বিশেষ নোটিশঃ সুপ্রিয় গল্পেরঝুরিয়ান - আপনারা যে গল্প সাবমিট করবেন সেই গল্পের প্রথম লাইনে অবশ্যাই গল্পের আসল লেখকের নাম লেখা থাকতে হবে যেমন ~ লেখকের নামঃ আরিফ আজাদ , প্রথম লাইনে রাইটারের নাম না থাকলে গল্প পাবলিশ করা হবেনা
আপনাদের মতামত জানাতে আমাদের সাপোর্টে মেসেজ দিতে পারেন অথবা ফেসবুক পেজে মেসেজ দিতে পারেন , ধন্যবাদ
X
পৈতৃক বাড়িটা দুই ভাইয়ে ভাগ করিয়া লইয়া ছিল৷
পাশের দোতলা বাড়িটা মেজভাই বিপিনের৷ ছোটভায়ের অনেকদিন পূর্বে মৃত্যু হইয়াছিল৷ বিপিনেরও ধান-চালের কারবার৷ তাহার অবস্থাও ভালো, কিন্তু বড় ভাই নবীনের সমান নয় ৷
তথাপি ইহার বাড়িটাই দোতলা ৷ মেজবউ হেমাঙ্গিনী শহরের মেয়ে ৷ সে দাসদাসী রাখিয়া, লোকজন খাওয়াইয়া, জাঁকজমকে থাকিতে ভালবাসে ৷ পয়সা বাঁচাইয়া গর্বিত চালে চলে না বলিয়াই বছর-চারেক পূর্বে দুই দায়ে কলহ করিয়া পৃথক হইয়াছিল ৷ সেই অবধি প্রকাশ্য কলহ অনেক হইয়াছে, অনেকবার মিটিয়াছে, কিন্তু মনোমানিল্য একটি দিনেরও জন্য মিটে নাই ৷ কারণ, সেটা বড় জা কাদম্বিনীর একলার হাতে ৷ তিনি পাকা লোক, ঠিক বুঝিতেন ভাঙ্গা হাঁড়ি জোড়া লাগে না ৷ কিন্তু মেজবউ অত পাকা নয়, অমন করিয়া বুঝিতেও পারিত না ৷ ঝগড়াটা প্রথমে সেই করিয়া ফেলিত বটে, কিন্তু সেই মিটাবার জন্য, কথা রবিবার জন্য, খাওয়াইবার জন্য ভিতরে ভিতরে ছটফট করিয়া একদিন আস্তে আস্তে কাছে আসিয়া বসিত ৷ শেষে হাতে-পায়ে পড়িয়া কাঁদিয়া-কাঁটিয়া, ঘাট মানিয়া, বড় জা-কে নিজের ঘরে ধরিয়া আনিয়া ভাব করিত ৷ এমনই করিয়া দুই জা-য়ে অনেকদিন কাটিয়াছে ৷ আজ বেলা সাড়ে তিনটার সময় হেমাঙ্গিনী এ বাড়িতে আসিয়া উপস্থিত হইল ৷ কূপের পাশে সিমেন্ট বাঁধানো বেদির উপর বসিয়া কেষ্ট সাবান দিয়া একরাশ কাপড় পরিষ্কার করিতেছিল; কাদম্বিনী দূরে দাঁড়াইয়া, অল্প সাবান ও অধিক গায়ের জোরে কাপড় কাচিবার কৌশলটা শিখাইয়া দিচ্ছিল ৷ মেজ-জা কে দেখিবার মাত্র বলিয়া উঠিলেন, মাগো, ছোড়াটা কি নোংরা কাপড়-চোপড় নিয়ে এসেছে!
