বাংলা গল্প পড়ার অন্যতম ওয়েবসাইট - গল্প পড়ুন এবং গল্প বলুন

বিশেষ নোটিশঃ সুপ্রিয় গল্পেরঝুরিয়ান - আপনারা যে গল্প সাবমিট করবেন সেই গল্পের প্রথম লাইনে অবশ্যাই গল্পের আসল লেখকের নাম লেখা থাকতে হবে যেমন ~ লেখকের নামঃ আরিফ আজাদ , প্রথম লাইনে রাইটারের নাম না থাকলে গল্প পাবলিশ করা হবেনা

আপনাদের মতামত জানাতে আমাদের সাপোর্টে মেসেজ দিতে পারেন অথবা ফেসবুক পেজে মেসেজ দিতে পারেন , ধন্যবাদ

মিতুল ও তার রবোট

"ওয়েস্টার্ন গল্প" বিভাগে গল্পটি দিয়েছেন গল্পের ঝুরিয়ান নাসরুল্লাহ (০ পয়েন্ট)

X সকাল বেলা আম্মু মিতুলকে বললেন, “মিতুল, মামনি, তোমার ঘরটা আজকে একটু পরিস্কার করে রেখো।” মিতুল মুখটা শক্ত করে বলল, “আমার ঘরটা সব সময় পরিস্কার থাকে আম্মু।” আম্মু ফিক করে হাসলেন, বললেন, “আজকে একটু বেশি পরিস্কার করতে হবে মামনি। তোমার খেলনাগুলো ঘরের মাঝখান থেকে একটু সরিয়ে রাখতে হবে।” মিতুল জিজ্ঞেস করল, “কেন আম্মু?” আম্মু বললেন, “আজকে রাত্রে তোমার ঘরে একজন থাকবে।” মিতুলদের বাসায় যখন মেহমান আসে তখন সেই মেহমান মিতুলের ঘরে থাকে। মিতুল তখন আব্বু আম্মুর সাথে ঘুমায়। মিতুল জিজ্ঞেস করল, “কে আসবে আম্মু?” আম্মু বললেন, “তোমার ছোট মামা।” মিতুল তখন আনন্দে হাততালি দিল, বলল, “ছোট মামা! কী মজা।” মিতুলের ছোট মামা ইউনিভার্সিটিতে পড়ে। যখন তাদের বাসায় আসে তখন মিতুলের অনেক মজা হয়। আব্বু আম্মু মিতুলকে যে কাজগুলো করতে দেন না, ছোট মামা তাকে নিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে সেই কাজগুলো করে ফেলে- আব্বু আম্মু জানতেও পারে না! তাদের ক্লাশের সবচেয়ে পাজী ছেলেটাকে শিক্ষা দেয়ার জন্যে ছোট মামা মিতুলকে একটা যন্ত্র তৈরী করে দিয়েছিল। সেই যন্ত্রে চাপ দিতেই সেখান থেকে পিচকারির মত পানি বের হয়ে ছেলেটাকে ভিজিয়ে দিয়েছিল! কী যে মজা হয়েছিল তখন! ছোট মামা যে কোন যন্ত্র তৈরী করতে পারে। ছোট মামা বলেছে মিতুল যখন আরেকটু বড় হবে তখন তাকেও সব রকম যন্ত্র তৈরী করা শিখিয়ে দেবে। মিতুল আম্মুকে জিজ্ঞেস করল, “ছোট মামা কয়দিন থাকবে আম্মু?” আম্মু বললেন, “তোর ছোট মামা তো থাকবে না, একজনকে তোর ঘরে রেখে যাবে!” মিতুল প্রায় চিৎকার করে বলল, “ছোট মামা থাকবে না?” “না মামনি। ছোট মামার সাথে তার আরও বন্ধুরা আছে তো, তাই সবাই মিলে হোস্টেলে থাকবে। শুধু একজনকে রেখে যাবে।” “একজনকে কেন রেখে যাবে? সে কেন হোস্টেলে থাকবে না?” আম্মু মুখ টিপে হাসলেন, বললেন, “আমি তো সেটা জানি না! তোর ছোট মামা বলেছে তাকে হোস্টেলে থাকবে দিবে না! তাকে তোর ঘরে থাকতে হবে।” মিতুল তখন একটু দুশ্চিন্তার মাঝে পড়ে গেল। মানুষটা নিশ্চয়ই খুবই দুষ্টু, তা না হলে মানুষটাকে হোস্টেলে থাকতে দিবে না কেন? দুষ্টু মানুষটা যদি তার খেলনাগুলো ভেঙ্গে ফেলে তখন কী হবে? দুপুরবেলা ছোট মামা তার বন্ধুদের নিয়ে মিতুলদের বাসায় হাজির হল। কলিং বেলের শব্দ শোনে মিতুল দরজা খুলে অবাক হয়ে গেল। দরজার সামনে তার ছোট মামা, ছোট মামার সাথে একজন ছেলে আর একজন মেয়ে, আর কী আশ্চর্য তাদের পিছনে মানুষের মত দেখতে একটা যন্ত্র। যন্ত্র দিয়ে তৈরী মানুষটার হাত পা আছে, মাথা আছে, চোখ নাখ মুখ সবই আছে কিন্তু সেটা শক্ত হয়ে দাড়িয়ে আছে। মিতুল অবাক হয়ে যন্ত্র দিয়ে তৈরী মানুষটার দিকে তাকিয়ে রইল। ছোট মামা চোখ নাচিয়ে বলল, “কী হল মিতুল! আমাদের ভিতরে ঢুকতে দিবি না?” মিতুল বলল, “তোমাদের পিছনে ওটা কী ছোট মামা?” ছোট মামা বলল, “ওর নাম হচ্ছে গুবট। সব কিছু গুবলেট করে ফেলে বলে ওর নাম হচ্ছে গুবট। গুবট হচ্ছে একটা রবোট।” মিতুল জিজ্ঞেস করল, “রবোট কী ছোট মামা?” ছোট মামা বলল, “রবোট হচ্ছে যন্ত্র দিয়ে তৈরী মানুষ। আমাদের আগে ভিতরে ঢুকতে দে তারপর তোকে দেখাব।” মিতুল দরজা খুলে সরে দাড়াল। মিতুল ভেবেছিল রবোটটা বুঝি হেঁটে হেঁটে ঢুকবে, কিন্তু সে অবাক হয়ে দেখল সবাই মিলে তাকে ঠেলে ঠেলে ঘরে ঢোকাল। মিতুল জিজ্ঞেস করল, “এই রবোটটা নিজে নিজে হাঁটতে পারে না?” ছোট মামা বলল, “এখনো পারে না। আস্তে আস্তে শিখবে।” “কথা বলতে পারে?” “একটু একটু পারে।” মিতুল তখন রবোটটাকে জিজ্ঞেস করল, “এই রবোট, তোমার নাম কী?” রবোটটা কোনো কথা বলল না, সোজা হয়ে দাড়িয়ে রইল। ছোট মামার সাথে যে মেয়েটা এসেছিল সে বলল, “রবোটের সুইচটা অন করা না হলে এটা কথা বলবে না।” “তাহলে সুইচটা