বাংলা গল্প পড়ার অন্যতম ওয়েবসাইট - গল্প পড়ুন এবং গল্প বলুন

বিশেষ নোটিশঃ সুপ্রিয় গল্পেরঝুরিয়ান - আপনারা যে গল্প সাবমিট করবেন সেই গল্পের প্রথম লাইনে অবশ্যাই গল্পের আসল লেখকের নাম লেখা থাকতে হবে যেমন ~ লেখকের নামঃ আরিফ আজাদ , প্রথম লাইনে রাইটারের নাম না থাকলে গল্প পাবলিশ করা হবেনা

আপনাদের মতামত জানাতে আমাদের সাপোর্টে মেসেজ দিতে পারেন অথবা ফেসবুক পেজে মেসেজ দিতে পারেন , ধন্যবাদ

অবনীল(পর্ব-৫)

"সাইন্স ফিকশন" বিভাগে গল্পটি দিয়েছেন গল্পের ঝুরিয়ান S O F I Y A (০ পয়েন্ট)

X শুধু মহাকাশযানের ভেতরে দেখতে পার? হ্যাঁ, মহাকাশযানের ভেতর্বকার ক্যামেরাগুলো নষ্ট হয় নি—ভেতরে দেখতে পারি। রিরা একটা নিশ্বাস ফেলে জিজ্ঞেস করল, নীলমানব এখন কী করছে? এতক্ষণ মহাকাশযানের সামনে দাঁড়িয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে ছিল। কয়েকটা। স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র বসিয়ে এসেছে। এখন খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে পিছন দিকে যাচ্ছে, ঘাড়ে করে বেশ কয়েকটা স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র নিয়ে যাচ্ছে। তুমি বলতে চাও নীলমানবটা কোনো বিশ্রাম নেয় না? না। খায় না? না, এখনো খেতে দেখি নি। ঘুমায় না? এখনো ঘুমায় নি। রিরা কোনো কথা না বলে ছাদের দিকে মাথা রেখে দুই হাতের উপর শুয়ে রইল। নীলমানব খায় না বা ঘুমায় না—কথাটা পুরোপুরি সত্যি নয়। ঘণ্টা ছয়েক পরে সে একটা খাবারের ট্রে নিয়ে হাজির হল। মেঝেতে রেখে সে ট্রেটা পা দিয়ে রিরার দিকে ঠেলে দিল। রিরা চাপা গলায় বলল, প্রসেসর। বলো। ওকে বলো একজন মানুষকে পা দিয়ে খাবার ঠেলে দেওয়া যায় না। সেটা অসম্মানজনক। বলে লাভ নেই। কেন? সে এসব বোঝে না। নীলমানদের কালচার মানুষের কালচার থেকে ভিন্ন। হোক। রিরা পাথরের মতো মুখ করে বলল, তুমি ওকে বলো একজন মানুষকে তার খাবার পা দিয়ে ঠেলে দেওয়া যায় না। প্রসেসর বিজাতীয় ভাষায় কিছু একটা বলল এবং নীলমানবকে হঠাৎ একটু বিভ্রান্ত দেখায়। সে কয়েক মুহূর্ত একটা কিছু ভাবল, তারপর হাতের স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটি তাক করে রিরার দিকে এগিয়ে এল। রিরার কাছাকাছি এসে সে খাবারের ট্রেটা হাতে নিয়ে রিরার দিকে এগিয়ে দেয়, নিচু গলায় বলে, অনুগ্রহ করে। কিশিমারা। রিরা স্থিরদৃষ্টিতে কিছুক্ষণ নীলমানবটির দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, কুগুরা। ধন্যবাদ। নীলমানবটি দুই পা পিছনে সরে গিয়ে হেলান দিয়ে বসে রিরার দিকে স্থিরদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। রিরা খাবারের ট্রেটির দিকে তাকাল, একজন মানুষ যতটুকু খেতে পারে খাবার তার থেকে অনেক বেশি। নীলমানবদের খাবারের অভ্যাস নিশ্চয়ই অন্যরকম, কারণ ট্রেতে প্রোটিনের পরিমাণ অনেক বেশি। রিরা যেটুকু খেতে পারবে, আলাদা করে সরিয়ে বার্কি খাবারসহ ট্রেটা নীলমানবটির দিকে এগিয়ে দেয়। নীলমানটা অনিশ্চিতভাবে কিছুক্ষণ রিরার দিকে তাকিয়ে থাকে, তারপর এগিয়ে এসে খাবারের ট্রেটা