বিশেষ নোটিশঃ সুপ্রিয় গল্পেরঝুরিয়ান - আপনারা যে গল্প সাবমিট করবেন সেই গল্পের প্রথম লাইনে অবশ্যাই গল্পের আসল লেখকের নাম লেখা থাকতে হবে যেমন ~ লেখকের নামঃ আরিফ আজাদ , প্রথম লাইনে রাইটারের নাম না থাকলে গল্প পাবলিশ করা হবেনা
আপনাদের মতামত জানাতে আমাদের সাপোর্টে মেসেজ দিতে পারেন অথবা ফেসবুক পেজে মেসেজ দিতে পারেন , ধন্যবাদ
X
১
খুব জ্যোৎস্না, তেমনি হাড়কাঁপানো
শীত। পৌষ মাসের শেষ। সদর
কাছারি হইতে লবটুলিয়ার ডিহি
কাছারিতে তদারক করিতে
গিয়াছি। লবটুলিয়ার কাছারিতে
রাত্রে রান্না শেষ হইয়া সকলের
আহারাদি হইতে রাত এগারটা
বাজিয়া যাইত। একদিন খাওয়া শেষ
করিয়া রান্নাঘর হইতে বাহিরে
আসিয়া দেখি, তত রাত্রে আর সেই
কন্কনে হিমবর্ষী আকাশের তলায়
কে একটি মেয়ে ফুটফুটে জ্যোৎস্নায়
কাছারির কম্পাউন্ডের সীমানায়
দাঁড়াইয়া আছে। পাটোয়ারীকে
জিজ্ঞাসা করিলাম-ওখানে কে
দাঁড়িয়ে?
পাটোয়ারী বলিল-ও কুন্তা। আপনার
আসবার কথা শুনে আমায় কাল
বলছিল-ম্যানেজারবাবু আসবেন,
তাঁর পাতের ভাত আমি গিয়ে নিয়ে
আসবো। আমার ছেলেপুলের বড় কষ্ট।
তাই বলেছিলাম-যাস্।
কথা বলিতেছি, এমন সময় কাছারির
টহলদার বলোয়া আমার পাতের
ডালমাখা ভাত, ভাঙ্গা মাছের
টুকরা, পাতের গোড়ায় ফেলা
তরকারি ও ভাত, দুধের বাটির
ভুক্তাবশিষ্ট দুধভাত-সব লইয়া গিয়া
মেয়েটির আনীত একটা পেতলের
কানাউঁচু থালায় ঢালিয়া দিল।
মেয়েটি চলিয়া গেল।
আট-দশ দিন সেবার লবটুলিয়ার
কাছারিতে ছিলাম, প্রতিরাত্রে
দেখিতাম ইঁদারার পাড়ে সেই
মেয়েটি আমার পাতের ভাতের জন্য
সেই গভীর রাত্রে আর সেই ভয়ানক
শীতের মধ্যে বাহিরে শুধু আঁচল
গায়ে দিয়া দাঁড়াইয়া আছে।
প্রতিদিন দেখিতে দেখিতে একদিন
কৌতূহলবশে পাটোয়ারীকে
জিজ্ঞাসা করিলাম-কুন্তা-যে রোজ
ভাত নিয়ে যায়, ও কে, আর এই
জঙ্গলে থাকেই বা কোথায়? দিনে
তো কখনো দেখি নে ওকে?
পাটোয়ারী বলিল-বলছি হুজুর।
ঘরের মধ্যে সন্ধ্যা হইতে কাঠের
গুঁড়ি জ্বালাইয়া গন্গনে আগুন করা
হইয়াছে-তারই ধারে চেয়ার
পাতিয়া অনেকক্ষণ ধরিয়া বসিয়া
কিস্তির আদায়ী হিসাব
মিলাইতেছিলাম। আহারাদি শেষ
করিয়া আসিয়া মনে হইল একদিনের
পক্ষে কাজ যথেষ্টই করিয়াছি।
কাগজপত্র গুটাইয়া পাটোয়ারীর
গল্প শুনিতে প্রস্তুত হইলাম।
-শুনুন হুজুর। বছর দশেক আগে এ
অঞ্চলে দেবী সিং রাজপুতের বড়
রবরবা ছিল। তার ভয়ে যত
গাঙ্গোতা আর চাষী ও চরির প্রজা
জুজু হয়ে থাকত। দেবী সিং-এর
ব্যবসা ছিল খুব চড়া সুদে টাকা ধার
দেওয়া এইসব লোককে-আর তারপর
লাঠিবাজি করে সুদ আসল টাকা
আদায় করা। তার তাঁবে আট-ন’জন
লাঠিয়াল পাইকই ছিল। এখন যেমন
রাসবিহারী সিং রাজপুত এ-
অঞ্চলের মহাজন, তখন ছিল দেবী
সিং।
দেবী সিং জৌনপুর জেলা থেকে
এসে পূর্ণিয়ায় বাস করে। তারপর
টাকা ধার দিয়ে জোর-জবরদস্তি
করে এ দেশের যত ভীতু গাঙ্গোতা
প্রজাদের হাতের মুঠোয় পুরে
ফেললে। এখানে আসবার বছর কয়েক
পরে সে কাশী যায় এবং সেখানে
এক বাইজীর বাড়ি গান শুনতে গিয়ে
তার চৌদ্দ-পনের বছরের মেয়ের
সঙ্গে দেবী সিং-এর খুব ভাব হয়।
তারপর তাকে নিয়ে দেবী সিং
পালিয়ে এখানে আসে। দেবী সিং-
এর বয়স সাতাশ-আটাশ হবে। এখানে
এসে দেবী সিং তাকে বিয়ে করে।
কিন্তু বাইজীর মেয়ে বলে সবাই
যখন জেনে ফেললে, তখন দেবী
সিং-এর নিজের জাতভাই রাজপুতরা
ওর সঙ্গে খাওয়াদাওয়া বন্ধ করে
ওকে একঘরে করলে। পয়সার জোরে
দেবী সিং সে সব গ্রাহ্য করত না।
তারপর বাবুগিরি আর অযথা ব্যয়
করে এবং এই রাসবিহারী সিং-এর
সঙ্গে মকদ্দমা করতে গিয়ে দেবী
সিং সর্বস্বান্ত হয়ে গেল। আজ বছর
চারেক হোলো সে মারা গিয়েছে।
ঐ কুন্তাই দেবী সিং রাজপুতের সেই
বিধবা স্ত্রী। এক সময়ে ও লবটুলিয়া
থেকে কিংখাবের ঝালর-দেওয়া
পালকি চেপে কুশী ও কলবলিয়ার
সঙ্গমে স্নান করতে যেত, বিকানীর
মিছরি খেয়ে জল খেত-আজ ওর ওই
দুর্দশা! আরো মুশকিল এই যে
বাইজীর মেয়ে সবাই জানে বলে ওর
এখানে জাত নেই, তা কি ওর
স্বামীর আত্মীয়-বন্ধু রাজপুতদের
মধ্যে, কি দেশওয়ালী
গাঙ্গোতাদের মধ্যে। ক্ষেত থেকে
গম কাটা হয়ে গেলে যে গমের গুঁড়ো
শীষ পড়ে থাকে, তাই টুকরি করে
ক্ষেতে ক্ষেতে বেড়িয়ে কুড়িয়ে
এনে বছরে দু-এক মাস ও ছোট ছোট
ছেলেমেয়েদের আধপেটা খাইয়ে
রাখে। কিন্তু কখনো হাত পেতে
ভিক্ষে করতে ওকে দেখি নি হুজুর।
আপনি এসেছেন জমিদারের
ম্যানেজার, রাজার সমান, আপনার
এখানে প্রসাদ পেলে ওর তাতে
অপমান নেই।
বলিলাম-ওর মা, সেই বাইজী, ওর
খোঁজ করে নি তারপর কখনো?