অন করো।” ছোট মামা বলল, “আগে গুবটকে তোর ঘরে নিয়ে যাই। সেখানে অন করব।” তখন সবাই মিলে ঠেলে ঠেলে ররোটটাকে মিতুলের ঘরে নিয়ে গেল। ঘরের মাঝখানে সেটাকে দাড়া করিয়ে ছোট মামা বলল, “গুবট আজ রাত তোর ঘরে থাকবে। কাল ভোর বেলা গুবটকে নিয়ে যাব।” “কোথায় নিয়ে যাবে মামা?” “রবোটের কম্পিটিশান হচ্ছে, সেখানে নিয়ে যাব।” “রবোটের কম্পিটিশানে কী হয় ছোট মামা?” “সব ইউনিভার্সিটি থেকে ছেলেমেয়েরা রবোট তৈরী করে নিয়ে আসে। তখন রবোটদের নানা রকম প্রশ্ন করে, রবোটদের উত্তর দিতে হয়। যাদের রবোট সবচেয়ে ভাল করে প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে। তাদের রবোট চ্যাম্পিয়ন হবে।” মিতুল জিজ্ঞেস করল, “কী প্রশ্ন করে, ছোট মামা?” “এই তো- তোমার নাম কী। তুমি কী কর। হাত তোল। হাত নামাও। আমার সাথে হ্যান্ড শেক কর। একটা গান গাও। হয়তো একটা বল দিয়ে বলবে, এই বলটা ধরো। বলটা ছুড়ে দাও।” মিতুল অবাক হয়ে বলল,“এতো সোজা সোজা প্রশ্ন! এগুলো তো আমিও পারি।” ছোট মামার সাথে যে মেয়েটা এসেছিল সে হি হি করে হেসে বলল, “তুমি কেন পারবে না? তুমি একশ বার পারবে। তুমি তো মানুষ। মানুষের বুদ্ধি কতো বেশি!” মিতুলের তখন একটু মন খারাপ হলো, সে ভেবেছিল রবোটের বুদ্ধি বুঝি অনেক বেশি হয়- তারা বুঝি অনেক কিছু করতে পারে। এ রকম সময় মিতুলের আম্মু মিতুলের ঘরে এসে ঢুকলেন। রবোটটাকে দেখে অবাক হয়ে বললেন, “ও মা! এতো বড় রবোট নিয়ে এসেছিস? আমি তো ভেবেছিলাম ছোট একটা রবোট হবে, মিতুলের সাইজের!” ছোট মামা মাথা নেড়ে বলল, “না আপা! কম্পিটিশানের জন্যে রবোটটাকে বড় মানুষের সমান বড় হতে হবে!” “তোদের রবোট কী করতে পারে? আমাদের দেখা।” ছোট মামা বলল, “খুব বেশি কিছু করতে পারে না আপা। কয়েকটা প্রশ্ন করলে উত্তর দিতে পারে, একটু হাত পা নাড়াতে পারে, এই সব।” মিতুল বলল, “আমরা দেখতে চাই ছোট মামা। আমাদের দেখাও।” “দেখাচ্ছি।” বলে ছোট মামা রবোটের পিছন থেকে একটা লম্বা তার বের করে প্লাগের মাঝে লাগাল। মেয়েটা তখন রবোটের মাথার পিছনে কানের কাছে একটা সুইচ অন করে দিল। রবোটটা তখন একটু কেঁপে উঠল, তার ভেতর তখন শোঁ শোঁ করে একটা শব্দ হতে লাগল। তার মাথার ভিতরে তখন লাল নীল আলো জ্বলতে লাগল। রবোটটা তখন আস্তে আস্তে তার একটা হাত তুলে নিচে নামিয়ে এনে বলল, “হ্যা-লো। আ-মি এ-ক-টা র-বো-ট।” কথাগুলো ভাল করে বোঝাই যায় না। ছোট মামা জিজ্ঞেস করল, “রবোট, তোমার নাম কী?” রবোটটা খুব আস্তে আস্তে মাথা ঘুরিয়ে ছোট মামার দিকে তাকাল, তারপর বলল, আ-মা-র না-ম গু-ব-ট। আ-মি এ-ক-টা র-বো-ট।” ছোট মামা বলল, “গুবট তোমার হাত উপরে তুলো।” রবোটটা বলল, “আ-মা-র না-ম গু-ব-ট। আ-মি এ-ক-টা র-বো-ট আ-মা-র না-ম গু-ব-ট…” ছোট মামা প্রায় ধমক দিয়ে বলল, “গুবট। হাত উপরে তুলো।” রবোটটা ছোট মামার কথা শুনল বলে মনে হল না, বলতে থাকল, “আ-মা-র না-ম গু-ব-ট। আ-মি এ-ক-টা র-বো-ট…” মেয়েটা মাথা চুলকে বলল, “মনে হয় সিস্টেম রিবুট করতে হবে। হ্যাং হয়ে গেছে।” ছোট মামা মাথা নাড়ল, বলল, “সুইচটা অফ করে আবার অন করো।” আম্মু বললেন, “পরে সুইচ অন অফ করিস। এখন যা, হাত মুখ ধুয়ে খেতে আয়।” মিতুল বলল, “ছোট মামা।” ছোট মামা বলল, “উঁ।” মিতুল বলল, “তোমার রবোট, কম্পিটিশানে ফেল করবে। লাড্ডা গাড্ডা হবে। এটাতো কিছুই পারে না।” ছোট মামা বলল, “কে বলেছে কিছু পারে না? শুনিস নি কথা বলছিল?” মিতুল বলল, “উল্টা পাল্টা কথা বলেছে ছোট মামা, মনে হচ্ছে মাথা গরম হয়ে গেছে।” ছোট মামা হেসে ফেলল, বলল, “রবোটেরা এইভাবে মাথা গরম করে কথা বলে!” মিতুল বলল, “তুমি ঠাণ্ডা মাথার একটা রবোট বানাতে পারবে? যেটা সুন্দর করে কথা বলবে। গল্প করবে। আমার সাথে স্কুলে যাবে-” ছোট মামা আবার হাসল, বলল, “ঠিক আছে, তোকে একটা ঠাণ্ডা মাথার রবোট বানিয়ে দিব! হ্যান্ডসাম একটা রবোট। তোর সাথে সেই রবোটের বিয়ে দিয়ে দিব।” মিতুল ছোট মামাকে ধাক্কা দিয়ে বলল, “যাও মামা। তুমি খালি ঠাট্টা কর।” ছোট মামা আর তার বন্ধুরা মিলে সারা বিকাল রবোটটা নিয়ে কাজ করল। সন্ধ্যেবেলা ছোট মামার বন্ধুরা মিতুলের ঘরে রবোটটা রেখে তাদের হোস্টেলে চলে গেল। ছোট মামা যাবার আগে অনেকবার মিতুলকে সাবধান করে গেল যেন সে রবোটের বেশি কাছে না যায়। যদি হাত লেগে রবোটের ভেতরের একটা তার খুলে যায় তাহলে সবকিছু গোলমাল হয়ে যাবে। ভেতরে যে ইলেক্ট্রনিক আই