হাতে নেয়। রিরা যখন খেতে শুরু করল তখন নীলমানবটিও খৈতে শুরু করল। নীলমানবের খাবারের ভঙ্গিটুকু এক বিচিত্র, খাবারের টুকরো যত ছোটই হোক কিংবা যত বড়ই হোক সেটা সে দুই হাতে ধরে খায়। কে জানে এর পেছনে হয়তো কোনো সংস্কার রয়েছে। তবে রিরার কৌতূহলটি হল অন্য ব্যাপারে, যে কোনো কারণেই হোক নীলমানবটি বসেছে তার কাছাকাছি, স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটা রেখেছে এমন জায়গায় যে রিরা ইচ্ছে করলে সেটা ধরে ফেলতে পারে। রিরা খেতে খেতে পুরো ব্যাপারটা একটু ভেবে দেখল নীলমানবটি কিছু সন্দেহ করছে না, অন্যমনস্কভাবে খাবার মুখে তুলছে। রিরা বাম হাত দিয়ে ইচ্ছে করলেই এক ঝটকায় স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটা তুলে নিতে পারে সাথে সাথে এই মহাকাশযানে পুরো সমীকরণটি পাল্টে যাবে। যদি তুলতে না পারে তা হলে একটা ঝামেলা হতে পারে কিন্তু সেটা নিয়ে এখন চিন্তা না করাই ভালো। রিরা চোখের কোনা দিয়ে নলিমানবটিকে লক্ষ করল এবং যখন সে দু হাতে এক টুকরো প্রোটিন হাতে নিয়েছে রিরা তখন ঝাঁপিয়ে পড়ল স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটির ওপর। নীলমানবটি হকচকিয়ে গিয়ে যখন কী হচ্ছে বুঝতে পেরেছে তখন খুব দেরি হয়ে। গেছে। রিরার হাতে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র এবং ট্রিগারে আঙুল। সে হিংস্র গলায় বলল, দুই হাত উপরে নীলমানব। নীলমানবটি কী করবে বুঝতে পারছিল না, রিরা তখন অধৈর্য গলায় চিৎকার করে উঠল, হাত উপরে। নীলমানবটি ইতস্ততভাবে হাত উপরে তুলল। রিরা স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র ঝাকুনি দিয়ে বলল, দেয়ালের কাছে যাও। নীলমানবটি বিভ্রান্ত হয়ে দুই হাত উপরে তুলে দেয়ালের কাছে এগিয়ে যায়। দেয়ালে হেলান দিয়ে সে এক ধরনের বিস্ময় নিয়ে রিরার দিকে তাকিয়ে রইল। প্রসেসর হঠাৎ শিস দেওয়ার মতো একটা শব্দ করে বলল, চমৎকার। রিরা কোনো কথা বলল না। প্রসেসর আবার বলল, গুলি কর রিরা। অস্ত্রটি তার হৃৎপিণ্ডের দিকে তাক করে গুলি কর। তুমি আরো একবার সুযোগ পেয়ে আমি নিশ্চিতভাবে বলতে পারি আর এই সুযোগ পাবে না। রিরা অস্ত্র তাক করে দাঁড়িয়ে রইল, প্রসেসর আবার বলল, গুলি কর রিরা। গুলি কর। রিরা স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটি নিজের পায়ের দিকে তাক করে শেকল লক্ষ করে গুলি করল, বন্ধ ঘরের মাঝে ভয়ংকর শব্দে সেই অস্ত্রের বিস্ফোরণের শব্দ প্রতিধ্বনিত হয়ে উঠল। নীলমানব নিষ্পলক দৃষ্টিতে রিরার দিকে তাকিয়ে রইল, প্রসেসর আবার বলল, রিরা, গুলি কর। হত্যা কর নীলমানবকে। রিরা নিজেকে মুক্ত করে নীলমানবের দিকে এগিয়ে গেল, পায়ে বাধা শেকলের অংশ নূপুরের মতো শব্দ করে ওঠে। প্রসেসর চাপা গলায় বলল, দেরি করো না, রিরা। এই সুযোগ আর তুমি পাবে না। রিরা এক মুহূর্ত দ্বিধা করে তারপর স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটি নীলমানবের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, নাও। নীলমানবটি এক ধবনের বিস্ময় নিয়ে রিরার দিকে তাকিয়ে থাকে, এখনো