বাংলা গল্প পড়ার অন্যতম ওয়েবসাইট - গল্প পড়ুন এবং গল্প বলুন

বিশেষ নোটিশঃ সুপ্রিয় গল্পেরঝুরিয়ান - আপনারা যে গল্প সাবমিট করবেন সেই গল্পের প্রথম লাইনে অবশ্যাই গল্পের আসল লেখকের নাম লেখা থাকতে হবে যেমন ~ লেখকের নামঃ আরিফ আজাদ , প্রথম লাইনে রাইটারের নাম না থাকলে গল্প পাবলিশ করা হবেনা

আপনাদের মতামত জানাতে আমাদের সাপোর্টে মেসেজ দিতে পারেন অথবা ফেসবুক পেজে মেসেজ দিতে পারেন , ধন্যবাদ

গুলাগ অভিযান চ্যাপ্টার- ৪ বাকি অংশ

"সাইমুম সিরিজ" বিভাগে গল্পটি দিয়েছেন গল্পের ঝুরিয়ান রিয়েন সরকার (০ পয়েন্ট)

X আহমদ মুসার ডাইরী পড়া বন্ধ হয়ে গেল। সবাই উৎকর্ণ হয়ে উঠেছে। আহমদ মুসা ডাইরীটা সার্গিও’র হাতে দিয়ে দ্রুত সরে এল গুহার মুখে হাসান তারিকের পাশে। মুক্ত আকাশের দিকে কান পেতে একটু শোনার চেষ্টা করেই আহমদ মুসা বলে উঠল, ‘আমাদের মাথার উপরে হেলিকপ্টার। মনে হচ্ছে আলো না জ্বালিয়ে খুব নিচু দিয়ে ওরা এসেছে।’ বলেই আহমদ মুসা মুহূর্তের জন্যে থামল। পরমুহূর্তেই আহমদ মুসা ব্যাগ থেকে মুখোশ বের করে একটা নিজে নিয়ে অন্যগুলো সকলের সামনে ছুড়ে দিয়ে চাপা উত্তেজিত কণ্ঠে বলে উঠল, ‘তোমরা সকলে তাড়াতাড়ি গ্যাস মুখোশ পড়ে নাও। নিশ্চয় শব্দ মনিটরিং করে আমাদের অবস্থান পিন পয়েন্ট করার পর তারা এসেছে। অন্ধকারে নিশ্চয় তারা নামতে সাহস পাবে না। গ্যাস বোমাই তাদের টার্গেট।’ আহমদ মুসার কথা শেষ হওয়ার আগেই চারদিক থেকে ছোট ছোট বেলুন ফাটলে যেমন শব্দ হয় সেরকম শব্দ উঠতে শুরু করেছিল। সবাই গ্যাস মুখোশ পরে নিয়েছিল। আহমদ মুসাও তাড়াতাড়ি গ্যাস মুখোশ পরে নিল। ভ্যানিসা ও সার্গিও’র মুখে আতংক। ভ্যানিসা বলল, ‘ভাইয়া.......।’ ভ্যানিসা মুখ খুলতেই আহমদ মুসা ঠোঁটে আঙুল চেপে তাকে কথা বলতে নিষেধ করল। ‘ভাইয়া’ শব্দ বের হওয়ার পরই ভ্যানিসার মুখ বন্ধ হয়ে গেল। আহমদ মুসা ফিসফিস কণ্ঠে বলল, ‘হেলিকপ্টারে ওদের শক্তিশালী শব্দগ্রাহক যন্ত্র আছে। আর কোন কথা নয়। ওদের বুঝাতে হবে যে, ওদের প্রাণঘাতি গ্যাস বোমায় আমরা সবাই মারা গেছি। এ বিশ্বাস যদি ওদের হয় তাহলে ওরা নিশ্চিন্তে চলে যাবে, অথবা আরও নিশ্চিত হবার জন্যে নিশ্চংকচিত্তে এই গুহার সামনে ল্যান্ড করবে।’ কথা শেষ করে আহমদ মুসা গুহামুখের দিকে একটু সরে গিয়ে বসল। তারপর অখন্ড নিরবতা। আকাশে হেলিকপ্টারের চাপা হালকা যান্ত্রিক গর্জন, নিচে আশে-পাশে মাঝে মাঝে গ্যাসবোমা ফাটার ফটফট শব্দ। দীর্ঘ এক ঘন্টা নিরবতার পর সবাই অনুভব করল হেলিকপ্টারের শব্দ আরও নিকটতর হচ্ছে। বুঝল সবাই নামছে হেলিকপ্টার থেকে। আহমদ মুসা হাসান তারিকের দিকে তাকিয়ে ফিসফিস কণ্ঠে বলল, ‘ওরা সম্ভবত দেখতে নামছে যে আমরা বেঁচে আছি কিনা। ওরা গুহামুখের দিকে আসবে, সাবধানে থেকো। আমি ওদের পেছন দিকে যাবার চেষ্টা করছি।’ বলে আহমদ মুসা গুহা থেকে বেরিয়ে গেল। তার মুখে গ্যাস মুখোশ এবং হাতে এম-১০ মেশিন রিভলবার। হেলিকপ্টার ল্যান্ড করল গুহার একটু সামনে সমাধীক্ষেত্রের উপর। আহমদ মুসা তখন ক্রলিং করে গুহামুখ থেকে অনেকখানি সরে গেছে। আকাশটা মেঘে ঢেকে যাওয়ায় অন্ধকার এখন নিশ্ছিদ্র হয়ে উঠেছে। হেলিকপ্টারটিকে অন্ধকারের বুকে আরও অন্ধকার একটা পিন্ড বলে মনে হচ্ছে। চোখের সামনে আর সবকিছুই অন্ধকারে হারিয়ে গেছে। হঠাৎ অন্ধকারের মধ্যে একটা ব্রাশ ফায়ারের শব্দ উঠল এবং তা অব্যাহতভাবে চলল। আহমদ মুসা বুঝল, ব্রাশফায়ারের কেন্দ্রবিন্দু হলো গুহামুখ। আহমদ মুসা নিশ্চিত হলো, ওরা গুহার দিকে যাবে। এই ব্রাশফায়ার তারই পূর্ব প্রস্তুতি। তারা দেখতে চায় গুলীর কোন জবাব আসে কিনা। কেউ জীবিত থাকলে নিশ্চয় আত্মরক্ষার জন্যে জবাব দেবে। হাসান তারিক ব্রাশফায়ারের কোন জবাব দিল না। খুশি হলো আহমদ মুসা, হাসান তারিক ওদের পাতা ফাঁদে পা দেয়নি। শক্তিশালী শত্রুকে বাইরে গুহা বা ঘরের ভেতর থেকে সমর্থক গুলী চালিয়ে শত্রুর কাছে নিজের অস্তিত্বের