পাটোয়ারী বলিল-দেখি নি তো
কখনো হুজুর। কুন্তাও কখনো মায়ের
খোঁজ করে নি। ও-ই দুঃখ-ধান্দা করে
ছেলেপুলেকে খাওয়াচ্ছে। খন ওকে
কি দেখছেন, ওর একসময় যা রূপ ছিল,
এ-অঞ্চলে সে রকম কখনো কেউ দেখে
নি। এখন বয়েসও হয়েছে, আর বিধবা
হওয়ার পরে দুঃখে-কষ্টে সে
চেহারার কিছু নেই। বড় ভালো আর
শান্ত মেয়ে কুন্তা। কিন্তু এদেশে
ওকে কেউ দেখতে পারে না, সবাই
নাক সিঁটকে থাকে, নিচু চোখে
দেখে, বোধ হয় বাইজীর মেয়ে বলে।
বলিলাম-তা বুঝলাম, কিন্তু এই রাত
বারোটার সময় এই ঘন জঙ্গলের মধ্যে
দিয়ে ও একা লবটুলিয়া বস্তিতে
যাবে-সে তো এখান থেকে প্রায়
তিন পোয়া পথ!
-ওর কি ভয় করলে চলে হুজুর? এই
জঙ্গলে হরবখ্ত্ ওকে একলা ফিরতে
হয়। নইলে কে আছে ওর, যে চালাবে?
তখন ছিল পৌষ মাস, পৌষ-কিস্তির
তাগাদা শেষ করিয়াই চলিয়া
আসিলাম। মাঘ মাসের মাঝামাঝি
আর একবার একটা ক্ষুদ্র চরি মহাল
ইজারা দিবার উদ্দেশ্যে লবটুলিয়া
যাওয়ার প্রয়োজন হইয়াছিল।
তখনো শীত কিছুমাত্র কমে নাই,
তার উপরে সারাদিন পশ্চিমা
বাতাস বহিবার ফলে প্রত্যহ সন্ধ্যার
পরে শীত দ্বিগুণ বাড়িতে লাগিল।
কদিন মহালের উত্তর সীমানায়
বেড়াইতে বেড়াইতে কাছারি হইতে
অনেক দূরে গিয়া পড়িয়াছি-
সেদিকটাতে বহুদূর পর্যন্ত শুধু
কুলগাছের জঙ্গল। এইসব জঙ্গল জমা
লইয়া ছাপরা ও মজঃফরপুর জেলার
কালোয়ার-জাতীয় লোকে লাক্ষার
চাষ করিয়া বিস্তর পয়সা উপার্জন
করে। কুলের জঙ্গলের মধ্যে প্রায় পথ
ভুলিবার উপক্রম করিয়াছি, এমন সময়
হঠাৎ একটা নারীকণ্ঠে
আর্তক্রন্দনের শব্দ, বালক-বালিকার
গলার চিৎকার ও কান্না এবং কর্কশ
পুরুষকণ্ঠে গালিগালাজ শুনিতে
পাইলাম। কিছুদূর অগ্রসর হইয়া
দেখি, একটি মেয়েকে লাক্ষার
ইজারাদারের চাকরেরা চুলের মুঠি
ধরিয়া টানিয়া লইয়া আসিতেছে।
মেয়েটির পরনে ছিন্ন মলিন বস্ত্র,
সঙ্গে দু’তিনটি ছোট ছোট
রোরুদ্যমান বালক-বালিকা, দুজন
ছত্রি চাকরের মধ্যে একজনের হাতে
একটা ছোট ঝুড়িতে আধঝুড়ি পাকা
কুল। আমাকে দেখিয়া ছত্রি দুজন
উৎসাহ পাইয়া যাহা বলিল তাহার
অর্থ এই যে, তাহাদের ইজারাকরা
জঙ্গলে এই গাঙ্গোতিন চুরি করিয়া
কুল পাড়িতেছিল বলিয়া তাহাকে
কাছারিতে পাটোয়ারীর
বিচারার্থ ধরিয়া লইয়া যাইতেছে,
হুজুর আসিয়া পড়িয়াছেন, ভালোই
হইয়াছে।
প্রথমেই ধমক দিয়া মেয়েটিকে
তাহাদের হাত হইতে ছাড়াইলাম।
মেয়েটি তখন ভয়ে লজ্জায়
জড়োসড়ো হইয়া একটি কুলঝোপের
আড়ালে গিয়া দাঁড়াইয়াছে।
তাহার দুর্দশা দেখিয়া এত কষ্ট হইল!
ইজারাদারের লোকেরা কি সহজে
ছাড়িতে চায়! তাহাদের বুঝাইলাম-
বাপু, গরিব মেয়েমানুষ যদি ওর
ছেলেপুলেকে খাওয়াইবার জন্য
আধঝুড়ি টক কুল পাড়িয়াই থাকে,
তাহাতে তোমাদের লাক্ষাচাষের
বিশেষ কি ক্ষতিটা হইয়াছে।
উহাকে বাড়ি যাইতে দাও।
একজন বলিল-জানেন না হুজুর, ওর
নাম কুন্তা, এই লবটুলিয়াতে ওর
বাড়ি, ওর অভ্যেস চুরি করে কুল
পাড়া। আরো একবার আর-বছর হাতে
হাতে ধরেছিলাম-ওকে এবার
শিক্ষা না দিয়ে দিলে-
প্রায় চমকিয়া উঠিলাম। কুন্তা!
তাহাকে তো চিনি নাই? তাহার
একটা কারণ, দিনের আলোতে
কুন্তাকে তো দেখি নাই, যাহা
দেখিয়াছি রাত্রে। ইজারাদারের
লোকজনকে তৎক্ষণাৎ শাসাইয়া
কুন্তাকে মুক্ত করিলাম। সে লজ্জায়
মাটির সঙ্গে মিশিয়া
ছেলেপুলেদের লইয়া বাড়ি চলিয়া
গেল। যাইবার সময় কুলের ধামাটি ও
আঁক্শিগাছটা সেখানেই ফেলিয়া
গেল। বোধ হয় ভয়ে ও সঙ্কোচে।
আমি উপস্থিত লোকগুলির মধ্যে
একজনকে সেগুলি কাছারিতে লইয়া
যাইতে বলাতে তাহারা খুব খুশি
হইয়া ভাবিল ধামা ও আঁক্শি
সরকারে নিশ্চয়ই বাজেয়াপ্ত হইবে।
কাছারিতে আসিয়া পাটোয়ারীকে
বলিলাম-তোমাদের দেশের লোক
এত নিষ্ঠুর কেন বনোয়ারীলাল?
বনোয়ারী পাটোয়ারী খুব দুঃখিত
হইল। বনোয়ারী লোকটা ভালো,
এদেশের তুলনায় সত্যিই তার হৃদয়ে
দয়ামায়া আছে। কুন্তার ধামা ও
আক্শি সে তখনই পাইক দিয়া
লবটুলিয়াতে কুন্তার বাড়ি
পাঠাইয়া দিল।
সেই রাত্রি হইতে কুন্তা বোধ হয়
লজ্জায় আর কাছারিতেও ভাত
লইতে আসে নাই।
২
শীত শেষ হইয়া বসন্ত পড়িয়াছে।
আমাদের এ জঙ্গল-মহালের পূর্ব-
দক্ষিণ সীমানা হইতে সাত-আট
ক্রোশ দূরে অর্থাৎ সদর কাছারি
হইতে প্রায় চৌদ্দ-পনের ক্রোশ দূরে
ফাল্গুন মাসে হোলির সময় একটা
প্রসিদ্ধ গ্রাম্য মেলা বসে, এবার
সেখানে যাইব বলিয়া ঠিক
করিয়াছিলাম। বহু লোকের সমাগম
অনেক দিন দেখি নাই, এদেশের
মেলা কি রকম জানিবার একটা
কৌতূহলও ছিল। কিন্তু কাছারির
লোকে পুনঃ পুনঃ নিষেধ করিল, পথ
দুর্গম ও পাহাড়-জঙ্গলে ভর্তি,
উপরন্তু গোটা পথটার প্রায় সর্বত্রই
বাঘের ও বন্যমহিষের ভয়, মাঝে
মাঝে বস্তি আছে বটে, কিন্তু সে
বড় দূরে দূরে, বিপদে পড়িলে
তাহারা বিশেষ কোনো উপকারে
আসিবে না, ইত্যাদি।
জীবনে কখনো এতটুকু সাহসের কাজ
করিবার অবকাশ পাই নাই, এই সময়ে
এইসব জায়গায় যতদিন আছি যাহা
করিয়া লইতে পারি, বাংলা দেশে
ও কলিকাতায় ফিরিয়া গেলে
কোথায় পাইব পাহাড় জঙ্গল,
কোথায় পাইব বাঘ ও বন্যমহিষ?