সে বিশ্বাস করতে পারছে না রিরা কী করতে চাইছে। রিরা আবার বলল, নাও। নীলমানবটি নিজের বুকে হাত দিয়ে বলল, আমি অস্ত্র? হ্যাঁ, আমি তোমাকে এই স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটি দিচ্ছি। আমি আমার পায়ের শেকল খোলার জন্য নিয়েছিলাম, শেকল খুলেছি, এখন আর প্রয়োজন নেই। তোমার অস্ত্র তুমি নাও। নীলমানব কী বুঝল কে জানে, সে হাত বাড়িয়ে অস্ত্রটি নিল এবং হঠাৎ হেসে ফেলল। ঝকঝকে সাদা দাঁত এবং এক ধরনের ভালো মানুষের মতো হাসি—রিরা হঠাৎ আবার বুঝতে পারে নীলমানবটি অসম্ভব রূপবান। নীলমানবটি অস্ত্র হাতে নিয়ে কয়েক মুহূর্ত আড্রষ্টের মতো দাঁড়িয়ে থাকে, সেটি কী করবে যেন বুঝতে পারে না। ইতস্তত করে সে দুই পা এগিয়ে বিছানার উপর অস্ত্রটি রেখে রিরার কাছে ফিরে এল, রিরা তার হাতটি বাড়িয়ে দিয়ে বলল, আমার নাম রিরা। নীলমানবটি রিরার হাত ধরে নবম গলায় বলল, আমি কুশান। তোমার সঙ্গে পরিচিত হয়ে খুশি হলাম কুশান। কুশান বিড়বিড় করে কী যেন বলল, রিরা ঠিক বুঝতে পারল না। রিরা সেটা নিয়ে মাথা ঘামাল না, বলল, এই মহাকাশযানে অনেক লাল এবং নীল রক্তক্ষয় হয়েছে। সেটা যথেষ্ট। আশা করছি আমি এবং তুমি সেই নির্বুদ্ধিতার কথা ভুলে যাব। নীলমানব তার নিজের বিজাতীয় ভাষায় কিছু একটা বলল, রিরা তার কিছু একটা বুঝতে পারল না। সে গলা উঁচিয়ে বলল, প্রসেসর। বলে রিরা। কশান কী বলেছে? সে বলেছে তোমার গায়ের রঙ যদি পচা আঙুরের মতো না হত, তা হলে তোমাকে মোটামুটি সুন্দরী হিসেবে চালিয়ে দেওয়া যেত। রিরা কথাটি শুনতে পায় নি ভান করে হঠাৎ করে নিজের পায়ে বাধা শেকলের অংশগুলো খুলতে ব্যস্ত হয়ে গেল। নীলমানব কুশান এবং রিরা মিলে মহাকাশযানটাকে সুরক্ষিত করতে শুরু করে। মহাকাশযানের যেসব জায়গা ভেঙে ফঁকফোকর বা ফাটল তৈরি হয়েছিল, সেগুলো বুজিয়ে দিতে শুরু করল এই গ্রহটিতে বুদ্ধিহীন ভয়ংকর এবং নৃশংস এক ধরনের প্রাণী আছে, এরকম একটা তথ্য তারা জানে। সেই প্রাণী বা প্রাণীগুলো কী রকম সে সম্পর্কে তাদের কোনো ধারণা নেই। কাজেই তারা কোনোরকম ঝুঁকি নিতে চাইল না। বাইরে থেকে হঠাৎ করে কোনো প্রাণী ঢুকে গেলে তার সাথে রীতিমতো যুদ্ধ করার জন্য স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র বা ক্ষেপণাস্ত্র প্রস্তুত করে রাখল। নীলমানব কুশানের সাথে কথা বলে রিরা আবিষ্কার করল, মানুষ কথা বলার সময় শুধু কণ্ঠস্বর নয়, চোখ-হাত খুলে এমনকি পুরো শরীর ব্যবহার করে। দুজনের পরিচিত শব্দের সংখ্যা খুব বেশি নয়, বেশ কিছু শব্দ অনুমান করে কাজ চালিয়ে নিতে হয় কিন্তু তারপরেও দুজনের কথাবার্তা বলতে খুব সমস্যা হল না। রিরা আবিষ্কার করল, নীলমানব কুশান বুদ্ধিমান এবং ধীরস্থির। এটি কি কুশানের নিজস্ব ব্যাপার নাকি নীলমানদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য—রিরা সে ব্যাপারে নিঃসন্দেই হতে পারল না। দুজনে মিলে কাজ করতে কোনো অসুবিধা হল না মহাকাশযানটিকে সুরক্ষিত করার জন্য কুশানের নিজস্ব কিছু পরিকল্পনা ছিল। রিরা দ্বিধান্বিতভাবে তার ভেতরে কিছু কিছু পরিবর্তন করার কথা বলা মাত্রই কুশান সাথে