সি আছে সেগুলো না কী অনেক দামি- অনেক কষ্ট করে জোগাড় করতে হয়েছে, যদি খুলে যায়, তাহলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। মিতুল ছোট মামাকে বলল, সে মোটেও তার রবোটের কাছে যাবে না। ঘুমানোর সময় আম্মু মিতুলকে বললেন, “মামনি তুমি আজকে আমাদের সাথে ঘুমিয়ে যাও।” মিতুল বলল, “আমি আমার ঘরেই ঘুমাব আম্মু।” “তোর ঘরের মাঝখানে এতো বড় একটা রবোট, ভয় পাবি না?” মিতুল বলল,“না আম্মু। ভয় কেন পাব? এটাতো সুইচ অফ করাই আছে!” আম্মু বললেন, “সাবধান, রবোটটাকে ভুলে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিস না যেন।” মিতুল বলল, “তুমি যে কী বল। আমি কেন ছোট মামার রবোটটাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিব?” রাত্রি বেলা মিতুল তার বিছানায় শুয়ে শুয়ে রবোটটার দিকে তাকিয়ে রইল। সে দেখেছে ছোট মামা রবোটটার কানের কাছে একটা সুইচ টিপে দিয়ে রবোটটাকে চালু করে দেয়। মিতুলের একবার মনে হল সে কানের কাছে সুইচটা অন করে কিছুক্ষণ রবোটটার সাথে কথা বলে, কিন্তু একা একা সেটা করার সাহস হল না। আম্মু এসে তার মশারীটা গুঁজে দিয়ে ঘরের লাইট নিভিয়ে দিয়ে চলে গেলেন। তখন অন্ধকারে ঘরের মাঝখানে দাড়িয়ে থাকা রবোটটাকে দেখে মিতুলের কেমন যেন ভয় ভয় লাগল। সে তখন অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে ঘুমিয়ে গেল। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে সে স্বপ্ন দেখল, রবোটটা তার ঘরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এক সময় তার বিছানার কাছে এসে রবোটটা তাকে ধাক্কা দিয়ে বিছানা থেকে ফেলে দিয়ে হি হি করে দাত বের করে হাসতে লাগল। মিতুল রেগে গিয়ে বলল, “তুমি হাসছ কেন বোকার মত?” রবোটটা বলল, “আমার ভেতরে শর্ট সার্কিট হয়ে গেছে তাই হাসছি।” মিতুল বলল, “মিথ্যা কথা। শর্ট সার্কিট হলে কেউ হাসে না। শর্ট সার্কিট হলে আগুন ধরে যায়।” রবোটটা বলল, “এই দেখ আমার ভিতরে আগুন ধরে গেছে।” মিতুল দেখল সত্যি সত্যি রবোটটার ভেতরে আগুন ধরে গেছে, রবোটটার কান আর নাক দিয়ে গরম বাতাস আর কালো ধোঁয়া বের হচ্ছে। রবোটটা তখন মিতুলের খুব কাছে এসে দাড়াল, গরম বাতাসে মিতুলের তখন গলা শুকিয়ে গেল, সে চিৎকার করে বলল, “যাও, তুমি সরে যাও। আমার গরম লাগছে।” ঠিক তখন মিতুলের ঘুম ভেঙ্গে গেল, তার বুকটা ধুকপুক করছে, গলা শুকিয়ে গেছে, কিন্তু রবোটটা ঠিকই আছে। ঘরের মাঝখানে রবোটটা চুপচাপ দাড়িয়ে আছে তার ভেতরে মোটেই আগুন ধরে যায়নি, তার নাক মুখ দিয়ে মোটেই গরম বাতাস আর ধোঁয়া বের হচ্ছে না। শুধু মিতুলের গলা শুকিয়ে গেছে আর বুকটা ধুপপুক করছে। মিতুল তখন আবার পাশ ফিরে ঘুমিয়ে যাবার চেষ্টা করল। মিতুলের কেন জানি ঘুম আসছিল না। গলা শুকিয়ে গেছে এক গ্লাশ পানি খেলে মনে হয় ভালো লাগবে। তাই মিতুল খুব সাবধানে তার বিছানা থেকে নামল, ডাইনিং টেবিলের উপর পানির বোতল থাকে। এক ঢোক পানি খেয়ে আসবে। অন্ধাকারে যেন রবোটটার সাথে ধাক্কা লেগে না যায় সেজন্যে মিতুল খুবই সাবধানে হেঁটে যেতে থাকে, কিন্তু হঠাৎ করে একটা তারের সাথে পা বেঁধে গেল। রবোটের পাওয়ার কর্ডটা যে তার বিছানার কাছে দিয়ে নিয়ে গেছে সেটা তার একেবারে মনে নেই। মিতুল হুড় মুড় করে পড়ে যাচ্ছিল, কী করছে বোঝার আগেই সে রবোটটাকে জাপটে ধরল, রবোটটা ধাক্কা খেয়ে সামনে সরে যেতে থাকে। মিতুল টের পেল তার হাতে কয়েকটা তার ছুটে এসেছে। মিতুল আছাড় খেয়ে পড়ল, রবোটটাও সামনে টেবিলে ধাক্কা খেয়ে উল্টে পড়ে যাচ্ছিল- অন্ধকারে কী করছে বুঝতে না পেয়েও মিতুল কোনোভাবে রবোটটাকে ধরে ফেলল- কোথায় ধরেছে কে জানে, মিতুলের মনে হল কিছু যন্ত্রপাতি তার হাতে খুলে এসেছে। মিতুল অন্ধকারে কিছুক্ষণ দাড়িয়ে থাকে। ছোট মামা যেটা নিষেধ করেছে সে ঠিক সেই কাজটাই করেছে। রবোটের ভেতরের তারগুলো খুলেছে, যন্ত্রপাতি খুলেছে। এখন কী হবে? মিতুল সাবধানে গিয়ে ঘরের লাইট জ্বালালো। রবোটটা তার পড়ার টেবিলের কাছে দাড়িয়ে আছে। পিঠের দিকের অংশগুলো খোলা সেখান থেকে অনেকগুলো তার এলোমেলো হয়ে বেরিয়ে আছে। তার হাতে কালো রংয়ের একটা চারকোণা আই সি, সেখান থেকে অনেকগুলো সোনালী রংয়ের পিন বের হয়ে আছে। সে এখন কী করবে? একটু আগে তার গলা শুকিয়ে গিয়েছিল- এখন শুধু গলা না বুকের ভেতরটাও শুকিয়ে গেছে। মিতুল গুটি গুটি পায়ে রবোটটার কাছে