ভবিষ্যতের দিনে আমার মুখে
গল্পশ্রবণনিরত পৌত্র-পৌত্রীদের
মুখ ও উৎসুক তরুণ দৃষ্টি কল্পনা করিয়া
মুনেশ্বর মাহাতো, পাটোয়ারী ও
নবীন-বাবু মুহুরীর সকল আপত্তি
উড়াইয়া দিয়া মেলার দিন খুব
সকালে ঘোড়া করিয়া রওনা
হইলাম। আমাদের মহালের সীমানা
ছাড়াইতেই ঘণ্টা-দুই লাগিয়া গেল,
কারণ পূর্ব-দক্ষিণ সীমানাতেই
আমাদের মহালের জঙ্গল বেশি, পথ
নাই বলিলেও চলে, ঘোড়া ভিন্ন
অন্য কোনো যানবাহন সে পথে চলা
অসম্ভব, যেখানে সেখানে ছোট-বড়
শিলাখণ্ড ছড়ানো, শাল-জঙ্গল,
দীর্ঘ কাশ ও বনঝাউ-এর বন, সমস্ত
পথটা উঁচু-নিচু, মাঝে মাঝে উঁচু
বালিয়াড়ি রাঙা মাটির ডাঙা,
ছোট পাহাড়, পাহাড়ের উপর ঘন
কাঁটাগাছের জঙ্গল। আমি
যদৃচ্ছাক্রমে কখনো দ্রুত, কখনো
ধীরে অশ্বচালনা করিতেছি,
ঘোড়াকে কদম চালে ঠিক চালানো
সম্ভব হইতেছে না-খারাপ রাস্তা ও
ইতস্তত বিক্ষিপ্ত শিলাখণ্ডের দরুন
কিছুদূর অন্তর অন্তর ঘোড়ার চাল
ভাঙ্গিয়া যাইতেছে, কখনো গ্যালপ,
কখনো দুলকি, কখনো বা পায়চারি
করিবার মতো মৃদু গতিতে শুধু
হাঁটিয়া যাইতেছে।
আমি কিন্তু কাছারি ছাড়িয়া
পর্যন্তই আনন্দে মগ্ন হইয়া আছি,
এখানে চাকুরি লইয়া আসার দিনটি
হইতে এদেশের এই ধূ-ধূ মুক্ত প্রান্তর
ও বনভূমি আমাকে ক্রমশ দেশ
ভুলাইয়া দিতেছে, সভ্য জগতের শত
প্রকারের আরামের উপকরণ ও
অভ্যাসকে ভুলাইয়া দিতেছে,
বন্ধুবান্ধব পর্যন্ত ভুলাইবার যোগাড়
করিয়া তুলিয়াছে। যাক্ না ঘোড়া
আস্তে বা জোরে, শৈলসানুতে
যতক্ষণ প্রথম বসন্তে প্রস্ফুটিত
রাঙা পলাশ ফুলের মেলা বসিয়াছে,
পাহাড়ের নিচে, উপরে মাঠের
সর্বত্র ঝুপ্সি গাছের ডাল ঝাড় ঝাড়
ধাতুপফুলের ভারে অবনত,
গোলগোলি ফুলের নিষ্পত্র দুগ্ধশুভ্র
কাণ্ডে হলুদ রঙের বড় বড় সূর্যমুখী
ফুলের মতো ফুল মধ্যাহ্নের রৌদ্রকে
মৃদু সুগন্ধে অলস করিয়া তুলিয়াছে-
তখন কতটা পথ চলিল, কে রাখে
তাহার হিসাব?
কিন্তু হিসাব খানিকটা যে
রাখিতেই হইবে, নতুবা দিগ্ভ্রান্ত ও
পথভ্রান্ত হইবার সম্পূর্ণ সম্ভাবনা,
আমাদের জঙ্গলের সীমানা
অতিক্রম করিবার পূর্বেই এ সত্যটি
ভালো করিয়া বুঝিলাম। কিছুদূর
তখন অন্যমনস্কভাবে গিয়াছি, হঠাৎ
দেখি সম্মুখে বহুদূরে একটা খুব বড়
অরণ্যানীর ধূম্রনীল শীর্ষদেশ
রেখাকারে দিগ্বলয়ের সে-অংশে
এ-প্রান্ত হইতে ও-প্রান্ত পর্যন্ত
বিস্তৃত। কোথা হইতে আসিল এত বড়
বন এখানে? কাছারিতে কেহ তো
একথা বলে নাই যে, মৈষণ্ডির
মেলার কাছাকাছি কোথাও অমন
বিশাল অরণ্য বর্তমান? পরক্ষণেই
ঠাহর করিয়া বুঝিলাম, পথ
হারাইয়াছি, সম্মুখের বনরেখা
মোহনপুরা রিজার্ভ ফরেস্ট না হইয়া
যায় না-যাহা আমাদের কাছারি
হইতে খাড়া উত্তর-পূর্ব কোণে
অবস্থিত। এসব দিকে চলতি বাঁধাপথ
বলিয়া কোনো জিনিস নাই,
লোকজনও কেহ বড়-একটা হাঁটে না।
তাহার উপর চারিদিকে দেখিতে
ঠিক একই রকম, সেই এক ধরনের ডাঙা,
এক ধরনের গোলগোলি ও ধাতুপফুলের
বন, সঙ্গে সঙ্গে আছে চড়া রৌদ্রের
কম্পমান তাপ-তরঙ্গ। দিক্ ভুল হইতে
বেশিক্ষণ লাগে না আনাড়ি
লোকের পক্ষে।
ঘোড়ার মুখ আবার ফিরাইলাম।
হুঁশিয়ার হইয়া গন্তব্যস্থানের
অবস্থান নির্ণয় করিয়া একটা
দিক্চিহ্ন দূর হইতে আন্দাজ করিয়া
বাছিয়া লইলাম। অকূল সমুদ্রে
জাহাজ ঠিক পথে চালনা, অনন্ত
আকাশে এরোপ্লেনের পাইলটের
কাজ করা আর এইসব অজানা
সুবিশাল পথহীন বনপ্রান্তরে
অশ্বচালনা করিয়া তাহাকে
গন্তব্যস্থানে লইয়া যাওয়া প্রায়
একই শ্রেণীর ব্যাপার। অভিজ্ঞতা
যাঁহাদের আছে, তাঁহাদের এ কথার
সত্যতা বুঝিতে বিলম্ব হইবে না।
আবার রৌদ্রদগ্ধ নিষ্পত্র গুল্মরাজি,
আবার বনকুসুমের মৃদুমধুর গন্ধ, আবার
অনাবৃত শিলাস্তূপসদৃশ প্রতীয়মান
গণ্ডশৈলমালা, আবার রক্তপলাশের
শোভা। বেলা বেশ চড়িল; জল
খাইতে পাইলে ভালো হইত, ইহার
মধ্যেই মনে হইল; কারো নদী ছাড়া
এ পথে কোথাও জল নাই, জানি;
এখনো আমাদের জঙ্গলেরই সীমা
কতক্ষণে ছাড়াইব ঠিক নাই, কারো
নদী তো বহুদূর-এ চিন্তার সঙ্গে
তৃষ্ণা যেন হঠাৎ বাড়িয়া উঠিল।
মুকুন্দি চাকলাদারকে বলিয়া
দিয়াছিলাম আমাদের মহালের
সীমানায় সীমানাজ্ঞাপক বাবলা
কাঠের খুঁটি বা মহাবীরের ধ্বজার