সাথে সেগুলো মেনে নেয়। কুশানের জায়গায় একজন মানুষ হলে এত সহজে মেনে নিত না। মহাকাশযানের ক্যাপ্টেন বৰ্কেন বলেছিলেন, নীলমানব বিচ্ছিন্ন প্রাণীসত্তা নয়, তারা সব সময় একসাথে কাজ করে। এখানেও নিশ্চয়ই সেটি হচ্ছে, রিরা যখনই কোনো প্রস্তাব করছে কুশান সাথে সাথে সেটি মেনে নিচ্ছে। নীলমানবদের সে ভয়ংকর দুর্ধর্ষ এবং একরোখা জেনে এসেছে কিন্তু এই মহাকাশযানে দুজনে একসাথে আটকা পড়ে যখন একসাথে কাজ করতে হচ্ছে, তখন কুশানকে মোটেও একরোখা বা দুর্ধর্ষ মনে হচ্ছে না। মহাকাশযানটি দখল করার সময় এই কুশান এবং তার সঙ্গীসাথীরাই যে ভয়ংকর আক্রমণ চালিয়েছিল, কুশানকে দেখে সে কথাটি বিশ্বাসযোগ্যই মনে হয় না। কুশানকে দেখে মনে হয় একজন স্বল্পভাষী সহৃদয় মানুষ—ভয়ংকর একরোখা যোদ্ধা কিছুতেই নয়। টাইটেনিয়ামের শক্ত দরজা দিয়ে যেসব করিডর এবং টানেল বন্ধ করা সম্ভব হল, দুজনে মিলে সেগুলো বন্ধ করে দিল। বড় বড় ফুটোগুলোতে ধাতব পাত লাগিয়ে ওয়েল্ড করে দেওয়া হল। বড় বড় ফুটোগুলো বন্ধ হবার পর দুজনে মিলে ফাটলগুলোতে ধাতব আকরিকের পেস্ট দিয়ে সেগুলো সিল করে দিতে শুরু করল। মহাকাশযানটি বিধ্বস্ত হবার পর তার প্রায় সব অ্যালার্ম সিস্টেম নষ্ট হয়ে গিয়েছে, দুজনে মিলে সেগুলোও আবার দাঁড় করাতে শুরু করল। মহাকাশযানটি মানুষের, প্রযুক্তিটিও মানুষের, তাই এ ধরনের কাজের সাথে কুশান পরিচিত নয়। তবে খুব দ্রুত সে কাজ শিখে নিতে পারে এবং আশ্চর্য ক্ষিপ্রতায় সে কাজে দক্ষ হয়ে উঠতে পারে। মহাকাশযানে কুশানের মতো একজন মহাকাশচারীকে পেয়ে যাওয়া নিশ্চয়ই রীতিমতো সৌভাগ্যের একটা ব্যাপার। মহাকাশযানটিকে মোটামুটিভাবে সুরক্ষিত করে তারা প্রথমবার ভালো করে গ্রহটির দিকে নজর দেবার সুযোগ পেল। গ্রহটি একেবারেই সাদামাটা গ্রহ, বাইরে রুক্ষ পাথর ছাড়া আর কিছু নেই। বিশাল একটা উপগ্রহ থেকে বিচ্ছুরিত আলো গ্ৰহটাকে আলোকিত করে রেখেছে। এই উপগ্রহটির আলো কোথা থেকে আসছে, রিরা ভালো করে বুঝতে পারল না। তবে উপগ্রহের উপরের দিক থেকে কুণ্ডলী পাকানো আলোর বিচ্ছুরণ দেখে মনে হয় শক্তিশালী চৌম্বকীয় ক্ষেত্রে ইলেকট্রন এবং আয়ন আটকা পড়ে বিশাল একটা প্লাজমাক্ষেত্রের মতো কাজ করছে। সম্ভবত সেটাই আলো হিসেবে আসছে। আলোটা স্থির নয়, এটি বাড়ছে এবং কমছে। তার রঙেরও পরিবর্তন হচ্ছে, বেশিরভাগ সময়ে এটি উজ্জ্বল সাদা রঙের কিন্তু হঠাৎ হঠাৎ কমলা রঙে পাল্টে যায়। রিরার মনে হতে থাকে দূরে কোথাও বুঝি আগুন লেগেছে এবং সেই আগুনের কমলা আভা এসে পড়ছে, রিরা তখন ভেতরে ভেতরে এক ধরনের অস্থিরতা অনুভব করে। রিরা এক ধরনের হিংসা নিয়ে লক্ষ করেছে নীলমানবের ভেতরে কখনোই কোনো অস্থিরতা নেই। এক ধরনের কৌতূহলী শান্ত চোখে সে সবকিছু গভীর আগ্রহ নিয়ে লক্ষ করে, কোনো কিছু নিয়েই সে ব্যস্ত হয়ে ওঠে না। প্রথমে কিছুদিন এক ধরনের অমানুষিক পরিশ্রম করে তারা মহাকাশযানটিকে মোটামুটি সুরক্ষিত করার পর অন্য বিষয়গুলোর দিকে নজর দিতে শুরু করে। এখানে তাদের কতদিন থাকতে হবে তারা জানে না, তাই খাবার সরবরাহের ব্যাপারটি নিশ্চিত করে নিল। বিদ্যুৎপ্রবাহ নিশ্চিত করার