জানান দেয়া ঠিক নয়। কারণ তাতে বোমা বা গ্রেনেড হামলার শিকার হয়ে বিপর্যয় ঘটার সম্ভাবনা থাকে। গুহা বা ঘর থেকে বাইরের প্রবল শক্তির প্রতি আক্রমণটা পিনপয়েন্টেড ও চূড়ান্ত হতে হয়। আহমদ মুসা এসব ভাবছিল আর হেলিকপ্টারের পেছন দিকে অগ্রসর হচ্ছিল। আহমদ মুসা পাঁচ মিনিটের মত ক্রলিং করে চলার পর হেলিকপ্টারের পেছনে গিয়ে পৌছল। ধীরে ধীরে উঠে বসল আহমদ মুসা। উঠে বসার পর মাথাটা স্থির হবার সাথে সাথেই একটা কঠিন বস্তু এসে মাথায় চেপে বসল। সংগে সংগেই ভারী একটা কণ্ঠ, ‘আমার চোখে ইনফ্রারেড গগলস আছে। তোমার সবকিছুই আমি দেখতে পাচ্ছি। চালাকি করার চেষ্টা করলে মাথার খুলি উড়ে যাবে।’ রুক্ষ ও কঠোর কণ্ঠ লোকটির। আহমদ মুসার হাতে এম-১০, কিন্তু হাত যেমন ছিল তেমনি কোলের উপর রাখল। আক্রমণকারীর চোখে ইনফ্রারেড গগলস আছে তা আহমদ মুসা বিশ্বাস করেছে। এই গগলসটা থাকার কারণেই সে আহমদ মুসাকে দেখে ফলো করেছে। আক্রমণকারী লোকটি একটু থেমেই আবার বলে উঠল, ‘বেন্টো, ওর হাতের ভয়ংকর এম-১০টা নিয়ে নাও।’ সংগে সংগেই একজন লোক আহমদ মুসার পাশে এসে আহমদ মুসার হাত থেকে এম-১০টা নিয়ে নিল। পরক্ষণেই পেছনের রিভলবারধারী লোকটি তার রিভলবারের নল দিয়ে আহমদ মুসার মাথাকে একটু সামনে ঠেলে দিয়ে বলে উঠল, ‘উঠে দাঁড়াও।’ আহমদ মুসা উঠে দাঁড়ালে সে বলল, ‘সামনে আগাও হেলিকপ্টারের দরজার দিকে।’ হাঁটতে লাগল আহমদ মুসা। পেছনে রিভলবারধারী লোকটির রিভলবার আহমদ মুসার মাথা থেকে তিল পরিমাণও নড়েনি। হেলিকপ্টারের দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়াল আহমদ মুসা। রিভলবারধারী পেছন থেকে বলল, ‘বেন্টো, ওর দুহাতে পেছনে এনে বেঁধে ফেল।’ বেন্টো নামক লোকটিকে আহমদ মুসার পেছনে জায়গা করে দেবার জন্যে রিভলবারধারী আহমদ মুসার পাশে সরে আসছিল। তার রিভলবারের নলটিও আহমদ মুসার মাথা থেকে আলগা হয়ে গিয়েছিল। মুহূর্তের এই ফাঁকেই ঘটে গেল ঘটনাটা। হঠাৎ আহমদ মুসার মাথা তীর বেগে নিমণমুখী হলো, আর তার দুই পা ঈষৎ ফাঁক হয়ে ক্ষেপণাস্ত্রের মত উৎক্ষিপ্ত হলো উপর দিকে এবং ধনুকের মত তা বেঁকে একটা আঘাত করল রিভলবারধারীর চোখে-মুখে, অন্য পা টি হাতুড়ীর মত গিয়ে পড়ল আহমদ মুসাকে বাঁধার জন্যে এগিয়ে আসা দ্বিতীয় লোকটির বুকে। দুজনেই পড়ে গিয়েছিল। রিভলবারধারীর অবস্থাই বেশি খারাপ হয়েছিল। আহমদ মুসার পায়ের আঘাতে লোকটির ইনফ্রারেড গগলস ভেঙে চোখে ঢুকে গিয়েছিল। কিন্তু হাতের রিভলবার তার হাত থেকে ছুটে যায়নি। সে পড়ে গিয়ে চোখ বন্ধ রেখেই এলোপাথাড়ি গুলী করা শুরু করে দিয়েছিল। আহমদ মুসাও পড়ে গিয়েছিল। শুয়ে থেকেই রিভলবারধারীর রিভলবার ধরা হাত সে চিহ্নিত করতে পারল গুলী বর্ষণ দেখে। আহমদ মুসা ঝাঁপিয়ে পড়ে দুহাত দিয়ে তার রিভলবার কেড়ে নেয়ার চেষ্টা করল। লোকটিও তার দুহাত দিয়ে রিভলবার আঁকড়ে ধরে গুলী করছিল। রিভলবার নিয়ে ধস্তাধস্তি শুরু হয়ে গেল দুজনের মধ্যে। লোকটি তার সর্বশক্তি দিয়ে রিভলবারের নল আহমদ মুসার দিকে ঘুরাতে চেষ্টা করছিল এবং আহমদ মুসাও। আহমদ মুসাই শেষে জিতে গেল। লোকটির রিভলবারের গুলী তার নিজেরই থুথনির নিচ দিয়ে ঢুকে মস্তক বিদ্ধ করল। রিভলবারটি হাতে নিয়ে আহমদ মুসা পাশের লোকটির দিকে এগুলো। সে মাটিতে পড়েছিল। আহমদ মুসা ভাবল, লোকটি এলোপাথাড়ী গুলীর মধ্যে মাটিতে পড়ে থেকে আত্মরক্ষা করছে। অন্ধকারেই আন্দাজ করে আহমদ মুসা তার রিভলবার লোকটির মাথায় চেপে ধরল এবং বলল, ‘দুহাত একটু নড়াতে চেষ্টা করলে মাথা ছাতু করে দেব।’ বলে আহমদ মুসা তার বাম হাত দিয়ে লোকটির ডান কব্জি চেপে ধরল। কিন্তু হাতটি নিসাড়। আহমদ মুসা তার বাম হাতটি আরও সামনে সরিয়ে নিতেই অনুভব করল লোকটির হাত খোলা, তার শিথিল হাতের পাশেই আহমদ মুসা পেয়ে গেল তার এম-১০ মেশিন রিভলবার। লোকটি কি জ্ঞান হারিয়েছে? - এই চিন্তা করেই আহমদ মুসা তার ডান হাত লোকটির মুখের উপর নিয়ে এল। গরম তরল কিছুতে আহমদ মুসার ডান হাতটা ডুবে গেল। ‘রক্ত নিশ্চয়’- ভাবল আহমদ মুসা। আহমদ মুসা তার হাত লোকটির মাথায় নিয়ে এল। মাথায় রক্তের বন্যা। আহমদ মুসা বুঝল লোকটি মাথায় গুলী খেয়ে মরেছে। এটা রিভলবারধারী লোকটির এলোপাথাড়ী গুলীরই ফল। মাথায় গুলী খাওয়ায় চিৎকারেরও অবসর পায়নি। উঠে দাঁড়াল আহমদ মুসা। এই সময় তার পেছনে গুহামুখ থেকে সাব-মেশিনগানের একটানা গর্জন ভেসে এল। আহমদ মুসা গুলীর একটানা ষ্টাইল দেখেই বুঝল এ সাব মেশিনগান হাসান তারিকের। খুশি হলো আহমদ মুসা যে, হাসান তারিক প্রথম গুলী ছুড়েছে এবং টার্গেট পিনপয়েন্ট করেই গুলী ছুড়ছে। এদের পাল্টা আক্রমণের আর অবসর হবে না। তাই হলো। হাসান তারিকের সাব মেশিনগান থেমে গেল। কিন্তু এ পক্ষের পাল্টা আক্রমণ আর হলো না। কিছুক্ষণ নিরবতা। শত্রুপক্ষের কেউ আর অবশিষ্ট নেই, নিশ্চিত হলো আহমদ মুসা। গুহা মুখের দিকে লক্ষ্য করে আহমদ মুসা বলল, ‘হাসান তারিক, তোমরা বেরিয়ে এস, গেম ইজ ওভার।’ বৈদ্যুতিক লণ্ঠন সাথে করে বেরিয়ে এল হাসান তারিকরা। চলে এল ওরা হেলিকপ্টারের কাছে। ‘ওদিকের কি খবর হাসান তারিক?’ জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা। ‘ওরা পাঁচজন গিয়েছিল। পাঁচজনই মারা পড়েছে ভাইয়া।’ হাসান তারিক বলল। ‘এদিকে ঐযে দুজনের লাশ দেখ, ওরাই শুধু ছিল।’ বলে উঠল আহমদ মুসা। ‘তার মানে হেলিকপ্টারটি এখন আমাদের।’ আনন্দে বলে উঠল ভ্যানিসা। ‘হ্যাঁ, যুদ্ধ-লব্ধ মাল। নিজের অবশ্যই বলতে পার।’ আহমদ মুসা বলল। ‘এখন হেলিকপ্টারে উঠে তো আলো জ্বালানো যায়।’ বলল ভ্যানিসা। ‘হ্যাঁ যায়।’ বলেই আহমদ মুসা উৎকর্ণ হয়ে দক্ষিণ দিকে তাকাল। হঠাৎ আহমদ মুসাকে এভাবে উৎকর্ণ হয়ে উঠতে দেখে সবাই তাকাল দক্ষিণ দিকে। সবাই শুনতে পেয়েছে দক্ষিণ দিক থেকে একটা হেলিকপ্টারের শব্দ ভেসে আসছে। সবাই তাকিয়ে থাকল ওদিকে। শব্দটি কাছে চলে এসেছে। খুব নিচু দিয়ে উড়ে আসছে হেলিকপ্টারটি আলো নিভিয়ে। তাই খুব কাছে এসে গেলেও হেলিকপ্টারটি দেখা যাচ্ছে না। আহমদ মুসা দ্রুত হেলিকপ্টারে উঠে গেল। মিনিটখানেকের মধ্যেই নেমে এল এ্যান্টি-এয়ারক্রাপ্ট ধরনের হালকা গান নিয়ে। এ গানগুলো লোফ্লাইং বিমান, হেলিকপ্টার কিংবা মাটিতে থাকা যে কোন হালকা ধরনের স্থাপনা ধ্বংসে বংবহার করা যায়। এয়ার থেকে এয়ার, এয়ার থেকে গ্রাউন্ড সব রকমেই এগুলো ব্যবহার করা যায়। চারটি গানের একটা নিজে রেখে অন্য তিনটি হাসান তারিক, সার্গিও ও ভ্যানিসাকে দিয়ে বলল, ‘প্রথম হেলিকপ্টারটি আমাদের দখলে। দ্বিতীয় শত্রু হেলিকপ্টারটি আসছে হয় প্রথমটির খোঁজ নিতে, অথবা প্রথমটির আমন্ত্রণ পেয়ে। শত্রু হেলিকপ্টারটি নিকট আকাশে আসার পর আমাদের চারজনের একযোগে প্রথম আঘাতেই তাকে ধ্বংস করতে হবে। বোমা ফেলার সুযোগ তাকে দেয়া যাবে না।’ থামল আহমদ মুসা। ওরা তিনজন একসাথেই বলে উঠল, ‘আমরা বুঝেছি ভাইয়া।’ ল্যান্ড করা হেলিকপ্টারটির দক্ষিণপূর্ব কোণ বরাবর সমাধীক্ষেত্রের মাঝখানে পজিশন নিয়ে সবাই বসল আহমদ মুসার নির্দেশে। লম্বালম্বি এক লাইনে প্রথমে আহমদ মুসা, তারপরে সার্গিও, পরে ভ্যানিসা এবং সবশেষে হাসান তারিক। রাতের কালো আঁধার কেটে ততোধিক কালো হেলিকপ্টারটি যমদূতের মত আসছে খুব চাপা একটা গর্জন তুলে। সমাধীক্ষেত্রের আকাশে ঢুকে পড়েছে হেলিকপ্টারটি। গতি তার ধীর হয়েছে। অনেকটা দ্বিধাগ্রস্ত গতি। মনে হয় অয়্যারলেসের যোগাযোগে প্রথম হেলিকপ্টার থেকে সাড়া পাচ্ছে না। হঠাৎ সমাধীক্ষেত্রের মাঝখানের আকাশে এসে স্থির হয়ে থাকা হেলিকপ্টার থেকে সার্চ লাইটের একটা তীব্র আলো গিয়ে পড়ল মাটিতে ল্যান্ড করা হেলিকপ্টারটির উপর। সেই আলোতে হেলিকপ্টারের দক্ষিণ পাশে পড়ে থাকা দুটি লাশের দৃশ্যও স্পষ্ট হয়ে উঠল। ‘ফায়ার। ওটা এখন বিটালিয়েশনে আসবে।’ চাপা কণ্ঠে গর্জন করে উঠল আহমদ মুসা। সংগে সংগেই চারটি এ্যান্টি-এয়ারক্র্যাফট গান গর্জন করে উঠল। চারটি গান থেকে আটটি আগুনের বুলেট ছুটে গেল হেলিকপ্টারের দিকে। আকাশে দাঁড়ানো হেলিকপ্টারকে তাক করে ধীরে সুস্থে ছোঁড়া আটটি বুলেটই গিয়ে আঘাত করল হেলিকপ্টারটিকে। ভীষণভাবে কেঁপে উঠল হেলিকপ্টারটি। পরক্ষণেই মাথা নিচু করে একটা ড্রাইভ দিয়ে উত্তর দিক হয়ে পূর্ব দিকে ঘুরল। সেই সাথে একাধারে মেশিনগানের গুলী ও বোমা পড়তে শুরু করেছে হেলিকপ্টার থেকে। হেলিকপ্টারটি একটু পূর্ব দিকে গিয়ে আবার পশ্চিম দিকে ফেরার চেষ্টা করে আবার পূর্বমুখী হয়ে ছুটতে শুরু করল। আগুনের ফুলকি বেরুচ্ছে হেলিকপ্টারের ইঞ্জিন থেকে। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই হেলিকপ্টারটি পাহাড়ের আড়ালে দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে গেল। অল্পক্ষণ পরেই পূর্ব দিকে ভয়ানক বিস্ফোরণের শব্দ ভেসে এল। ‘হেলিকপ্টারটি ধ্বংস হয়ে গেল, ভাইয়া।’ বলল ভ্যানিসা আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে। সবাই উঠে দাঁড়িয়েছে বসা পজিশন থেকে। কিন্তু আহমদ মুসা ওঠেনি। ‘ভাইয়া আসুন। আমরা গুহামুখের দিকে একটু সরে যাই। বোমার আগুন এদিকে আসছে।’ বলল হাসান তারিক আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে। হাসান তারিকের কথার দিকে ভ্রুক্ষেপ না করে আহমদ মুসা বলে উঠল, ‘হেলিকপ্টার বিস্ফোরণে যে বনি আদমরা মারা গেল, তার জন্য আমরা কতটুকু দায়ী হাসান তারিক?’ ধীর, ব্যথিত কণ্ঠ আহমদ মুসার। ‘আমরা দায়ী নই ভাইয়া। আমরা আত্মরক্ষার জন্যেই গুলী করেছি হেলিকপ্টারকে। ওরা বুঝতে পেরেছিল ওদের হেলিকপ্টারের সব লোক মারা গেছে। ওরা এর প্রতিশোধ নিতে বোমা ও গুলীর সয়লাব বইয়ে দিত এই সমাধীক্ষেত্রে। ওদের হেলিকপ্টারকে না মারলে আমাদেরকেই মরতে হতো।’ বলল হাসান তারিক। হাসান তারিক থামতেই সার্গিও বলে উঠল, ‘এ প্রশ্ন আপনি তুলছেন কি করে ভাই? এটা যুদ্ধের ময়দান। মারার জন্যেই তারা এসেছিল, তারা না মরলে আমাদের মরতে হতো।’ ম্লান হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘আপনাদের যুক্তিগুলো আমারও জানা। কিন্তু অনেক সময় অনেক ঘটনায় নিজের দিয়ে নিজেকে জানানো যায় না। নিঃসন্দেহে এই হত্যাগুলো প্রয়োজনের। আল্লাহর বিধান একে স্বীকৃতি দেয়। কিন্তু তবু মনে হয় তাঁর বান্দাহদের প্রতি আল্লাহ অপরিসীম মেহেরবান। আল্লাহ ব্যাথা পান তার বান্দাহদের এইসব মৃত্যুতে।’ ‘না ভাইয়া, আল্লাহ ব্যাথা পান বান্দাহদের পথভ্রষ্টতায়। বান্দাহদের পথ ভ্রষ্টতাই তো এইসব করুণ পরিণতির জন্য দায়ী।’ বলল হাসান তারিক। ‘তুমি ঠিক বলেছ হাসান তারিক। বান্দাহদের পথভ্রষ্টতাই মূল কথা। এই পথভ্রষ্টতা সব হানাহানি, জুলূম-নির্যাতন এবং হতাহতের জন্য দায়ী। শান্তির জন্যই এই পথভ্রষ্টতার হাত থেকে মানুষকে বাঁচাতে হবে।’ আহমদ মুসা বলল। ‘বাঁচাবার এই সংগ্রামই তো ইসলাম করছে। কিন্তু কল্যাণের এই সংগ্রামকেই উৎখাত করার জন্য এগিয়ে এসেছে পথভ্রষ্টরা। চলার পথ থেকে পথভ্রষ্টদের সরাতে না পারলে মানবতার শান্তির সংগ্রাম, মানবতার মুক্তির সংগ্রাম থেমে যাবে, শেষ হয়ে যাবে। সুতরাং মানুষের শান্তি ও মুক্তির জন্যই তো সংগ্রাম প্রয়োজন পথভ্রষ্টদের বিরুদ্ধে। এই সংগ্রামে আজকের হেলিকপ্টার বিধ্বস্ত হওয়ার মত আরও অসংখ্য ঘটনা ঘটতেই পারে।’ বলল হাসান তারিক। ‘ধন্যবাদ মি. হাসান তারিক। আজ আপনাদের কথা খুব আপন বলে মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে মুসলিম ও ইসলাম গৌরবের বস্তু। কিন্তু এতদিন একে অপমানজনক মনে করে এসেছি।’ সার্গিও বলল। ‘শুধু অপমানজনক নয়, আমরা নিষ্ঠুরভাবে আমাদের পূর্ব পুরুষের কবর ভেঙে ফেলেছি এবং পরিবারের ইতিহাসকে সমাধিস্থ করেছি।’ বলল ভ্যানিসা। ‘যারা কবর ভেঙেছেন, যারা ইতিহাস কবরস্থ করেছেন তাদের সৌভাগ্য হয়নি ডাইরীটা পড়ার, যা আজ আহমদ মুসা ভাই আমাদের পড়ে শোনালেন।’ সার্গিও বলল। ‘ডাইরী পড়া তো শেষ হয়নি ভাইয়া।’ বলল ভ্যানিসা। ভ্যানিসা থামতেই আহমদ মুসা বলে উঠল, ‘সব আলোচনা এখন বন্ধ। এখন কাজ। প্রথম কথা হলো, বাক্সটা গর্তে নামিয়ে আগের অবস্থায় রেখে দেয়া। আর.............।’ আহমদ মুসার কথার মাঝখানেই সার্গিও বলে উঠল, ‘বাক্সটিকে আর মাটির তলায় পাঠানো হবে না ভাইয়া। দেখছেন তো, পরিবারের ইতিহাসকে সমাধিস্থ করা নিয়ে ভ্যানিসা কি রকম ক্রিটিক্যাল কথাবার্তা বলছে শুরু থেকেই।’ ‘না ভাইয়া, আমার মত আছে। বাক্সটাকে মাটির তলায় যেখানে ছিল সেখানে পাঠিয়ে দিন।’ বলে হাসতে লাগল ভ্যানিসা। হাসতে হাসতেই আবার বলে উঠল, ‘জানি ভাইয়া, আপনি পারবেন না আর বাক্সটাকে সমাধিস্থ করতে। দাদু গাজী আল জামাল এক মুহূর্তেই আমাদের মাথাকে আকাশস্পর্শী করেছেন। আমরা কি পারি এই মাথাকে আবার লুটিয়ে দিতে!’ আবেগ কম্পিত কণ্ঠ ভ্যানিসার কান্নায় ভরে গেল। মুখের হাসি নিভে গেল চোখের পানিতে। ম্লান হাসল সার্গিও। আবেগ উত্তেজনায় লাল হয়ে উঠেছে তার মুখও। বলল, ‘ঠিক বলেছ বোন, ঐ বাক্সটা গনজালো পরিবারকে নতুন জীবন দান করল। ওকে কবর নয়, আমাদের মাথায় রাখতে হবে।’ ‘কিন্তু আম্মার তো শর্ত ছিল, বাক্স আবার মাটির তলায় রাখতে হবে।’ দ্রুতকণ্ঠে বলল আহমদ মুসা। ‘আম্মা যা বলেছেন, আম্মাই তা আর মানবেন না। সুতরাং সে চিন্তা নেই।’ সার্গিও বলল। ‘তাছাড়া আমাদের পূর্ব পুরুষ যিনি এই ইতিহাসকে সমাধিস্থ করেছিলেন, তাঁর চিঠিওতো শুনলাম। তিনিও আশা করেছিলেন তারই উত্তর পুরুষের কেউ এই ইতিহাস উদ্ধার করবেন। আজ তাঁর আশাই পূর্ণ হলো। সুতরাং আগের অবস্থায় ফিরে যাবার কোন প্রশ্ন নেই।’ বলল ভ্যানিসা। আহমদ মুসা হাসল। স্বস্তির হাসি। বলল সার্গিওকে উদ্দেশ্য করে, ‘তাহলে এখন করণীয় বলুন।’ ‘এখন আমরা হেলিকপ্টার নিয়ে যাত্রা করব।’ বলল সার্গিও। ‘কোথায়?’ আহমদ মুসা বলল। ‘পশ্চিম উপকূলে আমাদের ঘাঁটিতে, যার কথা আমি আগেও বলেছিলাম।’ বলল সার্গিও। ‘হেলিকপ্টার নিলে অসুবিধা হবে না? কেউ দেখে ফেলবে না? জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা। ‘আমাদের ঘাঁটিটা হলো পশ্চিম উপকূলীয় শহর ‘সিরেটা ও দজ রিবেরা’র মাঝখানে এক পার্বত্য উপত্যকায়। ঐ ঘাঁটিতে কোন বাড়ি-ঘর নেই। পাহাড়ের বিভিন্ন গুহাকে বাড়িতে রূপান্তরিত করা হয়েছে। সুতরাং ও ঘাঁটি কারও নজরে পড়ার মত নয়। হেলিকপ্টারটি জংগলের আড়াল করে চালিয়ে নিয়ে যাব। আর ওখানে নিয়ে গিয়েই হেলিকপ্টারে নতুন রং দিয়ে ওটা পাল্টে ফেলব আমরা। এ হেলিকপ্টারেই আমরা কেকো দ্বীপের হারতা পৌছতে পারি।’ বলল সার্গিও। ‘এখানে হেলিকপ্টারের রেজিষ্ট্রেশন নেই?’ আহমদ মুসা বলল। ‘আছে কমার্শিয়াল হেলিকপ্টারগুলোর। পার্সোনাল হেলিকপ্টারের নেই।’ বলল সার্গিও। মুখটা প্রসন্ন হয়ে উঠল আহমদ মুসার। বলল, ‘চলুন বাক্সটা হেলিকপ্টারে তুলে যাত্রার জন্য তৈরি হই।’ বলে আহমদ মুসা গুহা লক্ষ্যে হাঁটতে শুরু করল। ভ্যানিসা হাঁটতে শুরু করে বলল, ‘হেলিকপ্টার জিন্দাবাদ।’ ‘হেলিকপ্টার জিন্দাবাদ কেন?’ পেছন ফিরে জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা। ‘হেলিকপ্টারই আমাকে ও সার্গিও ভাইয়াকে ওদিকে নিয়ে যাচ্ছে। আমরা বাদই পড়ে গিয়েছিলাম।’ বলল ভ্যানিসা আদুরে শিশুর ভংগিতে। সবাই হেসে উঠল। হেলিকপ্টার উড়ে চলেছে তেরসিয়েরা দ্বীপের পশ্চিম উপকূলের দিকে। হেলিকপ্টার চালাচ্ছে হাসান তারিক। তার পেছনেই তিনটি সিটে বসে আছে আহমদ মুসা, সার্গিও ও ভ্যানিসা। কথা বলছিল সার্গিও, ‘আমি আশ্চর্য হয়ে যাচ্ছি আহমদ মুসা ভাই, ‘গাজী আলী জামাল’ হয়ে গেল ‘গনজালো’। আমাদের পরিবারও টের পেল না এই বিকৃতি।’ শুধু ‘গাজী আলী জামাল’ নাম কেন, দ্বীপপুঞ্জের নামও তো বিকৃত হয়েছে। কোথায় নামটা ছিল ‘আয-যোহর’ সেটা হয়ে গেল ‘আজোরস’। এ রকমই হয়। সময়ের পরিবর্তনে যখন কোন ভাষার চর্চা কমে যায়, কিংবা আদৌ থাকে না, তখন সে ভাষার শব্দগুলো বিকৃত হয়ে যায়। অন্যভাষার লেখকরা এই বিকৃতিকে ত্বরান্বিত করে। যেমন স্পেনের ‘জাবালুত তারিক’ হয়েছে ‘জিব্রালটার’। বলল আহমদ মুসা। আমার মনে হয় দ্বীপপুঞ্জের বিভিন্ন নামের মত মানুষের ঐতিহ্য-সংস্কৃতি যেটা আগে ছিল, সেটারও ব্যাপক বিকৃতি ঘটেছে।’ ভ্যানিসা বলল। এ সময় আহমদ মুসা একটু নড়ে-চড়ে বসল। তার চোখে-মুখে হঠাৎ প্রশ্ন ভেসে উঠল। কোন কথা যেন হঠাৎ তার মনে পড়ে গেছে। সে দ্রুত কণ্ঠে বলে উঠল, ‘একটা কথা মনে পড়েছে ভ্যানিসা। সেই উচ্চ ভূমিটায়, যেখানে তোমাদের আদি বাড়ি ছিল বলেছিলে, যে বেদিটা আছে সেখানে আমি পাথরের বাটি দেখেছি। বেদিও পাথরের ছিল। সেখান থেকে দুটো বিশাল সাপকে নেমে যেতে দেখেছি। এখন আমার মনে পড়ছে সাপ দুটো বাটিতে কিছু খেয়েছে। আবার তোমরা দুজন বেদির পাশেই গাছের উপর ছিলে। তোমরা সব দেখার কথা। কি দেখেছ? তোমরা ওখানে গাছেই বা কেন ছিলে? এসব প্রশ্ন আমার রয়েছে। জবাব খুঁজে পাইনি।’ আহমদ মুসা থামতেই ভ্যানিসা সার্গিওর দিকে চেয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বলল, ‘ভাইয়া, তুমিই উত্তরটা দাও।’ গম্ভীর হয়ে উঠেছে সার্গিও। একটু ভাবল। একটা ম্লান হাসি ফুটে উঠল তার ঠোঁটে। বলল, ‘সাপ দুটোকে আমাদের পরিবারের সদস্য মনে করা হয়। পনের দিন বা এক মাস পর পর বেদির ঐ পাথর বাটিটায় দুধ দেয়া হয়। সাপ দুটো তা খেয়ে যায়। এই নিয়ম চলে আসছে কত যুগযুগ ধরে তা আমরা জানি না। আমাদের পূর্ব পুরুষরা এটা করেছে, সাপ দুটোর পিতা-দাদারাও এভাবে একই নিয়মে দুধ খেয়ে এসেছে। বিস্ময়ের ব্যাপার এক সাথে দুটোর বেশি সাপ দুধ খেতে আসে না। আমাদের পারিবারিক বিশ্বাস হলো, সাপ দুটো আমাদের সৌভাগ্যের প্রতীক। আদি ভিটা আমরা ছেড়েছি, কিন্তু তারা ছাড়েনি। তারা আদি বাস্তুভিটাকে ধরে রেখেছে লড়াইয়ে জয়ী হয়ে। আমাদের পরিবারের বিশ্বাস হলো, আমরা অতীতের শক্তি, সম্পদ সব একদিন ফিরে পাব। দ্বীপপুঞ্জে একদিন আবার গনজালো পরিবারের পতাকা উড়বে। সাপ দুটো আমাদের ঐশ্বর্য ও ঐতিহ্যের পাদপিঠকে আঁকড়ে থাকা তারই একটা প্রমাণ।’ একটু থামল সার্গিও। সার্গিও থামতেই আহমদ মুসা বলল, ‘লড়াইয়ে জয়ী হয়ে’ কথাটার অর্থ বুঝলাম না। আর আপনাদের সাপের ইতিহাস কার থেকে শুরু? নিশ্চয় শুরু থেকে নয়।’ ‘অবশ্যই শুরু থেকে নয়’, বলতে শুরু করল সার্গিও, ‘আমাদের পারিবারিক এক মহাবিপর্যয়ের সময় থেকে সাপের ইতিহাস শুরু বলে আমি শুনেছি। ইতিহাসটা হলোঃ গনজালো পরিবার তখনও দ্বীপের শাসক। সেই সময়ের কোন একদিন আমাদের পারিবারিক বাড়ি ও শাসনকেন্দ্র দুর্গটি আক্রান্ত হয় উত্তর আটলান্টিকের সবচেয়ে বড় জলদস্যুর নৌবাহিনী দ্বারা। রাতের বেলা আক্রমণটা এতই আকস্মিক ছিল যে, আত্মরক্ষার কোন উদ্যোগ নেয়াই সম্ভব হয়নি। দূর্গের সৈন্য ও প্রহরীরা সবাই মর্মান্তিক গণহত্যার শিকার হয়। পরিবারের পুরুষ সদস্যরা বেশির ভাগই মারা যায়। কিন্তু আমাদের পরিবারের শীর্ষ ও দ্বীপপুঞ্জের শাসকপদে অধিষ্ঠিত ব্যক্তিটি তার অবশিষ্ট পরিবার-পরিজন নিয়ে দক্ষিণে সিলভার উপত্যকায় পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। জলদস্যু রেডরিংগর বাহিনী আমাদের দূর্গ দখলের ঐ রাতেই ভোরে আমাদের দ্বীপে ভয়াবহ ভূমিকম্প সংঘটিত হয়। ভূমিকম্পের কেন্দ্র যেন ছিল আমাদের দূর্গটি। দূর্গ সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়ে গেল। সেই সাথে ধ্বংস হয়ে গেল জলদস্যু রেডরিংগসহ তার বাহিনী। পরদিন দূর্গের শাসক আমাদের পূর্বপুরুষ দেখতে এসেছিলেন দুর্গের অবস্থা। আর দুর্গের আশে-পাশের লোকদের সাহায্যের জন্যে এনেছিলেন দুধ, রুটি, বিস্কুট ইত্যাদি। তিনি এসে দেখেন পাড়া-প্রতিবেশীদের তেমন ক্ষতি হয়নি। শুধু ধ্বংস হয়েছে দুর্গটাই। সবচেয়ে বিস্ময়কর যে ঘটনা দেখেন সেটা হলো, জলদস্যু সর্দার রেডরিংগ ও তার স্ত্রী দুর্গের গেটের বাইরে মৃত অবস্থায় পড়ে আছে। জানা যায় সর্প দংশনে তাদের মৃত্যু হয়েছে। আর যে সাপ দুটো তাদের কামড়েছিল সে দুটো সাপ তাদের পাশেই বসেছিল। মানুষের ভীড় সে দৃশ্য অবলোকন