অনুরূপ যাহা হয় কিছু পুঁতিয়া রাখে।
এ সীমানায় কখনো আসি নাই,
দেখিয়া বুঝিলাম চাকলাদার সে
আদেশ পালন করে নাই। ভাবিয়াছে,
এই জঙ্গল ঠেলিয়া কলিকাতার
ম্যানেজারবাবু আর সীমানা
পরিদর্শনে আসিয়াছেন, তুমিও
যেমন! কে খাটিয়া মরে? যেমন আছে
তেমনিই থাকুক। পথের কিছুদূরে
আমাদের সীমানা ছাড়াইয়া এক
জায়গায় ধোঁয়া উঠিতেছে দেখিয়া
সেখানে গেলাম। জঙ্গলের মধ্যে
একদল লোক কাঠ পুড়াইয়া কয়লা
করিতেছে-এই কয়লা তাহারা
গ্রামে গ্রামে শীতকালে বেচিবে।
এদেশের শীতে গরিব লোকে
মালসায় কয়লার আগুন করিয়া শীত
নিবারণ করে; কাঠকয়লা চার সের
পয়সায় বিক্রি হয়, তাও কিনিবার
পয়সা অনেকের জোটে না, আর এত
পরিশ্রম করিয়া কাঠকয়লা পুড়াইয়া
পয়সায় চার সের দরে বেচিয়া
কয়লাওয়ালাদের মজুরিই বা
কিভাবে পোষায়, তাও বুঝি না।
এদেশে পয়সা জিনিসটা বাংলা
দেশের মতো সস্তা নয়, এখানে
আসিয়া পর্যন্ত তা দেখিতেছি।
শুকনো কাশ ও সাবাই ঘাসের ছোট্ট
একটা ছাউনি কেঁদ ও আমলকীর বনে,
সেখানে বড় একটা মাটির হাঁড়িতে
মকাই সিদ্ধ করিয়া কাঁচা
শালপাতায় সকলে একত্রে খাইতে
বসিয়াছে, আমি যখন গেলাম। লবণ
ছাড়া অন্য কোনো উপকরণই নাই।
নিকটে বড় বড় গর্তের মধ্যে
ডালপালা পুড়িতেছে, একটা ছোকরা
সেখানে বসিয়া কাঁচা শালের
লম্বা ডাল দিয়া আগুনে ডালপালা
উল্টাইয়া দিতেছে।
জিজ্ঞাসা করিলাম- কি ও গর্তের
মধ্যে, কি পুড়ছে?
তাহারা খাওয়া ছাড়িয়া সকলে
একযোগে দাঁড়াইয়া উঠিয়া
ভীতনেত্রে আমার দিকে চাহিয়া
থতমত খাইয়া বলিল-লক্ড়ি কয়লা
হুজুর।
আমার ঘোড়ায় চড়া মূর্তি দেখিয়া
লোকগুলা ভয় পাইয়াছে, বুঝিলাম
আমাকে বনবিভাগের লোক
ভাবিয়াছে। এসব অঞ্চলের বন
গভর্নমেন্টের খাসমহলের অন্তর্ভুক্ত,
বিনা অনুমতিতে বন কাটা কি কয়লা
পোড়ানো বে-আইনী।
তাহাদের আশ্বস্ত করিলাম। আমি
বনবিভাগের কর্মচারী নই, কোনো
ভয় নাই তাদের, যত ইচ্ছা কয়লা
করুক। একটু জল পাওয়া যায় এখানে?
খাওয়া ফেলিয়া একজন ছুটিয়া
গিয়া মাজা ঝকঝকে জামবাটিতে
পরিষ্কার জল আনিয়া দিল।
জিজ্ঞাসা করিয়া জানিলাম,
কাছেই বনের মধ্যে ঝরনা আছে, তার
জল।
ঝরনা?-আমার কৌতূহল হইল। ঝরনা
কোথায়? শুনি নাই তো এখানে
ঝরনা আছে!
উহারা বলিল- ঝরনা নাই হুজুর, উনুই!
পাথরের গর্তে একটু একটু করে জল
জমে, এক ঘণ্টায় আধ সের জল হয়, খুব
সাফা পানি, ঠাণ্ডাও বহুৎ।
জায়গাটা দেখিতে গেলাম। কি
সুন্দর ঠাণ্ডা বনবীথি! পাখিরা
বোধ হয় এই নির্জন অরণ্যে
শিলাতলে শরৎ বসন্তের দিনে, কি
গভীর নিশীথ রাত্রে জলকেলি
করিতে নামে। বনের খুব ঘন অংশে
বড় বড় পিয়াল ও কেঁদের ডালপালা
দিয়া ঘেরা একটা নাবাল জায়গা,
তলাটা কালো পাথরের, একখানা
খুব বড় প্রস্তরবেদী যেন কালে ক্ষয়
পাইয়া ঢেঁকির গড়ের মতো হইয়া
গিয়াছে। যেন খুব একটা বড়
প্রাকৃতিক পাথরের খোরা। তার
উপর সপুষ্প পিয়াল শাখা ঝুপসি
হইয়া পড়িয়া ঘন ছায়ার সৃষ্টি
করিয়াছে। পিয়াল ও শাল মঞ্জরীর
সুগন্ধ বনের ছায়ায় ভুরভুর করিতেছে।
পাথরের খোলে বিন্দু বিন্দু জল
জমিতেছে, এইমাত্র জল তুলিয়া
লইয়া গিয়াছে, এখনো আধ ছটাক
জলও জমে নাই। উহারা বলিল-এ
ঝরনার কথা অনেকে জানে না হুজুর,
আমরা বনে জঙ্গলে হরবখ্ত্ বেড়াই,
আমরা জানি।
আরো মাইলপাঁচেক গিয়া কারো
নদী পড়িল, খুব উঁচু বালির পাড় দু-
ধারে, অনেকটা খাড়া নিচে
নামিয়া গেলে তবে নদীর খাত,
বর্তমানে খুব সামান্যই জল আছে, দু-
পারে অনেক দূর পর্যন্ত বালুকাময়
তীর ধূ-ধূ করিতেছে। যেন পাহাড়
হইতে নামিতেছে মনে হইল; ঘোড়ায়
জল পার হইয়া যাইতে যাইতে এক
জায়গায় ঘোড়ার জিন পর্যন্ত
আসিয়া ঠেকিল, রেকাবদলসুদ্ধ পা
মুড়িয়া অতি সন্তর্পণে পার হইলাম।
ওপারে ফুটন্ত রক্তপলাশের বন, উঁচু-
নিচু রাঙা-রাঙা শিলাখণ্ড, আর
শুধুই পলাশ আর পলাশ, সর্বত্র
পলাশফুলের মেলা। একবার দূরে
একটা বুনো মহিষকে ধাতুপফুলের বন
হইতে বাহির হইতে দেখিলাম-সেটা
পাথরের উপর দাঁড়াইয়া পায়ের ক্ষুর
দিয়া মাটি খুঁড়িতে লাগিল।
ঘোড়ার মুখের লাগাম কষিয়া
থমকিয়া দাঁড়াইলাম; ত্রিসীমানায়
কোথাও জনমানব নাই, যদি শিং
পাতিয়া তাড়া করিয়া আসে?