জন্য তারা অনেক সময় নিয়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে থাকা। জ্বালানিটুকু সংরক্ষণের ব্যবস্থা করল। জ্বালানির যেন অপচয় না হয়, সেজন্য পুরো মহাকাশযান ঘুরে ঘুরে যেখানে প্রয়োজন নেই সেখানে বিদ্যুৎ এবং তাপপ্রবাহ বন্ধ করে দিল। ভেতরে অক্সিজেন সরবরাহের পাম্পটি দুজনে মিলে ওভারহল করে প্রায় নতুন করে ফেলল। দৈনন্দিন জীবনের ব্যাপারটি নিশ্চিত করে তাদেরকে কমিউনিকেশন্স মডিউলটির দিকে নজর দিতে হবে। প্রথমবার দেখে মনে হয়েছে পুরো ইউনিটটি ধ্বংস হয়ে গেছে, তার ভেতর থেকে কোনোটা রক্ষা করা যাবে কি না এখনো তারা জানে না। যোগাযোগের কোনো ব্যবস্থা করতে না পারলে এই মহাজগতের কেউ জানবে না যে, তারা এই গ্রহটিতে আটকা পড়ে গেছে—কেউ তাদের উদ্ধার করতে আসবে না। এক-দুইদিনের ভেতরেই কমিউনিকেশন্স মডিউলের ম্যানুয়েল নিয়ে তারা সেগুলো নিয়ে বসবে। যেভাবেই হোক একটা শক্তিশালী ট্রান্সমিটার তৈরি করে মহাবিশ্বে খবর পাঠাতে হবে যে, তারা এখানে আটকা পড়ে আছে, তাদেরকে উদ্ধার করতে হবে। নতুন এই গ্রহে রিরা এবং কুশান বেশ কিছুদিন থেকে আছে, এই গ্রহে বুদ্ধিহীন নৃশংস এবং ভয়ংকর এক ধরনের প্রাণী থাকার কথা তারা সে ধরনের কোনো প্রাণী এখনো দেখে নি। সত্যি কথা বলতে কী তারা এখন পর্যন্ত এই গ্রহে কোনো ধরনের প্রাণীই দেখতে পায় নি। গ্রহটির ওপর নজর রাখার জন্য তারা মহাকাশযানের একেবারে উপরে একটা পর্যবেক্ষণ টাওয়ার তৈরি করেছে, কোয়ার্টজের স্বচ্ছ জানালা দিয়ে তারা বাইরে বহুদূর দেখতে পায়, যখন তাদের কোনো কাজ না থাকে রিরা এবং কুশান এই টাওয়ারে বসে নির্জন নিষ্প্রাণ গ্রহটিকে দেখে। পুরো গ্রহটিতে সব সময় এক ধরনের ভুতুড়ে আলো, আকাশের অর্ধেকটা জুড়ে একটা বিশাল উপগ্রহ অনেকটা জীবন্ত প্রাণীর মতো তাদের দিকে তাকিয়ে থাকে। মহাকাশটি মোটামুটি স্থিতিশীল। হঠাৎ কখনো কখনো এক ধরনের ঝড়ো হাওয়া বইতে থাকে, বাতাসে তখন এক বিচিত্র ধরনের শব্দ হতে থাকে, মনে হয় কোনো অশরীরী ইনিয়ে বিনিয়ে কাঁদছে, রিরা তখন অত্যন্ত অস্থির অনুভব করতে থাকে কিন্তু কুশানকে কখনোই বিচলিত হতে দেখা যায় না। যখন রিরা এবং কুশানের দৈনন্দিন জীবন প্রায় রুটিন হয়ে যাবার উপক্রম হয়ে এসেছে, তখন এই গ্রহের প্রথম বিচিত্র রূপটি তাদের চোখে পড়ল। কমিউনিকেশন্স মডিউল কক্ষে একটা সংবেদী রিলিভারকে প্রায় অনেকখানি সারিয়ে তুলতে গিয়ে রিরা এবং কুশান প্রায় টানা আট ঘণ্টা পরিশ্রম করেছে। এখন দুজনেই ক্লান্ত। কৃত্রিম প্রোটিনের সাথে কয়েকটা শক্ত রুটি, খানিকটা স্নায়ু সতেজকারী পানীয় খেয়ে দুজনে পর্যবেক্ষণ টাওয়ারে এসে বসেছে। বেশ কিছুদিন একসাথে থেকে তাদের ভেতরকার ভাষার বেশ উন্নতি হয়েছে—দুজনেই দুজনকে বেশ বুঝতে পারে, কোনো একটা কিছু বোঝানোর জন্য আজকাল প্রসেসরের সাহায্য বলতে গেলে নিতেই হয় না। রিরা টাওয়ারে বসে বাইরের মন খারাপ করা গ্রহটির দিকে তাকিয়ে বলল, আমাদের না জানি আর কতদিন এই গ্রহে থাকতে হবে! কুশান তার কথার কোনো উত্তর দিল না, তার বড় এবং খানিকটা বিচিত্র চোখে রিরার দিকে তাকিয়ে রইল। রিরা আবার বলল, এই