বাংলা গল্প পড়ার অন্যতম ওয়েবসাইট - গল্প পড়ুন এবং গল্প বলুন

বিশেষ নোটিশঃ সুপ্রিয় গল্পেরঝুরিয়ান - আপনারা যে গল্প সাবমিট করবেন সেই গল্পের প্রথম লাইনে অবশ্যাই গল্পের আসল লেখকের নাম লেখা থাকতে হবে যেমন ~ লেখকের নামঃ আরিফ আজাদ , প্রথম লাইনে রাইটারের নাম না থাকলে গল্প পাবলিশ করা হবেনা

আপনাদের মতামত জানাতে আমাদের সাপোর্টে মেসেজ দিতে পারেন অথবা ফেসবুক পেজে মেসেজ দিতে পারেন , ধন্যবাদ

ধ্বংস টাওয়ারের নীচে চ্যাপ্টার- ১

"সাইমুম সিরিজ" বিভাগে গল্পটি দিয়েছেন গল্পের ঝুরিয়ান রিয়েন সরকার (০ পয়েন্ট)

X ধ্বংস টাওয়ারের নীচে চ্যাপ্টার- ১ ১ ছুটছিল আহমদ মুসা পূর্বমুখী প্রশস্ত করিডোর ধরে। তার পেছনে বুমেদীন বিল্লাহ। দুজনের হাতেই দুটি ডেডলি কারবাইন। উদ্যত অবস্থায়। ভালো করে লক্ষ্য করলে দেখা যেত দুটো কারবাইনের নল দিয়েই ধুঁয়া বেরুচ্ছে। তাদের পেছনে করিডোরের এক চৌমাথা। চৌমাথার উপর পড়ে আছে ছয় সাতটি লাশ। ওরা ছুটে এসেছিল উত্তর ও দক্ষিণের করিডোরটার দিক থেকে আহমদ মুসাকে বাধা দেয়ার জন্যে। বন্দীখানার ভেতরে প্রহরীদের সাথে যে সংঘর্ষ হয়, তার গুলীর শব্দ তারা পেয়েছিল। আহমদ মুসার বন্দীখানা থেকে বেরুতে চেয়েছিল নিশব্দেই। কিন্তু তা পারেনি। আবার গেটেও যে গোপন এ্যালার্ম ব্যবস্থা ছিল তা আহমদ মুসারা একবারও ভাবেনি। এ এলার্ম পেয়েই দুপাশ থেকে বাড়তি প্রহরীরা ছুটে এসেছিল গেটের দিকে। এ সবের ফলেই হাইম হাইকেলকে খোঁজার জন্যে আহমদ মুসারা বন্দীখানায় যে কাজটা নি:শব্দে সারতে চেয়েছিল তা আর হয়নি। তাদেরকে বন্দীখানা থেকে ছয়টি লাশ মাড়িয়ে বেরিয়ে আসতে হয়েছিল। সব আট-ঘাট বেঁধে তাদের বন্দী করে রাখলেও তাতে একটা বড় ফসকা গিরা ছিল। তাদেরকে ক্লোরোফরম করেছিল তারা ঠিকই, কিন্তু আহমদ মুসা ও বুমেদীন বিল্লাহ তাদের নিশ্বাস বন্ধ করে রাখায় ক্লোরোফরম তাদের উপর কাজ করেনি। তারা সংজ্ঞা হারাবার ভান করে ওদের বোকা বানাতে পেরেছিল। ওরা আহমদ মুসাদের পিছমোড়া করে বেঁধে মেঝেয় ফেলে রেখে দরজা বন্ধ করে বেরিয়ে যেতেই আহমদ মুসা চোখ খুলেছিল। বুমেদীন বিল্লাহও। গেট আগলাবার ও বন্দীদের উপর নজর রাখার জন্য দুজন প্রহরী রাখা ও তাদের কড়া নির্দেশ দেয়ার বিষয়টাও তারা শুনে নেয়। চোখ খুলেই মেঝের উপর উঠে বসে আহমদ মুসা। পিছমোড়া করে বাঁধা হাতের বাঁধন পরখ করার চেষ্টা করে বলে, ‘বিল্লাহ ওরা বিশেষ ধরনের রাবার রোপ দিয়ে বেঁধেছে। সম্ভবত এটা কোনভাবেই কাটা যাবে না।’ বুমেদীন বিল্লাহও উঠে বসেছিল। বলেছিল, ‘রাবারের বাঁধন খোলাও কঠিন ভাইয়া।’ আহমদ মুসা চোখ বন্ধ করে একটু ভেবেছিল। বলেছিল, ‘তবে বিল্লাহ রাবার দড়িতে যদি ইলাষ্টিসিটি থাকে, তাহলে কিন্তু একটা পথ বের করা যায়। বাঁধনটা যেভাবে হাতকে কামড়ে ধরেছে, তাতে রাবার দড়িতে ইলাষ্টিসিটি আছে বলেই মনে হচ্ছে। তোমারটা কেমন বিল্লাহ?’ ‘ঠিক ভাইয়া, বাঁধনটা হাতে যেন ক্রমশই চেপে বসেছে।’ বলেছিল বুমেদীন বিল্লাহ। খুশি হয় আহমদ মুসা। ঘরে ছিল ঘুট ঘুটে অন্ধকার। আহমদ মুসা বুমেদীন বিল্লাহর দিকে ঘুরে বসে বলেছিল, ‘আমি একটু চেষ্টা করি। দেখি তোমার বাঁধন কি বলে?’ ‘কাজটা খুবই কঠিন ভাইয়া। পিছমোড়া করে বাঁধা হাত খুব একটা শক্তি খাটাতে পারবে না। কিন্তু বাঁধন দারুণ শক্ত বোঝাই যাচ্ছে।’ বলেছিল বুমেদীন বিল্লাহ। ‘তা ঠিক, বাঁধনটা খুবই শক্ত। কিন্তু বাঁধনের একটা সিংগল তারকে তুমি যদি আলগা করতে পার, তাহলে কিন্তু কাজ খুবই সহজ হয়ে যাবে।’ আহমদ মুসা বলেছিল। কথা শেষ করেই আহমদ মুসা বুমেদীন বিল্লাহকে আবার বলে, ‘তোমার হাত এদিকে দাও।’ আহমদ মুসা তার দিকে পেছন ফিরেছিল। আহমদ মুসা হাতের আঙুল দিয়ে বুমেদীন বিল্লাহর হাতের বাঁধন পরীক্ষা করে। অত্যন্ত শক্ত বাঁধন, রাবার ইলাষ্টিক হওয়ার কারণেই বাঁধন আরও কামড়ে ধরেছে হাতকে। আহমদ মুসা অনেক চেষ্টার পর চিমটি দিয়ে ধরে একটা তারকে আলগা করে তাতে আঙুল ঢোকাতে পারল। এ সময় বাইরে থেকে একজনের কণ্ঠ শোনা যায়। বলেছিল সে, ‘শালারা সংজ্ঞা হারায়নি। সাবধান। ঘর খোল। ওদের ঘুমিয়ে রাখতে হবে।’ কথাটা কানে যেতেই আহমদ মুসা বুঝে ফেলে সব। নিশ্চয় এঘরে সাউন্ড মনিটর যন্ত্র আছে, এমনকি টিভি ক্যামেরাও থাকতে পারে। তারা ঐভাবে কথা বলে ভুল করেছে। ব্যাপারটা বুঝার সংগে সংগেই আহমদ মুসা বুমেদীন বিল্লাহর হাতের বাঁধনে ঢুকানো আঙুলটা বড়শির মত বাকা করে হাত দিয়ে জোরে টান দেবার উপায় না খুঁজে পেয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল সামনের দিকে। আছড়ে পড়ে আহমদ মুসা মেঝের উপর। মুখ খুলে যায় বিল্লাহর হাতের বাঁধনের। বুমেদীন বিল্লাহ দ্রুত বাঁধন থেকে মুক্ত হয়ে এগিয়ে যায় আহমদ মুসার দিকে। ‘তাড়াতাড়ি বিল্লাহ। ওরা দরজা খুলছে।’ বুমেদীন বিল্লাহ অন্ধকারে আহমদ মুসার হাত খুঁজে নিয়েছিল। পরীক্ষা করে দেখে হাতে কামড়ে বসে আছে শক্ত বাঁধন। অন্ধকারে হাতের বাঁধন হাতড়ে একটা তার খুঁজে নিয়ে তা বিচ্ছিন্ন করার মত অত সময় তখন নেই। কিন্তু হঠাৎ পেয়ে গেল গিরার মুখটা। গিরার বাইরে দুই তারের বাড়তি অংশে গিয়েই তার হাত পড়েছিল। সংগে সংগেই বিল্লাহ সেই বাড়তি অংশটুকু ডান হাতে ধরে জোরে টান দেয় এবং আলগা হয়ে উঠে আসা তারের ভেতর বাম হাতের চার আঙুল ঢুকিয়ে তারকে টেনে ধরে। সঙ্গে সঙ্গেই ডান হাতের চার আঙুলও বাম হাতেদর আঙুলের সাথে গিয়ে যোগ হয়। তারপর ‘রেডি ভাইয়া’ বলে তীব্র একটা হ্যাচকা টানে ছিড়ে ফেলল রাবারের দড়ি। হাতের বাঁধন খুলে গিয়েছিল আহমদ মুসার। কিন্তু পায়ের বাঁধন তখনও বাকি। খুলে যায় এই সময় দরজা। উজ্জ্বল আলোয় ভরে যায় ঘর। হুড়মুড় করে পাশাপাশি দ্রুত হেঁটে দুজন কারবাইন বাগিয়ে ঘরে ঢোকে। তাদের পেছনে আরও দুজন এসেছিল। তারা কারবাইন বাগিয়ে পূর্ব থেকে পাহারায় থাকা দুজনের সাথে দরজা আগলে দাঁড়ায়। দরজা খোলার আগেই আহমদ মুসা শুয়ে পড়েছিল হাত দুটি পিঠের তলায় নিয়ে, যেন বুঝা যায় তার হাত বাঁধাই আছে। আর পা বাঁধা তা দেখাই যাচ্ছিল। কিন্তু বিমূঢ়ভাবে দাঁড়িয়েছিল বুমেদীন বিল্লাহ। তার হাত-পা খোলা। ঘরে ঢুকেই একজন চিৎকার করে ওঠে, ‘একশালা বাঁধন খুলে ফেলেছে।’ ঘরে ঢুকে দুজনই বুমেদীন বিল্লাহর দিকে এগোয়। তারা যাচ্ছিল আহমদ মুসার পাঁচ ছয় ফুট দূর দিয়ে। আহমদ মুসার দেহটা কাত হয়ে নড়ে ওঠে, যেন সে ওদের ভালো করে দেখতে চাচ্ছে। হঠাৎ আহমদ মুসার দুহাত পিঠের তলা থেকে বেরিয়ে আসে এবং তার দুপা তীরের মত ছুটে গিয়ে আঘাত করে বিল্লাহর দিকে অগ্রসর হওয়া লোক দুজনের হাঁটুর নিচটায়। ওরা আকস্মিক এই আঘাতে চিৎ হয়ে উল্টে পড়ে যায়। ওরা আহমদ মুসার পাশেই পড়েছিল। আর ওদের একজনের কারবাইন ছিটকে এসে আহমদ মুসার উপর পড়ে। আহমদ মুসা লুফে নিয়েছিল কারবাইনটা। চোখের পলকে ব্যারেল ঘুরিয়ে নেয় সে দরজায় দাঁড়ানো চারজনের দিকে। ওরাও কি ঘটছে দেখতে পেয়েছিল। প্রথমটায় একটা বিমূঢ় ভাব তাদের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু আহমদ মুসাকে কারবাইন তাক করতে দেখে তারা সম্বিত ফিরে পায়। তারাও ঘুরাতে যায় তাদের ষ্টেনগানের নল। কিন্তু তখন দেরি হয়ে গিয়েছিল। তাদের ষ্টেনগানের ব্যারেল ঘুরে আসার আগেই আহমদ মুসার গুলীবৃষ্টির শিকার হয় তারা। দেহগুলো ঢলে পড়ে দরজার উপর। ওদিকে মেঝেয় পড়ে যাওয়া দুজনের একজন গড়িয়ে দ্বিতীয় ষ্টেনগানটার দিকে এগুচ্ছিল। অন্যজন এগুচ্ছিল আহমদ মুসার দিকে। বুমেদীন বিল্লাহ ছুটে গিয়ে ষ্টেনগানটা আগেই হাত করে নেয় এবং ষ্টেনগানের ব্যারেল ঘুরিয়েই গুলী করে ওদের দুজনকে। আহমদ মুসাও তার ষ্টেনগানের ব্যারেল ঘুরিয়ে নিয়েছিল। বিল্লাহ গুলী করে ওদের দুজনকে লক্ষ্য করে। ‘ধন্যবাদ বিল্লাহ, ওয়েলডান।’ বলে আহমদ মুসা উঠে বসে এবং পায়ের বাঁধন ছিঁড়ে ফেলে। আহমদ মুসা ও বিল্লাহ দুজনে দুটি রিভলবার এবং আরও দুটি কারবাইন কুড়িয়ে নিয়ে বেরিয়ে এসেছিল ঘর থেকে। ছুটছিল আহমদ মুসারা করিডোর ধরে। এখন তাদের কাছে এখান থেকে বের হওয়াটাই একমত্র লক্ষ্য। আহমদ মুসা সিদ্ধান্ত নিয়েই নিয়েছে, এই পরিস্থিতিতে বিজ্ঞানী হাইম হাইকেলকে খোঁজা যাবে না। বের হবার জন্যে আহমদ মুসারা ‘এক্সিট’ সাইন দেখে সামনে দৌড়াচ্ছে। ছুটতে ছুটতে হঠাৎ এক সময় আহমদ মুসার মনে হলো কেউ আর বাধা দিতে আসছে না কেন! বন্দীখানা থেকে বের হবার পর করিডোরের প্রথম মোড়টাতেই শুধু দুপাশ থেকে আসা প্রহরীদের বাধার সম্মুখীন হয়েছে তারা। তারপর থেকে তারা সামনে এগুচ্ছেই। কিন্তু কোন দিন থেকেই বাধা আসছে না, প্রতিরোধ আসছে না। করিডোরটা একটা ঘরে এসে প্রবেশ করল। হঠাৎ থমকে দাঁড়াল আহমদ মুসা। দ্রুত কণ্ঠে বলে উঠল, ‘বিল্লাহ, আমরা নিশ্চিতই ট্রাপে পড়ে গেছি। এক্সিট আসলে.............।’ আহমদ মুসা কথা শেষ করতে পারলো না। মেঝেটা তাদের পায়ের তলা থেকে সরে গেল। পাকা ফলের মত তারা পতিত হলো। গিয়ে আছড়ে পড়ল একটা শক্ত মেঝেতে। শব্দটা ফাঁপা ধরনের। মেঝে শক্ত হলেও আহমদ মুসাদের তেমন একটা লাগেনি। যে উচ্চতা থেকে পড়েছে তা চৌদ্দ পনের ফুটের বেশি হবে না। শক্ত মেঝেটাতে পড়ার সংগে সংগেই একটা ঝাঁকুনি খেল তারা। তার সাথে উঠল শব্দ। ইঞ্জিন ষ্টার্টের শব্দ। আহমদ মুসা বুঝল এবং চারদিকে তাকিয়েও দেখল তারা একটা গাড়ির মেঝেতে এসে পড়েছে। তারা পড়ার সময় গাড়িতে ছাদ ছিল না। কিন্তু তারা পড়ার সাথে সাথেই দুপাশ ও পেছন থেকে ষ্টিলের দেয়াল উঠে এসে উপরটা ঢেকে দিয়েছে। ‘আমরা একটা গাড়িতে পড়েছি বিল্লাহ। এ গাড়িটাও একটা ফাঁদ।’ আহমদ মুসা বলল। গাড়িটা তখন তীব্র গতিতে চলতে শুরু করেছে। ‘ঠিক ভাইয়া। গাড়িটাও একটা ট্রাপ। আমাদের কোথাও নিয়ে যাচ্ছে।’ ‘আরেক বন্দীখানায় নিশ্চয়।’ গাড়িটার চারদিক পর্যবেক্ষণ করতে করতে বলল আহমদ মুসা। দেখল আহমদ মুসা, তারা যে ফ্লোরের উপর বসে আছে সেটা অল্প দুলছে। পরিষ্কারই বোঝা যাচ্ছে, এটা স্প্রিং-এর উপর রয়েছে। অবাকই হলো আহমদ মুসা। গাড়ি স্প্রিং-এর উপর থাকাটা স্বাভাবিক। কিন্তু ফ্লোর আলাদাভাবে স্প্রিং-এর উপর থাকাটা তার কাছে একেবারেই নতুন। কেন? এর কোন ফাংশন আছে? উপরে যে ঢাকনাটা গাড়ির ছাদে পরিণত হয়েছে, তার দুপাশে দুটি হাতল। মাথার উপর হাত বাড়ালেই মাথার উপরের ঢাকনাটা পাওয়া যায়। ভাবল খোলার এটা একটা ম্যানুয়াল ব্যবস্থা হতে পারে। মেঝের উপর আরেক দফা চোখ বুলাতে গিয়ে আহমদ মুসা আরেকটা জিনিস লক্ষ্য করল। মেঝেটা লম্বালম্বি দুভাবে বিভক্ত। মাঝ বরাবর দুঅংশের জোড়। জোড়টা আলগা মনে হলো আহমদ মুসার কাছে। জোড়টা লম্বালম্বির দুপ্রান্তে অস্পষ্ট হলেও ঘর্ষণের দাগ দেখতে পেল আহমদ মুসা। ভ্রুকুঞ্চিত হলো তার। স্প্রিং-এর কারণে উঁচু-নিচুঁ হবার ফলে এ দাগ হয়নি। আরও বড় ধরনের কোন আঘাতের ফলেই এ দাগ সৃষ্টি হতে পারে। কি সে আঘাত? ভাবছিল আহমদ মুসা। ‘কি দেখছেন ভাইয়া? গুরুত্বপূর্ণ কিছু?’ বুমেদীন বিল্লাহ বলল। ‘বিল্লাহ আমার মনে হচ্ছে, গাড়ির উপরের ঢাকনার মত গাড়ির এ ফ্লোরটাও স্থানান্তরযোগ্য।’ বলল আহমদ মুসা। ‘তার মানে? ঢাকনা যেমন সরে গিয়ে আমাদের গ্রহণ করেছে, তেমনি এ ফ্লোরও কি সরে গিয়ে আমাদের ফেলে দেবে?’ বুমেদীন বিল্লাহ বলল। বিস্ময়-বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে তাকাল আহমদ মুসা বিল্লাহর দিকে। পরক্ষণেই তার চোখে বিস্ময়ের বদলে দেখা দিল এক ঝলক আনন্দ। বলল, ‘তুমি ঠিক বলেছ বিল্লাহ। তোমাকে ধন্যবাদ। আমি তাৎপর্য খুঁজে পাচ্ছিলাম না। সত্যিই তুমি যা বলেছ, তার বাইরে আর কোন অর্থ দেখা যাচ্ছে না।’ একটু থেমেই আহমদ মুসা আবার বলে উঠল, ‘ঢাকনা খোলা ছিল আমাদের গ্রহণ করে নিয়ে আসার জন্যে, তাহলে ফ্লোর খুলবে কি আমাদের নামিয়ে দিয়ে চলে যাবার জনে?’ ‘সেটা কি হবে নতুন বন্দীখানা?’ হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘বিল্লাহ, তুমি সাংবাদিক থেকে একেবারে গোয়েন্দা বনে যাচ্ছ।’ আহমদ মুসা বলল। বুমেদীন বিল্লাহ কিছু বলতে যাচ্ছিল। হঠাৎ গাড়িটা একটা ঝাঁকুনি দিয়ে থেমে গেল। ঝাঁকুনির সাথে সাথেই আহমদ মুসা উঠে দাঁড়িয়েছে। উঠে দাঁড়াবার সাথে সাথেই সে অনুভব করল পায়ের তলার মেঝে নড়ে উঠেছে। সংগে সংগে আহমদ মুসা চিৎকার করে উঠল, ‘বিল্লাহ ফ্লোর নেমে যাচ্ছে। সাবধান গাড়ি ছেড় না।’ বলেই আহমদ মুসা এদিক ওদিক তাকিয়ে ডান হাত বাড়িয়ে গাড়ির ছাদের ডান দিকের হাতলটি ধরে ফেলল। বুমেদীন বিল্লাহ বসেছিল। সাবধান হবার সুযোগ নিতে পারেনি। শেষ মুহূর্তে পড়ে যাবার সময় কোন অবলম্বন না পেয়ে আহমদ মুসার একটি পা দুহাতে জড়িয়ে ধরল। আহমদ মুসা ডান হাত দিয়ে হাতলের উপর ঝুলে পড়েছিল। বিল্লাহ ঝুলে পড়ল আহমদ মুসাকে ধরে। ছোট দুটি স্ক্রুতে আটকানো হাতলের পক্ষে দুজনের ভার বহনের শক্তি ছিল না। আহমদ মুসার হাত অনুভব করল হাতল ঢিলা হয়ে যাচ্ছে। আহমদ মুসা চিৎকার করে বিল্লাহর উদ্দেশ্যে বলল, ‘তাড়াতাড়ি আমার গা বেয়ে উঠে এসে বাঁ দিকের হাতলটি ধর। এ হাতলটি খসে যাচ্ছে। আহমদ মুসাও বাম হাত দিয়ে বাঁ দিকের হাতল ধরার চেষ্টা করছে। কিন্তু পারছে না। বিল্লাহ একবার তাকাল উপর দিকে। তারপর আহমদ মুসাকে ছেড়ে দিল। পড়তে লাগল সে নিচের দিকে। আহমদ মুসা নিচের দিকে তাকিয়ে ‘বিল্লাহ’ বলে চিৎকার করে উঠল। তারপর নিজেও তার হাত ছেড়ে দিল হাতল থেকে। কিন্তু বিল্লাহ পড়ে যাওয়ার পরক্ষণেই গাড়ির ফ্লোর আবার উঠে আসতে শুরু করেছে। উঠে আসা ফ্লোরে আহমদ মুসার দেহ আটকে গেল। আহমদ মুসার মুখ বেদনায় নীল হয়ে উঠেছে। গাড়ির ষ্টিলের ফ্লোরে একটা মুষ্ঠাঘাত করে বলল, ‘ও আল্লাহ, বিল্লাহ একা কোথায় গেল!’ আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াতে যাচ্ছিল কিন্তু গাড়িটা আবার ভীষণ বেগে পেছন দিকে যাত্রা শুরু করল। আহমদ মুসা বুঝল গাড়িটা যেখান থেকে এসেছে সেখানেই ফিরে যাচ্ছে। আরও বুঝল, গাড়িটা নিশ্চয় স্বয়ংক্রিয়ভাবে চলছে। তা না হলে সে পড়ে যায়নি এটা জানার পর গাড়ি এভাবে ফেরত যেত না এবং আবার ফ্লোর নামিয়ে দিয়ে তাকেও ফেলার চেষ্টা করত। উঠে দাঁড়াল আহমদ মুসা। গাড়িকে থামানো কিংবা গাড়ি থেকে বের হয়ে যাওয়া যায় কিনা তার উপায় সন্ধান করতে লাগল। আহমদ মুসা ভাবল, গাড়িটা স্বয়ংক্রিয় হলে অবশ্যই তা কতকগুলো অবস্থা বা সময়-সীমা দ্বারা পরিচালিত হয়। সেগুলো কি? তারা যখন গাড়ির মেঝেতে আছড়ে পড়ে, তখন দুপাশ থেকে ঢাকনা এসে গাড়িকে ঢেকে দেয় এবং গাড়িও ষ্টার্ট নেয়। তাদের আছড়ে পড়া, গাড়ি ঢাকনায় ঢেকে যাওয়া এবং ষ্টার্ট নেয়া কি একে-অপরের সাথে সম্পর্কযুক্ত? আবার গাড়ি তার লক্ষ্যে পৌছে যাওয়ার পর গাড়ির ফ্লোর খুলে যাওয়া, আবার বন্ধ হওয়া এবং গাড়ি ষ্টার্ট নেয়ার বিষয়টা নিশ্চয় নির্ধারিত প্রোগ্রাম ও সময়-সীমার সাথে সম্পর্কিত। আহমদ মুসা গাড়ির ঢাকনার দুটি হাতলের কথা ভাবল। হাতল রাখার মধ্যে নিশ্চয় বড় কোন তাৎপর্য আছে। কিন্তু পরক্ষণেই আবার ভাবল, হাতলের উপর ঝুলেই তো সে একবার বেঁচেছিল। কিন্তু ঢাকনা তো খুলে যায়নি। আবার ভাবল, দুহাতল একসাথে ধরে সে একটা চেষ্টা করতে পারে। চিন্তার সাথে সাথেই আহমদ মুসা দুহাত বাড়িয়ে দুপাশের দুটি হাতল ধরে ঢাকনার উপর চাপ সৃষ্টির জন্যে ঝুলে পড়ল। সংগে সংগেই ঢাকনাটি গুটিয়ে গিয়ে ইঞ্জিন ও ক্যারিয়ারের মাঝখানে ঢুকে গেল। আহমদ মুসা আছড়ে পড়ল ক্যারিয়ারের সামনের প্রাচীরের উপর। তার দুটি হাত ঢাকনার ফাঁকে পড়ে থেঁথলে গেল। কিন্তু সে দেখল গাড়িটা থেমে গেছে। গাড়ি থেমে গেলেও আহমদ মুসা কিছুক্ষণ নড়তে পারলো না আছড়ে পড়ার ধাক্কা এবং বেদনার নি:সাড় হয়ে যাওয়া দুটি হাত নিয়ে। শীঘ্রই আহমদ মুসা শরীরটাকে টেনে নিয়ে উঠে দাঁড়াল। প্রথমেই চোখ পড়ল