কিন্তু সৌভাগ্যের বিষয়, সেটা
আবার পথের পাশের বনের মধ্যে
ঢুকিয়া অদৃশ্য হইয়া গেল।
নদী ছাড়াইয়া আরো কিছুদূর গিয়া
পথের দৃশ্য কি চমৎকার! তবুও তো
ঠিক-দুপুর ঝাঁ ঝাঁ করিতেছে,
অপরাহ্নের ছায়া নাই, রাত্রির
জ্যোৎস্নালোক নাই-কিন্তু সেই
নিস্তব্ধ খররৌদ্র-মধ্যাহ্নে বাঁ-
দিকে বনাবৃত দীর্ঘ শৈলমালা,
দক্ষিণে লৌহপ্রস্তর ও পাইয়োরাইট
ছড়ানো উঁচু-নিচু জমিতে শুধুই
শুভ্রকাণ্ড গোলগোলি ফুলের গাছ ও
রাঙা ধাতুপফুলের জঙ্গল। সেই
জায়গাটা সত্যিই একেবারে অদ্ভুত;
অমন রুক্ষ অথচ সুন্দর, পুষ্কাকীর্ণ অথচ
উদ্দাম ও অতিমাত্রায় বন্য ভূমিশ্রী
দেখিই নাই কখনো জীবনে। আর
তার উপর ঠিক-দুপুরের খাঁ-খাঁ রৌদ্র।
মাথার উপরের আকাশ কি ঘন নীল!
আকাশে কোথাও একটা পাখি নাই,
শূন্য-মাটিতে বন্য-প্রকৃতির বুকে
কোথাও একটা মানুষ বা জীবজন্তু
নাই-নিঃশব্দ, ভয়ানক নিরালা।
চারিদিকে চাহিয়া প্রকৃতির এই
বিজন রূপলীলার মধ্যে ডুবিয়া
গেলাম-ভারতবর্ষে এমন জায়গা
আছে জানিতাম না তো! এই যেন
ফিল্মে দেখা দক্ষিণ-আমেরিকার
আরিজোনা বা নাভাজো মরুভূমি
কিংবা হড্সনের পুস্তকে বর্ণিত
গিলা নদীর অববাহিকা- অঞ্চল।
মেলায় পৌঁছিতে বেলা একটা
বাজিয়া গেল। প্রকাণ্ড মেলা, যে
দীর্ঘ শৈলশ্রেণী পথের বাঁ-ধারে
আমার সঙ্গে সঙ্গে ক্রোশ-তিনেক
ধরিয়া চলিয়া আসিতেছিল, তারই
সর্বদক্ষিণ প্রান্তে ছোট্ট একটা
গ্রামের মাঠে, পাহাড়ের ঢালুতে
চারিদিকে শাল-পলাশের বনের
মধ্যে এই মেলা বসিয়াছে।
মহিষারড়ি, কড়ারী, তিনটাঙা,
লছমনিয়াটোলা, ভীমদাসটোলা,
মহালিখারূপ প্রভৃতি দূরের নিকটের
নানা স্থান হইতে লোকজন, প্রধানত
মেয়েরা আসিয়াছে। তরুণী বন্য
মেয়েরা আসিয়াছে চুলে পিয়ালফুল
কি রাঙা ধাতুপফুল গুঁজিয়া; কারো
কারো মাথায় বাঁকা খোঁপায়
কাঠের চিরুনি আটকানো, বেশ
সুঠাম, সুললিত, লাবণ্যভরা দেহের
গঠন প্রায় অনেক মেয়েরই-তারা
আমোদ করিয়া খেলো পুঁতির দানার
মালা, সস্তা জাপানি কি
জার্মানির সাবানের বাক্স, বাঁশি,
আয়না, অতি বাজে এসেন্স
কিনিতেছে, পুরুষেরা এক পয়সায়
দশটা কালী সিগারেট কিনিতেছে,
ছেলেমেয়েরা তিলুয়া, রেউড়ি,
রামদানার লাড্ডু ও তেলেভাজা
খাজা কিনিয়া খাইতেছে। হঠাৎ
মেয়েমানুষের গলায় আর্তকান্নার
স্বর শুনিয়া চমকিয়া উঠিলাম।
একটা উঁচু পাহাড়ি ডাঙায় যুবক-
যুবতীরা ভিড় করিয়া দাঁড়াইয়া
হাসিখুশি গল্পগুজব আদর-আপ্যায়নে
মত্ত ছিল-কান্নাটা উঠিল সেখান
হইতেই। ব্যাপার কি? কেহ কি হঠাৎ
পঞ্চত্বপ্রাপ্ত হইল? একজন লোককে
জিজ্ঞাসা করিয়া জানিলাম, তা
নয়, কোনো একটি বধূর সহিত তার
পিত্রালয়ের গ্রামের কোনো
মেয়ের সাক্ষাৎ হইয়াছে-এদেশের
রীতিই নাকি এইরূপ, গ্রামের মেয়ে
বা কোনো প্রবাসিনী সখী,
কুটুম্বিনী বা আত্মীয়ার সঙ্গে
অনেকদিন পরে দেখা হইলেই উভয়ে
উভয়ের গলা জড়াইয়া মড়াকান্না
জুড়িয়া দিবে। অনভিজ্ঞ লোকে
ভাবিতে পারে উহাদের কেহ
মরিয়া গিয়াছে, আসলে ইহা আদর-
আপ্যায়নের একটা অঙ্গ। না
কাঁদিলে নিন্দা হইবে। মেয়েরা
বাপের বাড়ির মানুষ দেখিয়া কাঁদে
নাই-অর্থাৎ তাহা হইলে প্রমাণ হয়
যে, স্বামীগৃহে বড় সুখেই আছে-
মেয়েমানুষের পক্ষে ইহা নাকি বড়ই
লজ্জার কথা।
এক জায়গায় বইয়ের দোকানে চটের
থলের উপর বই সাজাইয়া বসিয়াছে-
হিন্দি গোলেবকাউলী, লয়লা-মজনু,
বেতাল পঁচিশী, প্রেমসাগর
ইত্যাদি। প্রবীণ লোকে কেহ কেহ
বই উল্টাইয়া-পাল্টাইয়া
দেখিতেছে-বুঝিলাম বুকস্টলে
দণ্ডায়মান পাঠকের অবস্থা
আনাতোঁল ফ্রাঁসের প্যারিসেও
যেমন, এই বন্য দেশে কড়ারী
তিনটাঙার হোলির মেলাতেও
তাহাই। বিনা পয়সায় দাঁড়াইয়া
পড়িয়া লইতে পারিলে কেহ বড়-
একটা বই কেনে না। দোকানীর
ব্যবসাবুদ্ধি কিন্তু বেশ প্রখর, সে
জনৈক তন্ময়চিত্ত পাঠককে
জিজ্ঞাসা করিল- কেতাব কিনবে
কি? না হয় তো রেখে দিয়ে অন্য
কাজ দেখ। মেলার স্থান হইতে
কিছুদূরে একটা শালবনের ছায়ায়
অনেক লোক রাঁধিয়া খাইতেছে-
ইহাদের জন্য মেলার এক অংশে
তরিতরকারির বাজার বসিয়াছে,
কাঁচা শালপাতার ঠোঙায় শুঁটকি
কুচো চিংড়ি ও লাল পিঁপড়ের ডিম
বিক্রয় হইতেছে। লাল পিঁপড়ের ডিম
এখানকার একটি প্রিয় সুখাদ্য। তা
ছাড়া আছে কাঁচা পেঁপে, শুকনো
কুল, কেঁদ-ফুল, পেয়ারা ও বুনো শিম।
হঠাৎ কাহার ডাক কানে গেল-
ম্যানেজারবাবু,-
চাহিয়া দেখি ভিড় ঠেলিয়া
লবটুলিয়ার পাটোয়ারীর ভাই ব্রহ্মা
মাহাতো আগাইয়া আসিতেছে।-
হুজুর, আপনি কখন এলেন? সঙ্গে কে?
বলিলাম-ব্রহ্মা এখানে কি মেলা
দেখতে?
-না হুজুর, আমি মেলার ইজারাদার।
আসুন, আসুন, আমার তাঁবুতে চলুন একটু
পায়ের ধুলো দেবেন।
মেলার একপাশে ইজারাদারের
তাঁবু, সেখানে ব্রহ্মা খুব খাতির
করিয়া আমায় লইয়া গিয়া একখানা
পুরোনো বেণ্ট্উড চেয়ারে বসাইল।
সেখানে একজন লোক দেখিলাম,
অমন লোক বোধ হয় পৃথিবীতে আর
দেখিব না। লোকটি কে জানি না,
ব্রহ্মা, মাহাতোর কোনো কর্মচারী
হইবে। বয়স পঞ্চাশ-ষাট বছর, গা
খালি, রং কালো, মাথার চুল কাঁচা-
পাকায় মেশানো। তাহার হাতে
একটা বড় থলিতে এক থলি পয়সা,
বগলে একখানা খাতা, সম্ভবত
মেলার খাজনা আদায় করিয়া
বেড়াইতেছে, ব্রহ্মা মাহাতোকে
হিসাব বুঝাইয়া দিবে। মুগ্ধ হইলাম
তাহার চোখের দৃষ্টির ও মুখের
অসাধারণ দীন-নম্র ভাব দেখিয়া।
যেন কিছু ভয়ের ভাবও মেশানো
ছিল সে দৃষ্টিতে। ব্রহ্মা মাহাতো
রাজা নয়, ম্যাজিস্ট্রেট নয়,
কাহারো দণ্ডমুণ্ডের কর্তা নয়,
গভর্নমেন্টের খাসমহলের জনৈক
বর্ধিষ্ণু প্রজা মাত্র-লইয়াছেই না
হয় মেলার ইজারা,-এত দীন ভাব
কেন ও লোকটার তার কাছে? তারও
পরে আমি যখন তাঁবুতে গেলাম,
স্বয়ং ব্রহ্মা মাহাতো আমাকে অত
খাতির করিতেছে দেখিয়া লোকটা
আমার দিকে অতিরিক্ত সম্ভ্রম ও
দীনতার দৃষ্টিতে ভয়ে ভয়ে এক-আধ
বারের বেশি চাহিতে ভরসা পাইল
না। ভাবিলাম লোকটার অত
দীনহীন দৃষ্টি কেন? খুব কি গরিব?
লোকটার মুখে কি যেন ছিল,
বারবার আমি চাহিয়া দেখিতে
লাগিলাম, এমনধারা সত্যিকার
দীন-বিনম্র মুখ কখনো দেখি নাই।
ব্রহ্মা মাহাতোকে লোকটার কথা
জিজ্ঞাসা করিয়া জানিলাম তার
বাড়ি কড়ারী তিনটাঙা, যে গ্রামে
ব্রহ্মা মাহাতোর বাড়ি; নাম
গিরিধারীলাল, জাতি গাঙ্গোতা।
উহার এক ছোট ছেলে ছাড়া আর
সংসারে কেহই নাই। অবস্থা যাহা
অনুমান করিয়াছিলাম-অতি গরিব।
সম্প্রতি ব্রহ্মা তাহাকে মেলায়
দোকানের আদায়কারী কর্মচারী
বহাল করিয়াছে-দৈনিক চার আনা
বেতন ও খাইতে দিবে।
গিরিধারীলালের সঙ্গে আমার
আরো দেখা হইয়াছিল, কিন্তু
তাহার সঙ্গে শেষবারের
সাক্ষাতের সময়কার অবস্থা বড় করুণ,
পরে সে-সব কথা বলিব। অনেক
ধরনের মানুষ দেখিয়াছি, কিন্তু
গিরিধারীলালের মতো সাচ্চা
মানুষ কখনো দেখি নাই। কত কাল
হইয়া গেল, কত লোককে ভুলিয়া
গিয়াছি, কিন্তু যাহাদের কথা
চিরকাল মনে আঁকা আছে ও
থাকিবে, সেই অতি অল্প কয়েকজন
লোকের মধ্যে গিরিধারীলাল
একজন।
৩
বেলা পড়িয়া আসিতেছে, এখনই
রওনা হওয়া দরকার, ব্রহ্মা
মাহাতোকে সে কথা বলিয়া বিদায়
চাহিলাম। ব্রহ্মা মাহাতো তো
একেবারে আকাশ হইতে পড়িল,
তাঁবুতে যাহারা উপস্থিত ছিল
তাহারা হাঁ করিয়া আমার মুখের
দিকে চাহিল। অসম্ভব! এই ত্রিশ
মাইল রাস্তা অবেলায় ফেরা! হুজুর
কলিকাতার মানুষ, এ অঞ্চলের পথের
খবর জানা নাই তাই একথা
বলিতেছেন। দশ মাইল যাইতে সূর্য
যাইবে ডুবিয়া, না হয়
জ্যোৎস্নারাত্রিই হইল, ঘন পাহাড়-
জঙ্গলের পথ, মানুষজন কোথাও নাই,
বাঘ বাহির হইতে পারে, বুনো মহিষ
আছে, বিশেষত পাকা কুলের সময়,
এখন ভালুক তো নিশ্চয়ই বাহির
হইবে, কারো নদীর ওপারে
মহালিখারূপের জঙ্গলে এই তো
সেদিনেও এক গোরুর গাড়ির
গাড়োয়ানকে বাঘে লইয়াছে,
বেচারি জঙ্গলের পথে একা
আসিতেছিল। অসম্ভব, হুজুর। রাত্রে
এখানে থাকুন, খাওয়াদাওয়া করুন,
যখন দয়া করিয়া আসিয়াছেন
গরিবের ডেরায়। কাল সকালে তখন
ধীরে-সুস্থে গেলেই হইবে।
এ বাসন্তী পূর্ণিমায় পরিপূর্ণ
জ্যোৎস্নারাত্রে জনহীন পাহাড়-
জঙ্গলের পথ একা ঘোড়ায় চড়িয়া
যাওয়ার প্রলোভন আমার কাছে
দুর্দমনীয় হইয়া উঠিল। জীবনে আর
কখনো হইবে না, এই হয়তো শেষ, আর
যে অপূর্ব বন-পাহাড়ের দৃশ্য দেখিয়া
আসিয়াছি পথে! জ্যোৎস্নারাত্রে-
বিশেষত পূর্ণিমার জ্যোৎস্নায়
তাহাদের রূপ একবার দেখিব না
যদি, তবে এতটা কষ্ট করিয়া
আসিবার কি অর্থ হয়?