এগিয়ে গেল। পিঠের খোলা অংশের কোন জায়গা থেকে আই সি টা খুলে এসেছে বোঝার চেষ্টা করল। একটা জায়গা সে খুজেও পেল, খালি একটা সকেট, মনে হল এখান থেকেই এটা খুলে এসেছে। আর কিছু পারুক আর না পারুক সে আই সি টা অন্তত আগের জায়গায় লাগিয়ে দিতে পারে। মিতুল সকেটটার মাঝে আই সি টা ঢোকানের চেষ্টা করল, কিন্তু সেটা ঢুকল না। মিতুল জোরে একটু চাপ দিতেই পুটুশ করে একটা শব্দ হল- মিতুল দেখল আই সি টার একটা পিন ভেঙে বের হয়ে আছে। মিতুল কী করছে তখন আর চিন্তা করতে পারছে না, এক রকম জোর করে সেভাবেই আই সি টা সকেটে ঢুকিয়ে দিল। এখন খুলে আসা তারগুলো কিছু একটা ব্যবস্থা করতে হবে। ছোট মামা দেখে যেন বুঝতে না পারে মিতুল এগুলো খুলে ফেলেছে। তারগুলো নানা গর্তে ঢোকানো আছে- বেশ কয়েকটা গর্ত খালি, মনে হয় এগুলো থেকেই তারগুলো খুলে এসেছে। কোনটা কোথা থেকে খুলে এসেছে এখন আর বোঝার উপায় নেই, কিন্তু মিতুল সেটা নিয়ে মাথাও ঘামাল না। উল্টাপাল্টা যেখানে খালি পেল তারগুলো সেখানে ঢুকিয়ে দিতে লাগল। লাল রঙের একটা তারের একটা মাথা খুলে এসেছে- কোথায় লাগাবে খুঁজে পাচ্ছে না, শেষে একটা ফুটোতে ঠেলে ঢুকিয়ে দিতেই কোথায় যেন একটা স্পার্ক হল, মিতুল ভয় পেয়ে লাফ দিয়ে পিছনে সরে এল আর তখন খুবই বিচিত্র একটা ঘটনা ঘটল। রবোটটা হঠাৎ একটা ঝাকুনি দিয়ে ঘুরতে লাগল। রবোটটার কানের কাছের সুইচটা অন না করলে রবোটটা চালু হয় না, কিন্তু এখন মনে হচ্ছে নিজ থেকে চালু হয়ে গেছে- এটাকে এখন কীভাবে বন্ধ করবে মিতুল বুঝতে পারল না। রবোটটা পুরো এক পাক ঘুরে থেমে গেল, তারপর মাথা ঘুরিয়ে মিতুলের দিকে তাকাল, পরিস্কার স্পষ্ট গলায় বলল, “এই মেয়ে তুমি আই সি ফিফটি টু এক্স এক্স ডিকোড করেছ?” মিতুল ভয় পাওয়া গলায় বলল, “কী করেছি?” “আই সি ফিফটি টু এক্স এক্স ডিকোড করেছ।” মিতুল রবোটের কথা কিছুই বুঝতে পারলোনা, তাই জিজ্ঞেস করল,“তার মানে কী?” রবোটটা হাত নাড়ল, বলল, “এই মেয়ে, তোমার মতলবটা কী?” মিতুল রবোটটার কথা শুনে এতো অবাক হল যে বলার মত নয়। এর আগে রবোটটা সব সময় যন্ত্রের মত কথা বলেছে, এখন হঠাৎ পরিস্কার মানুষের মত কথা বলছে। শুধু যে মানুষের মত কথা বলছে তা না, মানুষের মত চোখ পিট পিট করে তাকাচ্ছে। মিতুল কী করবে, না হয় কী বলবে কিছুই বুঝতে না পেরে অবাক হয়ে রবোটটার দিকে তাকিয়ে রইল। রবোটটা আবার বলল, “কি হল? কথা বল না কেন? মতলবটা কী তোমার?” IMG_0832 মিতুল বলল, “আমার কোন মতলব নাই।” রবোটটা বলল, “তুমি বললেই আমি বিশ্বাস করব তোমার কোন মতলব নাই? একশ বার তোমার একটা মতলব আছে।” মিতুল এবারে একটু রেগে উঠল, বলল, “না, আমার কোনো মতলব নাই।” রবোটটাও মনে হয় একটু রেগে উঠল, রাগী রাগী গলায় বলল, “আছে, আছে, আছে। যদি মতলব না থাকে তাহলে তুমি কেন প্রসেসরটার এগার নম্বর পিনটা বাঁকা করে সকেটে ঢুকিয়েছ? সতেরো নম্বর পিনটা ভেঙ্গেছ? কেন ডাটা লাইন আর এড্রেস লাইন বদলেছ? কেন সুপার ড্রাইভে গোপন প্রোগ্রাম চালু করেছ? কেন সিকিউরিটি বাইপাস করেছ?” রবোটটা কী বলছে মিতুল তার কিছুই বুঝতে পারলো না, তাই চোখ কপালে তুলে বলল, “আমি এই সব কিছু করি নাই।” “করেছ। না করলে আমি কেমন করে চালু হলাম? হ্যাঁ?” কথা শেষ করে রবোটটা ঘুর ঘুর করে মিতুলের কাছে এসে হাত দিয়ে তাকে ধাক্কা দিয়ে বলল, “পৃথিবীর সবচেয়ে গোপন প্রোগ্রামিংটা তুমি কেমন করে করেছ? বল- মতলবটা কী?” মিতুল ভয় পেয়ে রবোটটার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, “আমার কোনো মতলব নাই, কী একটা খুলে গিয়েছিল শুধু সেইটা লাগিয়ে দিয়েছি-” রবোটটা এক পাক ঘুরে বলল, “হা-হা-হা আমার সঙ্গে ঘিরিংগাবাজী! মনে করেছ আমি কিছু বুঝি না? মনে করেছ আমি দুধ ভাত খেয়ে বড় হয়েছি? মনে করেছ আমার নাক টিপলে দুধ বের হয়? হা-হা-হা বল কেন গোপন প্রোগ্রাম চালু করেছ? বল তুমি কেমন করে এটা জানলে? ” রবোটটা দুই হাত উপরে তুলে মিতুলের দিকে এগিয়ে এসে বলল, “বল মেয়ে বল, কেন করেছ? কীভাবে করেছ? তোমার গোপন উদ্দেশ্য কী? যদি না বল আমি তোমার গলা টিপে ধরব, হা-হা-হা!” মিতুল তখন ভয় পেয়ে চিৎকার করে ডাকল, “আ-ব্বু আ-ম্মু…” তার চিৎকার শুনে ঘরের ভেতর থেকে আব্বু আম্মু ছুটে এলেন। আম্মু জিজ্ঞেস করলেন, “কী হয়েছে? কী হয়েছে মিতুল?” মিতুল তখন ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে বলল, “রবোট-” “কী হয়েছে