আর কোন উপায় দেখল না। আহমদ মুসার ষ্টেনগান তাক করাই ছিল। শুধু ট্রিগার চেপে ধরল সে। ওরা আর গুলী করার সুযোগ পেল না। গুলী খেয়ে পড়ে গেল তিনটি দেহই। আহমদ মুসা ষ্টেনগান বাগিয়ে ধরে ছুটল ব্যাগের দিকে। তার পেছনে পেছনে ছুটল হাসান তারিক ও ভ্যানিসারাও। ব্যাগেই গ্যাসমাস্ক পাওয়া গেল। দ্রুত গ্যাসমাস্ক পরে নিল সবাই। হেলিকপ্টার এসে গেছে। নিশ্চয় হেলিকপ্টারে ওরা ষ্টেনগানের শব্দ শুনেছে। ওদের দূরবীনে আহমদ মুসারা ধরাও পড়ে যেতে পারে। ‘সবাই এস, জংগলের আড়ালে যেতে হবে।’ খুব নিচু স্বরে কথাগুলো বলে আহমদ মুসা ছুটল জংগলের দিকে। তার সাথে সবাই। হেলিকপ্টার আসছিল গ্যাস স্প্রে করতে করতে। হেলিকপ্টার থেকে মেশিনগান দাগাও শুরু হলো। ‘হেলিকপ্টার নিশ্চয় ষ্টেনগানের শব্দ শুনেছে, এখন দেখতে পেয়েছে তাদের লোকদের লাশও। আমরা উচ্চভূমির জংগলে আশ্রয় নিয়েছি, এটাও নিশ্চয় ওরা দেখতে পেয়েছে। এস, আমরা উত্তর দিকের ঢালের দিকে আগাই। ওদিকে তাদের লোক আছে। ওদিকে মেশিনগানের ফায়ার কম হতে পারে।’ নিচু চাপা কণ্ঠে কথাগুলো বলার সাথে সাথে আহমদ মুসা উত্তর দিকে দৌড়াতে শুরু করেছে। তার ষ্টেনগানের নল সামনে উদ্যত। আঙুল ষ্টেনগানের ট্রিগারে। তার পেছনে অন্য সবাই। পথের মাঝামাঝি জায়গায় একটা ঘন ঝোপের পাশ কাটিয়ে সামনে এগুতেই আহমদ মুসা ৫জন ষ্টেনগানধারীর একেবারে মুখোমুখি পড়ে গেল। ওরাও দৌড়ে আসছিল, সম্ভবত এদিকে ষ্টেনগানের আওয়াজ শুনেই। ঘটনার আকস্মিকতা উভয় পক্ষকেই বিমূঢ় করে দিয়েছিল। কিন্তু আহমদ মুসা এ ধরণের অবস্থার জন্যে আগে থেকেই প্রস্তুত ছিল। তার ষ্টেনগানও হাতে বাগিয়ে ধরা ছিল, হাতের আঙুলও ছিল ট্রিগারে। সুতরাং জিতে গেল আহমদ মুসাই। সে দ্রুত নিজেকে সামলে নিয়ে ট্রিগারে চেপে ধরল আঙুল। ওরাও বিমূঢ়তার প্রাথমিক ধাক্কা কাটিয়ে সক্রিয় হয়ে উঠেছিল। নড়ে উঠেছিল তাদের ষ্টেনগানও। কিন্তু তারা এ্যাকশনে যাবার আগেই সে সুযোগ তাদের শেষ হয়ে গেল। পাঁচজনই ষ্টেনগানের গুলীতে ঝাঁঝরা হয়ে ভূমি শয্যা নিল। আহমদ মুসা একবার পেছনে তাকিয়ে ‘এস তোমরা’ বলে আবার দৌড়াতে শুরু করল। সবাই এসে পৌছল উত্তর ঢালের মুখে। আহমদ মুসা সবাইকে বড় গাছের গোড়ায় আশ্রয় নিতে বলল। কিন্তু হেলিকপ্টারের গুলী জংগলের মাঝামাঝি অতিক্রম করার পর বন্ধ হয়ে গেল। হেলিকপ্টার চলে এল ঢালের ওপর। ‘ওরা ঢালে পাঠানো ওদের লোকদের খুঁজছে।’ বলে একটু হাসল আহমদ মুসা। বলল নিচু স্বরে আবার, ‘ঢালে ওদের লোকদের পাচ্ছে না। সুতরাং এখন নিশ্চয় ওরা ভাবছে, তাদের লোকরা ঢালের কাজ সেরে উচ্চভূমির জংগলে উঠে এসেছে। এই ষ্টেনগানের ফায়ারও তাদের কানে গেছে। অতএব এখন তারা ভাবতে বাধ্য হবে, জংগলে তাদের লোকদের সাথে আমাদের লোকদের সংঘর্ষ চলছে। ফলে এখন তাদের মেশিনগান ও গ্যাস আক্রমণ দুটোই অকেজো।’ ‘কি করে?’ বলল ভ্যানিসা খুব আসেত্ম। তার বিস্ময়-বিমুগ্ধ চোখে সপ্রশংস দৃষ্টি। ‘গ্যাসমাস্ক আমরা দখল করেছি, এ বিষয়ে তারা নিশ্চিত। সুতরাং গ্যাস আক্রমণ কোন কাজ দেবে না। আর যেহেতু ওরা ধরে নিতে বাধ্য হয়েছে, ওদের লোকরাও এখন উচ্চভূমিতে, তাই হেলিকপ্টার থেকে মেশিনগান আক্রমণও তারা চালাতে পারছে না।’ আহমদ মুসা বলল প্রায় ফিসফিস করে। কথাটা বলেই আহমদ মুসা তাকাল হাসান তারিকের দিকে। দ্রুত চাপা কণ্ঠে নির্দেশ দিল, ‘হাসান তারিক, তুমি যাও এখনি যে লাশগুলো পড়ল ওদের কাছে। ওরা ওদের সহকর্মীদের মোবাইলগুলো সংগ্রহের কথা বলেছিল। সবাইকে সার্চ করে মোবাইলগুলো নিয়ে এস।’ ‘আমি যেতে পারি মি. তারিকের সাথে। তাকে সহযোগিতা করব।’ বলল সার্গিও যথাসাধ্য তার দরাজ কণ্ঠকে নিচু রেখে। ‘না মি. সার্গিও, আপনি ভ্যানিসার কাছে থাকুন।’ আহমদ মুসা বলল। ‘আপনি তো আছেনই।’ বলল সার্গিও। ‘না আমি থাকছি না। এখনি গাছে উঠব।’ আহমদ মুসা বলল। ‘গাছে কেন?’ ‘ওখান থেকে হেলিকপ্টারকে ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করা যাবে। ওদের কিছু একটা ব্যবস্থা করা দরকার।’ বলেই আহমদ মুসা এগুলো সামনের সবচেয়ে বড় গাছটার দিকে। গাছে উঠল আহমদ মুসা। গাছের এমন এক জায়গায় উঠে সে বসল যাতে চারদিকের আকাশটাকে ভালোভাবে দেখা যায়। মাথার উপরটাতেই গাছের ডাল-পালার আড়াল। হেলিকপ্টার সরাসরি উপর থেকে তাকে দেখতে পাবে না। কিন্তু সে হেলিকপ্টারকে টার্গেট করতে পারবে। কিন্তু অসুবিধা যেটা হবে সেটা হলো, একমাত্র উপর ছাড়া চারপাশ থেকে হেলিকপ্টার তাকে দেখতে পাবে, যদি তারা বিশেষভাবে এদিকটার দিকে তাকায়। উচ্চভূমির গোটা আকাশটাই চক্কর দিচ্ছে হেলিকপ্টার দুটি। তবে এক সাথে নয়, আলাদাভাবে এবং বেশ দূরত্ব রেখে। আহমদ মুসা গাছের ডালে যুতসইভাবে বসে তখনও তৈরি হয়ে উঠতে পারেনি। এই সময় দেখতে পেল, একটি হেলিকপ্টার পূবদিকে কিছু দূরে হঠাৎ দাঁড়িয়ে গেল। আহমদ মুসার মনে হলো, হেলিকপ্টারটি তাকে দেখতে পেয়েছে। হেলিকপ্টারের খোলা দরজা এদিকে হা করে তাকিয়ে আছে। নিশ্চয় দূরবীনের দুটি চোখ এ দিকে স্থিরভাবে নিবদ্ধ, ভাবল আহমদ মুসা। দক্ষিণ দিকের দ্বিতীয় হেলিকপ্টারটি উড়ে আসছিল পশ্চিম দিক থেকে পূর্ব দিকে। সে হেলিকপ্টারটিও হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ল, দেখল আহমদ মুসা। সেই সাথে দেখতে পেল, হেলিকপ্টারটির মাথা বোঁ করে উত্তরমুখী হয়ে ঘুরে গেল। দ্রুত আহমদ মুসা তাকাল পূবের হেলিকপ্টারটির দিকে। দেখল, পূবের হেলিকপ্টারটির মাথাও পশ্চিম দিকে ঘুরে গেছে। আহমদ মুসার বুঝতে বাকি রইল না দক্ষিণ দিকের হেলিকপ্টারটি, পূবের হেলিকপ্টারকে সবকিছু জানিয়ে দিয়েছে। এখন দুটি হেলিকপ্টারই তাকে আক্রমণ করার জন্যে প্রস্তুত। আহমদ মুসার এই চিন্তা শেষ হবার আগেই দেখল, হেলিকপ্টার দুটি তার দিকে দৌড় শুরু করেছে। আহমদ মুসা দ্রুত ভাবল, সে ঝুলানো দড়ি বেয়ে নিচে নেমে আত্মরক্ষার ব্যবস্থা করতে পারে। কিন্তু তার ফলে হেলিকপ্টার দুটি বেপরোয়া আক্রমণের সুযোগ পেয়ে যাবে উচ্চভূমির উপরে। কারণ তারা এখন নিশ্চিত মনে করবে, তাদের লোকেরা উচ্চভূমিতে জীবিত থাকলে তাদের শত্রুরা এভাবে গাছে উঠতে পারতো না। সুতরাং হেলিকপ্টার দুটোকে সে সুযোগ দেয়া যাবে না। এ চিন্তার সাথে সাথে আহমদ মুসা চারদিকে তাকাল। তার চার দিকেই গাছ আছে তবে বেশ দূরে দূরে। কোন কোনটির দূরত্ব পনের-বিশফুট হবে। দক্ষিণ পূর্ব কোণের দিকে একটা গাছকে টার্গেট করল আহমদ মুসা। আহমদ মুসা দ্রুত উঠে এসে আশে-পাশের কয়েকটা ছোট ডাল ভেঙে তার শরীরের বিভিন্ন স্থানে গুঁজে দিয়ে বাদুড়ের মত খুব সহজভাবে এগুলো দক্ষিণ পূবমুখী একটা মোটা ডাল বেয়ে। ডালের প্রান্তের দিকে রশির মাথা শক্ত করে বেঁধে আহমদ মুসা ফিরে এল তার আগের জায়গায় রশির শেষ প্রান্তটা হাতে ধরে। তার পর দ্রুত কিছুটা নেমে এসে দুহাতে রশির দুপ্রান্ত জড়িয়ে দুপায়ে গাছটিকে প্রচন্ড শক্তিতে পেছনে ঠেলে ঝাঁপিয়ে পড়ল আহমদ মুসা। মুহূর্তেই লম্বা রশির ঝুলন্ত গতিবেগ ক্ষেপণাস্ত্রের মত আহমদ মুসাকে পৌছে দিল দক্ষিণ-পুবের সেই গাছটির একটা ডালের সান্নিধ্যে। আহমদ মুসা এক হাতে ডালটি ধরে ফেলে রশি ছেড়ে দিয়ে দুহাতে ডালটি আঁকড়ে উঠে গেল গাছে। দুটি হেলিকপ্টারের শব্দও অনেক কাছে এসে গেছে। আহমদ মুসা দ্রুত গাছের উপর দিকে উঠে যাচ্ছে। পাতায় জড়ানো অনেকগুলো ডালের এক গ্রন্থিতে আশ্রয় নিল আহমদ মুসা। হেলিকপ্টার দুটি এসে গেছে। তাদের টার্গেট সবচেয়ে লম্বা ঐ গাছটি। প্রবল এক পশলা গুলী বর্ষণ করল গাছটির উপর। গাছের উপর আকাশে ইতস্তত ঘুরতে লাগল হেলিকপ্টার দুটি। গাছটিতে কোন লোক নেই এবং সে যে নিচে নেমে গেছে তা তারা বুঝে ফেলেছে। এ সময় একটা বোমা বিস্ফোরিত হলো গাছের নিচে। ওরা বোমা ফেলেছে, বুঝল আহমদ মুসা। গ্যাস বোমা নয়, আগুনে বোমা। তবু