সকলের সনির্বন্ধ অনুরোধ এড়াইয়া
রওনা হইলাম। ব্রহ্মা মাহাতো
ঠিকই বলিয়াছিল, কারো নদীতে
পৌঁছিবার কিছু পূর্বেই টক্টকে লাল
সুবৃহৎ সূর্যটা পশ্চিম দিক্চক্রবালে
একটা অনুচ্চ শৈলমালার পিছনে
অস্ত গেল। কারো নদীর তীরের
বালিয়াড়ির উপর যখন ঘোড়াসুদ্ধ
উঠিয়াছি, এইবার এখান হইতে ঢালু
বালির পথে নদীগর্ভে নামিব-হঠাৎ
সেই সূর্যাস্তের দৃশ্য এবং ঠিক পূর্বে
বহু দূরে কৃষ্ণ রেখার মতো
পরিদৃশ্যমান মোহনপুরা রিজার্ভ
ফরেস্টের মাথায় নবোদিত
পূর্ণচন্দ্রের দৃশ্য-যুগপৎ এই অস্ত ও
উদয়ের দৃশ্যে থমকিয়া ঘোড়াকে
লাগাম কষিয়া দাঁড় করাইলাম। সেই
নির্জন অপরিচিত নদীতীরে সমস্তই
যেন একটা অবাস্তব ব্যাপারের
মতো দেখাইতেছে-
পথে সর্বত্র পাহাড়ের ঢালুতে ও
ডাঙায় ছাড়া-ছাড়া জঙ্গল, মাঝে
মাঝে সরু পথটাকে যেন দুই দিক
হইতে চাপিয়া ধরিতেছে, আবার
কোথাও কিছুদূরে সরিয়া যাইতেছে।
কি ভয়ঙ্কর নির্জন চারিদিক,
দিনমানে যা-হয় একরূপ ছিল,
জ্যোৎস্না উঠিবার পর মনে হইতেছে
যেন অজানা ও অদ্ভুত সৌন্দর্যময়
পরীরাজ্যের মধ্য দিয়া চলিয়াছি।
সঙ্গে সঙ্গে বাঘের ভয়ও হইল, মনে
পড়িল মেলায় ব্রহ্মা মাহাতো এবং
কাছারিতে প্রায়-সকলেই রাত্রে
এপথে একা আসিতে বারবার নিষেধ
করিয়াছিল, মনে পড়িল নন্দকিশোর
গোসাঁই নামে আমাদের একজন
বাথানদার প্রজা আজ মাস দুই-তিন
আগে কাছারিতে বসিয়া গল্প
করিয়াছিল এই মহালিখারূপের
জঙ্গলে সেই সময় কাহাকে বাঘে
খাওয়ার ব্যাপার। জঙ্গলের এখানে-
ওখানে বড় বড় কুলগাছে কুল পাকিয়া
ডাল নত হইয়া আছে-তলায় বিস্তর
শুকনো ও পাকা কুল ছড়ানো-সুতরাং
ভালুক বাহির হইবারও সম্ভাবনা
খুবই। বুনো মহিষ এ বনে না
থাকিলেও মোহনপুরা জঙ্গল হইতে
এবেলার মতো এক-আধটা ছিটকাইয়া
আসিতে কতক্ষণ! সম্মুখে এখনো
পনের মাইল নির্জন বনপ্রান্তরের
উপর দিয়া পথ।
ভয়ের অনুভূতি চারিপাশের
সৌন্দর্যকে যেন আরো বাড়াইয়া
তুলিল। এক এক স্থানে পথ দক্ষিণ
হইতে খাড়া উত্তরে ও উত্তর হইতে
পূর্বে ঘুরিয়া গিয়াছে, পথের খুব
কাছে বাম দিকে সর্বত্রই একটানা
অনুচ্চ শৈলমালা, তাদের ঢালুতে
গোলগোলি ও পলাশের জঙ্গল,
উপরের দিকে শাল ও বড় বড় ঘাস।
জ্যোৎস্না এবার ফুটফুট করিতেছে,
গাছের ছায়া হ্রস্বতম হইয়া
উঠিয়াছে, কি একটা বন্যফুলের
সুবাসে জ্যোৎস্নাশুভ্র প্রান্তর
ভরপুর, অনেক দূরে পাহাড়ে
সাঁওতালেরা জুম চাষের জন্য আগুন
দিয়াছে, সে কি অভিনব দৃশ্য, মনে
হইতেছে পাহাড়ে আলোর মালা কে
যেন সাজাইয়া রাখিয়াছে।
কখনো যদি এসব দিকে না আসিতাম,
কেহ বলিলেও বিশ্বাস করিতাম না
যে, বাংলা দেশের এত নিকটেই এরূপ
সম্পূর্ণ জনহীন অরণ্যপ্রান্তর ও
শৈলমালা আছে, যাহা সৌন্দর্যে
আরিজোনার পাথুরে মরুদেশ বা
রোডেসিয়ার বুশভেল্ডের অপেক্ষা
কম নয় কোনো অংশে-বিপদের দিক
দিয়া দেখিতে গেলেও এসব অঞ্চল
নিতান্ত পুতুপুতু বলা চলে না,
সন্ধ্যার পরেই যেখানে বাঘ-
ভালুকের ভয়ে লোকে পথ হাঁটে না।
এই মুক্ত জ্যোৎস্নাশুভ্র বনপ্রান্তরের
মধ্য দিয়া যাইতে যাইতে
ভাবিতেছিলাম, এ এক আলাদা
জীবন, যারা ঘরের দেয়ালের মধ্যে
আবদ্ধ থাকিতে ভালবাসে না,
সংসার করা যাদের রক্তে নাই,
সেইসব বারমুখো, খাপছাড়া
প্রকৃতির মানুষের পক্ষে এমন জীবনই
তো কাম্য। লিকাতা হইতে প্রথম
প্রথম আসিয়া এখানকার এই ভীষণ
নির্জনতা ও সম্পূর্ণ বন্য
জীবনযাত্রা কি অসহ্য হইয়াছিল,
কিন্তু এখন আমার মনে হয় এই ভালো,
এই বর্বর রুক্ষ বন্য প্রকৃতি আমাকে
তার স্বাধীনতা ও মুক্তির মন্ত্রে
দীক্ষিত করিয়াছে, শহরের খাঁচার
মধ্যে আর দাঁড়ে বসিয়া থাকিতে
পারিব কি? এই পথহীন প্রান্তরের
শিলাখণ্ড ও শাল-পলাশের বনের
মধ্য দিয়া এই রকম মুক্ত আকাশতলে
পরিপূর্ণ জ্যোৎস্নায় হু-হু ঘোড়া
ছুটাইয়া চলার আনন্দের সহিত আমি
দুনিয়ার কোনো সম্পদ বিনিময়
করিতে চাই না।
জ্যোৎস্না আরো ফুটিয়াছে,
নক্ষত্রদল জ্যোৎস্নালোকে প্রায়
অদৃশ্য, চারিধারে চাহিয়া মনে হয়
এ সে পৃথিবী নয় এতদিন যাহাকে
জানিতাম, এ স্বপ্নভূমি, এই
দিগন্তব্যাপী জ্যোৎস্নায় অপার্থিব
জীবেরা এখানে নামে গভীর
রাত্রে, তারা তপস্যার বস্তু, কল্পনা
ও স্বপ্নের বস্তু, বনের ফুল যারা
ভালবাসে না, সুন্দরকে চেনে না,
দিগ্বলয়রেখা যাদের কখনো
হাতছানি দিয়া ডাকে নাই, তাদের
কাছে এ পৃথিবী ধরা দেয় না কোনো
কালেই।
মহালিখারূপের জঙ্গল শেষ হইতেই
মাইল চার গিয়া আমাদের সীমানা
শুরু হইল। রাত প্রায় নটার সময়ে
কাছারি পৌঁছিলাম।
৪
কাছারিতে ঢোলের শব্দ শুনিয়া
বাহিরের দিকে চাহিয়া দেখি
একদল লোক কাছারির কম্পাউন্ডে
কোথা হইতে আসিয়া ঢোল
বাজাইতেছে। ঢোলের শব্দে
কাছারির সিপাহী কর্মচারীরা
আসিয়া তাহাদের ঘিরিয়া
দাঁড়াইল। কাহাকেও ডাকিয়া
ব্যাপারটা কি জিজ্ঞাসা করিব
ভাবিতেছি, এমন সময় জমাদার
মুক্তিনাথ সিং দরজার কাছে
আসিয়া সেলাম করিয়া বলিল-
একবার বাইরে আসবেন মেহেরবানি
করে?