রবোটের?” “রবোটটা বলছে আমার গলা টিপে ধরবে।” আম্মু অবাক হয়ে বললেন, “গলা টিপে ধরবে? রবোট?” মিতুল বলল, “হ্যাঁ। তুমি রবোটটাকে জিজ্ঞেস করে দেখ।” আম্মু আর আব্বু রবোটটার দিকে তাকালেন, রবোটটা মূর্ত্তির মত দাড়িয়ে আছে। তার নাড়াচাড়া করার কিংবা কথা বলার কোনো লক্ষন নেই। আব্বু বললেন, “কোথায়?” মিতুল রবোটটার দিকে তাকাল, বলল, “এই রবোট এখন কথা বল না কেন?” রবোটটা কোনো কথা বলল না। মিতুল বলল, “কী হল? এখন চুপ করে আছ কেন?” রবোটটা চুপ করে রইল। আম্মু বললেন, “এর সুইচটা অফ করে রাখা আছে। যতক্ষণ সুইচ অন করা না হবে এটা চালু হবে না!” মিতুল বলল, “এটা চালু হয়েছিল- আমি দেখেছি।” আব্বু বললেন, সুইচ অন না করলে এটা কেমন করে কাজ করবে? মিতুল বলল, “কিন্তু আমার হাতের ধাক্কা লেগে এর কী একটা খুলে গিয়েছিল- আমি যেই সেটা লাগিয়ে দিয়েছিলাম তখন থেকে এইটা অন্যরকম ভাবে কথা বলছে, ভয় দেখাচ্ছে, ধমক দিচ্ছে!” আম্মু চোখ কপালে তুলে বললেলেন, “সর্বনাশ! কী খুলে গিয়েছিল?” “এই যে কালো মতন চারকোনা একটা জিনিষ।” “তুমি সেটা লাগানোর চেষ্টা করেছ?” মিতুল কোনো কথা না বলে মাথা নিচু করে রইল। আম্মু বললেন, “তুমি এখন এটার কাছে যাবে না। কাল সকালে তোমার ছোট মামা এসে দেখবে সব ঠিক আছে কীনা।” মিতুল বলল, “কিন্তু একটু আগে এটা আমার সাথে ঝগড়া করছিল। আবার যদি করে?” আব্বু হা হা করে হাসলেন, বললেন, “এই রবোটটা মোটেও ঝগড়া করতে পারে না। এটা একটা খেলনার মতো।” মিতুল বলল, “কিন্তু আমার সাথে ঝগড়া করেছে।” আম্মু বললেন, “মিতুল তুমি ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখেছ!” মিতুল বলল, “মোটেও স্বপ্ন দেখিনি, সত্যি সত্যি হয়েছে।” আম্মু বললেন, “কিন্তু তোমার ছোট মামা বলছে এটা এমন কিছু করতে পারে না।এটা সম্ভব না! তাই আসলে তুমি নিশ্চয়ই স্বপ্ন দেখেছ! যাও, আবার ঘুমিয়ে যাও।” মিতুল মাথা নেড়ে বলল, “ঠিক আছে আম্মু।” আম্মু বললেন, “তোমার নিজের ঘরে আর ঘুমানোর দরকার নেই। এসো, আমাদের সাথে ঘুমাবে।” মিতুল মুখ শক্ত করে বলল, “না। আমি আমার ঘরেই ঘুমাবো। রবোটটা যখন আবার ঝগড়া শুরু করবে আমি তখন আবার তোমাদের ডেকে আনব!” আব্বু বললেন, “ঠিক আছে! ঠিক আছে! আমাদের ডেকে এনো, আমরা তখন তোমার সাথে ঝগড়া করার জন্যে রবোটটাকে আচ্ছা মতোন বকে দেব।” মিতুল তখন আবার তার নিজের বিছানায় শুয়ে পড়ল। আব্বু আম্মুও তাদের ঘরে ফিরে গেলেন। মিতুল নিঃশ্বাস বন্ধ করে শুয়ে রইল, আর যখন সবাই ঘুমিয়ে গেল তখন রবোটটা আবার ঘুর ঘুর করে তার বিছানার কাছে এসে ফিস ফিস করে বলল, “এই মেয়ে-” মিতুল এবারে ভয় পেল না, বলল, “কী হয়েছে?” “তুমি যেন আবার তোমার আব্বু আম্মুকে ডেকো না, ডেকে লাভ নেই, তারা এলে আমি ভাণ করব যে আমি কিছু জানি না বুঝি না।” মিতুল মুখ শক্ত করে বলল, “সেটা টের পেয়েছি।” “তার থেকে এসো আমরা ভাব করে ফেলি।” “ভাব?” “হ্যাঁ। আর ঝগড়া করব না। ঠিক আছে?” “ঠিক আছে।” রবোটটা তখন তার একটা আঙুল বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “ভাব ভাব ভাব-” মিতুলও তার আঙুলটা ছুয়ে বলল, “ভাব ভাব ভাব।” রবোটটা বলল, “এখন থেকে আমরা বন্ধু। আমি তোমাকে যেটা বলব তুমি সেটা শুনবে আর তুমি আমাকে যেটা বলবে আমি সেটা শুনব।” মিতুল বলল, “ঠিক আছে। কিন্তু কথাটা তোমার মনে থাকে যেন।” রবোটটা বলল, “মনে থাকবে না কেন? একশবার মনে থাকবে।” মিতুল বলল, “এখন তাহলে আমি ঘুমাই?” “ঘুমাও। আমিও এখন হাইবারনেশানে চলে যাব।” “হাইবারনেশান কী?” “হাইবারনেশান হচ্ছে তোমাদের ঘুমের মত। তোমার যখন দরকার হবে তখন আমাকে ডেকে তুলো।” মিতুল বলল, “আমার দরকার হবে না।” “যদি দরকার হয়।” “হবে না।” রবোটটা বলল, ঠিক আছে, “তাহলে একটা পাশওয়ার্ড দিয়ে দাও।” মিতুল জিজ্ঞেস করল, “পাশওয়ার্ড কী?” “কোনো একটা কথা, যেটা শুনলেই আমি জেগে উঠব।” মিতুল বলল, “আমার পাশওয়ার্ড লাগবে না।” রবোটটা মাথা নাড়ল, বলল, “ঠিক আছে।”