ড্রাইভিং বক্সের দিকে। যেখানে ড্রাইভিং সিট বা ড্রাইভার কিছুই দেখল না। আহমদ মুসা নিশ্চিত হলো গাড়িটা স্বয়ংক্রিয়ভাবে চলে কম্পিউটারাইজড প্রোগ্রাম অনুসারে। দ্রুত তাকাল দুপাশের দিকে। দেখল একটা সুড়ঙ্গের দক্ষিণ পাশ ঘেঁষে রেল। তার উপরে দাঁড়ানো গাড়িটা। আর উত্তর দিকে দিয়ে মসৃণ একটা পথ, ফুটপাথ বলা যায়, রাস্তাও বলা যায়। দুটো গাড়ি পাশাপাশি চলতে পারে। আহমদ মুসা দিকটা ঠিক করলো অনুমানের উপর। আহমদ মুসার ধারণা সুড়ঙ্গটা ডেট্রোয়েট ডেট্রোয়েট নদীর দিকে চলে গেছে। আর ডেট্রোয়েট নদীটা নগরীর পূর্ব প্রান্ত ঘেঁষে। আহমদ মুসা লাফ দিয়ে গাড়ি থেকে নামল। সে মাটিতে পড়ার আগেই গাড়ি ছুটতে শুরু করেছে। গাড়ির ফোল্ড হওয়া ঢাকনাটাও উঠে এসে ঢেকে দিয়েছে গাড়িটাকে। বুঝল আহমদ মুসা, নামার জন্যে যখন সে ডান পা উপরে তোলে তখন বাম পায়ের একটা বাড়তি চাপ পড়েছিল গাড়ির মেঝের উপর। সেই চাপেই গাড়িটা ষ্টার্ট নিয়ে থাকতে পারে। আর গাড়ি চলার সাথে নিশ্চয় সম্পর্ক আছে ঢাকনা গাড়িটাকে ঢেকে দেয়ার। আহমদ মুসা লাফ দিয়ে নেমেই ছুটল যে দিক থেকে এসেছিল সেই দিকে। বিল্লাহর কি অবস্থা হয়েছে কে জানে! তাকে উদ্ধারই এখন প্রথম কাজ। দশ মিনিট দৌড়াবার পর এক জায়গায় এসে তাকে থমকে দাঁড়াতে হলো। সামনে সুড়ঙ্গ জুড়ে ষ্টিলের দেয়াল। বাম দিকে তাকিয়ে দেখল, গাড়ি চলার রেলটি ষ্টিলের দেয়ালের ভেতরে ঢুকে গেছে। আহমদ মুসা বুঝল, ষ্টিলের দেয়াল খোলা যায়। নিশ্চয় এ জন্যে কোন স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা আছে। আহমদ মুসা একটু এগিয়ে টোকা দিল দেয়ালের গায়ে। একদম নিরেট ষ্টিলের দেয়াল। দেয়ালের গা সহ উপর নিচে অনেক খোঁজাখুঁজি করল দেয়াল সরিয়ে দেয়া বা দেয়ালে দরজা খোলার কোন ক্লু পাওয়া যায় কিনা। কিন্তু কিছু পাওয়া গেল না। ভাবল আহমদ মুসা, হতে পারে রেলের উপর, গাড়ির চাপের সাথে সম্পর্কিত কোন স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা আছে। উদ্বিগ্ন হলো আহমদ মুসা। ভেতরে ঢুকতে না পারলে খুঁজবে কি করে বুমেদীন বিল্লাহকে। সে বিপদে পড়েনি তো! যেখানে সে পড়েছে, সেটা নিশ্চয় আন্ডার গ্রাউন্ড বন্দীখানা। বন্দীখানা হওয়ার অর্থ লোকজন সেখানে আছে। তাদের হাতেই সে এখন পড়েছে। তারা বিল্লাহর উপর চরম কিছু কি করবে? শংকিত হলো আহমদ মুসা। কিন্তু ভাবল আবার, আহমদ মুসাকে না পাওয়া পর্যন্ত বিল্লাহকে তারা কিছু করতে নাও পারে। গাড়ির রেল ট্রাক থেকে উত্তর পাশের রাস্তায় উঠে আসার জন্যে আহমদ মুসা ঘুরে দাঁড়াল। ঠিক এ সময়ই আহমদ মুসা অনুভব করল তার পায়ের তলার মাটি কাঁপছে। কি কারণে মাটি কাঁপছে? জেনারেটর চলা, গাড়ি চলা ইত্যাদি নানা কারণে মাটি কাঁপতে পারে। তাহলে আবার সেই গাড়ি ফেরত আসছে না তো? চিন্তার সাথে সাথেই আহমদ মুসা রাস্তার উপর শুয়ে পড়ে রেল-এর উপর কান পাতল। রেলের উপর গাড়ির চাকার ঘর্ষনের স্পষ্ট শব্দ শুনতে পেল আহমদ মুসা। গাড়ি ফিরে আসছে নিশ্চিত হলো আহমদ মুসা। কিন্তু কেন ফিরে আসছে? ধরা পড়া বন্দীদের কাছে আসছে? সে ধরা পড়েনি এটা নিশ্চয় ওরা জেনে ফেলেছে এবং তাকে খোঁজার জন্যেই ওরা আসছে? যা হোক, এখন তাকে লুকাতে হবে। কিন্তু কোথায়? চারদিকে চোখ বুলাল আহমদ মুসা। লুকানোর মত আশ্রয় কোথাও নেই। অথচ কিছুতেই ওদের চোখে পড়া যাবে না। অবশেষে রেল লাইনটার পাশে মরার মত পড়ে থাকার কথা চিন্তা করল। তাতে সহজে ওদের চোখে পড়লেও আকস্মিক আক্রমণ করার একটা সুযোগ থেকে যাবে। চিন্তার সাথে সাথেই আহমদ মুসা রেল লাইনটার পাশে সটান শুয়ে পড়ল। ছুটে আসছে গাড়ি। কান খাড়া করে চোখ বন্ধ করে নিঃসাড়ে পড়ে আছে আহমদ মুসা। শব্দ শুনে যখন মনে হলো গাড়ি দৃষ্টি সীমার মধ্যে পৌছেছে, তখন আস্তে মাথাটা একটু কাত করে সামনে তাকাল। গাড়ি দেখতে পেল সে। গাড়িটা খোলা নয়, ঢাকা। খুশিতে লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল আহমদ মুসা। গাড়িতে যারা আসছে, তারা তাকে দেখতে পাবে না। বরং সে এখন ভেতরে ঢোকার জন্যে এই গাড়ির সাহায্য নিতে পারে। গাড়ির রেল লাইন থেকে ফুট তিনেক সরে দাঁড়াল আহমদ মুসা। পরিকল্পনা ঠিক করে নিয়েছে সে। গাড়ি এই দেয়ালের কাছে এসে যে থামবে না সেটা সেটা জানে। তারা আসার সময় এখানে গাড়ি থামেনি। বন্দীদের নামিয়ে দেবার জন্যে বন্দীখানার উপরে গিয়েই প্রথম থেমেছিল। গাড়ি এসে গেছে। আহমদ মুসা রেল লাইনটার পাশ বরাবর সামনে এগিয়ে দেয়ালের গা ঘেঁষে দাঁড়াল। গাড়ি তখনও দশ বারো ফুট দূরে। আহমদ মুসার পাশ থেকেই দেয়ালের একটা অংশ নিঃশব্দে উপরে উঠে গেল। যে দরজাটা উন্মুক্ত হলো তা গাড়িটা সহজভাবে ঢোকার জন্য যথেষ্ট। দরজা খোলার সেকেন্ডের মধ্যেই গাড়িটা ঢুকে গেল ভেতরে। দরজার পাশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ছিল আহমদ মুসা। গাড়িটা ঢুকে যাওয়ার পর মুহূর্তেই আহমদ মুসা চোখের পলকে দেয়ালের এপার থেকে ওপারে ঢুকে গেল। ঢুকেই ভেতরের দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়াল। তার সাথে সাথেই বন্ধ হয়ে গেল দরজা। বাহির থেকে ভেতরটা একেবারেই আলাদা। বর্গাকৃতির বিশাল ঘর। মেঝেতে দামী পাথর বিছানো। অবশিষ্ট তিনটি দেয়ালেই দরজা। ঘরের উত্তর দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে পড়েছে গাড়িটা। উত্তর দেয়ালেও একটা দরজা। সবগুলো দরজাই বন্ধ। ঘরে লুকানোর কোন আড়াল নেই। গাড়িটা দাঁড়িয়ে পড়তে দেখেই আহমদ মুসা ছুটে গিয়ে গাড়ির ওপাশের দেয়াল ও গাড়ির চাকার মাঝখানে আশ্রয় নিল। আহমদ মুসা হাঁটু গেড়ে বসে সবে উপর দিকে তাকাল। দেখল, একটা অস্পষ্ট শীষ দেয়ার শব্দ করে গাড়ির উপরের কভার সরে গেল। গাড়ির মেঝেতে বসা একজনের মাথার হ্যাট নজরে পড়ল আহমদ মুসার। তাড়াতাড়ি আহমদ মুসা গাড়ির তলে সরে গেল। ‘জন, চল নেমে পড়ি।’ গাড়ির মেঝে থেকে একজনের কণ্ঠ শোনা গেল। ‘চল, মিখাইল। কিন্তু জ্যাকের তো এতক্ষণে এখানে পৌছার কথা। এদিকটা একবার দেখে আমরা ওদিকে যেতে পারি। হারামজাদাটা লুকালো কোথায়, তাকে তো পেতে হবে!’ বলল জন নামের লোকটি। ‘চিন্তা নেই, ছোটটাকে তো পাওয়া গেছে। তার মুখ থেকেই সব কথা বেরুবে। চল।’ মিখাইল নামের লোকটি বলল। বলে মিখাইল নামের লোকটি নিচে লাফিয়ে পড়ল। ‘হ্যাঁ তা তো দেবেই।’ নিচ থেকে বলল মিখাইল। আহমদ মুসা গাড়ির নিচে মেঝে দিয়ে সাপের মত এগুচ্ছে মিখাইলের দিকে। এগুবার সময় ভাবল, গাড়ির নিচের এই মেঝেটা স্বয়ংক্রিয়ভাবে সরিয়ে দেবার ব্যবস্থা আছে। এদিক দিয়েই কিছুক্ষণ আগে বুমেদীন বিল্লাহ পড়ে গেছে। এ পর্যন্ত ভাবতেই তার বুকটা ধক করে কেঁপে উঠল মিখাইলের কথায়। বুমেদীন বিল্লাহ তাহলে এখন ওদের হাতে! বিল্লাহকে জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্যেই এরা তাহলে এসেছে! এটা চিন্তা করে নতুন করে সে ভাবল, বিল্লাহর কাছে পৌছা পর্যন্ত এদের ফলো করা উচিত হবে। এর আগে সে ভেবেছিল এদের দুজনকে কাবু করে গাড়ির কাছে রেখে দিয়ে সে বিল্লাহর সন্ধানে যাবে। এ সিদ্ধান্ত নিয়েই সে মিখাইলের দিকে এগুচ্ছিল। গাড়ি থেকে লাফ দিয়ে নামল জনও। দুজনে এগুলো পুবের দরজার দিকে। আহমদ মুসার দুচোখ তাদের অনুসরণ করল। ওরা দুজন গিয়ে দরজার সামনে দাঁড়াল। ওদের একজন গিয়ে দরজার বাম পাশের দেয়ালে লম্বালম্বি আয়তাকার একটা প্যানেলের কাছে গিয়ে দাঁড়াল। কালো বোর্ডের উপর সাদা ‘কী’ ডিজিটগুলো জ্বল জ্বল করছে। প্যানেলের সাইজ দেখে আহমদ মুসা ধরে নিল ওটা আলফাবেটিক্যাল প্যানেল হবে। লোকটি তার তর্জনি দিয়ে প্যানেলের ‘কি’ গুলোতে টোকা দিতে লাগল। টোকা শেষ হতেই দরজা খুলে গেল। ওরা দরজা দিয়ে ওপারে ঢুকে গেল। আর সাথে সাথেই বন্ধ হয়ে গেল দরজা। আহমদ মুসা ছুটে গিয়ে যখন দরজার কাছে দাঁড়াল, তার আগেই দরজা বন্ধ হওয়ার