গ্রহটি আমার নার্ভের ওপর উঠে যাচ্ছে। কুশান জিজ্ঞেস করল, কেন? গ্রহটিতে কোনো দিন-রাত নেই, আলো-আঁধার নেই। সব সময়েই এক ধরনের ভুতুড়ে আলো। কুশান নিচু গলায় বলল, মহাকাশচারীদের অনেক লম্বা সময় মহাকাশযানে থাকতে হয়। তাদের দিন-রাতের অনুভূতি থাকে না। রিরা একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, আমার আছে। আমি মনে হয় খাঁটি মহাকাশচারী নই। কুশান একটু হেসে বলল, না রিরা। তুমি খাঁটি মহাকাশচারী। আমাদের নীলমনিবদের মাঝে তোমার মতো মহাকাশচারী পাওয়া খুব কঠিন। রিরা ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, আমার কোন কাজটি দেখে তোমার এই ধারণা হল? তোমার সব কাজ দেখে। তুমি যেভাবে একা এই পুরো মহাকাশযানটাকে রক্ষা করেছ, তার কোনো তুলনা নেই। রিরা একটু হেসে বলল, বেঁচে থাকার তাগিদটা অসম্ভব শক্তিশালী তাগিদ, সেজন্য মানুষ অনেক কাজ করে। কুশান গম্ভীর মুখে বলল, আমার জানামতে তুমি শুধু একটি ভুল করেছ। কী ভুল করেছি? প্রথম যখন আমাকে পেয়েছিলে, তখন সাথে সাথে তোমার আমাকে হত্যা করা উচিত ছিল। রিরা শব্দ করে হেসে বলল, সে কী! এটা তুমি কী বলছ? আমি ঠিকই বলছি। আমাকে হত্যা না করে তুমি নিজের ওপরে অসম্ভব বড় ঝুঁকি নিয়েছিলে। রিরা এক ধরনের কৌতকের দৃষ্টিতে কুশানের দিকে তাকিয়ে রইল। বলল, তা হলে তুমিও আমাদের মূল প্রসেসরের মতো বিশ্বাস কর তোমাকে হত্যা করা উচিত ছিল? কুশান গম্ভীর মুখে মাথা নাড়ল, বলল, তুমি আমাকে হত্যা না করায় আমি এখনো বেঁচে আছি। মানুষ কীভাবে কাজ করে, ভাবনা-চিন্তা করে সেটা বোঝার সুযোগ পেয়েছি। এটি চমৎকার অভিজ্ঞতা। রিরা কথার পিঠে আরেকটি কথা বলতে গিয়ে হঠাৎ থেমে গেল। তার কাছে মনে হল হঠাৎ করে গ্রহটির কিছু একটা পরিবর্তন হয়েছে। সে চাপা গলায় ডাকল, কুশান। আমার মনে হচ্ছে গ্রহটার কিছু একটা পরিবর্তন হচ্ছে। কী পরিবর্তন? ঠিক বুঝতে পারছি না। মনে হচ্ছে গ্রহটা অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে। অন্ধকার? হ্যাঁ। দেখ আলোটা কেমন কমে আসছে। রিরার সন্দেহ কিছুক্ষণের মাঝেই সত্য প্রমাণিত হল। সত্যি সত্যি হঠাৎ করে গ্রহটা অন্ধকার হতে শুরু করল। বিশাল একটা চোখের মতো যে উপগ্রহটা সব সময় এই গ্রহটার দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে রয়েছে, তার মাঝে একটা ছায়া পড়তে শুরু করেছে, হঠাৎ করে পুরো গ্রহটা অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে। রিরা বিস্ফারিত চোখে কোয়ার্টজের জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইল, অবাক হয়ে বলল, কী আশ্চর্য! হঠাৎ করে গ্রহটা অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে। কুশান কোনো কথা না বলে একটু বিস্ময়ের ভঙ্গি করে রিরার দিকে তাকিয়ে রইল, তাকে দেখে মনে হতে থাকে হঠাৎ করে আলোকোজ্জ্বল একটা গ্রহ অন্ধকার হয়ে যাওয়া বুঝি খুব স্বাভাবিক ব্যাপার। কিছুক্ষণের মাঝে চারদিক নিকষ কালো অন্ধকারে ঢেকে গেল। উজ্জ্বল আলোতে অভ্যস্ত চোখ হঠাৎ করে এই গাঢ় অন্ধকারে কেমন যেন এক ধরনের নির্ভরতা খুঁজে পায়। রিরা খানিকটা বিস্ময় নিয়ে