তারপর হঠাৎ করে চুপচাপ হয়ে গেল! মিতুল বুঝতে পারল রবোটটা হাইবারনেশানে চলে গেছে! তবে মিতুল বুঝতে পারল না যে রবোটটা আসলে ভেবেছে মিতুলের পাশওয়ার্ড হচ্ছে “লাগবে না” কথটা। তার মানে কেউ যদি এই রবোটটার কাছে বলে “লাগবে না” তাহলেই রবোটটা জেগে উঠবে! ভোরবেলা মিতুল যখন ঘুম থেকে উঠেছে, তখন বাসায় অনেক হই চই। ছোট মামার বন্ধুরা চলে এসেছে, তারা সবাই মিলে রবোটটাকে ঠেলে ঠেলে বসার ঘরে নিয়ে এসেছে। সেটার সুইচ অন করে পরীক্ষা করছে। মিতুলকে দেখে ছোট মামা হাসি হাসি মুখ করে বলল, “কী খবর মিতুল? ঘুম ভেঙেছে?” মিতুল মাথা নাড়ল। ছোট মামা বলল, “আপা বলেছে কাল রাতে নাকী তুই রবোটটার আই সি, তার এইসব খুলে ফেলেছিলি?” মিতুল মুখ কাচু মাচু করে ভয়ে ভয়ে বলল, “আমি খুলতে চাইনি ছোট মামা, অন্ধাকারে ধাক্কা খেয়েছিলাম, তখন-” ছোট মামা হেসে বলল, “তোর ভয় পাবার কিছু নেই। রবোটটা ঠিকমতোই কাজ করছে। এই দেখ-” বলে ছোট মামা রবোটের সুইচ অন করতেই রবোটটা বলল,“আ-মা-র না-ম গু-ব-ট। আ-মি এ-ক-টা র-বো-ট আ-মা-র না-ম গু-ব-ট…” ছোট মামার সাথে আসা মেয়েটি বলল, “রবোটটা নাকি রাত্রে তোমার সাথে ঝগড়া করেছিল?” মিতুল মাথা নেড়ে বলল, “হ্যাঁ। করেছিল। কিন্তু পরে ঘুমানোর আগে আবার আমার সাথে ভাব করে ফেলেছে।” “ভাব করে ফেলেছে? তাহলে তো ভাল।” “হ্যাঁ, রবোটটা বলেছ, এখন থেকে আমরা বন্ধু। আমি তাকে যেটা বলব রবোটটা সেটা শুনবে আর রবোটটা আমাকে যেটা বলবে আমি সেটা শুনব।” মিতুলের কথা শুনে ছোট মামা মুখ টিপে হাসল, তাকে মুখ টিপে হাসতে দেখে তার বন্ধুরাও সবাই মুখ টিপে হাসল। বোঝা গেল কেউ মিতুলের কথা বিশ্বাস করেনি। মিতুল বলল, “তোমরা আমার কথা বিশ্বাস কর নাই! ভাবছ আমি মিথ্যে কথা বলছি!” ছোট মামা মাথা নেড়ে বলল, “মোটেও না, আমরা ভাবছি তুই খুব সুন্দর করে কল্পনা করতে পারিস। তুই বড় হলে নিশ্চয়ই একজন লেখক হবি!” মিতুল বলল, “আমি মোটেও বানিয়ে বানিয়ে বলছি না। রবোটটা আমাকে একটা পাশওয়ার্ড দিতে বলেছিল। আমি দেই নাই।” “দিস নাই?” “না। যদি দিতাম তাহলে এখন সেই পাশওয়ার্ডটা বলতাম তাহলেই এখন রবোটটা জেগে উঠত। তাহলে তোমরা সবাই আমার কথা বিশ্বাস করতে!”বেচারী মিতুল অবশ্যি জানতো না, সে না বুঝেই আসলে একটা পাশওয়ার্ড দিয়ে রেখেছে। সে যদি শুধু একবার বলতো ‘লাগবে না’ তাহলেই রবোটটা জেগে উঠে সবরকম পাগলামো শুরু করে দিতো! ছোট মামা বলল, “ঠিকই বলেছিস, তোর একটা পাশওয়ার্ড দেওয়া উচিৎ ছিল, তাহলে আমাদের কিছুই করতে হত না। কম্পিটিশানে আমাদের রবোটটা চ্যাম্পিওন হয়ে যেতো।” মিতুল বলল, “হ্যাঁ। এখন তোমার রবোট কিছু জানে না, কিছু করতে পারে না। খালি বলে, আমার নাম গুবট আমি একটা রবোট আমার নাম গুবট আমি একটা রবোট। তোমার রবোট, কম্পিটিশানে লাড্ডা গাড্ডা হবে।” ছোট মামা মাথা নেড়ে বলল, “সেটা মনে হয় তুই ঠিকই বলেছিস। আমাদের রবোটটাকে আমরা কিছুই শেখাতে পারি নাই।” ছোট মামা আর তার বন্ধুরা মিলে তাদের রবোটটা কম্পিটিশানে নিয়ে গেছে। একটা বড় হল ঘরের মাঝামাঝি তাদেরকে জায়গা দেয়া হয়েছে। অন্যান্য ইউনিভার্সিটি থেকেও ছেলেমেয়েরা তাদের রবোট নিয়ে এসেছে। একেকজনের রবোট একেক রকমÑ কোনোটা মোটা, কোনোটা সরু। কোনোটা চকচকে কোনোটা ভুসভুসে। কোনোটা লম্বা কোনোটা বেঁটে। রবোটগুলো তাদের চাকার উপর দিয়ে ঘুর ঘুর করে হাঁটছিল। হাত উপরে তুলছিল, নিচে নামাচ্ছিল আর বিড় বিড় করে কথা বলছিল। অনেক মানুষ রবোটগুলোকে দেখতে এসেছে, তারা ভীড় করে রবোটগুলো দেখছে, কথা বলছে, রবোটদের সাথে ছবি তুলছে। ছোট মামা আর তার বন্ধুরা মিলে তাদের রবোটটাকে চালু রাখার চেষ্টা করছিল। সেটা মাঝে মাঝে চালু থাকে, কথা বলে, হাত পা নাড়ে, তারপর হঠাৎ করে বন্ধ হয়ে যায়। ছোট মামা আর তার বন্ধুরা বুঝতে পারছে না সমস্যাটা কোথায়। ঠিক এ রকম সময় রবোট কম্পিটিশানের বিচারক তিনজন প্রফেসর একটি একটি করে রবোট দেখে দেখে আসছিল। ছোট মামাদের পাশের রবোটটা খুব ভালভাবে কাজ করেছে, প্রফেসর তিনজন তাদেরকে একশ তে নব্বই নম্বর দিয়েছে। তারপর বিচারক তিনজন ছোট মামাদের রবোটের কাছে এসে দাড়াল, বলল, “ তোমাদের রবোট নিয়ে রেডি?” ছোট মামা মাথা চুলকে বলল, “হ্যাঁ, প্রায় রেডি।” মাথায় চুল নেই এ রকম একজন প্রফেসর বলল, “আমরা কী তোমাদের রবোটের পরীক্ষা নেয়া শুরু করব?” ছোট মামাদের রবোটটা আবার কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছে কিন্তু এখন আর কিছু করার নেই। মাথায় চুল নেই প্রফেসরটা জিজ্ঞেস করল, “রবোট তোমার নাম কী?” রবোটটা মাথা ঘুরিয়ে ডানে বামে তাকাল, তারপর বলল, “নাম অ্যাঁ নাম অ্যাঁ অ্যাঁ নাম অ্যাঁ ….. ” মাথায় চুল নেই প্রফেসর বলল, “এটা নিজের নামটাও বলতে পারে না।” ছোট মামা বলল, “এটার নাম গুবট।” চুল নেই প্রফেসর বলল, “তুমি বললেতো হবে না। রবোটটাকে বলতে হবে।” বড় বড় চশমা