-কি জমাদার, কি ব্যাপার?
-হুজুর, দক্ষিণ দেশে এবার ধান মরে
যাওয়াতে অজন্মা হয়েছে, লোকে
চালাতে না পেরে দেশে দেশে
নাচের দল নিয়ে বেরিয়েছে। ওরা
কাছারিতে হুজুরের সামনে নাচবে
বলে এসেছে, যদি হুকুম হয় তবে নাচ
দেখায়।
নাচের দল আমার আপিসঘরের
সামনে আসিয়া দাঁড়াইল।
মুক্তিনাথ সিং জিজ্ঞাসা করিল,
কোন্ নাচ তাহারা দেখাইতে
পারে। দলের মধ্যে একজন ষাট-
বাষট্টি বছরের বৃদ্ধ সেলাম করিয়া
বিনীতভাবে বলিল-হুজুর, হো হো
নাচ আর ছক্কর-বাজি নাচ।
দলটি দেখিয়া মনে হইল নাচের কিছু
জানুক না-জানুক পেটে দুটি খাইবার
আশায় সব ধরনের, সব বয়সের লোক
ইহার মধ্যে ঢুকিয়া পড়িয়াছে।
অনেকক্ষণ ধরিয়া তাহারা নাচিল ও
গান গাহিল। বেলা পড়িবার সময়
তাহারা আসিয়াছিল, ক্রমে
আকাশে জ্যোৎস্না ফুটিল, তখনো
তাহারা ঘুরিয়া ঘুরিয়া হাত ধরিয়া
নাচিতেছে ও গান গাহিতেছে।
অদ্ভুত ধরনের নাচ ও সম্পূর্ণ
অপরিচিত সুরের গান। এই মুক্ত
প্রকৃতির বিশাল প্রসার ও এই সভ্য
জগৎ হইতে বহুদূরে অবস্থিত নিভৃত
বন্য আবেষ্টনীর মধ্যে এই
দিগন্তপরিপ্লাবী ছায়াবিহীন
জ্যোৎস্নালোকে এই নাচগানই
চমৎকার খাপ খায়। একটি গানের
অর্থ এইরূপঃ
‘শিশুকালে বেশ ছিলাম। আমাদের
গ্রামের পিছনে যে পাহাড়, তার
মাথায় কেঁদ বন, সেই বনে কুড়িয়ে
বেড়াতাম পাকা ফল, গাঁথতাম
পিয়াল ফুলের মালা। দিন খুব সুখেই
কাট্ত, ভালবাসা কাকে বলে, তা
তখন জানতাম না। পাঁচ-নহরী ঝরনার
ধারে সেদিন কররা পাখি মারতে
গিয়েছি। হাতে আমার বাঁশের নল ও
আঠা-কাঠি। তুমি কুসুম-রঙে
ছাপানো শাড়ি পরে এসেছিলে জল
ভরতে। দেখে বললে-ছিঃ,
পুরুষমানুষে কি সাত-নলি দিয়ে
বনের পাখি মারে! আমি লজ্জায়
ফেলে দিলাম বাঁশের নল, ফেলে
দিলাম আঠা-কাঠির তাড়া। বনের
পাখি গেল উড়ে, কিন্তু আমার মন-
পাখি তোমার প্রেমের ফাঁদে
চিরদিনের মতো যে ধরা পড়ে গেল!
আমায় সাত-নলি চেলে পাখি
মারতে বারণ করে এ কি করলে তুমি
আমার! কাজটা কি ভালো হল সখি?’
ওদের ভাষা কিছু বুঝি, কিছু বুঝি
না। গানগুলি সেইজন্যই বোধ হয়
আমার কাছে আরো অদ্ভুত লাগিল।
এই পাহাড় ও পিয়ালবনের সুরে বাঁধা
এদের গান, এখানেই ভালো
লাগিবে।
ইহাদের দক্ষিণা মাত্র চার আনা
পয়সা। কাছারির আমলারা
একবাক্যে বলিল-হুজুর, তা-ই অনেক
জায়গায় পায় না, বেশি দিয়ে ওদের
লোভ বাড়াবেন না, তা ছাড়া
বাজার নষ্ট হবে। যা রেট্ তার
বেশি দিলে গরিব গেরস্তরা
নিজেদের বাড়িতে নাচ করাতে
পারবে না হুজুর। অবাক হইলাম-দু-
তিন ঘণ্টা প্রাণপণে খাটিয়াছে,
কম্সে কম সতের-আঠারজন লোক-চার
আনায় ইহাদের জনপিছু একটা
করিয়া পয়সাও তো পড়িবে না।
আমাদের কাছারিতে নাচ
দেখাইতে এই জনহীন প্রান্তর ও বন
পার হইয়া এতদূর আসিয়াছে। সমস্ত
দিনের মধ্যে ইহাই রোজগার। কাছে
আর কোনো গ্রাম নাই যেখানে আজ
রাত্রে নাচ দেখাইবে।
রাত্রে কাছারিতে তাহাদের
খাওয়া ও থাকার ব্যবস্থা করিয়া
দিলাম। সকালে তাহাদের দলের
সর্দারকে ডাকাইয়া দুইটি টাকা
দিতে লোকটা অবাক হইয়া আমার
মুখের দিকে চাহিয়া রহিল। নাচ
দেখিয়া খাইতে কেহই দেয় না,
তাহার উপর আবার দু-টাকা দক্ষিণা!
তাহাদের দলে বার-তের বছরের
একটি ছেলে আছে, ছেলেটির
চেহারা যাত্রাদলের কৃষ্ণঠাকুরের
মতো। একমাথা ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া চুল,
ভারি শান্ত, সুন্দর চোখমুখ, কুচকুচে
কালো গায়ের রং। দলের সামনে
দাঁড়াইয়া সে-ই প্রথমে সুর ধরে ও
পায়ে ঘুঙুর বাঁধিয়া নাচে যখন-
ঠোঁটের কোণে হাসি মিলাইয়া
থাকে। সুন্দর ভঙ্গিতে হাত দুলাইয়া
মিষ্ট সুরে গায়-
রাজা লিজিয়ে সেলাম ম্যায়
পরদেশিঁয়া।
শুধু দুটি খাইবার জন্য ছেলেটি দলের
সঙ্গে ঘুরিতেছে। পয়সার ভাগ সে
বড়-একটা পায় না। তাও সে খাওয়া
কি। চীনা ঘাসের দানা, আর নুন।
বড়জোর তার সঙ্গে একটু তরকারি-
আলুপটল নয়, জংলী গুড়মী ফল ভাজা,
নয়তো বাথুয়া শাক সিদ্ধ, কিংবা
ধুঁধুল ভাজা। এই খাইয়াই মুখে হাসি
সর্বদা লাগিয়া আছে। দিব্যি
স্বাস্থ্য, অপূর্ব লাবণ্য সারা অঙ্গে।
দলের অধিকারীকে বলিলাম,
ধাতুরিয়াকে রেখে যাও এখানে।
কাছারিতে কাজ করবে, আর থাকবে
খাবে।
অধিকারী সেই দাড়িওয়ালা বৃদ্ধ
লোকটি, সে-ও এক অদ্ভুত ধরনের
লোক। এই বাষট্টি বছরেও সে
একেবারে বালকের মতো। বলিল-ও
থাকতে পারবে না হুজুর। গাঁয়ের সব
লোকের সঙ্গে একসঙ্গে আছে, তাই ও
আছে ভালো। একলা থাকলে মন
কেমন করবে, ছেলেমানুষ কি থাকতে
পারে? আবার আপনার সামনে ওকে
নিয়ে আসব হুজুর।
গল্পটির বিষয়ে মন্তব্য করুন
গল্পটির বিষয়ে মন্তব্য করতে আপনার একাউন্টে প্রবেশ করুন ... ধন্যবাদ... Login Now