বলল, এই অন্ধকারটা কেমন অদ্ভুত দেখেছ? কোনো কিছু দেখতে না পাওয়ার মাঝে এক ধবনের আরাম আছে। কুশান নিচু গলায় বলল, তুমি সত্যি কিছু দেখতে পাচ্ছ না? রিরা অবাক হয়ে বলল, তুমি কী বলতে চাইছ? তুমি দেখতে পাচ্ছ? হ্যাঁ। আমি দেখতে পাচ্ছি। হঠাৎ করে রিরার মনে পড়ল কুশানের চোখ ইনফ্রারেড থেকে আলট্রাভায়োলেট পর্যন্ত সংবেদী। রিরার চোখে যখন সবকিছু অন্ধকার, কুশান তখনো দেখতে পারে কিন্তু তবুও তার কাছে ব্যাপারটা অসম্ভব মনে হতে থাকে। সে অবাক হয়ে বলল, তুমি সত্যি দেখতে পাচ্ছ? হ্যাঁ রিরা, আমি সবকিছু দেখতে পাচ্ছি। তুমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছ? হ্যাঁ, আমি সবকিছু স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। একটু নীলাভ রঙ, কিন্তু স্পষ্ট। রিরা হঠাৎ ছেলেমানুষের মতো গলায় বলল, আমি তোমার কথা বিশ্বাস করি না। কুশান শব্দ করে হেসে বলল, তোমাকে আমার সব কথা বিশ্বাস করতে হবে কে বলেছে? আমাকে তুমি ছুঁতে পারবে? কেন পারব না? রিরা একটু সরে বসে বলল, ছোঁও দেখি। রিরা হঠাৎ করে অনুভব করে একটা হাত খুব আলতোভাবে তাকে স্পর্শ করল–অনেকটা আদর করার মতো তার গাল স্পর্শ করে হাতটি তার চিবুকের কাছে এসে থেমে যায়। কুশান বলল, এটা তোমার চিবুক। রিরা অনুভব করে হাতটি সরে গিয়ে খুব কোমলভাবে তার চুল স্পর্শ করে বলল, এই যে তোমার চুল। রিরা হঠাৎ অনুভব করল কুশানের দুটি হাত খুব ধীরে ধীরে তার দুই গালের কাছে এসে তার মুখটি উপরে তুলেছে খুব কাছে থেকে সে হঠাৎ কুশানের নিশ্বাস শুনতে পেল। রিরা হঠাৎ কেমন যেন অস্বস্তি অনুভব করে, সে ইতস্তত করে বলল, কুশান, তুমি কী করছ? তোমাকে দেখছি। আমাকে তুমি আগে দেখ নি? অবশ্যই দেখেছি, কিন্তু এখন— এখন কী? এখন সবকিছুতে একটু নীলচে আভা। আর— আর কী? নীলচে আভাতে তোমাকেও নীল দেখাচ্ছে। হঠাৎ করে তোমাকে একটা নীলমানবীর মতো লাগছে। তোমাকে এত সুন্দর দেখাচ্ছে যে, আমি চোখ ফেরাতে পারছি না রিরা। রিরা হঠাৎ একটু লজ্জা পেয়ে যায়, সে সাবধানে কুশানের হাত দুটি সরিয়ে হালকা গলায় বলল, তার অর্থ কী বুঝতে পারছ? কী? সাধারণ আলোতে আমার চেহারায় কোনো সৌন্দর্য নেই। আমার সৌন্দর্য আসে শুধুমাত্র নীল আলোতে যখন আমাকে নীলমানবীর মতো দেখায়! আমি সেটা বলতে চাই নি রিরা। তুমি তা হলে কী বলতে চাইছ? কুশান একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, আমি ঠিক জানি না রিরা। আমি খুব গুছিয়ে কথা বলতে পারি না। হঠাৎ করে নীলাভ আলোতে তোমাকে দেখে আমার পুরোনো দিনের কথা মনে পড়ে গেল। পুরোনো দিনের কথা? হ্যাঁ, আমার শৈশবের কথা, আমার পরিরারের কথা। যুদ্ধে নাম লেখানোর পর থেকে বহুকাল তাদের কারো সাথে যোগাযোগ নেই। তারা কে কোথায় আছে, কেমন আছে কিছু জানি না। রিরা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, আমি যখন একাডেমিতে পড়ছি, তখন তোমাদের ওপর আমাদের একটা কোর্স করতে হত। সেখানে আমাদের শেখানো হয়েছিল—তোমরা। অত্যন্ত দুর্ধর্ষ এবং একরোখা। রিরার কথা শুনে কুশানের কী প্রতিক্রিয়া হল অন্ধকারে ঠিক দেখা গেল না। রিরা বলল, আলো জ্বেলে দিই।