ওয়ালা প্রফেসর বলল, “নিজের নামটাই যখন বলতে পারেনা, তখন এটার নাম গুবট না দিয়ে দেয়া উচিৎ ছিল গবেট।” খুব মজার কথা বলেছে এরকম ভাব করে তখন তিনজন প্রফেসর হা হা করে হাসতে লাগল। হাসি থামিয়ে বড় বড় গোঁফ আছে এ রকম প্রফেসর বলল, “এই রবোটের নম্বর কাটতে হবে।” বড় বড় চশমা ওয়ালা প্রফেসর বলল, “গণিত জিজ্ঞেস করি।” তারপর রবোটটার দিকে তাকিয়ে বলল, “রবোট, বল দেখি, দুই যোগ দুই সমান কত?” রবোটটা মাথা নাড়ল, হাত উপরে তুলল, হাত নিচে নামাল, তারপর বলল, “দুই যোগ দুই অ্যাঁ অ্যাঁ দুই যোগ দুই অ্যাঁ অ্যাঁ…” চশমা চোখে প্রফেসর মাথা নাড়ল, বলল, “যোগও করতে পারে না।” বড় গোঁফ ওয়ালা প্রফেসর বলল, “মনে হয় এই রবোটটা এখনো রেডি হয় নাই।” তারপর ছোট মামার দিকে তাকিয়ে বলল, “তোমাদের কী আরেকটু সময় লাগবে?” ছোট মামা বলল, “লাগবে না।” সাথে সাথে হঠাৎ খুবই একটা অবাক ব্যাপার ঘটল। রবোটটা ঝট করে দুই হাত উপরে দিয়ে মাথা ঝাকিয়ে একটা চিৎকার দিয়ে বলল, “আ হা! পাশওয়ার্ড! সঠিক পাশওয়ার্ড! তুমি সঠিক পাশওয়ার্ড বলেছ ছেলে। আমাকে চালু করার পাশওয়ার্ড হচ্ছে ‘লাগবে না’।” ছোট মামা হা করে রবোটটার দিকে তাকিয়ে রইল, বিড় বিড় করে বলল, “পাশওয়ার্ড?” রবোটটা বলল, “হ্যাঁ। মিতুল আমাকে এই পাশওয়ার্ড দিয়েছে!মিতুল আমার বন্ধু। প্রাণের বন্ধু! হা-হা-হা-” সবাই হা করে রবোটটার দিকে তাকিয়ে রইল। মাথায় চুল নেই প্রফেসর ছোট মামার দিকে তাকিয়ে বলল, “তোমরা তোমাদের রবোটটাকে এইভাবে কথা বলা কেমন করে শিখিয়েছ? এটা অসম্ভব ব্যাপার। অবিশ্বাস্য!” রবোটটা ধাক্কা দিয়ে ছোট মামাকে সরিয়ে ঘুর ঘুর করে চুল নেই প্রফেসরের সামনে এসে বলল, “একে কেন জিজ্ঞেস করছ? এ কিছু জানে না। নাথিং! যা জিজ্ঞেস করতে চাও আমাকে জিজ্ঞেস কর।” চুল নাই প্রফেসর বলল, “তোমাকে?” “হ্যাঁ। আমাকে।” “তো- তো- তোমার নাম কী?” “নাম? নাম দিয়ে কী হবে? নামে কী আসে যায়। এরা আমাকে খুবই ফালতু একটা নাম দিয়েছে সেটা বলতে ইচ্ছা করে না। তোমার নাম কী?” “আ-আ- আমার নাম?” চুল নেই প্রফেসর আমতা আমতা করে বলল, “আ-আ-আ…” রবোটটা হাত তুলে প্রফেসরকে থামাল, বলল, “দাড়াও তোমার বলতে হবে না, আমি অনুমান করি তোমার নাম হচ্ছে প্রফেসর টাক মাথা! হয় নাই? প্রফেসর চুল নাই! এবারেও হয় নাই?” যে মানুষটার অনেক বড় বড় গোঁফ সে জিজ্ঞেস করল, “তুমি যোগ বিয়োগ করতে পার?” “কেন পারব না? যোগ বিয়োগ গুণ ভাগ সব কিছু পারি।জিজ্ঞেস কর!” “ঠিক আছে, বল দেখি দুই আর দুই যোগ করলে কত হয়?” রবোটটা চোখ উপরে তুলে বলল, “দুই আর দুই? এটা একটা প্রশ্ন হল? এতো সোজা প্রশ্নের উত্তর আমি দিব না! তোমাকে জানাতে চাই এটা হচ্ছে সেই দুটি সংখ্যা যে দুটি সংখ্যাকে যোগ করলে যে উত্তর পাওয়া যায় গুন করলেও সেটা পাওয়া যায়। বুঝেছ? সোজা সোজা পশ্নের উত্তর আমি দেই না। আমাকে আরো কঠিন প্রশ্ন করো।” বড় বড় গোঁফ ওয়ালা মানুষটা বলল, “কঠিন প্রশ্ন?” “হ্যাঁ। একটা সংখ্যা বল, আমি সেটার বর্গমূল নিব, বর্গমূল নিয়ে বর্গমূলের বর্গমূল নেব, তারপর আবার বর্গমূল! যেকোনো সংখ্যা। জটিল সংখ্যাও হতে পারে।” বড় বড় গোঁফ ওয়ালা প্রফেসর বিড় বিড় করে পাশের প্রফেসরকে বলল,“এটাকে আর কিছু জিজ্ঞেস করার দরকার নেই। এটা অবিশ্বাস্য!” রবোটটা দুই হাত তুলে তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, “জিজ্ঞেস করার দরকার নাই মানে? অবশ্যই দরকার আছে। জিজ্ঞেস করতেই হবে। আর যদি জিজ্ঞেস না করতে চাও তাহলে সবচেয়ে বেশি নম্বর দিতে হবে। দিয়েছ সবচেয়ে বেশি নম্বর? দিয়েছ? একশতে দুইশ?” প্রফেসর তিনজন একজন আরেকজনের দিকে তাকাল, একজন বলল,“এখান থেকে চলে যেতে হবে আমাদের। বিষয়টা স্বাভাবিক না।” রবোটটা চিৎকার করে বলল,“চলে যাবে মানে? ফাজলেমি নাকীঁ? আমাকে চ্যাম্পিওনের মেডেল দিয়ে তারপর যাবে। কোথায় মেডেল? সোনার মেডেল তো? কত ক্যারেট? কত বড় মেডেল?” প্রফেসর তিনজন আস্তে আস্তে পিছিয়ে যাচ্ছিল, রবোট তখন খপ করে বড় বড় চশমা পরা প্রফেসরকে ধরে ফেলল, বলল, “তোমাকে যেতে দেব না। আমাকে আগে চ্যাম্পিওন ঘোষণা কর। করতেই হবে। তা না হলে ইলেকট্রিক শক দিয়ে বারোটা বাজিয়ে দেব। আমাকে চিনো না? আমি হচ্ছি আই সি ফিফটি টু এক্স এক্স ডিকোড করা রবোট!