আহমদ মুসা তার গ্যাস মুখোশটাকে ভালো করে টেনে-টুনে ঠিক করে নিল। ধুঁয়া ধেয়ে আসছে নিচ থেকে উপর দিকে। আহমদ মুসা খুশি হলো এই ভেবে যে, ধুঁয়া তাকে ঢেকে ফেলবে এবং হেলিকপ্টার থেকে কেউ তাকে দেখতে পাবে না। কিন্তু এই সাথে ভাবল ধুঁয়ায় আচ্ছন্ন হলে হেলিকপ্টার দুটোকে টার্গেট করা তার জন্যে কঠিন হয়ে পড়বে। তার উপর হেলিকপ্টার দুটি যদি এই অবস্থায় অন্যদিকে সরে যায়, তাহলে তার গাছে উঠাই বেকার যাবে। এই চিন্তার সাথে সাথেই আহমদ মুসা দুহাতে তার দুটি ষ্টেনগানকে তৈরি করে নিয়েছে। তখন ধোঁয়া উঠে আসেনি এবং তখনও হেলিকপ্টার দুটো গাছটির আকাশে চক্কর দিচ্ছে। গতি তাদের খুব স্লো। ডালের গ্রন্থিতে পা রেখে আহমদ মুসা গাছের কান্ডে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়েছে। তার ষ্টেনগান দুটির ব্যারেল অধীরভাবে অপেক্ষা করছে হেলিকপ্টার দুটি তার নাগালের মধ্যে আসার। আহমদ মুসা জানে, তার প্রথম আক্রমণই শেষ আক্রমণ হবে। প্রথম আক্রমণ থেকে যদি ওরা বেঁচে যায়, তাহলে ওদের পাল্টা আক্রমণের মুখে আহমদ মুসা দ্বিতীয় আক্রমণের সুযোগ পাবে না। এজন্যেই আহমদ মুসার ষ্টেনগান দুটি খুব সতর্ক। এক সময় উত্তর ও দক্ষিণ গামী হেলিকপ্টার দুটি আহমদ মুসার মাথার উপরে প্রায় ২০ ডিগ্রী কোণে পাশাপাশি চলে এল। দক্ষিণমুখি হেলিকপ্টারটি পুবপাশে, আর উত্তরমুখিটি পশ্চিম পাশে। দুটি ফুয়েল ট্যাংকার ষ্টেনগানের নাগালের মধ্যে এসেছে। গর্জে উঠল আহমদ মুসার দুহাতের দুটি ষ্টেনগান। অবিরাম গুলীর ঝাঁক ছুটে চলল হেলিকপ্টার দুটিকে লক্ষ্য করে। আক্রান্ত হয়েই হেলিকপ্টার দুটি দ্রুত সরে যেতে লাগল এবং অবিরাম গুলীবৃষ্টি তারাও শুরু করল ভূমির দিকে। আহমদ মুসা আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করল। হেলিকপ্টার দুটি সরে গিয়ে গুলীবৃষ্টি শুরু না করলে আহমদ মুসা পূব পাশের হেলিকপ্টারের গুলীতে এতক্ষণ ঝাঁঝরা হয়ে গোশতের স্তুপে পরিণত হয়ে যেত। হেলিকপ্টার দুটি দুদিকে চলে গেল, আর ফিরে এল না। আহমদ মুসার এ গাছটা অপেক্ষাকৃত ছোট এবং সেও গাছের শীর্ষ থেকে অনেকখানি নিচে, তাই আকাশটা আর তার চোখে পড়ছে না। আহমদ মুসা একটু অপেক্ষার সিদ্ধান্ত নিল। একটু পরেই নিচ থেকে সার্গিও চিৎকার করে উঠল, ‘মি. আহমদ মুসা, একটি হেলিকপ্টারে আগুন ধরে গেছে, অন্যটিও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে মনে হচ্ছে। দ্রুত ফিরে যাচ্ছে।’ সার্গিও’র কথা শেষ না হতেই প্রচন্ড বিস্ফোরনের শব্দ শোনা গেল পুব দিক থেকে। ‘হেলিকপ্টারটি ধ্বংস হয়ে গেছে মি. আহমদ মুসা।’ নিচ থেকে আনন্দে চিৎকার করে উঠল সার্গিও’র কণ্ঠ। ‘আলহামদুলিল্লাহ।’ বলে আহমদ মুসা গাছ থেকে নামা শুরু করল। গাছের নিচে দাঁড়িয়েছিল হাসান তারিক, সার্গিও এবং ভ্যানিসা। আহমদ মুসা গাছ থেকে নামতেই সার্গিও হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, ‘অভিনন্দন মি. আহমদ মুসা। আমাদের টেরসিয়েরা দ্বীপ অবিস্মরণীয় এক যুদ্ধ দেখল। সেই সাথে দেখল আহমদ .........।’ আহমদ মুসা তাকে বাধা দিয়ে বলে উঠল, ‘আর দেরি নয় মি. সার্গিও, এখনি এখান থেকে সরতে হবে। আমাদেরকে অহেতুক যুদ্ধ এড়াতে হবে।’ ‘অহেতুক কেন? এ যুদ্ধে শত্রুরা দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং দূর্বল হয়েছে।’ ‘এটুকুই লাভ মি. সার্গিও। কিন্তু এই লাভ করতে গিয়ে শত্রুদের যে পরিমাণ উস্কে দিয়েছি তাতে উদ্দেশ্য হাসিলের পথে এগুবার বদলে আত্মরক্ষার লড়াই-এ ব্যস্ত থাকতে হবে।’ বলল আহমদ মুসা। সার্গিও ও ভ্যানিসা স্থির দৃষ্টি তুলে আহমদ মুসার দিকে তাকিয়ে আছে। তাদের চোখে-মুখে বিস্ময়। আহমদ মুসা থামার একটু পরে সার্গিও বলে উঠল, ‘ধন্যবাদ মি. আহমদ মুসা। আপনি যেভাবে ভেবেছেন, ওটা আমাদের মাথাতেই আসেনি। আপনি ঠিকই বলেছেন।’ সার্গিও একটু থেমেই পরক্ষণে আবার বলল, ‘ওদের নতুন আক্রমণের আশংকা করছেন আপনি?’ ‘এই পরিস্থিতিতে ওরা বড় ধরনের আক্রমণে না এসেই পারে না। আমি হলে তো সর্বশক্তি দিয়ে আক্রমণ করতাম।’ আহমদ মুসা বলল। ‘তাহলে চলুন আমরা এখন থেকে তাড়াতাড়ি সরে পড়ি।’ বলল সার্গিও। ‘অস্ত্রগুলো কাজে লাগবে, কিন্তু এতগুলো অস্ত্র নেয়া হবে কি করে মি. সার্গিও?’ ‘অসুবিধা হবে না, আমরা সবাই ভাগ করে নেব। একটু এগুলেই আমরা দুটি ঘোড়া পেয়ে যাব।’ বলল সার্গিও। ‘আপনারা ঘোড়ায় এসেছিলেন? সামনে তাহলে ঘোড়া চলার মত ভালো রাস্তা আছে?’ আহমদ মুসা বলল। ‘দক্ষিণের পাহাড়-উপত্যকার খাড়া চড়াই-উৎরাইটা খুব বেশি নয়। তারপরেই ঘোড়া চলতে পারে।’ বলল সার্গিও। তৈরি হয়ে চলতে শুরু করল তারা। যে গিরিপথ দিয়ে তারা পাহাড়ে উঠেছিল লুকাবার জন্যে, সে গিরিপথ দিয়েই তাদের চলা শুরু হলো। ‘আমাদের এ যাত্রা কোথায়? আপনাদের বাড়িতে? কোথায় আপনাদের বাড়ি?’ জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা সার্গিওকে। ‘এই উচ্চ ভূমিটাই ছিল আমাদের আদি বাড়ি। ভূমিকম্পে ধ্বংস হয়ে গেলে আরও দক্ষিণে সরে একটা বাড়ি তৈরি করা হয়েছিল। যখন নিরিবিলি সময় কাটাতে চাই, তখন এ বাড়িতেই আমরা আসি।’ বলল সার্গিও। ‘এই উচ্চভূমিটা কি করে বাড়ি হয়? না সমুদ্রের তীর, না নদীর ধার এটা।’ আহমদ মুসা বলল। ‘এটাই ছিল তখন সমুদ্র তীর। এই উচ্চভূমিটা একটা দূর্গ। দূর্গটা তৈরি হয়েছিল সমুদ্র তীরে। এর উত্তরের অঞ্চলটা ভূমিকম্পের ফলে জেগে উঠেছে।’ ‘এই দুর্গটা আপনাদের পরিবারের বাড়ি হলে ধরে নিতে হবে যে আপনারাই এ দ্বীপের আদি শাসক পরিবার?’ জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার। ‘এ দ্বীপের নয় এ দ্বীপপুঞ্জের। আমাদের গনজালো পরিবারই এ দ্বীপের আদি শাসক।’ বলল সার্গিও। পূর্বমুখী গিরিপথ কিছুটা গিয়ে একেবারে এবাউট টার্ণ করে পশ্চিমমুখী হয়ে একটা সমতল উপত্যকায় প্রবেশ করল। চারদিকের পাহাড়ের দেয়াল ঘেরা উপত্যকাটা বেশ বড়। সারি সারি কবর সে উপত্যকায়। প্রতিটি কবরের শিয়রে ক্রুস শোভা পাচ্ছে। ‘এটা আমাদের আদি পারিবারিক কবরস্থান। ভূমিকম্প আমাদের দূর্গ ধ্বংস করেছে। কিন্তু এ কবরস্থানটা অক্ষত আছে।’ বলল সার্গিও। উপত্যকার মাঝ বরাবর দিয়ে তারা পশ্চিমে এগিয়ে চলল। দুধারে কবরের সারি। সামনে চলছিল হাসান তারিক। তারপর ভ্যানিসা। ভ্যানিসার পরে সার্গিও। সবশেষে আহমদ মুসা। উপত্যকার পশ্চিম প্রান্তে তারা এসে গেছে। হঠাৎ হাসান তারিক থমকে দাঁড়িয়েছে। ‘একি দেখছি আহমদ মুসা ভাই?’ বলল হাসান তারিক। ‘কি হল? কি দেখছেন?’ বলল সার্গিও ও ভ্যানিসা এক সাথে। তাদের কণ্ঠস্বরে উৎকণ্ঠা। দ্রুত আহমদ মুসা সামনে চলতে চলতে বলল, ‘কি হয়েছে, কি দেখছ?’ হাসান তারিক মুখে কিছু না বলে আঙুল দিয়ে ইংগিত করল সামনের কবরের দিকে। তাকাল আহমদ মুসা। কবরগুলো চোখে পড়ল তার। তাঁর ভ্রুও কুঞ্চিত হয়ে উঠল। উপত্যকার পশ্চিম প্রান্ত থেকে শুরু হয়ে বেশ কিছু দূর পর্যন্ত অনেকগুলো কবরের শিয়রে ক্রস রাখা নেই। এই কবরগুলোর সবগুলোর উপরের কাঠামো ভেঙে লন্ড-ভন্ড করা। কিন্তু তারপরও কবরের বুনিয়াদ নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়নি। এই কবরগুলো দক্ষিণ উত্তরমুখী করে তৈরী। অথচ এর পরের সবগুলো কবরই পূব-পশ্চিম মুখী এবং এদের প্রত্যেকটির শিয়রে ক্রস স্থাপিত আছে। আহমদ মুসাও বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গিয়েছিল। পেছন থেকে সার্গিও সামনে এসে আহমদ মুসা ও হাসান তারিকের মাঝখানে দাঁড়াল। সামনে তাকিয়ে মুখে হাসি টেনে বলে উঠল, ‘ও এই কবরগুলো ভাঙা কেন! অবাক হয়েছেন আপনারা?’ বলে একটু থামল সার্গিও। আহমদ মুসা ও হাসান তারিক কিছু বলল না। সার্গিওই আবার কথা বলে উঠল। বলল, ‘সব কথা জানি না। তবে শুনেছি, প্রায় একশ বছর আগে আমাদের এক পূর্ব পুরুষ আমাদের আজোরস দ্বীপপুঞ্জের আজকের আধুনিক আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা গোমেজ গনজালো এই কবরগুলো ভেঙে ফেলেন। সেই সময় ইউরোপের এক সংবাদপত্রে আমাদের পরিবারের দুর্নাম রটাবার জন্যে কি যেন লেখা হয়, তারপরেই তিনি এই কবরগুলো ভেঙে ফেলেন। শুধু তাই নয়, ভেংগে প্রথম কবরটার পাশে পারিবারিক একটা বাক্সও সমাধিস্থ করেন এবং কবরস্থানকে বিদেশীদের জন্যে নিষিদ্ধ করে দেন। একশ বছরের মধ্যে আপনারাই প্রথম বিদেশী এই কবরস্থানে প্রবেশ করেছেন।’ ‘বাক্সটা কেন সমাধিস্থ হলো, কিছু জানেন?’ জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা। ‘আমি জানি না। তবে অনুমান করি, কবরগুলো যে কারণে ভাঙা হয়েছে, সেই একই কারণে বাক্সটাকেও সমাধিস্থ করা হয়েছে।’ বলল সার্গিও। ‘কিন্তু ঐ কবরের কাছে কেন? যে কোন জায়গায় করলেই তো হতো!’ জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা। ‘আমারও সেই প্রশ্ন, কিন্তু উত্তর জানি না।’ সার্গিও বলল। সার্গিও থামতেই ভ্যানিসা বলে উঠল, ‘মনে হয় পরিত্যাজ্য গোপন কিছু সমাধিস্থ করা হয়েছে।’ ‘ধন্যবাদ ভ্যানিসা। আমারও তাই মনে হয়।’ বলল আহমদ মুসা। ‘কবরগুলো ভাঙা হলো কেন, এই ব্যাপারে আপনার কি মনে হয় ভাইয়া?’ ‘তোমার প্রশ্নের উত্তর আমি জানি। কিন্তু বলবো না। তোমাদের একশ বছর আগের পূর্ব পুরুষ যেমন তা সহ্য করতে পারেনি, তেমনি হয়তো তোমরাও পারবে না।’ আহমদ মুসা বলল। ‘পারবো ভাইয়া।’ বলল ভ্যানিসা। ‘ঠিক আছে বলব। আজ নয়। ঐ বাক্সটা যেদিন উদ্ধার করব, সেদিন বলব। এমনও হতে পারে আমাকে কিছুই বলতে হবে না। বাক্সটাই বলে দেবে সব।’ আহমদ মুসা বলল। বিস্ময় ফুটে উঠল সার্গিও ও ভ্যানিসা দুজনেরই চোখে-মুখে। বলে উঠল সার্গিও, ‘বাক্সে কি আছে কেমন করে অনুমান করতে পারছেন? আর ঐ বাক্স আপনি পাবেনই বা কি করে?’ ‘অনুমান কিভাবে তার উত্তর ভ্যানিসাই দিয়েছে। যে কারণে কবরগুলো ভাঙা সেই একই কারণে বাক্সটিকেও সমাধিস্থ করা হয়েছে। এদিক থেকে বাক্সে কি থাকতে পারে অনুমান করছি। আর বাক্স পাব কি করে? মাটি খুঁড়ে বের করতে হবে।’ আহমদ মুসা বলল। ‘বাক্সটাকে আপনি এত জরুরী মনে করেন?’ সার্গিও বলল। ‘হ্যাঁ মি. সার্গিও। আপনারা রাজী হলে এখনি খুঁড়ে ওটা বের করতে চাই।’ বলল আহমদ মুসা। ‘না মি. আহমদ মুসা। আজ নয়। আর একদিন আসব আমরা এদিকে। আর এ ব্যাপারে আম্মাকেও আমার রাজি করতে হবে। কারণ ওটা ছিল পারিবারিক এক সিদ্ধান্তের ব্যাপার।’ সার্গিও বলল। ‘আমার আপত্তি নেই মি. সার্গিও।’ আহমদ মুসা বলল। ‘তাহলে আবার যাত্রা শুরু হোক।’ সার্গিও বলল। যাত্রা আবার শুরু হলো আগের মতই। হাঁটা শুরু করে ভ্যানিসা আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে বলল, ‘কবর ভাঙার রহস্য জানার ব্যাপারটা তো দেখছি অনির্দিষ্ট সময় চেপে রাখতে হবে, কিন্তু আমি তো এক মুহূর্তও তা পারছি না।’ ‘বেশি প্রত্যাশার জিনিস হলে বেশি ভালো লাগবে ভ্যানিসা।’ বলল আহমদ মুসা একটু রসিকতার সুরে। ‘কিন্তু মি. আহমদ মুসা, প্রত্যাশা ও না পাওয়ার তিক্ত অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে চলছে ভ্যানিসা। তার উপর আরও লোড চাপানো আরও দুঃখজনক হবে।’ সার্গিও বলল। ‘কি সে তিক্ত অভিজ্ঞতা?’ জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা। সার্গিও মুখ খুলতে যাচ্ছিল। ভ্যানিসা চিৎকার করে তাকে বাধা দিয়ে বলল, ‘ভাইয়া, আমি কিন্তু এখানে বসে পড়ব।’ লজ্জায় রক্তিম হয়ে উঠেছে তার মুখ। ‘ঠিক আছে বলব না।’ বলল সার্গিও। আহমদ মুসা হাসল। বলল, ‘বলার দরকার নেই। আমার বুঝা হয়ে গেছে। আমার জিজ্ঞাসা মি. সার্গিও, উনি কি এখন রাজবন্দী, না বিদেশে?’ বিস্ময় ফুটে উঠল ভ্যানিসা ও সার্গিও দুজনের চোখে মুখে। পরক্ষণেই বিস্ময়ের স্থান দখল করে নিল বেদনা। বলল সার্গিও ধীরে ধীরে, ‘রাজবন্দী নয়, তবে নজরবন্দী।’ ‘ঘটনা কি?’ জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার। ‘ঘটনাটা বেদনার। ভ্যানিসা বিদ্রোহী গনজালো পরিবারের মেয়ে, আর সে আজোরসের পর্তুগীজ গভর্ণর পেড্রো পাওলেটা’র ছেলে। দুজনেই লিসবন বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠি ছিল। পাশ করে এসেছে। এখন লুই জুগো রাজধানী পন্ট ডেলগাডারের বাইরে বেরুতে পারে না। আর ভ্যানিসার জন্যে রাজধানীতে ঢোকা কঠিন।’ বলল সার্গিও। আহমদ মুসার ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠল। বলল, ‘এসব কোন ব্যাপারই নয়। আমি আগের কথাই একটু ঘুরিয়ে বলব, ভালো লাগার বস্তু পাওয়া একটু কঠিন হওয়া বাজার অর্থনীতির জন্যেও স্বাভাবিক।’ সার্গিও মুখ টিপে হাসল। আরও রক্তিম হয়ে উঠল ভ্যানিসার মুখ। কিছু বলল না কেউ।


এডিট ডিলিট প্রিন্ট করুন  অভিযোগ করুন     

গল্পটি পড়েছেন ৩৪৮ জন


এ জাতীয় গল্প

→ গুলাগ অভিযান চ্যাপ্টার- ১ বাকি অংশ
→ গুলাগ অভিযান চ্যাপ্টার- ৩ বাকি অংশ
→ গুলাগ অভিযান চ্যাপ্টার- ৪ বাকি অংশ

গল্পটির রেটিং দিনঃ-

গল্পটির বিষয়ে মন্তব্য করুন

  • গল্পটির বিষয়ে মন্তব্য করতে আপনার একাউন্টে প্রবেশ করুন ... ধন্যবাদ... Login Now