এডিট ডিলিট প্রিন্ট করুন  অভিযোগ করুন     

গল্পটি পড়েছেন ৩৮৩ জন


এ জাতীয় গল্প

গল্পটির রেটিং দিনঃ-

গল্পটির বিষয়ে মন্তব্য করুন

  • গল্পটির বিষয়ে মন্তব্য করতে আপনার একাউন্টে প্রবেশ করুন ... ধন্যবাদ... Login Now
  • Abdullah
    User ৩ বছর, ১১ মাস পুর্বে
    Next part ta taratari dien

  • arfan suvo
    User ৩ বছর, ১১ মাস পুর্বে
    য়ুবা তারাতার দিবা gj

  • মোহাম্মদ মফিজুল হোসেন
    User ৩ বছর, ১১ মাস পুর্বে
    নাইসgj gj gj

  • SHUVO SUTRADHAR
    Golpobuzz ৩ বছর, ১১ মাস পুর্বে
    nice. next part please.

  • Tuba Rubaiyat
    User ৩ বছর, ১১ মাস পুর্বে
    বইটা আমার খুব ভালো লেগেছে তাই দিলাম এখানেgj

  • Tuba Rubaiyat
    User ৩ বছর, ১১ মাস পুর্বে
    ভাইয়া এটা তো আমার লেখা না।।।এটা ড. জাফর ইকবাল স্যারের লেখা একটা সাইন্স ফিকশন।।। আজ লেখক সংযুক্ত করতে ভুলে গেছিgj

  • Partho
    Golpobuzz ৩ বছর, ১১ মাস পুর্বে
    নাইস ।বুড়ি হয়ে এত ভালো লেখা তো অবিশ্বাস্য