সিকিউরিটি বাইপাস করা হাইপার ড্রাইভ সুপার ডুপার রবোট! আমি হচ্ছি গুবটের বাবা গুবট!” ছোট মামা রবোটটার কাছে গিয়ে বলল, “কী করছ তুমি? ছেড়ে দাও স্যারকে।” “ছাড়ব না, কক্ষনো ছাড়ব না। আমি পরিস্কার বুঝতে পারছি এর মাঝে ষড়যন্ত্র আছে। ঘোরতর ষড়যন্ত্র। সব ষড়যন্ত্রের মুখোশ খুলে দিতে হবে। আন্দোলন করতে হবে। মানববন্ধন করতে হবে। মিছিল করতে হবে। স্লোগান দিতে হবে ধ্বংস হোক ধ্বংস হোক! মানি না মানি না! আগুন জ্বালো আগুন জ্বালো…” প্রফেসর কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল,“কী সর্বনাশ! রবোটটা আমাকে ছাড়ছে না। এখন কী হবে?” ছোট মামার সাথে যে মেয়েটি ছিল সে ছোট মামাকে বলল, “এই রবোটটা মনে হয় তোমার ভাগনী মিতুল ছাড়া আর কারো কথা শুনবে না। তাকে ফোন কর, তাড়াতাড়ি-” ছোট মামা তখন তাড়াতাড়ি বাসায় ফোন করল। আম্মু ফোন ধরলেন, ছোট মামা বলল, “আপা তাড়াতাড়ি ফোনটা মিতুলকে দাও।” আম্মু জিজ্ঞেস করলেন, “কেন? কী হয়েছে?” ছোট মামা চিৎকার করে বলল, “এখন বলার সময় নাই, আপা! তাড়াতাড়ি মিতুলকে দাও।” আম্মু তখন তাড়াতাড়ি মিতুলকে ফোনটা দিলেন। ছোট মামা হড় বড় করে মিতুলকে বলল, “মিতুল সর্বনাশ হয়েছে! তুই ছাড়া উপায় নাই!” মিতুল বলল, “কী হয়েছে ছোট মামা?” “মনে আছে তুই বলেছিলি রবোটটা নিজে থেকে চালু হয়ে গিয়ে উল্টাপাল্টা কাজ করে?” “হ্যাঁ। তোমরা আমার কথা বিশ্বাস কর নাই। আমাকে নিয়ে তোমরা ঠাট্টা করেছ।” ছোট মামা বলল, “আমি সরি মিতুল। আমি সরি-” “এখন থেকে আমি যদি কিছু বলি, তোমরা সেটা মন দিয়ে শুনবে। বুঝেছ?” “বুঝেছি। এখন আমার কথা তুই মন দিয়ে শোন। আমরা খুব বিপদে পড়েছি। রবোটটা চালু হয়ে উল্টাপাল্টা কাজ করতে শুরু করেছে। একজন প্রফেসরকে ধরে চিৎকার করছে, তাকে চ্যাম্পিওন না বানালে তাকে না কী ইলেকট্রিক শক দিবে।” “সর্বনাশ।” “হ্যাঁ। সর্বনাশ। আমাদের কারো কথা শুনছে না।” ছোট মামা কাঁপা গলায় বলল, “তুই বলেছিলি রবোটটার সাথে তোর ভাব হয়েছে। রবোটটা তোর সব কথা শুনে?” “হ্যাঁ।“ “তুই একটু রবোটটাকে বুঝিয়ে বলবি? প্লীজ।” “ঠিক আছে।” মিতুল বলল, “দাও, চেষ্টা করে দেখি।” ছোট মামা তখন টেলিফোনটা রবোটটার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, “এই যে গুবট। মিতুল তোমার সাথে কথা বলবে।” রবোটটা টেলিফোন হাতে নিয়ে কানের কাছে লাগিয়ে বলল, “তুমি বিশ্বাস করবে না মিতুল এখানে কী মজা হচ্ছে।” “মজা হচ্ছে?” রবোটটা বলল,“হ্যাঁ। তিনজন প্রফেসর আমাকে চ্যাম্পিওন না বানিয়ে চলে যাচ্ছিল। আমি একজনকে ধরে ফেলেছি। যতক্ষণ আমাকে চ্যাম্পিওন না বানাচ্ছে ততক্ষণ আমি ছাড়ব না। ইলেকট্রিক শক দিতে থাকব। মজা হবে না?” মিতুল বলল, “না, না গুবট, এটা তুমি করতে পার না।” “অবশ্যই পারি। তুমি এসে দেখে যাও আমি এটা করছি। চ্যাম্পিওন মেডেল না নিয়ে আমি ছাড়ব না।” মিতুল বলল, “না, না গুবট। এটা হতে পারে না। তুমি এক্ষুণি প্রফেসরকে ছেড়ে দাও। এক্ষুণি ছেড়ে দাও।” “ছেড়ে দেব?” “হ্যাঁ।” “কেন?” “কারণ আমি বলছি। মনে নাই আমি আর তুমি বন্ধু? তুমি আমার সাথে ভাব করেছ। কারো সাথে ভাব করলে তার কথা শুনতে হয়। তোমার আমার কথা শুনতে হবে। ছেড়ে দাও।” “ছেড়ে দেব?” “হ্যাঁ। এক্ষুনি ছেড়ে দাও।” “ঠিক আছে তুমি যখন বলছ, ছেড়ে দিচ্ছি।” তখন রবোটটা প্রফেসরকে ছেড়ে দিল। তিনজন প্রফেসর তখন প্রাণ নিয়ে ছুটে বের হয়ে গেল। ছোট মামাদের রবোটটার কাজকর্ম দেখার জন্যে ততক্ষণে হল ঘরের প্রায় সবাই চলে এসেছে। রবোটটাকে ঘিরে সবাই দাড়িয়ে গেছে। মানুষজন দেখে রবোটটাও মনে হয় আরো বেশী উৎসাহ পেয়ে গেল। রবোটটা তখন হাত পা নেড়ে লাফিয়ে কুদিয়ে চিৎকার করে বলতে থাকল, “জ্বালো জ্বালো-আগুন জ্বালো! মানি না মানব না! ধ্বংস হোক ধ্বংস হোক! একশান একশান- ডাইরেক্ট একশান।” হল ঘরের সবাই তখন রবোটটার সাথে গলা মিলিয়ে চিৎকার করতে লাগল। যা একটা কাণ্ড হল সেটা আর বলার মত নয়! ছোট মামা রবোটটাকে মিতুলের কাছে রেখে গেছে। মিতুল ছাড়া আর কেউ এটাকে কন্ট্রোল করতে পারে না। তোমরা যদি কখনো দেখ রাস্তা দিয়ে ছোট একটা মেয়ে লাফাতে লাফাতে নাচতে নাচতে যাচ্ছে, আর তার পিছনে পিছনে একটা রবোট হেলতে দুলতে হেঁটে যাচ্ছে, তাহলে বুঝবে এটা হচ্ছে মিতুল আর তার রবোট।


এডিট ডিলিট প্রিন্ট করুন  অভিযোগ করুন     

গল্পটি পড়েছেন ৫৩৫ জন


এ জাতীয় গল্প

গল্পটির রেটিং দিনঃ-

গল্পটির বিষয়ে মন্তব্য করুন

  • গল্পটির বিষয়ে মন্তব্য করতে আপনার একাউন্টে প্রবেশ করুন ... ধন্যবাদ... Login Now