কথাটা সত্য ৷ কেষ্ট'র সেই লাল-নীল পেড়ে ধুতি টা পরিয়া এবং চাদরটা গায়ে দিয়া কেহ কুটুমবাড়ি যায় না ৷ দুটোকে পরিষ্কার করার আবশ্যক ছিল বটে, কিন্তু রজতের অভাবে ঢের বেশি আবশ্যক হইয়াছিল পুত্র পাঁচুগোপালের জোড়া- দুই এবং তার পিতার জোড়া- দুই পরিষ্কার করার ৷ কেষ্ট আপাতত তাহাই করিতেছিল ৷ হেমাঙ্গিনী চাহিয়াই তের পাইল বস্ত্রগুলি কাহাদের ৷ কিন্তু সে উল্লেখ না করিয়ায় জিজ্ঞাসা করিল, ছেলেটি কে দিদি? ইতিপূর্বে নিজের ঘরে বসিয়া আড়ি পাতিয়া সে সমস্ত অবগত হইয়াছিল ৷ দিদি ইতস্তত করিতেছেন দেখিয়া পুনরায় কহিলেন, দিব্যি ছেলেটি তো! মুখের ভাব তোমার মতোই দিদি ৷ বলি, বাপের বাড়ির কেউ নাকি? কাদম্বিনী বিরক্ত মুখে জবাব দিলেন, হুঁ, আমার বৈমাত্রেয় ভাই ৷ ওরে, ও কেষ্ট, তোর মেজদিদিকে একটা প্রণাম কর্ না রে! কী অসভ্য ছেলেরে বাবা! গুরুজনকে একটা নমস্কার করতে হয়, তা ও কি তোর মা মাগি শিখিয়ে দিয়ে মরেনি রে? কেষ্ট থতমত খাইয়া উঠিয়া আসিয়া কাদম্বিনীর পায়ের কাছেই নমস্কার করাতে তিনি ধমকাইয়া উঠিলেন, আ মর, গাভী কালি নাকি! কাকে প্রণাম করতে বললুম, কাকে এসে করলে! বস্তুত আসিয়া অবধি তিরস্কার ও অপমানের অবিশ্রম আঘাতে তাহার মাথা বেঠিক হইয়া দিয়াছিল ৷ তাহার ঝাঁজে ব্যস্ত ও হতবুদ্ধি হইয়া হেমাঙ্গিনীর পায়ের কাছে সরিয়া আসিয়া শির অবনত করিতেই সে হাত ধরিয়া ফেলিয়া তাহার চিবুক স্পর্শ করিয়া আশীর্বাদ করিল--- থাক থাক, হয়েছে ভাই, চিরজীবি হও! কেষ্ট মূঢ়ের মতো তাহার মুখপানে চাহিয়া রহিল ৷ এদেশে এমন করিয়া যে কেহ কথা বলিতে পারে, ইহা যেন তাহার মাথায় ঢুকিল না ৷
তাহার সেই কুণ্ঠিত ভীত অসহায় মুখখানির পানে চাহিবামাত্রেই হেমাঙ্গিনীর বুকের ভিতরটা যেন মুচড়াইয়া কাদিয়া উঠিল ৷ নিজেকে আর সামলাতে না পারিয়া, সহসা এই হতভাগ্য অনাথ বালককে বুকের কাছে টানিয়া লইয়া, তাহার পরিশ্রান্ত ঘর্মাপ্লুত মুখখানি নিজের আঁচলে মুছাইয়া দিয়া জা-কে কহিল, আহা, একে দিয়ে কি কাপড় কাচিয়া নিতে আছে দিদি! একটা চাকর ডাকনি কেন?
কাদম্বিনী হঠাৎই অবাক হইয়া গিয়া জবাব দিতে পারিলেন না; কিন্তু নিমেষে সামলাইয়া লইয়া রাগিয়া উঠিয়া কহিলেন, আমি তো তোমার মতো বড় মানুষ নয় মেজবউ, যে বাড়িতে দশ-বিশটা চাকর-বাকর আছে ৷ আমাদের গেরস্ত ঘরে…
কথাটা শেষ হইবার পূর্বেই হেমাঙ্গিনী নিজের ঘরের দিকে মুখ তুলিয়া মেয়েকে ডাকিয়া কহিল, উমা, শিবুকে একবার এ বাড়িতে পাঠিয়ে দে তো মা, বঠ্-ঠাকুর আর রাতপরী ময়লা কাপড়গুলো পুকুর থেকে কেচে শুকোতে দিক ৷ বড় জায়ের দিকে ফিরিয়া চাহিয়া বলিল, এবেলা কেষ্ট আর পাচুগোপাল আমার ওখানে খাবে দিদি ৷ সে ইস্কুল থেকে এলেই পাঠিয়ে দিয়ো, আমি ততক্ষণে একে নিয়ে যাই ৷ কেষ্টকে কহিল, ওঁর মতো আমিও তোমার দিদি হই, কেষ্ট আমার সাথে এস ৷ বলিয়া তাহার একটা হাত ধরিয়া নিজেদের বাড়ি চলিয়া গেল ৷
কাদম্বিনী বাধা দিলেন না ৷ অধিকন্তু হেমাঙ্গিনী প্রদত্ত এত বড় খোঁচাটাও নিঃশব্দে হজম করিলেন ৷ তাহার কারণ, যে ব্যক্তি খোঁচা দিয়াছে, সে এ বেলার খরচটাও বাঁচিয়া দিয়াছে ৷ কাদম্বিনীর নিকট পয়সার বড় সংসারে আর কিছু ছিল না ৷ তাই, গাভী দুধ দিতে দাঁড়াইয়া পা ছুড়িলে তিনি সহিতে পারিতেন ৷
গল্পটির বিষয়ে মন্তব্য করুন
গল্পটির বিষয়ে মন্তব্য করতে আপনার একাউন্টে প্রবেশ করুন ... ধন্যবাদ... Login Now