ক্লিক শব্দ বাতাসে মিলিয়ে গেছে। আহমদ মুসা দ্রুত গিয়ে প্যানেলের কাছে দাঁড়াল। লোকটির নক করা দেখেই আহমদ মুসা জেনে ফেলেছে যে, সে কিবোর্ডে ‘DAVID’ টাইপ করেছে। অর্থাৎ ‘DAVID’ দরজার খোলার ‘পাস ওয়ার্ড’। আহমদ মুসা দ্রুত ‘DAVID’ টাইপ করল কি বোর্ডে। সঙ্গে সঙ্গে দরজা খুলে গেল। আহমদ মুসা উঁকি দিল দরজা দিয়ে। দেখল, ওরা ডান দিকে করিডোর ধরে এগুচ্ছে। দুদিকে চকিতে একবার চেয়েই আহমদ মুসা বুঝল, করিডোরটি এ ঘরকে তিন দিক থেকে বেষ্টন করে আছে। করিডোরের ওপাশ দিয়ে ঘরের সারি। আহমদ মুসা কাঁধ থেকে কারবাইনটা হাতে নিয়ে বিড়ালের মত ওদের পেছনে ছুটল। ওরা দুজন প্রথমে পশ্চিম দিকে বাঁক নিয়ে কিছুটা এগিয়ে উত্তরমূখী আরেকটা করিডোর ধরে এগিয়ে চলল। ওদের পিছে পিছে এগুচ্ছে আহমদ মুসা। একটা ছোট করিডোরের বাঁকে বসে পড়ল আহমদ মুসা। বাঁক ঘোরার অপেক্ষা করছে সে। অকস্মাৎ বিনামেঘে বজ্রপাতের মত গলার দুপাশ দিয়ে দুটো হাত এসে তাকে চেপে ধরল। সবটুকু মনোযোগ সামনে দিতে গিয়ে পেছনের ব্যাপারে সাবধান হয়নি আহমদ মুসা। এখন কি ঘটতে যাচ্ছে বুঝতে পারল সে। বুঝল, এই অবস্থায় সামনে-পিছনে দুদিক সামলানো তার পক্ষে সম্ভব হবে না। আক্রান্ত হয়েও আহমদ মুসা তাই আক্রমণকারীকে প্রতিরোধ না করে তার কারবাইন তুলে গুলী বৃষ্টি করল সামনের দুজনকে লক্ষ্য করে। আক্রমণকারীর দুটি হাত তখন আহমদ মুসার গলায় চেপে বসেছে। কারবাইনটা তখনও আহমদ মুসার হাতে। কিন্তু আক্রমণকারীকে তার কারবাইনের নলের আওতায় আনার অবস্থা তখন আহমদ মুসার নেই। গলা থেকে মাথা পর্যন্ত অংশ প্রায় অকেজো হয়ে পড়ছে। শ্বাস নালীর উপর চাপ পড়ায় শরীরের সক্রিয়তাও কমে যাচ্ছে। বুক, চোখ ও মাথার উপর চাপ কষ্টকর হয়ে উঠছে। বাঁচার জন্যে কিছু করার সময় ফুরিয়ে যাচ্ছে। শেষ সময়টুকুর সদ্ব্যবহার করতে চাইল আহমদ মুসা। সে সবটুকু দম একত্রিত করে দুহাতে আক্রমণকারীর জ্যাকেটের কলার জাপ্টে ধরে পা থেকে কোমর পর্যন্ত ঠিক খাড়া রেখে কোমর বাঁকিয়ে মাথা নিচে ছুড়ে দিয়ে ধনুকের মত বাঁকিয়ে নিয়ে এল। আহমদ মুসার এ কাজটা ছিল তীব্র গতির এবং আকস্মিক। লোকটার পেছনটা আহমদ মুসার উপর দিয়ে ঘুরে এসে মাটিতে পড়ল। লোকটির দুহাত আহমদ মুসার গলা থেকে আলগা হলো বটে, কিন্তু পরক্ষণেই আবার সে আহমদ মুসার গলা জড়িয়ে ধরল। ততক্ষণে আহমদ মুসার বুক ভরে নিঃশ্বাস নেয়া হয়ে গেছে। লোকটি আধা শোয়া অবস্থায় তার দুহাত আহমদ মুসার ঘাড়ে লক করে আহমদ মুসাকে মাটিতে ফেলার চেষ্টা করতে লাগল। আহমদ মুসা উবু অবস্থায় ছিল। সে দুপা প্রসারিত করে লোকটির ঘাড়ে লাগিয়ে একদিকে সে লোকটির দেহ পেছন দিকে পুশ করল, অন্যদিকে নিজের কাঁধ নিজের পেছন দিকে সজোরে ঠেলে দিল। লোকটির দুহাত খসে গেল আহমদ মুসার কাঁধ থেকে। হাত থেকে পড়ে যাওয়া কারবাইনটা পাশেই পড়ে ছিল। আহমদ মুসা দ্রুত তা কুড়িয়ে নিল এবং কারবাইনের নল ঘুরিয়ে নিল লোকটির দিকে। লোকটিও তার হাত ছুটে যাবার সাথে সাথে উঠে দাঁড়াচ্ছিল। আহমদ মুসাকে কারবাইন হাতে নিতে দেখে সেও পকেট থেকে বের করে নিয়েছিল রিভলবার। তার রিভলবার ধরা হাত উঠে আসছিল। কিন্তু গুলী করার সময় সে পেল না। তার আগেই আহমদ মুসার কারবাইনের গুলীতে তার বুক ঝাঁঝরা হয়ে গেল। গুলী করেই আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল এবং কারবাইনটা বাগিয়ে ধরে ছুটল জন-মিখাইলরা যে দিকে যাচ্ছিল সেদিকে। জন ও মিখাইলের লাশ ডিঙাবার সময় দেখল তাদের কেউই বেঁচে নেই। ওদের লাশ ডিঙাবার পরই করিডোরের একটি বাঁকে গিয়ে পৌছল। তার সামনে মানে উত্তরে এগোবার পথ বন্ধ। সে পূর্ব-পশ্চিম লম্বা সরল রেখার মত একটা করিডোরের মুখোমুখি। কোনদিকে যাবে? বুমেদীন বিল্লাহকে কোথায় তারা রেখেছে? ঠিক এই সময়ে আহমদ মুসার নজরে পড়ল করিডোরের পশ্চিম দিক থেকে পাঁচ ছয়জন ছুটে আসছে করিডোর ধরে। ওদের প্রত্যেকের হাতেই