করেছে। দ্বীপপুঞ্জের শাসক আমাদের পুর্বপুরুষ সেখানে পৌছতেই সাপ দুটো চলে যেতে থাকে। যেন সাপ দুটো লাশ দুটিকে পাহারা দিয়ে রেখেছিল দ্বীপের শাসকের আগমনের অপেক্ষায়। উপস্থিত প্রবীণদের কেউ কেউ আমাদের পূর্বপুরুষকে বলে, ‘ও দুটো আপনাদের বাস্তু সাপ। ওরা প্রতিশোধ নিয়েছে রিংগর উপরে, যেমন প্রতিশোধ নেয় ঈশ্বর ভূমিকম্পের মাধ্যমে। আপনাদের সাপের দুধ খেতে দিন। সংগে সংগেই আমাদের পূর্বপুরুষটি তার একজন লোকের হাত থেকে দুধের একটা বালতি নিয়ে কিছু দূরে রেখে দেন। সাপ দুটো ফিরে এসে দুধ খেয়ে চলে যায়। সেই থেকেই ওখানে নির্দিষ্ট সময় পরপর দুধ রাখার নিয়ম মেনে আসা হচ্ছে। দুটি সাপও সেই থেকে দুধ খেয়ে যাওয়ার নিয়ম মেনে চলছে।’ একটু থামল সার্গিও। থেমেই আবার বলে উঠল, ‘কাহিনী আপনি হয়তো বিশ্বাস করবেন না, বিজ্ঞানও বিশ্বাস করবে না। কিন্তু আপনি তো দেখেছেন দুটো সাপকে দুধ খেয়ে যেতে।’ আহমদ মুসা হাসল। বলল, ‘এক ধরনের সাপ কোথাও দুধের সন্ধান পেলে নির্দিষ্ট নিয়মেই সেখানে বার বার আসে। ভূমিকম্পের সন্ধান প্রাণীকূল আগেই পেয়ে থাকে। সেদিন ভূমিকম্পের আগে নিশ্চয় সেখানকার সাপগুলো মাটির তলা থেকে বেরিয়ে এসেছিল। ভূমিকম্প শুরু হলে মানুষ পালাচ্ছিল, সাপও পালাচ্ছিল। এই সময় রেডরিংগরা ভীত-সন্ত্রস্ত সাপের আক্রমণের শিকার হয়। এরপরও সাপের একটা নিজস্ব জগৎ আছে, সেই সাথে আল্লাহরও ইচ্ছা আছে। সুতরাং কিছু ঘটনা অলৌকিক পর্যায়ে পড়তেই পারে। আমি সাপকে দুধ খাওয়ানো বন্ধ করতে বলবো না। তবে সাপকে ভালোমন্দের নিয়ামক ভাবা চলবে না।’ ম্লান হাসল সার্গিও। বলল, ‘আপনার ব্যাখ্যাটি ঠিক। তবু যে বিশ্বাস আশা যোগায়, শক্তি যোগায় এবং তা যদি ক্ষতিকর না হয়, তাহলে সে বিশ্বাস রাখলে ক্ষতি কি!’ হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘গাজী আলী জামাল ওরফে গনজালো পরিবার আবার ঐশ্বর্য ঐতিহ্য ফিরে পাবে, এ বিশ্বাসের জন্যে সাপকে অবলম্বন করার দরকার নেই। আপনাদের সংগ্রামই তা প্রমাণ করে দেবে, সে শুভ দিন আপনাদের অবশ্যই আসবে।’ ‘ধন্যবাদ আহমদ মুসা ভাই। কিন্তু এ ধরনের বিশ্বাস ধর্মনীতির পরিপন্থী?’ বলল সার্গিও। ‘হ্যাঁ, আমাদের ইসলাম ধর্মের পরিপন্থী। ইসলামের বক্তব্য হলো, আল্লাহই সবকিছুর স্রষ্টা, প্রতিপালক, প্রত্যাবর্তনস্থল। সব ভালো-মন্দ তারই হাতে। পৃথিবীর কোন পরাক্রমশালী শাসককেই ভালো-মন্দের মালিক বলা যাবে না। বেআইনীভাবে তার কাছে মাথাও নোয়ানো যাবে না।’ আহমদ মুসা বলল। ‘ভাইয়া, স্রষ্টা মানে আল্লাহ যদি মন্দেরও মালিক হন, তাহলে মন্দের জন্যে তো তিনিই দায়ী হন। তাহলে মন্দের বিচার তিনি করবেন কেমন করে?’ বলল ভ্যানিসা। আহমদ মুসা হাসল। বলল, ‘আমল বা আচরণ মানুষের স্বাধীন ইচ্ছার জন্যে নির্ধারিত। কিন্তু এর ফলটা হয় খোদায়ী বিধান অনুসারে। ফলাফলের এ অংশটা আল্লাহর এখতিয়ারে। কিন্তু এই ফলাফল আসে আল্লাহর দেয়া প্রাকৃতিক বিধান অনুসারে, তবে মানুষের আমল ও আচরণের ভিত্তিতে। সুতরাং মন্দের জন্য আচরণকারী মানুষই দায়ী।’ ‘ভাইয়া আসুন, আমরা উদ্ভুত অবস্থার আলোচনায় আসি।’ বলে একটু থেমেই আবার বলা শুরু করল, ‘পারিবারিক ইতিহাস ও পূর্ব পুরুষের পরিচয় পাওয়ার পর সবকিছুই উলট-পালট হয়ে গেল। আমাদের পরিচয় এখন কি হবে সেটাই ভাবছি।’ বলল সার্গিও। ‘তোমরা যে পরিচয় চাও, সেটাই হবে সার্গিও।’ আহমদ মুসা বলল। ‘আমি বুঝতে পারছি না আহমদ মুসা ভাই, একটি মুসলিম পরিবার কিভাবে খৃষ্টান পরিবারে রূপান্তরিত হলো?’ বলল সার্গিও। ‘অস্বাভাবিক নয় সার্গিও। শত শত বছর খৃষ্টান পরিবেশে যদি একটি বা কয়েকটি মুসলিম পরিবার থাকে এবং সেই সাথে যদি তাদের শিক্ষা-দীক্ষার কোন ব্যবস্থা না থাকে, তাহলে ধীরে ধীরে জীবনাচরণ তাদের পরিবর্তিত হয়ে যায়, সেই সাথে হারিয়ে যায় তাদের বিশ্বাসও। এক সময় চারদিকের চলমান ধর্মই তাদের ধর্ম হয়ে যায়। এভাবেই গাজী আলী জামাল পরিবার আমূল বদলে গেছে।’ আহমদ মুসা বলল। ‘পূর্ব-পরিচয়ের এই আবিস্কার বিস্ময়কর। কিন্তু পরিচয়টা আমার জন্যে গৌরবের। আমার পূর্ব পুরুষরা স্পেনের নৌবাহিনীতে ছিল, অটোমান নৌবাহিনীতে ছিল। কিন্তু সবচেয়ে গৌরবের মনে হচ্ছে আধুনিক যুগ ও অনন্য সভ্যতার নির্মাতা আরব মুসলমানরা আমাদের পূর্ব পুরুষ। নিজেকে মুসলমান ভাবতে গৌরবই বোধ করছি।’ বলল ভ্যানিসা। ‘কিন্তু তোমাদের মুসলিম পরিচয় প্রকাশ হলে আজোরসের স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্ব দেয়া গনজালো পরিবারের জন্যে অসুবিধা হবে না?’ আহমদ মুসা বলল। জবাব দিল সার্গিও। বলল, ‘আমাদের পূর্ব পুরুষরা পতুর্গাল সরকারের প্রপাগান্ডাকে যতটা ভয় করেছিল, ততটা ভয়ের কোন কারণ নেই। পতুর্গালের প্রপাগান্ডায় কোন কাজ হয়নি। গনজালো পরিবারের ধর্ম আজোরসবাসীদের কাছে কোন বিবেচ্য বিষয় নয়। গনজালো পরিবারের নেতৃত্ব তাদের ইতিহাসের কারণে। গনজালো পরিবার মুসলিম হলে সে ইতিহাস মিথ্যা হয়ে যাবে না।’ ‘কিন্তু মুসলমানদের বিরুদ্ধে তো বিশ্বব্যাপী একটা খারাপ প্রপাগান্ডা চলছে। গনজালো পরিবারের মুসলিম পরিচয় আজোরসের স্বাধীনতা সংগ্রামে একটা সংকট সৃষ্টি করতে পারে।’ আহমদ মুসা বলল। ‘সে প্রপাগান্ডার ধার অনেকটা ভোঁতা হয়ে গেছে। এ প্রপাগান্ডার মূলে তো ছিল, ইহুদীরা। সে ইহুদীদের মেরুদন্ড ভেঙে গেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ইহুদীরা এখন প্রধান আসামীর কাঠগড়ায় দন্ডায়মান এবং একজন মুসলমান আপনিই এই ক্ষেত্রে সাহায্য করেছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে। সুতরাং মুসলমানদেরই সুদিন ফিরে আসছে। তারপরও যদি আমাদের পরিবারের মুসলিম পরিচয় আমাদের নেতৃত্বের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়, আমরা নেতৃত্ব ছেড়ে দিয়ে কর্মীর কাতারে দাঁড়াতে একটুও দ্বিধা করবো না। নেতৃত্ব ছাড়ব, কিন্তু ইতিহাস আর ছাড়ব না, আদর্শ ছাড়ব না।’ বলল সার্গিও। ‘ধন্যবাদ ভাইয়া। আমারও মত এটাই।’ আনন্দে চিৎকার করে উঠল ভ্যানিসা। ‘কনগ্রাচুলেশন। তোমাদের স্বাগত জানাচ্ছি ভ্যানিসা, সার্গিও।’ বলল আহমদ মুসা। ‘ওয়েলকাম ভাইয়া। খুবই খুশি লাগছে আপনার সাথে এক হতে পেরে। আরও খুশি লাগতো যদি আপনার অভিযানে শরীক হতে পারতাম।’ ভ্যানিসা বলল। আহমদ মুসা হাসল। বলল, ‘এও হতে পারে, বাধ্য হয়েই তোমাদের অভিযানে যোগ দিতে হচ্ছে। আমরা হারতা যাচ্ছি মূল অভিযানের প্রস্তুতির জন্য। ভবিষ্যত সম্পর্কে আমরা কিছুই জানি না। শত্রুর শক্তি এবং সেখানকার পরিস্থিতি সম্পর্কেও নয়। হতে পারে যে, অভিযানে তোমাদের অংশগ্রহণ অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। অতএব হতাশ হয়ো না। বরং প্রস্তুত থেকো।’ ‘অবশ্যই ভাইয়া। হারতা কবে যাত্রা করছেন?’ ভ্যানিসা বলল। ‘পশ্চিম উপকূলে তোমাদের ঘাঁটিতে যাবার পর তোমাদের সাথে পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নেব।’ বলল আহমদ মুসা। ‘হেলিকপ্টারেই যাবেন?’ ভ্যানিসা বলল। ‘সেটাও ঠিক হবে ওখানে যাবার পর। হেলিকপ্টার নিলে হেলিকপ্টারটি ফিরিয়ে আনার জন্য তোমাদের, মানে অন্তত সার্গিওর যেতে হবে।’ বলল আহমদ মুসা। ‘তাহলে হেলিকপ্টার নেন ভাইয়া।’ ভ্যানিসা বলল। আহমদ মুসা হাসল। অন্য সকলেই হেসে উঠল ভ্যানিসার বাচ্চাসুলভ আবদারে। হাসি থামলেও কেউ কোন কথা তৎক্ষণাৎ বলল না। নেমে এল নিরবতা। এই নিরবতার মধ্যে হেলিকপ্টারের চাপা গর্জনটা আরও স্পষ্ট হয়ে উঠল। সকলের দৃষ্টিই সামনে। লক্ষক্ষ্যর পথে যেন প্রাণপণে উড়ে চলেছে হেলিকপ্টার।


এডিট ডিলিট প্রিন্ট করুন  অভিযোগ করুন     

গল্পটি পড়েছেন ২৮৭ জন


এ জাতীয় গল্প

→ গুলাগ অভিযান চ্যাপ্টার- ১ বাকি অংশ
→ গুলাগ অভিযান চ্যাপ্টার- ২ বাকি অংশ
→ গুলাগ অভিযান চ্যাপ্টার- ৩ বাকি অংশ

গল্পটির রেটিং দিনঃ-

গল্পটির বিষয়ে মন্তব্য করুন

  • গল্পটির বিষয়ে মন্তব্য করতে আপনার একাউন্টে প্রবেশ করুন ... ধন্যবাদ... Login Now