কারবাইন। আহমদ মুসা এক ধাপ পেছনে হটে দেয়ালের আড়ালে দাঁড়াল। ওদের পায়ের শব্দের দিকে উৎকর্ণ হয়ে থাকল কিছুক্ষণ। ধীরে ধীরে ওদের পায়ের শব্দ নিকটতর হচ্ছে, ক্রমেই বাড়ছে ওদের পায়ের শব্দ। একেবারে কাছে এসে গেছে ওরা। হঠাৎ ওদের পায়ের শব্দ থেমে গেল। ভ্রুকুঞ্চিত হলো আহমদ মুসার। ওরা দাঁড়াল কেন? ব্যাপার কি দেখার জন্যে অতি সন্তর্পণে মুখটা সামনে এগিয়ে উঁকি দিল। উঁকি দেবার সাথে সাথেই এক ঝাঁক গুলী ছুটে এল তার দিকে। মাথা সরিয়ে নিয়েছে আহমদ মুসা। এক ঝাঁক গুলী তার মাথার কয়েক ইঞ্চি সামনে দিয়ে ছুটে গেল। মাথা সরিয়ে নিতে মুহূর্ত দেরি হলে তার মাথা ছাতু হয়ে যেত। উঁকি দিয়ে প্রথম দৃষ্টিতেই আহমদ মুসা দেখতে পেয়েছে ওরা দাঁড়িয়ে নেই, শিকারী বাঘের মত এক ধাপ এক ধাপ করে নিঃশব্দে তার দিকে এগুচ্ছে। এর অর্থ ওরাও আহমদ মুসাকে দেখতে পেয়েছে, এ বিষয়টা পরিষ্কার হয়ে গেল আহমদ মুসার কাছে। তার মানে যুদ্ধ সামনে। আহমদ মুসা কারবাইনের ট্রিগারে হাত রেখে দেয়ালে পাজর ঠেস দিয়ে কৌশল নিয়ে ভাবছে। এ সময় ওদিক থেকে গুলী শুরু হয়ে গেল। গুলী আসছে অবিরাম ধারায়। গুলীর এক অংশ দেয়ালের কোনায় এসে বিদ্ধ হচ্ছে। বেশীর ভাগই দেয়ালের পাশ দিয়ে গিয়ে করিডোরের বিপরীত দিকের দেয়ালকে বিদ্ধ করছে। এভাবে অনর্থক পাগলের মত গুলী বর্ষণ করে চলার অর্থ কি? নিজেকেই এ প্রশ্ন করল আহমদ মুসা। পরক্ষণেই উত্তর তার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল। আসলে ওদের মতলব হলো, আহমদ মুসা যাতে আক্রমণের সুযোগই না পায় এজন্যেই ওদের অব্যাহত আক্রমণ। তাদের এখনকার অনর্থক আক্রমণই এক সময় অর্থপূর্ণ হয়ে উঠবে। এখন যে গুলী কৌণিকভাবে আসছে, তা সমান্তরালে আসতে শুরু করলেই আহমদ মুসা গুলী বৃষ্টির মুখে অনাবৃত হয়ে পড়বে। এই সুযোগ আহমদ মুসা তাদের দিতে পারে না। কিন্তু কোন পথে এগুবে সে। এই আক্রমণের মধ্যেও তাকে পাল্টা আক্রমণের জন্যে একটা ফাঁক বের করতে হবে। আহমদ মুসা লক্ষ্য করে দেখল ছুটে আসা গুলীর ¯্রােত সীমাবদ্ধ আছে এক ফুট থেকে চার ফুট উচ্চতার মধ্যে। নিচের এক ফুট মাত্র তার জন্যে নিরাপদ জোন। এটাই তার পাল্টা আক্রমণের জন্য সুড়ঙ্গ পথ। আহমদ মুসা শুয়ে পড়ে সাপের মত এগুতে লাগল সামনে। করিডোরটির মুখে দেয়ালের শেষ প্রান্তে গিয়ে থামল আহমদ মুসা। ভাবল, সুযোগের এই সুড়ঙ্গটা মাত্র একবারই ব্যবহার করা যাবে। ওদেরকে বন্দুকের আওতায় আনার দরজা করে দেবে মাত্র একবারের জন্যে। সুতরাং তার প্রথম আক্রমণটা হবে শেষ আক্রমণ। আহমদ মুসা তার কারবাইনের লোডটা পরীক্ষা করে নিল। তারপর কারবাইনের ব্যারেল ঘুরিয়ে ট্রিগারে হাত রাখল। প্রস্তুত হয়ে মুখটা দেয়ালের বাইরে বাড়িয়ে দিতে যাবে এই সময় একটা কঠোর নির্দেশ শুনতে পেল পেছন দিক থেকে ‘তোমার খেলা সাঙ্গ শয়তানের বাচ্চা। আগে-পিছনে সবদিক থেকে ঘেরাও। অস্ত্র রেখে উঠে দাঁড়াও, দুহাত উপরে তোল, না হলে কারবাইনের ম্যাগাজিনের সবগুলো গুলী তোমার মাথায় ঢুকিয়ে দেব।’


এডিট ডিলিট প্রিন্ট করুন  অভিযোগ করুন     

গল্পটি পড়েছেন ৩৩৬ জন


এ জাতীয় গল্প

→ ধ্বংস টাওয়ারের নীচে চ্যাপ্টার- ১ বাকি অংশ
→ ধ্বংস টাওয়ারের নীচে চ্যাপ্টার- ২
→ ধ্বংস টাওয়ারের নীচে চ্যাপ্টার- ২ বাকি অংশ
→ ধ্বংস টাওয়ারের নীচে চ্যাপ্টার- ৩
→ ধ্বংস টাওয়ারের নীচে চ্যাপ্টার- ৩ বাকি অংশ
→ ধ্বংস টাওয়ারের নীচে চ্যাপ্টার- ৪
→ ধ্বংস টাওয়ারের নীচে চ্যাপ্টার- ৪ বাকি অংশ
→ ধ্বংস টাওয়ারের নীচে চ্যাপ্টার- ৫
→ ধ্বংস টাওয়ারের নীচে চ্যাপ্টার- ৬
→ ধ্বংস টাওয়ারের নীচে চ্যাপ্টার- ৬ বাকি অংশ
→ ধ্বংস টাওয়ারের নীচে চ্যাপ্টার- ৭
→ ধ্বংস টাওয়ারের নীচে চ্যাপ্টার- ৭ বাকি অংশ

গল্পটির রেটিং দিনঃ-

গল্পটির বিষয়ে মন্তব্য করুন

  • গল্পটির বিষয়ে মন্তব্য করতে আপনার একাউন্টে প্রবেশ করুন ... ধন্যবাদ... Login Now