বাংলা গল্প পড়ার অন্যতম ওয়েবসাইট - গল্প পড়ুন এবং গল্প বলুন

বিশেষ নোটিশঃ সুপ্রিয় গল্পেরঝুরিয়ান - আপনারা যে গল্প সাবমিট করবেন সেই গল্পের প্রথম লাইনে অবশ্যাই গল্পের আসল লেখকের নাম লেখা থাকতে হবে যেমন ~ লেখকের নামঃ আরিফ আজাদ , প্রথম লাইনে রাইটারের নাম না থাকলে গল্প পাবলিশ করা হবেনা

আপনাদের মতামত জানাতে আমাদের সাপোর্টে মেসেজ দিতে পারেন অথবা ফেসবুক পেজে মেসেজ দিতে পারেন , ধন্যবাদ

সময়ের ছায়া

"ফ্যান্টাসি" বিভাগে গল্পটি দিয়েছেন গল্পের ঝুরিয়ান Shahriar Hasan (০ পয়েন্ট)

X #The_Shadow_Of_Time লেখক:শাহরিয়ার_হাছান পব-১ ‘লিঙ্গ কেটে পাঁচ ধর্ষকের নির্মম হত্যাকাণ্ড! ’ আজ প্রতিটা খবরের চ্যানেল এবং পত্রিকার প্রধান খবরের তালিকায় এই শিরোনামটি। কফিতে চুমুক দিলো নীল, সে একবার খবরের কাগজের দিকে তাকাচ্ছে, আরেকবার তার সামনে চালু থাকা টিভির দিকে তাকাচ্ছে। উভয় স্থানে একই খবর। নীল রিমোট দিয়ে টিভি বন্ধ করে দিলো, টেবিলে রাখা নাস্তা খাবায় সে মন দিলো। মিনিট দশেক পর তার খাওয়া সেরে যেতেই সে একটা রহস্যময় মুচকি হাসি হাসল। ‘হাচ্ছি! যাহ! মনে হয় আমায় ঠাণ্ডা লেগেছে।’ মনে মনে বলল নীল। একটা ড্রয়ার হতে নীল এক পাতা নাঁপা টেবলেট বের করল। পাতা থেকে একটি টেবলেট নিয়ে পানি দিয়ে গড়গড় করে গিলে ফেলল। ‘সব রোগের এক ঔষধ, নাম তার নাঁপা।’ হেসে বলল নীল। পকেটে থাকা ফোনটা বেজে ওঠল, নীল ফোনটা তুলল। ওপাশ থেকে ভাঙা গলায় এক লোক বলছে, ‘লিঙ্গ কাইটা কেডায় জানি পাঁচটা নরপিশাচরে মাইরা ফালাইছে।’ কথাটা শুনে নীল ফিক করে হেসে দিলো। হাতে থাকা পানির গ্লাস থেকে ঢপ করে পানি মেঝেতে পরে গেলো। নীল হাসতে হাসতে বলল, ‘ভালোই হয়েছে। যে ওই পাঁচ নরপিশাচরে হত্যা করেছে তাকে মনে প্রাণে দোয়া করি আমি। দীর্ঘ আয়ু হোক তার, খোদা তাকে সর্বদা বিপদ মুক্ত রাখুক।’ ওপাশ থেকে লোকটা কাশতে কাশতে বলল, ‘ওই পাঁচটা ছেলে তোর বন্ধু না ছিল?’ নীল কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো। মিনিট দুয়েক পর সে মৃদু হেসে বলল, ‘বন্ধু ছিল!’ কথাটা বলেই নীল ফোন কেটে দিল। . . _ ‘দুঃখিত আপু.! খেয়াল করিনি।’ নরম গলায় বলল নীল। _ ‘সমস্যা নেই।’ বলেই মেয়েটি চলে গেলো। দূর থেকে নীলকে দেখে অরিক এগিয়ে আসলো। সে বলল, ‘কিরে কোথায় যাচ্ছিস?’ নীল হালকা হেসে বলল, ‘রহস্য ছাপাতে।’ অরিক আর নীলকে থামালো না। বুঝল সে নীল যাচ্ছে পাণ্ডুলিপি জমা দিতে। এবারের বই মেলায় আসছে তার মগজে সৃষ্ট এক খণ্ড রহস্য গল্প। নীল বাবা-মা হারা এক সন্তান। বছর খানেক আগে তার বাবা-মা খুন হয়। সেই থেকেই সে চুপচাপ। আগের মতো তেমন একটা কথা বলে না সে। তবে সর্বদা হাসবে সে, প্রশ্ন যেমনিই হোক উত্তর দেবার আগে একটুখানি হাসবে সে। বেশির ভাগ সময়ই সে হাসে ; হয়তো নিজের ভেতর থাকা কষ্টটা সে প্রকাশ করকে চায় না। কে জানে তার মনের খবর কী? তার বাবা-মা মারা যাবার পর থেকেই সে টুকটাক লেখালেখি শুরু করে। তার একাকীত্বের সঙ্গী হয়ে যায় এই লেখালেখি । . . পুলিশ অফিসারের ডেস্কের ওপর তুমুল ঝড় বয়ে যাচ্ছে। হাত দিয়ে টেবিলের ওপর একের পর এক চাপড় মেরে যাচ্ছেন জনাব আরিফুল। _ ‘আমার ছেলের লাশ দ্রুত ফেরত দে। না হলে তোর চাকরি খাবো।’ _ ‘আহা.! মশাই আপনি দেখি বাংলা কথা বুঝেন না। আপনার ছেলে ছিল একজন ধর্ষক, তার লিঙ্গ কেটে কেউ একজন হত্যা করেছে। লাশটি এখন পোস্টমার্টমের জন্যে পাঠানো হয়েছে। পোস্টমার্টম শেষে আপনার নিকট লাশটি ফেরত দেওয়া হবে তো। এখন শান্ত হন। ’ বলল পুলিশ অফিসার। _ ‘আমার ছেলেকে যে মেরেছে তাকে খুঁজে বের কর। ছাড়ব না আমি তাকে।’ পুলিশ অফিসার মৃদু হাসলেন। হেসে তিনি বললেন, ‘আগে নিজের ছেলের লাশটা অক্ষত অবস্থায় পাবেন কিনা সেটা ভাবুন। পোস্টমার্টম বুঝেন?’ জনাব আরিফুল ভ্রু কুঁচকাল। পুলিশ অফিসার একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলল, ‘লাশটির আগা মাথা পুরোটা কাটা হবে। কেটে পরীক্ষা করা হবে, তারপর আবার সেলাই করে জোড়া দিয়ে লাশটি আপনার নিকট হস্তান্তর করা হবে।বুঝলেন?’ জনাব আরিফুল একের পর এক দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলতে লাগলেন। পুলিশ অফিসার হাত নাড়িয়ে বললেন, ‘এমা প্রসার হাই করছেন কেনো? চিন্তার কিছু নেই তো। আমি একটা পদ্ধতি বলছি। আপনার তো অনেক উঁচুতে হাত তাই না? নিজের ক্ষমতা প্রয়োগ করুন।’ জনাব আরিফুল তার সাথে আসা ছেলেটাকে কারো কাছে কল দিতে বললেন। পুলিশ অফিসার থামিয়ে দিয়ে বললেন, ‘লাশ পাঁচটের পোস্টমার্টম করার নির্দেশে এসে গেছে-লিখিত নির্দেশ। তাই আমি বলছি কী মশাই এক কাজ করুন। মর্গ আর কোর্টে দৌড়ান। কোর্ট থেকে লিখিত নোটিশ নিয়ে আসুন।’ জনাব আরিফুল চুপ হয়ে গেলেন। পুলিশ অফিসার আবারও বলে ওঠলেন, ‘কোর্ট থেকে লিখিত নোটিশ ছাড়া আমাদের কাজে বাঁধা দেবার চেষ্টা করবেন না। আইনের পথের বাঁধা হতে যাবেন না ,পরের ছেলের বাঁচা কুচা লাশও পাবেন না। আউট। ’ জনাব আরিফুল থানা থেকে বেরিয়ে গেলেন। বের হবার সময় বললেন, ‘দেখে নিবো।সবাইকে দেখে নেব।’ পুলিশ অফিসার তার সহকারীকে বলল, ‘কেমন ছিল?’ _ ‘স্যার, একদম ফাটাফাটি। ’ _ ‘ভেবে ছিলাম লাশ উনার নিকট হস্তান্তর করে দিব। কিন্তু লোকটা প্রথমে থানায় ঢুকে যে আচরণ করলো! অতি ক্ষমতা দেখাতে গেলে এমনিই হবে।’ _ ‘তা ওই পাঁচ ধর্ষকদের যে হত্যা করেছে তাকে কী ধরবেন? নির্দেশ তো এসেছে ধরার।’ _ ‘ধ্যাত, পাগল। তোমার কী মনে হয় আমি ইনভেস্টিগেশন করবো?’ সহকারী মৃদু হাসল। পুলিশ অফিসার একটু হেসে বলল, ‘ধর্ষকের শাস্তি এক রায়ে মৃত্যুদণ্ডই হওয়া উচিত।’ . . _ ‘এই পাঁচটে লাশ পোস্টমার্টম করতে হবে।’ _ ‘এ তোমরা কেমন লাশ আনলে? লিঙ্গ কাটা, দুই হাতের কব্জি কাটা,পেট কাটা। নাড়ি ভুঁড়ি আছে তো ভেতরে?’ বলল জনাব তারেক। _ ‘পাঁচ ধর্ষকের লাশ, কোনো এক অজানা ব্যক্তি এদের হত্যা করেছে। ’ বাচ্চাদের মতো খিলখিলে হাসি হেসে জনাব তারেক বলল, ‘যাক,এত দিনে একটা সঠিক পোস্টমার্টম করতে পারবো। পাঁচটে পিশাচকে কাটার সুযোগ। এত দিন বহু নিরীহ লাশ কেটেছি, এবার কিছু পিশাচ কাটার পালা।’ . . _ ‘মা হলেন নিঃশ্বাস, বাবা হলে হৃৎপিণ্ড আর স্ত্রী? সে হলো দেহের অর্ধেকটা তাই তো তাকে বলে অর্ধাঙ্গিনী। আর বাকি অর্ধেকটা হলো জনসেবা।’ উচ্চস্বরে পড়লেন সম্পাদক মাসুদ আহমেদ। নীলের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে তিনি বললেন, ‘চিন্তা নেই গল্পটি ছেপে যাবে।আর হ্যাঁ, এই উক্তির জন্যে আমি তোমাকে ভদ্র কবি বলে ডাকব কেমন?’ নীল হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ালো, সেই সাথে মৃদু হাসল। সম্পাদক সাহেব নীলের দিকে এক দৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন। তিনি বললেন, ‘তোমার হাসিটা সুন্দর।’ কিছুক্ষণ খোশগল্প করার পর নীল নিজ বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিলো। . . অদ্ভুত এক পড়ন্ত বিকেল, আকাশ হালকা মেঘাচ্ছন্ন। মৃদু শীতল বাতাস বয়ে যাচ্ছে। লালচে আকাশটা অন্ধকারকে আহ্বান জানাচ্ছে। নীল টেবিলে বসে কিছু একটা হিসেব করছে- খুব মনোযোগ সহকারে। _ ‘এই পড়ন্ত বিকেল চাই না আমি তোমার হাত ধরে কাটাতে। চাইত শুধু চোখের দিকে তাকিয়ে কাটাতে। কারণ এই আকাশ হতে চোখের আকাশ বেশি প্রশান্তি দায়ক।’ কাগজে লিখছে নীল, হিসেব নয় বরং দিনলিপি। _ ‘কেউ একজন একদা বলেছিল আমায়, হবো কী তার নীল আকাশ? হেসে আমি বলি হয়ে তো কবেই গেছি। কিন্তু আজ সে নীল আকাশ হতে লুকিয়ে, কোনো এক ইট, বালির তৈরি দালানে।’ ডাইরীটা বন্ধ করে নিলো ওঠে দাঁড়ালো। ধীরে ধীরে চারিদিকে অন্ধকার ছেয়ে যেতে লাগলো। অন্ধকারের সাথে সাথে দিন ব্যাপি সাথে থাকা ছায়াও ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছে। রুমের বাতিটা জ্বালিয়ে ছায়াকে যাওয়া হতে আটকাল নীল। _ ‘ছায়া মশাই এত সহজে যেতে দিচ্ছি না। অন্ধকার দেখে আপনি পালিয়ে যাচ্ছেন, আমি তো আছি আলো দিতে।’ একটু থেমে আনমনে নীল বলে ওঠল, ‘একটু বেহায়া না হলে কীই বা ভালোবাসলাম?’ . . গভীর রাত, অন্ধকারের বুক চিড়ে একটা টুকরো আলো নিয়ে বিজয়ী বাদশার ন্যায় মাথার উঁচু করে আছে চাঁদটি। নীল কিছুক্ষণ চাঁদের দিকে তাকিয়ে রইলো। নীল বিড়বিড় করে বলে ওঠল, “হিমাংশুর পানে চাহিয়া ভাবি খালি দুঃখগুলা, যত ভাবি যাই তত লাপাতা হইয়া।’ রাত তখন তিনটে, চেয়ারের সাথে নিজেকে বাঁধা অবস্থায় দেখে ভূ পেয়ে চিৎকার দিতে লাগলো আরিফ। কালো পোষাক পরিধান করা এক ছেলে চাকু হাতে দাঁড়িয়ে। ছেলেটার দু'চোখ ছাড়া বাকি দেহ পুরো কালো কাপড়ে ঢাকা। আরিফ কাঁপা গলায় বলল, ‘কে তুমি?’ কোনো প্রত্যুত্তর না দিয়ে চাকু দিয়ে আরিফের ডান হাতের কব্জি কেটে দিলো ছেলেটা। আরিফ চিৎকার দিয়ে কাঁদতে লাগলো, ছেলেটা দেরি না করে আরিফের বাম হাতের কব্জিও কেটে দিলো। দেখতে দেখতে আরিফ মারা গেলো। . . আরিফের লাশ পোস্টমার্টমের জন্যে পাঠানো হচ্ছে। পুলিশ আরিফের কক্ষে কতগুলো মদের বোতল পেয়েছে,সেই সাথে একটা সিডি। যেখানে আরিফকে হত্যা করার পুরো দৃশ্য রয়েছে। খুব শান্ত মাথায় আরিফের দুই কব্জি কেটে তাকে হত্যা করা হয়েছে। হত্যাকারী সেই পাঁচ ধর্ষক হত্যাকারীই। দুইজনই কব্জি কাটে। আরিফের বাড়ি তল্লাশির পর পুলিশ বুঝতে পারল আরিফ মাদক চোরাচালানের সাথে যুক্ত। পুলিশ অফিসার তার সহকারীর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আরেকটা ভালো কাজ।’ . . _ ‘বাহ্! এ কেমন খুনীরে ভাই! মাত্র দু'দিনে এত মোটা ফাইল তৈরি করেছে?’গোয়েন্দা প্রধানকে উদ্দেশ্য করে বলল ফারহান। গোয়েন্দা প্রধান হেসে বলল, ‘পাঁচ জন ধর্ষক এবং একজন মাদক ব্যবসায়ীকে মেরেছে খুনী। দু'দিনে তাই এত মোটা ফাইল। কেসটা তোমাকেই একা সামলাতে হবে। তোমার সহকারী তো বান্দরবন গেছে কিছু ট্রেনিং নিতে, সেহেতু একা তোমাকেই কেসটা সামলাতে হবে।’ ফারহান হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ালো। . . জনাব করিম চিঠি হাতে শরিফ সাহেবের দিকে এগিয়ে গেলেন। ভাঙা গলায় তিনি বললেন, ‘স্যার,আপনার জন্যে চিঠি এসেছে।’ _ ‘এই আধুনিক যুগেও কেউ চিঠি পাঠায়? তাও আবার আমায়? হতচ্ছাড়াটা কে দেখি তো।’ চিঠি কোথায় থেকে এসেছে তা কোথাও লিখা নেই। চিঠিটা খুলতেই জনাব শরিফ থমকে গেলেন। চিঠিতে লিখা, ‘সময় এমনিই এক স্রোত যাকে থামানো যায় না, যার প্রবাহ সর্বদা একই রকম। কিন্তু সময়ের একটি ছায়া আছে। এই ছায়া কোনো একটা মানুষ রুপী পশুর সময় খেয়ে ফেলে। বুঝেছেন জনাব শরিফ সাহেব, হতে পারে আগামীকাল প্রতিটা খবরের চ্যানেলে আপনার ছবি থাকবে। আরে আরে কী ভাবছেন? আপনাকে তো আমি সেলিব্রেটি করবো।’ শরিফ সাহেবের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে, কান বেয়ে অল্প পরিমাণে কিছু ঘাম পরল। শরিফ সাহেবের সারাদিন চিন্তাগ্রস্ত অবস্থায় অতিবাহিত হলো। সূর্য যত পশ্চিম আকাশে হেলে পরছে, শরিফ সাহেবের ভয় ততই বৃদ্ধি পাচ্ছে। অন্ধকার নেমে আসতেই দুইজন লোক রুমের বাহিরে রেখে শরিফ সাহেব নিজ রুমে দরজা, জানলা বন্ধ করে বসে রইলেন। আজ রাতটা তাকে কোনো মতে পার করতে হবে। রাত একটা, চোখে রাজ্যের ঘুম ;তবুও শরিফ সাহেব জেগে আছেন। পুরো রাত তাকে না ঘুমিয়ে কাটাতে হবে। আচমকা বিদ্যুৎ চলে গেলো, রুমের বাতি নিভে যাবার সঙ্গে সঙ্গেই শরিফ সাহেব চিৎকার দিতে লাগলেন। রুমের বাহিরে থাকি ব্যক্তি দুইজন টর্চ লাইট হাতে রুমে প্রবেশ করলেন। তাদের দেখে শরিফ সাহেব কিছুটা শান্ত হলেন। _ ‘এই তোমরা আজ রাত আমার রুমেই থাকো।’ কাঁপা গলায় বললেন শরিফ সাহেব। ছেলে দুটো রুমের দরজা বন্ধ করে দিয়ে শরিফ সাহেবের দুই দিকে দুইজন বসে রইলো। রাত তখন তিনটে, বদ্ধ রুমে আচমকা খসখস শব্দ হচ্ছে। শরিফ সাহেব ছেলে দুইজনকে নির্দেশ দিলেন শব্দের উৎস খুঁজে বের করতে। আচমকা বিদ্যুৎ বেগে কিছু একটা এসে ছেলের দুটোর গলায় ঘুষি মারল। তৎক্ষণাৎ ছেলে দুটো মাটিতে লুটিয়ে পরল। শরিফ সাহেব দেখলেন একটা কালো ধোঁয়াটে কিছু একটা তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। বাতাসের বেগে ধোঁয়াটা এসে শরিফ সাহেবের গলা চেপে ধরল। শরিফ সাহেব চিৎকার দিতে চাইলেন কিন্তু কোনো কাজ হলো না। শরিফ সাহেবের হাত পা বেঁধে, কব্জি কেটে মেঝেতে ফেলে রাখল সেই অদ্ভুত ধোঁয়াটা। ধোঁয়া বললে ভুল হবে, ধোঁয়াটা সম্পূর্ণ একটা মানব রূপী। যে মানব চাইলে কালো ধোঁয়ায় পরিণত হতে পারে। শরিফ সাহেবের চোখে মৃত্যু দেখার ভয়। মৃদু আর্তনাদ করছেন তিনি, কিন্তু তা চার দেওয়ালের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। মারা যাবার পূর্বে শরিফ সাহেব দেখলেন তার বা পাশের দেয়াল ভেদ করে ধোঁয়াটে মানবটা চলে গেলো। চলবে….. পর্ব-২ ‘সকালটা যদি চায়ের কাপে চুমুক না দিয়ে শুরু হয় তাহলে কী চলে? মোটেও চলে না। পুরো দিনটাই হয়ে যায় মিষ্টি ছাড়া। দিনের শুরুটা তাই এক কাপ চা দিয়েই হতে হবে।’ মনে মনে বলল নীল। যতবারই সে চায়ের কাপে চুমুক দেয় ততবারই সে চায়ের প্রশংসায় মেতে ওঠে। ড্রয়ারের ভেতর থাকা নাইনএমের বন্দুকটার দিকে সে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো। . ‘সন্ধ্যা হয়ে এসেছে! আজ একটা সেমিনারিতে গেলাম। এক উটকো লোকের বিবৃতি বেশ ভাবাল আমায়। লোকটা অনেক বৃদ্ধ, এক পা কবরেতে গেছে চলে। রুক্ষ চামড়ার লোকটা বললেন তিনি নাকি জোয়াল কালে সময়ের ছায়াকে দেখেছেন। তিনি তার বিবৃতির শিরোনাম দিয়েছেন ‘দ্যা শ্যাডো অফ টাইম’। কবিদের এই সেমিনারিতে লেখালেখি কিংবা সাহিত্য নিয়ে কথা না বলে এমন রূপকথার গল্প বলা নিরর্থক। তবে গল্পটা বাকিদের বেশ ভালোই লেগেছে। সময়ের ছায়া, এই শব্দটাই তো মানুষের মনের আগ্রহ বাড়িয়ে দেয়। যাই হোক সময়ের ছায়াও আছে শুনে বেশ অবাক হলাম। কিছু কথা যেন উনার স্মৃতিকাতরতা ছিল, আমার কাছে এমন মনে হয়েছিল। ’ পথের ধার ঘেঁষে হাঁটতে হাঁটতে ভাবল নীল। . . _ ‘আপনাকে বেশ চিন্তিত দেখাচ্ছে। এর হেতু কী? ’ গোয়েন্দা প্রধানকে প্রশ্ন করলো ফারহান। _ ‘আরেকটি খুন হয়েছে, কব্জি কেটে খুন করা হয়েছে। সেই একই খুনী। এবার যাকে খুন করা হয়েছে সে মাদক ব্যবসার সাথে যুক্ত। আর আমি বুঝতে পারছি না তুমি এখনো কেস নিয়ে কোনো কাজ করা শুরু কেনো করোনি? এমন গাফিলতি কেনো?’ _ ‘প্রথম কথা হলো খুনী ভালো কাজ করে যাচ্ছে, দ্বিতীয়ত আমি চাচ্ছি খুনী আরো তিন চারটে খুন করুক। তারপর আমি তাকে ধরবো। কিছু নর্দমার কীট তো সাফ হবে তাই না?’ _ ‘নো.! আজ থেকেই কাজ শুরু করে দেও। অনুরোধ নয়, নির্দেশ দিচ্ছি তোমায়। খুনীকে ধরতে হবেই, যত দ্রুত সম্ভব।’ _ ‘ঠিকাছে। আমি তাহলে এখুনি বের হচ্ছি ; কেস সম্পর্কিত সকল খুঁটি নাটি তথ্যাদি সংগ্রহ করতে।’ ফারহান রুম থেকে বের হতে নিলো, গোয়েন্দা প্রধান বাঁধা দিলেন। _ ‘কেসটা যতটা সহজ মনে হচ্ছে ততটা নয়। খুনী যাদের মেরেছে তাদের হাত উঁচু পর্যায়ে ছিল। এর অর্থ খুনী যাদের মেরেছে তাদের কিন্তু কড়া নিরাপত্তা ছিল, তবুও তারা মারা গেছে। খুনী খুব শান্ত মাথায় সময় নিয়েই প্রতিটা খুন করেছে। তোমাকে সহায়তা একজন বিজ্ঞ গোয়েন্দা সহায়তা করবেন।’ গোয়েন্দা প্রধান ফোন করে কাউকে ভেতরে পাঠাতে বললেন। মিনিট দুয়েক পর ষার্ট বছর বয়সী একটা বৃদ্ধা দরজা ঠেলে রুমের ভেতর প্রবেশ করলেন। ফারহান আড় চোখে বৃদ্ধ লোকটার দিকে তাকিয়ে রইলো। বৃদ্ধ লোকটাকে ভেতরে প্রবেশ করতে দেখে গোয়েন্দা প্রধান ওঠে দাঁড়ালেন। বৃদ্ধ লোকটাকে বেশ সম্মানের সহিত গোয়েন্দা প্রধান বসতে বললেন। বৃদ্ধ লোকটার পাশে এসে বসল ফারহান। গোয়েন্দা প্রধান বৃদ্ধ লোকটাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘জনাব সাধু কেমন আছেন?’ _ ‘বিধাতার অশেষ রহমতে অনেক ভালোই আছি।’ ফারহান কপাল ভাজ করে গোয়েন্দা প্রধানের দিকে তাকিয়ে রইলো। গোয়েন্দা প্রধান হেসে বললেন, ‘উনার সাধু, উনি কথাও বলেন সাধু ভাষা। আবার উনি সাধুর মতোই সাধু সুলভ। মানে সাধুই সাধু।’ সাধু ফারহানের কাঁধে চাপড় মেরে বলল, ‘তো প্রিয় বৎস, অতি অল্প বয়সে গোয়েন্দাগিরিতে পা রাখিয়াছ। পরিবার পরিজনের কথা ভাবিয়া কখনো নিজ দায়িত্ব হইতে সরিয়া যাইবা না। বিশেষ করে প্রেমিকা হইতে দশ হাত দূরত্ব বজাইয়া রাখিবা। আমার কথা কী বোধগম্য?’ ফারহান মনে মনে একটু হাসল। _ ‘কাজের কথায় আসি?’বলল ফারহান। সাধু হ্যাঁ সূচক উপর হতে নিচে মাথা নাড়ালো। _ ‘খুনী সম্পর্কে আমি কয়েকখানা তথ্য জোগার করিয়াছি। খুনী খুবই শান্ত মস্তিষ্কে, সময় লইয়া দু'হাতের কব্জি কাটিয়া হত্যা করিয়া থাকে। আর খুনী একজন সৎ খুনীও বটে। হেতু সে নরপিশাচদেরই মারিয়া থাকে। তবে একটা লক্ষ্য করিয়াছি, তা হলো খুনী বুকেতে ভয় নাই। তাই সে এতগুলা খুন করিবার পরও ভয় না পাইয়া পরবর্তী খুনের পরিকল্পনা করিতেছে। দ্রুত তাকে ধরিতে হইবে, নইলে আরো অনেক খুন হইবে।’ ফারহান মিনিট দুয়েক চুপ থাকার পর ক্ষীণ গলায় বলল, ‘খুনী কষ্টে কাতর হয়তো! হয়তো তার কোনো আপনজন নেই, তাই সে কাউকে ভয় পায় না। কারণ সে জানে তার হারানোর মতো আর কিছুই নেই। তাই সে নরপিশাচদের হত্যা করে যাচ্ছে। যাতে অন্য কেউ তার প্রিয়জন না হারায়।’ . . রাত তখন আনুমানিক একটা। একটা কালো ধোঁয়া আরাফাতের পুরো কক্ষ তার দখলে নিয়ে নিয়েছে। কাশতে কাশতে আরাফাতের ঘুম ভেঙে গেলো। আশে পাশে তাকিয়ে ধোঁয়া দেখে সে ঘাবড়ে গেলো। _ ‘বাড়িতে আগুন লেগেছে নাকি.!’ আরাফাত চিৎকার দিকে নিলো ঠিক তখনি সে হতভম্ব হয়ে সামনে তাকিয়ে রইলো। ধোঁয়াগুলো ধীরে ধীরে এক সাথ হয়ে একটা মানব রূপ নিচ্ছে। পুরো দেহ তার কালো, শুধু দুই চোখ তার দেখা যাচ্ছে। ভয়ে আরাফাত কাঁপতে লাগলো। চিৎকার দেবার চেষ্টা করলো, কিন্তু সফল হলো না। ভয় তার গলা চেপে ধরেছে। মগজে ভয় নামক এক দীর্ঘ দাগ পড়েছে। ধোঁয়াটা মানব রূপ নেবার সাথে সাথেই লাফ মেরে বসে থাকা আরাফাতের বুকে লাথি মারলো। আরাফাতের মুখ দিয়ে অল্প পরিমাণে রক্ত বেরিয়ে আসলো। ধোঁয়াটা বলে ওঠল, ‘কাল থেকে তার আশে পাশেও যেন তোকে না দেখি।’ আরাফাত কোনো মতে বলে ওঠল, ‘কার আশে পাশে?’ ধোঁয়াটা আরাফাতের নিকট থেকে কিছুটা দূরে সরে গেলো। _ ‘সময়ের স্রোতে শুধু ভালো মানুষেরাই ভাসতে পারে। এখানে খারাপ মানুষের কোনো জায়গা নেই। খারাপ মানুষের স্থান হলো সময়ের ছায়াতে। যেই ছায়া একদিন তাদের কাল হয়ে দাঁড়ায়।’ _ ‘ক..কে তুমি? কী যা তা বলছেন.! আমি আপনার কী ক্ষতি করেছি? ’ কিছুটা সাহস জুগিয়ে বলল আরাফাত। ধোঁয়া মানব আচমকা ক্ষিপ্র গতিতে এসে আরাফাতের গালে এক চড় মারল। আরাফাতের গাল ফেটে রক্ত গড়িয়ে পড়তে লাগলো। _ ‘আজ যেই মেয়েটাকে জ্বালিয়েছিস তার থেকে দশ হাত দূরে থাকবি। নাহলে তুই আমার হাতে মরবি।’ কথাটা বলেই ধোঁয়াটা অদৃশ্য হয়ে গেলো। ধোঁয়াটা অদৃশ্য হবার পূর্বের আরাফাত বলল, ‘অনিশা?’ . . _ ‘তোমার ঘর দেখিতেছি সম্পূর্ণ ফাঁকা হইয়া রইয়াছে। না রইয়াছে মানুষ না আসবাবপত্র। ’ফারহানকে বলল সাধু। _ ‘একদা এই বাড়িতে সারাদিন হাসির রোল পরে থাকতো। কিন্তু সময় সব বদলিয়ে দিয়েছে। এখন শুধু স্মৃতি নিয়েই আমি এই বাড়িতে থাকি।’ _ ‘হাওয়া, বাতাস, বায়ু সবটাই তাহলে এখন স্মৃতি বাহন।’ ফারহান প্রত্যুত্তরে বলল, ‘আমাদের উচিত কেসের কাজ মন দেওয়া।’ _ ‘মন তো কবেই দিয়া ফেলিয়াছি। কিন্তু প্রিয় তুমি তো এখনো কেসে মন দিতে সক্ষম হও নাই। আমি অনেক তথ্য সংগ্রহ করিয়াছি। আজ থানা হতে খবর পাইয়াছি এক বালককে নাকি একটা কালসে ধোঁয়া গত রাতে আক্রমণ করিয়াছে। বিবরণ শুনিয়া পুলিশ অফিসার বালককে শ্রেফ পাগল বলিয়া সম্বোধন করিয়াছে। ললাটের লিখন ভালো ছিল বলিয়া আমি সেখানে উপস্থিত ছিলাম। বালককে বলিয়াছি আমার সঙ্গে দেখা করিতে। ঠিকানা তোমার বাড়িরই দিয়াছি। কিছু প্রহর পরেই সে এখানে উপস্থিত হইয়া যাইবে।’ _ ‘সবটা তো বুঝেছি। কিন্তু আপনি একটু চলিত ভাষায় কথা বলতে পারেন না?’ সাধু মৃদু হাসলো। . . _ ‘নীল! তোমার হাতের রগগুলো কালো হয়ে আছে কেনো? আর মুখ ফোলা কেনো? তুমি কী গত রাতে নেশা টেশা করেছ নাকি!’ নীলকে প্রশ্ন করলো নীলের চাচা। চাচার কথা শুনে নীল বলল, ‘না তেমন কিছু না। শরীরটা একটু খারাপ লাগছে। তা আপনি কখন আসলেন?’ _ ‘এই মাত্র এসেছি। তোমার ঘরের দরজাও খোলা ছিল। এত উদাসীন হলে হবে কী?’ নীল কিছু বলল না চুপ করে শুয়ে রইলো। চলবে…. পর্ব-৩ আরাফাত,আরাফাত! আরাফাত আরাফাত করে চিৎকার দিয়ে ডাকছেন জনাব মহিন উদ্দিন। আরাফাত রুম থেকে দ্রুত বেরিয়ে বাবার নিকট গেলো। _ ‘তোমার এই অবস্থা কে করেছে? আর আমাকে জানাও নাই কেনো?’ _ ‘বাবা আমি ঠিকাছি।’ নরম গলায় বলল আরাফাত। চিৎকার দিয়ে আরাফাতের বাবা বললেন, ‘কিসের ঠিক আছ? গাল ফেটে গেছে তোমার। আর তুমি বলছ ঠিক আছ?’ _ ‘এই দারওয়ানের বাচ্চা।’ চিৎকার দিয়ে আরাফাতের বাবা দারওয়ানকে ডাকলেন। দারওয়ান এসে আরাফাতের বাবাকে বললেন, ‘আসলে স্যার কিভাবে যে বহিরাগত কেউ বাড়িতে প্রবেশ করে ফেলল আ…’ দারওয়ান আর কিছু বলার পূর্বেই আরাফাতের বাবা একের পর এক চড় দিতে লাগলেন। যতক্ষণ অব্দি না গাল ফেটে রক্ত গড়িয়ে পরছে। র _ ‘বাবা,থামেন! কী করছেন আপনি!’ আরাফাতের বাবা দারওয়ানকে চড় মারা থামিয়ে দিলেন ।দারওয়ান থেকে দ্রুত পায়ে হেঁটে চলে গেলেন। _ ‘মামলা করেছিস?’ আরাফাতকে প্রশ্ন করল আরাফাতের বাবা। _ ‘ করতে থানায় গিয়েছিল, কিন্তু ঘটনার বিবরণ শুনে পুলিশ অফিসার আমায় পাগল বলে সম্বোধন করেছেন।’ আরাফাতের বাবা ক্ষ্যাপে গিয়ে বললেন, ‘কিহ! পুলিশ অফিসারের এত বড় সাহস। শালার চাকরিটা এবার আমি খাবো।’ আরাফাতের বাবা আরাফাতের মুখে পুরো ঘটনার বিবরণ শুনে নিলেন। পুরোটা শুনে তিনি চিন্তায় পরে গেলেন, ‘অদ্ভুত! এটা তো সম্ভব নয়।’ _ ‘আমি এখনো বুঝে ওঠতে পারছি না, গত রাতে এ কী হলো আমার সাথে। আমার কাছে এখনো সবটা স্বপ্নের মতো লাগছে। হুট করে একটা দমকা কালো ধোঁয়া এসে আমাকে আঘাত করে আবার হুট করেই গায়েব হয়ে গেলো।’ _ ‘তার মুখ দেখেছিলি?’ _ ‘না! শুধু দু'চোখ দেখেছি।’ _ ‘ দুই চোখ দেখতে কেমন ছিল?’ _ ‘চোখ দুটো সাধারণ মানুষের ছিল। কিন্তু..!’ _ ‘কিন্তু?’ কিছুটা থেমে, আরাফাত একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলল, ‘অসম্ভব ভয়ঙ্কর ছিল। ভ্রু গুলো নাক বরাবর বাকা হয়ে ছিল। দুই চোখের মণি একদম মাঝে ছিল। চোখের পলক পরছিল না। বাম চোখের পাতায় বড় একটা কালসে দাগ ছিল। বিভৎস ছিল! সাধারণ চোখের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি এতটা বিভৎস হতে পারে আমার জানা ছিল না। ’ আরাফাতের বাবা লক্ষ করলেন আরাফাতের হাতের লোমগুলো দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। . . পুলিশ অফিসারের ডেস্কের সামনে বসে আছেন জনাব মহিন উদ্দিন সাহেব। পাশে বসে আছে তার একমাত্র ছেলে আরাফাত। পুলিশ অফিসার পুরো ঘটনা শুনে একটু হাসলেন। _ ‘মানসিক ডাক্তারের কাছে যান আপনারা। দেখেন আপনার ছেলের ওপর আক্রমণ করেছে কেউ একজন, এই মামলা করলেও আমি গ্রহণ করতাম। কিন্তু আপনার এর সাথে একটা ভৌতিক ঘটনা জুড়ে দিয়েছেন। যার কোনো হেতু নেই। যে কেউ শুনলে বলবে আপনার ছেলের মানসিক ভারসাম্য ঠিক নেই।’ আরাফাতের বাবা কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। একটু পর তিনি বললেন, ‘ঠিকাছে, বিষয়টা আমি আমার কৌশল প্রয়োগ করার মাধ্যমে সুরাহা বের করি?’ পুলিশ অফিসার ঠোঁট উচকিয়ে বললেন, ‘যা ইচ্ছে করেন।’ আরাফাতের বাবা আরাফাতকে নিয়ে সেখান থেকে হনহন করে বেরিয়ে গেলো। _ ‘কী সব পাগল, ছাগল যে আসে.!’ মনে মনে বললেন পুলিশ অফিসার। আচমকা পুলিশ অফিসারের ফোন বেজে ওঠল। ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে তিনি বললেন নীল কল দিয়েছে। ফোনটা তিনি ধরলেন। _ ‘হ্যাঁ, বাবা নীল, শরীর এখন কি ঠিকাছে?’ বললেন পুলিশ অফিসার। _ ‘এই তো চাচাজান মোটামুটি আছি। জ্বরটা কমছেই না। ঘরে ঔষধ পত্রও নেই। শরীরে বলো পাচ্ছি না, যে ফার্মেসিতে গিয়ে ক্রয় করবো।’ _ ‘আচ্ছা, ঠিকাছে। আমি যাবার পথে ঔষধ নিয়ে যাব। সেই সাথে আমার চেনা জানা এক ভালো ডাক্তার’কেও আমার সঙ্গে নিয়ে যাবো। তুমি রেস্ট নেও।’ _ ‘আচ্ছা! চাচা!’ পুলিশ অফিসারই হলেন নীলের চাচা। . . _ ‘হাই প্রেসার! ছেলেটা অনেক টেনশন করে। আমি কিছু ঔষধ লিখে দিচ্ছি, আশা করি মাথা ব্যথাটা কেটে যাবে। ’ বললেন ডাক্তার। নীলের চাচা মাথা নাড়ালেন। ডাক্তারকে বিদায় জানিয়ে নীলের পাশে এসে বসলেন তিনি। _ ‘নীল, আমার কথা মন দিয়ে শোনো। কিছুদিন আমার সাথে আমার বাড়িতে থাকো। এ বাড়িতে থাকলে প্রতি মুহূর্ত তোমার অতীতের কথা মনে পরে যায়। দেখো আমি বলছি না অতীত ভুলে যেতে, কারণ আজকের বর্তমান তো তোমার অতীতেরই একটা রূপ। কিন্তু পুরোপুরি অতীত নিয়ে পরে থাকলে তো চলবে না। একটু তো বোঝার চেষ্টা করো।’ নীল চুপচাপ উনার দিকে তাকিয়ে রইলো। _ ‘ আচ্ছা তোমায় আমি একটা গল্প বলছি, মন দিয়ে শোনো। একদা একটি দ্বীপ ছিল। যেখানে সকল অনুভূতির বসবাস ছিল ; সুখ, দুঃখ, জ্ঞান, ধনী, অহংকার সবাই ছিল, তাদের পাশাপাশি ভালোবাসাও ছিল। একদিন দ্বীপে ঘোষণা দেয়া হয় যে দ্বীপটি পানির নিচে তলিয়ে যাবে। সুতরাং সকল অনুভূতিরা যেন তাদের নৌকা তৈরি করে দ্বীপ থেকে পালানোর জন্যে প্রস্তুতি নেয়। সকল অনুভূতিরা তাদের নৌকা তৈরিতে ব্যস্ত হয়ে পরল, শুধু মাত্র ভালোবাসা বাদে। ভালোবাসাই একমাত্র সেখানে শেষ মুহূর্ত অব্দি থাকার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু যখন দ্বীপটি প্রায় পুরোপুরি ডুবে যাচ্ছিল তখন ভালোবাসা সিদ্ধান্ত নেয় সে সাহায্য চাইবে। ধনীর একটি বিশালাকার নৌকা ছিল। ভালোবাসা ধনীর কাছে গিয়ে বলে, ‘ধনী, তুমি কি আমায় তোমার সাথে নিয়ে যেতে পারবে?’ ধনী গম্ভীর গলায় বলল, ‘না! আমার নৌকা স্বর্ণ, মুদ্রায় ভরপুর। তোমাকে নেবার মতো জায়গা নৌকাতে নেই।’ দ্বীপের ওপর ওঠা পানিতে ভালোবাসা ভিজে গেলো। সে সিদ্ধান্ত নিলো, সে অহংকারের কাছে সাহায্য চাইবে। যেই ভাবা সেই কাজ। সে অহংকারের কাছে গিয়ে অনুরোধ করলো, ‘অহংকার তুমি কী আমায় তোমার সাথে নিয়ে যেতে পারবে’ অহংকার কিছুটা রেগে গিয়ে বলল, ‘কখনই না। তুমি ভিজে গেছো। তোমাকে আমার নৌকাতে নিলে আমার নৌকার ক্ষতি হতে পারে। আমি তোমাকে আমার সাথে নিয়ে যেতে পারবো না।’ দুঃখ ভালোবাসার পাশ দিয়ে চলে যাচ্ছিল। ভালোবাসা দুঃখকে দেখে তার কাছে অনুরোধ করলো, ‘দুঃখ,আমায় তোমার সাথে নিয়ে যাও।’ দুঃখ প্রত্যুত্তরে বলল, ‘ভালোবাসা আমায় ক্ষমা করো,আমাকে এখন নিজের কথা ভাবতে হবে।’ দুঃখ চলে গেলো। একইভাবে ভালোবাসা সুখের কাছেও অনুরোধ করে কিন্তু সে তার ডাকে সাড়া না দিয়ে, মুখ ফিরিয়ে চলে যায়। কিন্তু সুখ খুবই খুশি ছিল যে সে ভালোবাসার ডাকে সাড়া দেয়নি। সকল অনুভূতি যে যার মতো চলে যাবার প্রস্তুতি নিতে লাগলো। অসহায় ভালোবাসা মন খারাপ করে বসে রইলো। আচমকা একটি কণ্ঠ ভালোবাসাকে বলল, ‘আমার সাথে চলো ,আমি তোমায় নিরাপদ স্থানে নিয়ে যাবো।’ ভালোবাসা খুবই খুশী হলো, তাড়াহুড়ো করে সে তার সাথে দ্বীপ ছেড়ে নিরাপদ স্থানে চলে গেলো। তাড়াহুড়োর কারণে ভালোবাসা সেই সহায়তাকারীর নাম জিজ্ঞেস করতেই ভুলে গেলো। নিরাপদ স্থানে ভালোবাসাকে পৌঁছে দিয়ে সহায়তাকারী কোথাও চলে গেলো। ভালোবাসা থাকে খুঁজল, কে সে জানার জন্যে । কিন্তু পেলো না। সে জ্ঞানকে জিজ্ঞেস করলো, ‘আচ্ছা,আমাকে সাহায্য করেছিল? জ্ঞান প্রত্যুত্তরে মৃদু স্বরে বলল, ‘এটা ছিল সময়, যে তোমায় সাহায্য করেছিল।’ নীলের চাচা থামতেই নীল বলল, ‘কিন্তু এখনো আমার কাঙ্ক্ষিত সময় আসেনি। গল্পটা ভালো ছিল, অনেক কিছু অনুধাবন করা সম্ভব। কিন্তু আমার সময় এখনো আসেনি। আশা করি বুঝতে পারছেন আমি কী বুঝাতে চেষ্টা করছি। আমাকে এখানেই থাকতে দিন।আমার বাড়িতে থাকবো আমি। এখানে আমার শৈশব কেটেছে, অনেক মধুর স্মৃতি রয়েছে এই বাড়িতে। হোক কষ্টদায়ক! স্মৃতিগুলো আমি ছাড়তে চাই না। মাফ করবেন!আপনার সাথে যেতে পারবো না। দুঃখিত!’ . . সাধু এবং ফারহানের সামনে বসে আছেন আরাফাত এবং আরাফাতের বাবা। আরাফাত সবটা খুলে বলল। শুনে ফারহান ভ্রু কুঁচকিয়ে বলল, ‘অদ্ভুত! ’ সাধু এক ফোঁটাও অবাক হলো না। তিনি বললেন, ‘বিষয়টা আমরা দেখছি। আমাদের ওপর ভরসা রাখতে পারেন।’ আরাফাতের বাবা এক গাল হাসলেন। হেসে তিনি বললেন, ‘যেভাবেই হোক আমার ছেলেকে যে আক্রমণ করেছে তাকে ধরবেন। বিনিময়ে যত লাগবে আমি দিব।’ সাধু হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ালো। আরাফাত এবং আরাফাতের বাবা কিছুক্ষণ পর চলে গেলো। ফারহান সাধুকে প্রশ্ন করল, ‘ঘটনার বিবরণ শুনে আপনি একটুও বিচলিত হলেন না?’ _ ‘আরাফাতকে যে আক্রমণ করেছে সে হলো একটা ছায়া। দ্যা শ্যাডো। ছায়াটা সময়ের সাথে পাল্লা দেবার চেষ্টা করছে। সময়ের ছায়া হবার বৃথা চেষ্টা।’ ফারহানের কৌতুহল শত গুণে বেড়ে গেলো। সে বলল, ‘সবটা খুলে বলুন। আর আপনি হঠাৎ চলিত ভাষায় কেনো কথা বলছেন?’ চলবে…… পর্ব-৪ হিম শীতল ঠাণ্ডা ঘরের ভেতর বন্দি করে রাখা হয়েছে নীলকে। শীতে সে কাঁপছে, দাঁতের সাথে তার দাঁত বারবার লেগে যাচ্ছে। সে বারবার আকুতি মিনতি করছে, ‘ছেড়ে দেও আমায়। আমি কিছু করিনি।’ আরাফাতের বাবা জনাব মহিন উদ্দিন তার কালসে দাঁতগুলো বের করে হাসতে লাগলেন। কালসে বত্রিশ পাটি দাঁতের এক বিভৎস হাসি হাসলেন তিনি। লোকটার গা গরম পোশাকে মুড়ানো। হাতে একটা লোহার রড, তেল মাখানো লোহার রড। পৈশাচিক এক হাসি দিয়ে তিনি বললেন, ‘আমার ছেলে তুই আক্রমণ করেছিলি।’ _ ‘আমি করিনি। ’ কাঁপা গলায় বলল নীল। _ ‘যেই মেয়েটাকে বিরক্ত করতে ছায়াটা নিষেধ করেছিল, সেই মেয়েটার নাম হলো অনিশা। আর অনিশা তুই খুব পছন্দ করিস তাই না? তোদের তো কোনো এক সময় সম্পর্কও ছিল। ছায়াটা যে তুই তার প্রমাণ কী আরো দিব?’ _ ‘ছায়াটা যদি আমিই হ’তাম তাহলে আপনি এখন অক্ষত অবস্থায় আমার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে পারতেন না। আমি নই ছায়াটা, আমি জানি না ছায়াটা কে! অনিশার সাথে তার কী যোগসূত্র তা আমার জানা নেই। ’ শান্ত গলায় বলল নীল। লোহার রড দিয়ে কষে নীলের গালে আঘাত করলেন জনাব মহিন উদ্দিন। নীলের একটা দাঁত ভেঙে নিচে পরল, সেই সাথে গালে কেটে রক্ত বের হতে লাগলো। মহিন উদ্দিন হাসতে লাগলেন। _ ‘আর হ্যাঁ, যেই মেয়েটার জন্যে তুই আমার ছেলের গায়ের হাত তুলেছিস সেই মেয়েটাকে তো আমি..!’ নীলের কান জোড়া খাড়া গয়ে গেলো। স্থির দৃষ্টিতে জনাব মহিন উদ্দিনের দিকে সে তাকিয়ে রইলো। তিনি নীলের চোখের ভাষাটা বেশ বুঝতে পারলেন। তিনি এক গাল হাসলেন। রাগান্বিত গলায় নীল বলল, ‘পৈশাচিক হাসি দিয়ে আমায় ভয় দেখানোর বৃথা চেষ্টাটা বাদ দিন। আমি ভয় পাই না, সৃষ্টি কুলের কাউকেই নয়। আমার হারানোর মতো কেউ নেই। আমি ভয় পাই না। এই টানা হাসি আমায় মানায়।’ লোহার রডটা দিয়ে জনাব মহিন উদ্দিন নীলের আরেক গালে কষে জোড়াল এক আঘাত করলো। গাল কেটে রক্ত বের হতে লাগলো। নীল একটা টানা হাসি হেসে জিহ্বা বের করে গাল হতে বেয়ে পরা রক্তগুলো চেটে খেয়ে ফেলল। চোখের দৃষ্টি তার তীক্ষ্ণ। আহত সিংহের মতো গর্জন দিচ্ছে নীল। জনাব মহিন উদ্দিন কিছুটা ঘাবড়ে গেলেন। শীতল রুম থেকে তিনি বেরিয়ে গেলেন। রুমের বাহিরে দাঁড়িয়ে তিনি কাউকে ফোন করে বললেন, মেয়েটাকে তুলে নিয়ে আসতে। ফোন রাখতেই হিংস্র এক গর্জনের শব্দ ভেসে আসল। নীলের হিংস্র চিৎকার। জনাব মহিন উদ্দিন লোহার রডটা নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলেন, নীলের নিকট গিয়ে একের পর এক আঘাত করতে লাগলেন। . . পুলিশ অফিসার তথা নীলের চাচা প্রতিবেশী হতে জানতে পারলেন নীল কারা জেনে জোর পূরক তুলে নিয়েছে । সড়কের মোড়ে থাকা সিসিটিভি ফুটেজ হতে তিনি জানতে পারলেন কাজটা জনাব মহিন উদ্দিনের। হিসেবটা তিনি মেলাতে পারলেন না, কেন নীলকে অপহরণ করবে? কিছুক্ষণ ভাবতেই উত্তরটা মগজে এসে হাজিরা দিয়ে গেলো। দুটো কারণে নীলকে অপহরণ করা হতে পারে :- প্রথমত নীল অনিশাকে পছন্দ করত। দ্বিতীয়ত মহিন উদ্দিনের কেস তিনি না নেবার নীল ওপর জুলুমের মাধ্যমে প্রতিশোধ নিতে চাচ্ছেন। . . সাধু একটা সিগারেট ধরালেন। দুটো টান মেরে তিনি বললেন, ‘মন স্থির রাখো। আমি যা বলতে চলেছি তা স্বাভাবিক ঘটনা নয়।’ ফারহান মৃদু হাসল, ‘এমন তাণ্ডব করা চরিত্রের সাথে আমি পূর্ব পরিচিত। দেখা যাক সময়ের ছায়া কোন ধরনের তাণ্ডব।’ সাধু সিগারেটটা ফেলে দিলেন। রুমে কিছুক্ষণ পায়চারি করতে লাগলেন, সেই সঙ্গে বিড় বিড় করে কিছু বলতে লাগলেন। কিছুক্ষণ পর সাধু ফারহানের কাছে এসে বসলেন। _ ‘বিড় বিড় করে মন্ত্র তো আর পাঠ করছিলেন না। যতদূর অনুমান আমার, আপনি মনে হয় আমায় যা বলবেন তা একবার বাতাসকে বলে চর্চা করে নিলেন। যাতে আমাকে বোঝাতে কোনো প্রকার অসুবিধে যেন আপনার না হয়।’ বলল ফারহান। _ ‘আগের তোমার প্রথম প্রশ্নের উত্তর দিই। তুমি প্রশ্ন করেছিলেন হঠাৎ চলিত ভাষা কেন্র কথা বলছি। আমি চলিত ভাষায় তখনি কথা বলি যখন রহস্যটা কিছু আমি আন্দাজ করতে সক্ষম হই। আমি ঘটনার বিবরণগুলো দেখার পর আমার মগজে সর্বপ্রথম সময়ের ছায়া শব্দটা উঁকি মারে। এখন দেখি আমার অনুমানটা শতভাগ সঠিক। ’ _ ‘ তাহলে জনাব রহস্য আর রহস্যের মায়াজালে না রেখে কিছুটা উদঘাটন করেই দিন।’ _ ‘আর হ্যাঁ যেই ব্যক্তিটাকে আমরা সময়ের ছায়া বলে সম্বোধন করছি ,সেই ব্যক্তিটাকে যদি আমরা ধরতে পারি ;তাহলে তার কাছ থেকে আমরা সে কিভাবে সময়ের ছায়া হয়েছে শুনব, তা আমাদের এত দিনের কথোপকথনের চেয়েও বেশি হবে বলে মনে করছি।’ _ ‘বেশ, তাই হোক। রহস্যময় ঘটনা শুনতে আমার হেব্বি লাগে। ’ _ ‘সময় তো বুঝই? সময়ের যে স্রোত আছে সেটাকে কে তো থামানো সম্ভব নয়। সময় ভ্রমণ নিয়ে অনেক মতভেদ আছে। তবে সময়ের ছায়াটা এক প্রকার সময়ের ভ্রমণ করতে সক্ষম ব্যক্তিকেই বোঝায়। তবে ঠিক পুরোপুরি তেমন হয়। সময়ের যে প্রবাহটা আছে সেখানেই থাকবে সেই ব্যক্তিটা। সময় ভ্রমণ করে না এগিয়ে যাবে, না পিছিয়ে যাবে। কিন্তু সময় ভ্রমণের জন্যে আলোর চেয়েও বেশি বেগে ছুটতে হবে। হয়তো শুনছ । এত বেগে ছুটতে নিশ্চয়ই অনেক শক্তি লাগবে, সেই সাথে বেগে বৃদ্ধির সাথে সাথে শক্তিটাও বাড়বে। এই যে শক্তিটা উৎপন্ন হচ্ছে সেটা সময় ভ্রমণ করতে গেলে হবে । কিন্তু কোনো ব্যক্তি যদি বিনা সময় ভ্রমণ করে এই শক্তিটা পেয়ে যায়? যেকোনো সময় যদি এই শক্তিটা আনতে পারে?’ _ ‘অর্থাৎ এমন এক ব্যক্তি যে কিনা সময় ভ্রমণ করার মতো ক্ষমতা রাখে। সেই পরিমাণ শক্তি, বেগ তার আছে। অদ্ভুত! মানে সে নিজেই কিছুটা সময়ের মতোই!’ _ ‘তাই তো সময়ের ছায়া তার নাম। জানি না সে তার ক্ষমতা কিভাবে পেয়েছে, আর তার ক্ষমতার সীমাবদ্ধ সম্পর্কে অবগত কিনা । এমনও হতে পারে ব্যক্তিটা ভবিষ্যৎ থেকে আসছে। এসে নিজের কাজ করে আবার চলে যাচ্ছে। যদি নিজ শক্তি সম্পর্কে অবগত হয় তাহলে বারবার সে সময় ভ্রমণ করার কথা। আর যদি না জেনে থাকে তাহলে সে আমাদের সময়েরই হবে। হয় সে এই ক্ষমতার শেষ লিমিটটা জানে না। এটাও হতে পারে সে শক্তিটা খুব কম ভাবে। তাই তার ব্যবহারের পরিসরও কম। সবই অনুমান মাত্র। ব্যক্তিটাই ভালো জানে। তাকে ধরতে হবে।’ _ ‘আমার তো তরই সইছে না। যেভাবেই হোক তাকে ধরতে হবে। সে শুধু অতি মানব নয় বরং একটা বিশাল রহস্যের খণ্ডও বটে।’ সাধু মুচকি হাসল। সেই সাথে ফারহানও। . . নীলের লোকেশন ট্রেস করে নীলের চাচা বদ্ধ গোডাউনের সামনে এসে দাঁড়ালেন। সাথে রয়েছে কয়েক জন পুলিশ। গোডাউনের ভেতর প্রবেশ করতেই থামকে দাঁড়ালেন তিনি । রক্তের স্রোত! মেঝেতে টাটকা রক্ত। সামনে পরে আছে মহিন উদ্দিন ছিন্ন বিচ্ছিন্ন লাশ। হাতের কব্জিগুলো কাটা, নাভি হতে পেটের বাম পাশ পুরো কাটা। নাড়ি ভুঁড়ি গুলো বেরিয়ে আছে। মহিন উদ্দিনের জিহ্বা বেরিয়ে আছে, জিহ্বা কামড়ে আঁকড়ে ধরে আছে দাঁতগুলো। মুখ পুরো সাদা। লাশের ঠিক কয়েক কদম সামনে পরে আছে মাথা ফাটা অবস্থায় নীল। নিঃশ্বাস নিচ্ছে সে, বেঁচে আছে। দ্রুত নীলের চাচা নীলকে নিয়ে হাসপাতালের দিকে রওনা দিলেন। বাকি পুলিশদের দায়িত্ব দিলেন ঘটনাস্থল সিল করে লাশটা মর্গে পাঠাতে। নীলের চাচা বুঝতে পারলেন সেখানে সেই আগন্তুক খুনীটা এসেছিল। চলবে… পর্ব-৫ সাধু এবং ফারহান রক্তে ভরা মেঝের দিকে তাকিয়ে আছে। বর্তমানে জনাব মহিন উদ্দিনের গোডাউনে। _ ‘পুলিশদের থেকে যতদূর জেনেছি তা হলো নীল নামক ছেলেকে অপহরণ করেন মহিন উদ্দিন। নীলের ওপর নির্যাতন চালানো হয়। নীলের চাচা পুলিশ অফিসার আরিফ লোকেশন ট্রেস করে এখানে এসে দেখলেন মেঝেতে রক্তাক্ত অবস্থায় পরে আছে নীল। নীলের সাথে মহিন উদ্দিনের ছিন্ন বিচ্ছিন্ন দেহ পরে আছে। নীলের জ্ঞান এখনো ফিরেনি। ফিরলে তার কাছ থেকেই পুরো ঘটনার বর্ণনা পাওয়া যাবে।’ গম্ভীর গলায় বলল ফারহান। _ ‘আমার নীল ছেলেটার ওপরই সন্দেহ হচ্ছে।’ সাধু এবং ফারহান পুরো কক্ষটা ঘুরে দেখল। সাধু ফারহানকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘দেখলে কক্ষের চারি পাশে থাকা কাচের জানলাগুলো?’ _ ‘হ্যাঁ, সেগুলো আমাদের একটা ঘটনার আংশিক দৃশ্য তুলে ধরছে। কাচগুলো গোডাউনের মেঝেতে পরে আছে। এর অর্থ বাহির থেকে গোডাউনের চারিদিক হতে এক দলা ধোঁয়া জানলা ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করে।’ _ ‘হ্যাঁ, ঠিক বলেছ। এর অর্থ নীল সেই ছায়াটা নয়।’ _ ‘তাহলে কী নীলের চাচা আরিফ? কারণ জনাব আরিফ সাহেবই তো বাহির থেকে আসেন। হতে পারে তিনিই..!’ ফারহানকে থামিয়ে দিয়ে সাধু বললেন, ‘হতে পারে। কারণ তিনি পুলিশ অফিসার, এই অব্দি ছায়াটার হাতে যত জন মারা গেছে তাদের কারোই কেস তিনি নেননি। তাহলে হতে পারে তিনিই ছায়াটা, অথবা তিনি জানেন ছায়াটা কে। তিনি হয়তো জানেন ছায়াটা কে, আর হয়তো তিনি ছায়া মানব দিয়ে এসব হত্যাকাণ্ড করাচ্ছেন। ’ _ ‘তাই হবার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। কারণ যাদের মারা হয় তাদের কুকর্মের তথ্য পুলিশেরা পেয়ে থাকে। এসব তথ্য পুলিশ অফিসারের কাছে থাকাই স্বাভাবিক।’ _ ‘তাহলে হিসেবটা মিলে গেলো। ধরতে হবে আরিফকে।’ গম্ভীর গলায় বললেন সাধু। . . প্রায় দু'ঘণ্টা হলো নীলের জ্ঞান ফিরেছে। এখন অনেকটা স্বাভাবিক সে। নীলের ডান পাশে টুলের ওপর বসে আছেন সাধু আর বাঁ পাশে ফারহান। সিগারেটের ধোঁয়াটে ধোঁয়া উড়িয়ে সাধু বললেন, ‘তুমি..’ সাধু আর কিছু বলার পূর্বেই নীল বাঁধা দিয়ে বলল, ‘গোয়েন্দা আপনি? আপনার ভেতর নূন্যতম বিবেক আছে কি?আমার তো মনে হয় না আছে। আমাকে জেরা করতে এসেছেন করুন। কিন্তু সিগারেটের ধোঁয়া উড়িয়ে বাকি রোগিদের বিরক্ত করার অধিকার কে দিল? আনুমানিক এই কক্ষে আরো চব্বিশ জন রোগী রয়েছেন। এদের ভেতর অনেকেই শ্বাসকষ্ট জনিত সমস্যায় ভুগছেন। হয় হাসপাতাল থেকে বের হন, না হয় সিগারেটটা ফেলে দিন।’ সাধু সিগারেটটা ফেলে দিল। কিছুক্ষণ আগে যে জোর নিয়ে তিনি নীলকে প্রশ্ন করতে গেছিলেন সে জোর আর উনার মধ্যে নেই। পুরো জনসম্মুখে নীল সাধুকে অপমান করে দিল। হাসপাতালের সেই কক্ষে থাকা প্রতিটা রোগী এবং নার্সের দৃষ্টি এখন সাধুর দিকে। দৃষ্টিতে স্পষ্ট বিরক্তির ছাপ । নীলকে থামিয়ে দিয়ে নীলের চাচা বললেন, ‘নীল শান্ত!’ নীল চুপ করল। নীলের চাচা আরিফ আবারও বলতে শুরু করলেন, ‘ওর পক্ষ থেকে আমি ক্ষমা চাচ্ছি।’ ফারহান কথা না বাড়িয়ে নীলকে প্রশ্ন করল, ‘ওখানে কী হয়েছিল? কে মহিন উদ্দিনকে হত্যা করেছিল?’ নীল স্থির দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ ফারহানের দাকে চেয়ে রইল। কাঁপা গলায় সে বলল, ‘আচমকা গোডাউনের সকল কাচ ভেঙে একটা কালো ধোঁয়া রুমে প্রবেশ করল। মহিন উদ্দিন সাহেব ভয় পান, প্রচুর ভয়। হাত থেকে লোহার রড মাটিতে পরে যায়। ধোঁয়াটা ধীরে ধীরে মানব রূপ নিতে শুরু করে। পুরো দেহ কুৎসিত! বিবর্ণও বলা চলে। শুধু চোখ জোড়া আমি দেখেছি। আমার সামনেই ছায়াটা মহিন উদ্দিনকে হত্যা করেন। এরপর লোহার রডটা দিয়ে আমার মাথায় একটা আঘাত করে। দ্বিতীয় আঘাতটা করতে নেয় ঠিক তখনি আমার চাচা ঘটনাস্থলে হাজির হন। ধোঁয়াটা সঙ্গে সঙ্গেই গায়েব হয়ে যায়। ’ ফারহান কিছু বলতে নিলো, সাধু তাকে থামিয়ে দিয়ে দিলেন। তিনি নীলকে প্রশ্ন করলেন, ‘ছায়াটার চোখ কেমন ছিল। ’ _ ‘স্বাভাবিক হয়েও অস্বাভাবিক ছিল। চোখে ভরা ছিল ঘৃণা, রাগ, ক্ষোভ। ভুরুগুলো বাকা হয়ে টান করে নাক বরাবর ছিল। চোখের পাতা নড়ছিল না। বাঘের চেয়েও হিংস্র তার দৃষ্টি।’ ক্ষীণ গলায় বলল নীল। ফারহান ওঠে দাঁড়াল, ‘তাহলে চলি আমরা। অন্য কোনো একদিন কথা হবে।’ কথাটা বলেই ফারহান হাসপাতাল থেকে বের হবার পথে পা বাড়ালো। ফারহানের পিছু পিছু যেতে লাগলেন সাধু। . . লিফ্টের ভেতর দাঁড়িয়ে আছেন সাধু, উনার বাঁ পাশে দাঁড়িয়ে ফারহান। দু'জনের মুখের টানা একটা হাসি। বিজয়ী হাসিও বটে। আচমকা ফিক করে ফারহান হেসে দিল। সাধু হাত নেড়ে বললেন, ‘আস্তে হাসো।’ _ ‘ছেলেটা আসলেই একটা খেলোয়াড়।’ বলল ফারহান। _ ‘আমার সিগারেট ধরানোর পদ্ধতিটা তাহলে কাজ করেছে?’ _ ‘শত ভাগ করেছে। এই ব্যাপারে কোনো দ্বিধাদ্বন্দ্ব অন্তত আমার নেই।’ হেসে বলল ফারহান। _ ‘নীলই হলো সেই সময়ের ছায়া।’ _ ‘হ্যাঁ! দেখলেন তো কী সাহস তার? আপনি শুধু সিগারেটটা ধরালেন আর তৎক্ষণাৎ সে রেগে গেলো। চোখের দৃষ্টিটা দেখে ছিলেন? যেন আপনাকে এখুনি খেয়ে ফেলবে। ’ _ ‘আরটা বিষয় লক্ষ্য করেছ? হয়তো করেছ! নীলের বলা ঘটনার বিবরণ শুনে হয়তো তুমি বুঝেই গেছ সে বানিয়ে বলছে।’ _ ‘অবশ্যই সে বানিয়ে বলছে। কারণ কালো ধোঁয়াটা বাহির থেকে এসে মহিন উদ্দিনকে হত্যা করে থাকলে নীল কোনো ভাবেই ছায়াটার চোখ দেখতে পারত না। কারণ মহিন উদ্দিনের লাশের মাথাটা ছিল নীলের দিক । যার অর্থ দাঁড়ায় এই যে ছায়াটা সামনে থেকে আক্রমণ করে। যার অর্থ ছায়াটার পিঠ দেখতে পারবে নীল, চোখ না। নীল আমাদের বোকা বানাতেই মহিন উদ্দিনকে হত্যা করার পর নিজে বাহিরে গিয়ে জানলার কাচ ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করে। তারপর নিজেই নিজের মাথায় আঘাত করে।’ ক্ষীণ গলায় বললেন সাধু। _ ‘একদম ঠিক।’ আলতো হেসে বলল ফারহান। . . নীলকে সবে মাত্র তার চাচা বাড়িতে নিয়ে এসেছেন। দোকান থেকে কিনে আনা খাবারগুলো প্লেটে রাখার জন্যে তিনি রান্না ঘরে চলে গেলেন। রুমে বর্তমানে নীল একা। নীলের উদাস মুখটা ধীরে ধীরে হাসি ভরা মুখে পরিণত হতে লাগল। একটা টানা হাসি হেসে গেল সে। সেই সাথে পুরো রুমে কালো একটা ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়তে লাগলো। ভয়ার্ত চোখ জোড়া চোখের পাতা দিয়ে সে ঢেকে দিল। সেকেণ্ড দুয়েক পর দ্রুত বেগে সে চোখের পাতা খুলল। সাথে সাথে তার ভুরুগুলো কৌণাকৃতির হয়ে গেল,নাক বরাবর। চোখ হিংস্র স্থির দৃষ্টি। . . _ ‘সবটা বুঝলাম। কিন্তু তোমরা কী করে ধরবে?প্রযুক্তির সহায়তা ছাড়া তাকে ধরা অসম্ভব। তাকে তো কোনো জেল বন্দি করে রাখতে পারবে না। ’ হতাশ হয়ে বললেন গোয়েন্দা প্রধান। সাধু মৃদু হাসলেন। হেসে তিনি বললেন, ‘পৃথিবীর বুকে এমন কোনো প্রযুক্তির আবিষ্কার ঘটেনি যা তাকে ধরে রাখতে পারবে। যদি কোনো জেল তাকে ধরেও রাখে কোনো কাজে দিবে না। কারণ সে সময় ভ্রমণের ক্ষমতা রাখে। বন্দি জেলে বসেও সে অনেক কিছু করতে পারবে। আমাদের তাকে কৌশলে ধরতে হবে। তার দুর্বলতা খুঁজতে হবে।’ ফারহান গম্ভীর গলায় বলল, ‘আমার মনে হচ্ছে আমি তার একটা দুর্বলতা জানি।’ _ ‘কী?’ প্রশ্ন করলেন গোয়েন্দা প্রধান। _ ‘সেই মেয়েটি, নাম যার অনিশা।’ সাধু ওঠে দাঁড়ালেন। জোড়াল কণ্ঠে বললেন, ‘সবচেয়ে বাজে বুদ্ধি। ’ _ ‘কিভাবে?’ _ ‘মহিন উদ্দিন লাস্ট যাকে ফোন করে তাকে কী করতে বলেছিল জানো? অনিশা নামক মেয়েটিকে অপহরণ করতে। এরপরই তো নীল মহিন উদ্দিনকে হত্যা করল। যেই মেয়ের নাম অন্য কেউ মুখে নিলে নীল তাকে বিভৎস এক মৃত্যু দেয় তা কখনই তার দুর্বলতা হতে পারে না।’ _ ‘বরং তার শক্তির উৎস..!’ মাথায় হাত দিয়ে ক্ষীণ গলায় বলল ফারহান। . . রাত তখন তিনটে। খাওয়া দাওয়ার পর্ব অনেক আগেই শেষ হয়েছে। নীলের চাচা নীলের পাশের ঘরে ঘুমনোর জন্যে চলে গেছেন। রুমে এখন নীল একা। ভেতর থেকে দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে সে ধোঁয়া হয়ে কোথাও চলে গেলো। নীলের বুকে শুয়ে আছে একটি মেয়ে। একটা কাগজ নীলের বাম হাতে গুঁজে দিয়ে মেয়েটি নীলকে বলল, ‘পরের খুনটা আজ রাতেই করো। ’ _ ‘না! আজ ভালো লাগছে না। ঘুমাব আমি।’ নরম গলায় বলল নীল। _ ‘আচ্ছা! মহিন উদ্দিনকে এত ভয়ঙ্কর মৃত্যু কেন দিলে? কব্জি কেটেও তো হত্যা করতে পারতে।’ নরম গলায় বলল মেয়েটি। _ ‘কারণ সে তোমার নাম কয়েকবার উচ্চারণ করেছে। নিষেধ করেছিলাম শোনেনি। তাই নরকে পাঠিয়ে দিলাম।’ হিংস্র গলায় বলল নীল চলবে….. পর্ব-৬ নীলের বুকে শুয়ে আছে অনিশা। কারো মুখে কোনো কথা নেই। নীরবতা ভেঙে অনিশা বলল, ‘সময়ের ছায়া হয়ে গেলে তুমি? অদ্ভুত না? ক'দিন আগেও তুমি ছিলে অতি সাধারণ এক মানব। আর এখন সময়ের ছায়া।’ _ ‘না! সময়ের ছায়া নই। তোমার ছায়া।’ আলতো হেসে বলল নীল। _ ‘আচ্ছা! সময়ের ছায়া হতে কী লাগে?’ _ ‘বেশি কিছু নয়। ত্রুটি বিহীন একটি মানব দেহ আর বুক ভরা সাহস। ’ _ ‘সত্যি! এত সহজ! কিভাবে?’ _ ‘সময় ভ্রমণ করতে যে পরিমাণ বেগ এবং শক্তির প্রয়োজন তার চেয়ে বেশি শক্তি চাইলে মানব দেহ তৈরি করতে পারবে। আমাদের দেহ বিশাল এক রসানাগার। দেহের প্রতিটা কোষ যদি তুমি নিয়ন্ত্রণ করতে পার তাহলে তুমি সময়ের ছায়া অনায়াসে হতে পারবে।’ _ ‘এটা অনেক মুশকিল কাজ!’ _ ‘তবে অসম্ভবও নয়। ’ অনিশা আর কিছু বলল না। নীল নিজ থেকেই আবারও বলে ওঠে, ‘জানো আমি আগে জানতাম না সময়ের ছায়া কী। আমার ক্ষমতার সীমাবদ্ধতা কতটুকু এবং আমার ক্ষমতা দিয়ে কী কী করতে পারব। ধন্যবাদ জানাই সেই দিনের সেমিনারির সেই লেখকটাকে। বৃদ্ধ লেখক সময়ের ছায়া নিয়ে অনেক কিছু বলেন। যার অনেকটাই আমার সাথে মিলে যায়। এরপর সময়ের ছায়া নিয়ে গবেষণা করে বুঝতে পারি আমার ক্ষমতা আসলে কতটুকু। শিখে গেলাম ধোঁয়া হওয়া।’ _ ‘ধোঁয়া হবার ক্ষমতা আপনার জন্যে ঠিক নয়। এই যে এখন আপনে আমার বেড রুমে! এটা কিন্তু ঠিক নয়।’ নীল এক গাল হাসল, ‘পাগলি একটা! ’ _ ‘বাবা জানলে আমায় জুতাপেটা করবে। তুমি একটু পর চলে যেও। ভোর হবার আগেই।’ _ ‘যাবো যখন কিছু করেই যাই!’ _ ‘চড় খাবি?’ . . ভোর হার সাথে সাথেই নীল নিজ রুম ফিরে আসল। অনিশা হয়তো ঘুমের ঘোরে তাকে কিছুক্ষণ খুঁজবে। এরপর না পেয়ে হয়তো গুটিসুটি মেরে ঘুমিয়ে থাকবে। অনিশার দেয়া সেই কাগজের টুকরোটা খুলে নীল পুরোটা পড়ে নিলো। পড়া শেষ নীল ফোন হাতে নিয়ে একটা নম্বর ডায়াল করল। ওপাশ থেকে ভাঙা গলায় একজন বৃদ্ধা বললেন, ‘কে বলছেন?’ _ ‘আমি নীল বলছি। আমি কী প্রবীণ অবসর প্রাপ্ত গোয়েন্দা সাধুর সাথে ককথা বলছি?’ _ ‘তুমি কী নীল?’ প্রশ্ন করলেন সাধু। _ ‘হ্যাঁ আমি নীল এবং তথাকথিত সেই সময়ের ছায়া।’ হেসে বলল নীল। সাধু ফোনের লাউড স্পিকার অন করে দিলো। সাধুর পাশে থাকা গোয়েন্দা প্রধান এবং ফারহান নীলের বলা কথাগুলো শুনতে লাগল। সাধু ভাঙা গলায় বলল, ‘সময়ের ছায়া? কী যা তা বলছ তুমি।’ নীল এক গাল হাসল। হেসে সে বলল, ‘নিজেকে খুব চালাক ভাবেন? শোনেন বাপেরও বাপ থাকে। আপনি সিগারেট ধরানোর পর আমি রেগে যাই। এরপর আপনার মুখে আমি হাসি দেখেছিলাম। হ্যাঁ, এখন বলবেন আপনি হাসেননি। কিন্তু একটা বিষয় মনে রাখবেন ঠোঁটে হাসি দমিয়ে রাখলেও গালের ভাজ দমিয়ে রাখা যায় না। আমি জানি আপনারা জেনে গেছেন আমি সময়ের ছায়া। এখন গোল টেবিল বৈঠক শুরু করেছেন কিভাবে আমাকে ধরবেন। দেখুন আমার কাজ আমাকে করতে দিন। আরো দুই তিনটে খুন করব। এরপর আমি আমার বাবা-মায়ের খুনীকে খুন করব। তারপর আমার কাজ শেষ। আমার পথের কাটা হবার চেষ্টা করবেন না।’ সাধু হেসে বললেন, ‘খুব চালাক তুমি। তোমাকে তো ধরবোই আমি।’ _ ‘আপনি বেশ চালাক। আপনার সাথে আসা সেই ছেলেটার নাম কী জানি? ওহ! হ্যাঁ, ফারহান। শুনেছিলাম ছেলেটা অনেক তুখোড়। কিন্তু এখন তো দেখি ছেলেটার মস্তিস্কের সিনান্সের সংযোগগুলো ভালো নয়।’ হেসে বলল নীল। সাধু কিছু বলতে নিলো, নীল থামিয়ে দিয়ে বলল, ‘একটা খুন করতে যাচ্ছি। সকল তথ্য আপনাকে মেসেজ করে পাঠিয়ে দিয়েছি। পারলে থামান। ’ সাধুর হাত থেকে ফোনটা কেড়ে নিয়ে গোয়েন্দা প্রধান বলল, ‘নিজেকে বেশি চালাক ভাব্বে না। তোমাকে ধরার নির্দেশ দিচ্ছি আমি।’ নীল কিছুক্ষণ হাসল, ‘ফারহান,শুনতে পাচ্ছ জানি আমি। সময় থাকলে একটু কষ্ট করে গোয়েন্দা প্রধানকে প্রশ্ন করবে আমাকে ধরার জন্যে এত উদ্বিগ্ন কেনো? উনার ব্যক্তিগত কোন স্বার্থ জড়িত নয় তো?’ কথাটা বলেই নীল ফোন কেটে দিলো। সাধু এবং ফারহান স্থির দৃষ্টিতে গোয়েন্দা প্রধানের দিকে তাকিয়ে রইল। গোয়েন্দা প্রধান বারবার চোখের পলক ফেলছেন। কিছু একটা লুকাচ্ছেন তিনি। ফারহান ক্ষীণ গলায় বলল, ‘গোয়েন্দাদের চোখের পলক এমন ভাবে পরা কিন্তু ভালো লক্ষণ নয় ।কিছু একটা লুকাচ্ছেন আপনি। শুরু থেকেই দেখেছি নীলকে ধরার জন্যে কতটা ব্যাকুল হয়ে পরেছেন আপনি। এর হেতু কী?’ গোয়েন্দা প্রধান টেবিলে চাপড় মেরে বললেন, ‘তুমি কী ভুলে যাচ্ছ বর্তমানে তুমি গোয়েন্দা প্রধানের সাথে কথা বলছ। তোমার সাহস কী করে হলো আমাকে প্রশ্ন করার?’ সাধু গম্ভীর গলায় বলে ওঠলেন, ‘আপনার কলিজাটা মনে হলো ভেতরে কাঁপছে। আমি কী সঠিক বলছি?’ গোয়েন্দা প্রধানের মুখ বন্ধ হয়ে গেল।তিনি কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। খানিক পর তিনি বললেন, ‘নীলকে আমি অনেক আগ ধরে চিনি। প্রায় বারো বছর ধরে চিনি। তার বাবা একজন গোয়েন্দা ছিলেন!’ সাধু ভ্রু কুঁচকিয়ে গোয়েন্দা প্রধানকে প্রশ্ন করলেন, ‘তাহলে শুর থেকেই আপনি নিশ্চয়ই অনুমান করেছিলেন সময়ের ছায়া হলো নীল?’ _ ‘হ্যাঁ!’ মৃদু গলায় বলল গোয়েন্দা প্রধান। _ ‘এর মানে সময়ের ছায়া কী সেটা আপনি জানেন! কীভাবে হতে হয় তা আপনি জানেন! নীলের ভেতর আপনি হয়তো কোনো প্রকার পরিবর্তন দেখেছিলেন তাই না?’ _ ‘হ্যাঁ! সময়ের ছায়া হতে কোনো যন্ত্র, মন্ত্রের প্রয়োজন নেই। দেহের প্রতিটা কোষ নিয়ন্ত্রণ করতে পারলেই হয়। মস্তিষ্ক থেকে শুরু করে হৃৎপিণ্ড থেকে শুরু করে একদম পায়ের নখ অব্দি প্রতিটা অঙ্গ নিয়ন্ত্রণ করতে পারলেই হয়। ’ কিছুক্ষণ নীরবতা। মিনিট দুয়েক পর ফারহান গোয়েন্দা প্রধানকে প্রশ্ন করলেন, ‘নীলের শেষ শিকার আপনি তাই না? তাই তাকে ধরতে আপনি এত উদ্বিগ্ন?’ গোয়েন্দা প্রধান হ্যাঁ সূচক ওপর থেকে নিচে মাথা নাড়ালো। বড় বড় চোখে গোয়েন্দা প্রধানের দিকে তাকিয়ে রইল সাধু এবং ফারহান। . . ড্রয়ার হতে নীল নাইনএমের বন্দুকটা বের করল। দু'ফোটা জল তার চোখ দিয়ে গড়িয়ে পরল। মৃদু গলায় সে বলল, ‘বাবা তুমি নেই! কিন্তু তোমার ব্যবহৃত সেই বন্দুকটা রয়ে গেলো। বন্দুক! তোমায় ব্যবহারের সময় হয়ে এসেছে।’ . . _ ‘আমাদের হাতে সময় নেই। গোয়েন্দা প্রধানকে হত্যা করার কারণ আমরা পরেও জানতে পারব। এখন নীল যেই লোকটাকে খুন করতে যাচ্ছে তাকে বাঁচাতে হবে।’ বলল ফারহান। সাধু সহমত প্রকাশ করল। ফারহান এবং সাধু বেরিয়ে পরল। . . রুমের ভেতর বন্দুক হাতে পায়চারি করছে ফারহান এবং সাধু। ড.রিয়াজ ফারহানকে প্রশ্ন করলেন, ‘আমাকে সেই ছায়াটা কেনো হত্যা করবে! আমি কী করেছি! ’ _ ‘আমরা জানি না। ’ বলল সাধু। আচমকা রুমের জানলা ভেঙে একটা কালো ধোঁয়া পুরো রুম দখল করে নিলো। সাধু এবং ফারহান একের পর এক গুলি চালাতে লাগল। কিন্তু কোনো লাভ হলো না। ধোঁয়াটা এক সাথ হয়ে একটি মানব দেহে পরিণত হলো। নীল! সাধু এবং ফারহান নীলের দিকে বন্দুক তাক করল। সাধু বলল, ‘এক চুল পরিমাণও নড়বে না। আর তোমার হাতের বন্দুকটা ফেলে দেও। ’ নীল একটু হাসল, বন্দুক দিয়ে সে সোজা ড.রিয়াজের মাথায় গুলি করে দিলো। কপালের মাঝ দিয়ে গুলিটা ছেদ করে মাথার খুলির পেছন দিয়ে বেরিয়ে গেলো। সাধু এবং ফারহানের দৃষ্টি সেকেণ্ড খানেকের জন্যে ড.রিয়াজের দিকে গেলো। চোখের পলক ফেলে তারা সামনে তাকিয়ে দেখে নীল উদাও। চোখের পলক ফেলার পূর্বেই সে গায়েব হয়ে গেছে! হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সাধু এবং ফারহান। চলবে….. পর্ব-৭ _ ‘ তোমাদের উপস্থিতিতে কী করে নীল ড.রিয়াজকে হত্যা করল? তোমরা দুইজন কী করছিলে?’ ফারহানকে প্রশ্ন করল গোয়েন্দা প্রধান। সাধু জলদগম্ভীর কণ্ঠস্বরে বললেন, ‘চোখের পলকে সব ঘটে গেলো। নীল এসেই গুলি করে চলে গেলো। আমরা তো বেকুবের মতো চেয়ে রইলাম। চোখের পলকে সব কিছু ঘটে যায়। কিছু করার ছিল না আমাদের। সকলের মাথায় রাখা উচিত সে সময়ের ছায়া। তাকে সাধারণ বন্দুকের বুলেট দিয়ে ভয় দেখানো যাবে না।’ _ ‘ওর পরবর্তী পদক্ষেপ আমরা জানি।’ গম্ভীর গলায় বলল ফারহান। _ ‘কী?’ প্রশ্ন করলেন গোয়েন্দা প্রধান। _ ‘কিছুক্ষণ আগেই তো ফোন কলে সে সবটা বলে দিয়েছে। সে এখন তার বাবা মায়ের খুনীদের খুঁজে বের করে হত্যা করবে। গোয়েন্দা প্রধান ক্ষীণ গলায় বললেন, ‘নীল জানেন না তার বাবা-মাকে কারা হত্যা করেছে। সুতরাং সে নিশ্চয়ই আমাদের ওপর নজর রাখবে। কারণ আমরা তার বাবা-মায়ের প্রকৃত খুনী কারা বের করার চেষ্টা করব, তাদের দিয়ে নীলকে ধরার চেষ্টা করব। সুতরাং আমার যাই করি না কেন অত্যন্ত সতর্কতার সহিত করতে হবে। ’ গোয়েন্দা প্রধানের চোখ দরজার দিকে পড়তেই তিনি লক্ষ করলেন দরজা পাশ হতে একটি ছায়া মূর্তি সরে গেছে। গোয়েন্দা প্রধানের দৃষ্টি অনুসরণ করে বাকিরাও দরজার দিকে তাকালো। সকলে বুঝতে পারল নীল সেখানে ছিল। . . _ ‘দরজায় তীব্র কড়া নাড়ার শব্দে বিরক্ত হয়ে অগত্যা ওঠে গেলাম। মাত্র এসেছি বাসায়, রাত ভর তো জেগে ছিলাম। আর সকালে তো খুন করতে গেলাম ।আর এখন আসলাম তাও বিরক্ত করতে চলে এসেছে ; নিশ্চিত আমি চাচা জানই হবেন।’ মনে মনে বলল নীল। ওঁখ কাঠের দরজাটা খুলে বাহিরে তাকিয়ে দেখল তারা চাচা দাঁড়িয়ে আছে। তিনি নীলকে দেখে বললেন, ‘দুপুরের খাবার এনেছি।’ নীল ভ্রু কুঁচকিয়ে বলল, ‘ওহ! তার মানে দুপুর হয়েও গেছে। কখন যে বেলা পার হয়ে গেলো বুঝতেই পারিনি।’ খাওয়া দাওয়া শেষে নীল বিছানায় গা এলিয়ে দিলো। আরো তিনটে দিন অতিবাহিত হলো । এই তিন দিনে কোনো খুন করেনি নীল। অপর দিকে গোয়েন্দা প্রধান, ফারহান এবং সাধু নীলের বাবা-মায়ের খুনীদের খুঁজে বেড়াচ্ছে। কোনো প্রকার ক্লু এখন অব্দি তারা পায়নি। . . _ ‘আমরা কিছু একটা তো ভুল করছি। নীল তো বসে থাকার মতো ছেলে নয়। সে নিশ্চয়ই প্রতিশোধ নিয়েছে। কিন্তু আমরা কোনো হত্যা কিংবা মিসিং রিপোর্ট পাইনি। ’ বললেন গোয়েন্দা প্রধান। _ ‘এর মানে এই নয় তো নীল প্রতিশোধ নিবে না?’ প্রশ্ন করল ফারহান। _ ‘তার চোখে আমি ঘেন্না দেখেছি। সে নিশ্চয়ই প্রতিশোধ নিবে। ’ ক্ষীণ গলায় বলল সাধু _ ‘নীলের বাবা হলো নয়ন। তাকে হঠাৎ একদিন তার বাড়িতে কারা জানি খুন করে। বাড়িতে তার স্ত্রী ছিল, তাকেও হত্যা করে। তখন নীল কলেজে ছিল। তাই সে রক্ষা পায়। কেসটা আমি হ্যাণ্ডেল করি বাট কেসের সাথে সম্পৃক্ত কোনো ব্যক্তিকেই খুঁজে পাইনি। কেসটা বন্ধ করতে হয়।’ বললেন গোয়েন্দা প্রধান। ফারহান অন্যমনস্ক হয়ে বলল, ‘আমরা কিছু একটা ভুল তো করছি।’ . . নীল নাইনএমের বন্দুকটা ড্রয়ারের ভেতর রেখে দিলো। একটা বাকা হাসি হেসে সে বলল, ‘বন্দুক তোমার কাজ শেষ। এবার তুমি বিশ্রাম নিতে পারো। তোমার সবগুলো বুলেট জায়গা মতই পৌঁছেছে। ’ বন্দুকের ভেতর কোনো বুলেট নেই। পূর্বে চারটে ছিল। এর মধ্যে একটি সে ড.রিয়াজকে হত্যা করতে ব্যবহার করে। তবে বর্তমানে বন্দুকে একটি বুলেটও নেই । নীল তার কাঁধে একটা কোমল হাতের স্পর্শ পেল। অনিশা! ঘুরে সে তার দিকে তাকালো। _ ‘কাজ শেষ। চলো এবার আমরাও দূরে কোথাও চলে যাই।’ বলল নীল। _ ‘ব্যাগ প্যাক করে ফেলেছি। চলো আজই বের হই। আর হ্যাঁ, পথে কিন্তু আমায় শুনাবে কী করে তুমি সময়ের ছায়া হয়েছ। আমিও হবো।’ _ ‘এক বিশাল রহস্যের প্যাঁচে পড়বে তুমি। যা এত দিন আমি তোমায় বলিনি। শুনলে তুমি প্রচুর অবাক হবে।’ _ ‘নীল সাহেব, আমি শুনার জন্যে প্রস্তুত।’ হেসে বলল অনিশা। . . সকলে বসে ভাবছে, আচমকা সাধু প্রশ্ন করলেন, ‘নীলের বাবা মাকে কিভাবে হত্যা করা হয়?’ গোয়েন্দা প্রধান কিছুক্ষণ ভেবে বললেন, ‘কব্জি!’ তিনি আর কিছু বললেন না। তার চোখ জোড়া বড় হতে লাগল। সেই সাধু এবং ফারহানেরও। ফারহান ক্ষীণ গলায় বলল, ‘কব্জি কেটে হত্যা!’ _ ‘কব্জি কেটে এবং কপালের মাঝ বরাবর গুলি করে । পুরো নীল যেভাবে হত্যা করে!’ ভয়ার্ত গলায় বলল গোয়েন্দা প্রধান। কিছুক্ষণ পর গোয়েন্দা প্রধান দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বললেন, ‘সম্ভব! নীল নিজেই নিজের বাবা-মাকে হত্যা করেছে। এটা কখনই সম্ভব নয়। আমরা কিছু একটা ভুল করছি। ’ কক্ষের কাচের দরজায় টোকা পড়ল। গোয়েন্দা প্রধান অনুমতি দিতেই লোকটা ভেতরে প্রবেশ করল। গোয়েন্দা প্রধানের নিকট এসে লোকটা বলল, ‘নীল তার প্রিয়তমা অনিশাকে নিয়ে আচমকা কোথাও চলে গেছে। সেই সাথে নীলের চাচা আরিফেরও কোনো খোঁজ মিলছে না।’ গোয়েন্দা প্রধান চোখের ইশারায় লোকটাকে চলে যেতে বললেন। গোয়েন্দা প্রধান ফারহানের দিকে ঝুঁকে বলল, ‘এর অর্থ বুঝো? নীলের কাজ শেষ। তাই সে দূরে চলে গেছে।’ ফারহান হন্তদন্ত হয়ে বলল, ‘নীলের বাড়িটা তল্লাশি করতে হবে। কিছু না কিছু তথ্য তো সেখান থেকে অবশ্যই পাওয়া যাবে। ’ গোয়েন্দা প্রধান নীলের বাড়ি তল্লাশির অনুমতি দিলেন। . . _ ‘পুরো বাড়ি তল্লাশি করে কিছুই পেলাম না। শুধু গত খুনে নীলের ব্যবহৃত নাইনএমের বন্দুকটা পেয়েছি। বন্দুকে বুলেটও নেই।’ গোয়েন্দা প্রধানকে বলল ফারহান। _ ‘নাইনএমের বন্দুক!’ কথাটা বলেই বসা থেকে ওঠে দাঁড়ালেন গোয়েন্দা প্রধান। ফারহানের কাছ থেকে তিনি বন্দুকটা নিয়ে নিলেন। একটা গোলাপি রং এর আলো পুরো বন্দুকে ফেলে তিনি কিছু একটা দেখতে লাগলেন। একটা স্থানে গোলাপি আলো ফেলে গোয়েন্দা প্রধান বললেন, ‘দেখেছ একশো ষোল লিখা! এর অর্থ এটা নীলের বাবা! বন্দুকে চারটি গুলি অবশিষ্ট ছিল।’ কথাটা বলেই তিনি বন্দুকের ভেতর কতটি গুলি রয়েছে চেক করতে লাগলেন। ভেতরে কোনো গুলি না পেয়ে তিনি বললেন, ‘এর মানে নীল বন্দুকটা চার বার ব্যবহার করেছে। তাহলে খুনী ড.রিয়াজকে বাদ দিলে মোট তিনজন।’ কিছুক্ষণ পর গোয়েন্দা প্রধান হেসে বললেন, ‘নীল তার বাবা-মাকে হত্যা করেনি। কারণ নীলের বাবা-মায়ের মাথার খুলির ভেতর যেই বুলেটটা পেয়েছিলাম সেটা নাইনএমের ছিল না।’ সাধু হুট করে টেবিলে চাপড় মেরে বললেন, ‘বুঝেছি! এর মানে নীল তার বাবা-মাকে যারা হত্যা করেছে তাদের মতো করেই সবাইকে হত্যা করছে। একটি চিহ্ন! হ্যাঁ! যাতে প্রকৃত খুনীরা সহজেই বুঝতে পারে তাদের কেও খুন করা হবে । তাদেরকে হত্যা করবে নীল সেটাও সে বলে দেয়।’ ফারহান নিচু স্বরে বলল, ‘ব্রিলিয়েন্ট!’ গোয়েন্দা প্রধান মৃদু হাসলেন। হেসে তিনি বললেন, ‘কেসটি পরিসমাপ্তি ঘটেছে। সব কিছু এখন আমার সামনে পরিষ্কার। নীল তার বাবা-মায়ের খুনীকে হত্যা করেছে। সে বিজয়ী। কোনো প্রকার প্রমাণ সে রাখেনি।’ ফারহান এবং সাধু ভ্রু কুঁচকাল। কেউ কিছু বুঝে ওঠতে পারছে না। চলবে…… পর্ব-৮ সাধু থেকে একটা সিগারেট নিয়ে গোয়েন্দা প্রধান আগুন ধরিয়ে টানতে শুরু করলেন। চেয়ারে বসে তিনি ডেস্কে থাকা টেলিফোন দিয়ে কাউকে ফোন দিয়ে কিছু ফাইল আনতে বললেন। একটা লোক এসে পুরো কিছু ফাইল গোয়েন্দা প্রধানের ডেস্কে গিয়ে রেখে আসলেন। গোয়েন্দা প্রধান ফাইলগুলো ফারহানের দিকে এগিয়ে দিলো। ফারহান ফাইলটা খুলে পড়তে শুরু করল। ফারহানের প্রত্যুত্তরের অপেক্ষা না করে গোয়েন্দা প্রধান বললেন, ‘যেদিন নীলের বাবা-মা মারা যান সেদিন তাদের বাড়ি হতে দেড় মাইল দূরে তিনটে খুন হয়। খুনী সেই তিনজনের কপালের মাঝ বরাবর গুলি করে হত্যা করে। বুলেট ছিল নাইনএমের বন্দুকের। ’ ফাইল পড়া শেষে ফারহান বলল, ‘এর মানে নীল অতীতে গিয়ে তার বাবার নাইনএমের রিভলবারে থাকা তিনটে বুলেট দিয়ে সেই তিন জন লোককে খুন করে। আর অর্থ সেই তিনজন হলো নীলের বাবা-মায়ের খুনী?’ ‘একদম ঠিক।’ টেবিলের ওপর চাপড় মেরে বললেন গোয়েন্দা প্রধান। সাধু জলদগম্ভীর কণ্ঠস্বরে বললেন, ‘একটা প্রশ্ন জাগল মনে। নীল অতীতে গিয়ে তার বাবা-মায়ের খুনীদের হত্যা করে, কিন্তু সে চাইলে তো তার বাবা মাকে খুন হবার হাত থেকে রক্ষা করতে পারত তাই না?’ গোয়েন্দা প্রধান না সূচক ডান থেকে বামে মাথা নাড়িয়ে বললেন, ‘এটা সে কখনো করবে না। কারণ…!’ গোয়েন্দা প্রধানকে থামিয়ে দিয়ে ফারহান বলল, ‘কারণ এমনটা আগেই হয় গেছে। সময়!’ সাধু বুঝতে পারল না। ফারহান আলতো হেসে বলল, ‘বর্তমানের নীল তথাকথিত সময়ের ছায়া তার বাবা-মায়ের খুনীকে শাস্তি দেবার জন্যেই হয়েছে। সুতরাং অতীতকে বদলা বর্তমান নীলের কোনো অস্তিত্বই থাকবে না। সহজে বলছি, বর্তমানের নীলের সাথে অতীতে আগেই ওসব ঘটেছে। তার বাবা-মায়ের মৃত্যু এবং খুনীদের মৃত্যু আগেই হয়ে গেছে। এখন যদি অতীতে নীল গিয়ে এসব কিছু থামিয়ে দেয় তাহলে বর্তমান নীলের কোনো অস্তিত্বই থাকবে না। নীল সময়ের ছায়া হয়েছে শুধু মাত্র তার বাবা-মায়ের খুনীদের খুঁজতে গিয়ে। সে অতীত বদলালে সব কিছু বদলে যাবে।’ সাধু ফারহানকে থামিয়ে দিয়ে বলল, ‘বদলাক! তাতে কী? নীল তো তার বাবা-মাকে তাহলে ফিরে পাচ্ছে!’ _ ‘সময় ভ্রমণ নিয়ে অনেক থিউরি আছে। অতীত বদলালে অনেক কিছুই হতে পারে। নীল নিশ্চয়ই অতীত বদলালে কী কী হতে পারে সবকিছুই জানে। সে ভেবে চিন্তেই করেছে। তা যাই হোক নীলকে ধরার কোনো প্রমাণ কিন্তু অবশ্য আমাদের হাতে।’ _ ‘হ্যাঁ! নীল খুন করেছে তা সত্য! কিন্তু খুন সে বছরখানেক আগে করেছে। আর খুনে ব্যবহৃত অস্ত্র এখনকার। যে কেউ শুনলে আমাদের পাগল বলে সম্বোধন করবে। ’ হেসে বলল সাধু। গোয়েন্দা প্রধান দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলল, ‘এতদিন শুধু শুধুই পরিশ্রম করেছি। নীল যা চেয়েছে তা তো করেছেই। তার বিরুদ্ধে কোনো শক্ত পক্ত প্রমাণই আমরা জোগার করতে পারিনি।’ ফারহান গম্ভীর গলায় বলল, ‘একটা আফসোস রয়েই গেল, নীল যে কিভাবে সময়ের ছায়া হলো।’ সাধু বললেন, ‘আচ্ছা! আমি তাহলে চলি।’ সাধু হেঁটে দরজা অব্দি আসতেই হুট করে থমকে দাঁড়ালেন। পেছন ফিরে তিনি বললেন, ‘এক মিনিট! নীল তার বাবা-মায়ের খুনীদের তো আগেই মারতে পারত! তার তো ক্ষমতা ছিল। তাহলে সে এতগুলা খুন কে করেছে?’ গোয়েন্দা প্রধান এবং ফারহান বড় বড় চোখে সাধুর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আসলেই তো!’ গোয়েন্দা প্রধানের ডেস্কে থাকা ফোনটা বেজে ওঠল। গোয়েন্দা প্রধান ফোন ধরতেই ওপাশ থেকে নীল বলে ওঠে, ‘লাউড স্পীকার অন প্লিজ।’ লাউড স্পীকার অন হতেই নীল বলে ওঠে, ‘খুব সুন্দর প্রশ্ন করেছেন সাধু সাহেব। জানতাম আপনার মগজেই প্রশ্নটা আসবে। আমি নিজেই উত্তরটা দিচ্ছি। আশা করি আমার উত্তর আপনাদের মগজে গভীর এক দাগ কাটবে।’ সেকেণ্ড দুয়েক পর হেসে নীল বলল, ‘গোয়েন্দা প্রধানকে আমি বড্ড বেশি ঘৃণা করি। অসম্ভব ঘৃণাও বলতে পারেন। অনেক চেষ্টা করেছি ঘৃণা কমাতে, কিন্তু পারিনি। জানেন এতগুলো খুন কেনো করেছি? অপরাধে বিরুদ্ধে আমি বজ্রকঠিন। কিন্তু খুনগুলো শুধু মাত্র আপনাদের চোখে আসতে করেছি। যাতে আপনারা আমাকে খুঁজেন। অর্থাৎ অকথ্য ভাষায় যাকে বলে আপনাদের আমি কুকুর বানিয়েছি। কুকুরের ন্যায় আপনার আমাকে খুঁজেছেন। কুকুরের মতো এদিক সেদিক মুখ দিয়েছেন। বিশেষ করে গোয়েন্দা প্রধান, এত শত গোয়েন্দা প্রধান সারাদিন আমায় নিয়ে চিন্তিত ছিলেন ।’ গোয়েন্দা প্রধান রেগে তেড়ে একটা অকথ্য গালি দিলেন। _ ‘চুপ!’ হিংস্র গলায় বলল নীল। _ ‘ছাড়ব না তোকে।’ রেগে বলল গোয়েন্দা প্রধান। _ ‘আপনি জানতে আমার বাবাকে মারা জন্যে কিছু লোক ওঠে পরে লেগেছে। আপনি চাইলে বাবাকে নিরাপত্তা দিতে পারতেন। কিন্তু দেননি! কারা মারতে চাইছে বেরও করেননি। আপনি! আপনি হলেন একটা কুত্তা। আপনি বাবার কেসটা চাইলে জোড়াল ভাবে সচল রাখতে পারতেন। কিন্তু আপনি বন্ধ করে দেন।’ ফোন কেটে গেলো। সাধু এবং ফারহান স্থির দৃষ্টিতে গোয়েন্দা প্রধানের দিকে তাকিয়ে রইলো। মৃদু স্বরে ফারহান গোয়েন্দা প্রধানকে প্রশ্ন করল, ‘কিন্তু কেনো?’ গোয়েন্দা প্রধান কিছু বললেন না। সাধু গম্ভীর গলায় বললেন, ‘কোন স্বার্থে আপনি এমন করেছেন জানি না আমি। স্বার্থহীন খুন করা আমি নীলের কাছ থেকে শিখেছি।’ কথাটা বলেই সাধু তার কোমড়ে থাকা রিভলবার বের করে সোজা গোয়েন্দা প্রধানের ঠিক কপালের মাঝ বরাবর গুলি করে দিলেন। দৃশ্যটা দেখে ফারহান চিৎকার দিয়ে ওঠল। কক্ষে প্রবেশ করল অনেকে। গোয়েন্দা প্রধানের লাশ এবং সাধুর হাতে বন্দুক দেখে সবাই বোঝে গেলে খুনটা কে করেছে। . . গোয়েন্দা প্রধানকে খুনের দায়ে সাধুকে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেওয়া হলো। . . তিন বছর পর… দরজায় তীব্র কড়া নাড়ার শব্দে নীল বিরক্ত হয়ে বাহিরে এসে দেখল ফুলের তোড়া হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সাধু এবং ফারহান । সাধু আলতো হেসে বলল, ‘ভেতরে আসতে দিবে না নাকি?’ নীল হেসে বলল, ‘ঘরের লোকদেরও ভেতরে আসতে বলতে হয়?’ দরজা ঠেলে ফারহান এবং সাধু ঘরের ভেতর প্রবেশ করল। ভেতরে আসতেই তারা দেখল অনিশার কোলে একটি শিশু বাচ্চা। ফারহান বাচ্চাটির গাল টেনে বলল, ‘বাহ্! বাপের মতো হয়েছে। সু-খবর আমি তো মামা হয়ে গেলাম।’ সাধু ফারহানের কাঁধে হাত রেখে হেসে বলল, ‘তুমি মামা হলে আমি কী হবো?’ _ ‘অবশ্যই নানা।’ নীল সকলের উদ্দেশ্যে বলল, ‘আহা! সবাই দেখি অনিশার ভাই এবং বাবা হচ্ছে। আরে ভাই কেউ আমার দলেও তো আসো।’ অনিশা মুখ বাকিয়ে বলল, ‘তুমি কিন্তু আমায় কখনো বলোনি তুমি কিভাবে সময়ের ছায়া হয়েছ। সেই সাথে তোমার বাবা-মায়ের খুনের রহস্য এবং গোয়েন্দা প্রধান কিভাবে খুনের সাথে যুক্ত বলোনি। ওহ! কিভাবে সাধুকে বাঁচালে তাও বলোনি।’ _ ‘এক কাপ চা চিনি দিয়া খা! যাও চার কাপ চা বানিয়ে আসো। তারপর বলছি সবটা।’ ফারহান বলল, ‘যান ভাবি দ্রুত করে আসেন। আমি এবং সাধু সাথে হলাম উৎসুক জনতা। সময়ের ছায়া নীল কিভাবে হলো শোনার অপেক্ষাতে আছি।’ চলেব…. পর্ব-৯ _ ‘ধরেন আপনাদের চা।’ বলল অনিশা। চায়ের কাপে চুমুক দিলো তিন জোড়া ঠোঁট। অনিশা তার ছোট্ট শিশু মেয়েকে নিয়ে ভেতরের রুমে গেল। যেখানে অনিশার বাবা-মা রয়েছে। উনাদের কাছে অনিশা তার মেয়ে দিয়ে নীলদের কাছে ফিরে গেল। ‘শুরু করা যাক তাহলে?’ সকলের উদ্দেশ্য বলল নীল। নীলকে থামিয়ে দিয়ে অনিশা বলল, ‘এই না,থামো। আর পাঁচটে মিনিট অপেক্ষা করো। তোমার চাচা আসতেছেন। উনাকেও সবটা খুলে বলো।’ মিনিট দুয়েকের ভেতর দরজায় কড়া নাগার শব্দ এলো। অনিশা দরজা খুলে দেখল নীলের চাচা। নীলের চাচা জনাব আরিফ নীলের পাশে বসলেন। তিনি নীলকে বললেন, ‘তাহলে আজ অপেক্ষার অবসান ঘটবে।’ নীল স্বভাবগত রহস্যময় একটা টানা হাসি হেসে গেল। নীল দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলতে শুরু করল, “সেবার আমি ইন্টার পরীক্ষার্থী। কলেজ থেকে বাড়ি ফিরছিলাম। বাড়ির বেশ কিছুটা কাছে পৌঁছতেই গালটা কেন জানি শুকিয়ে যেতে শুরু করে । কয়েক কদম এগুতে বুঝতে পারি পা জোড়া ভারি হয়ে আসছে। আমি বুঝে ওঠতে পারলাম না কী হচ্ছে! মনে হচ্ছিল অজানা একটা দুঃখ, কষ্ট আমার পুরো দেহকে গ্রাস করে চলেছে। বাড়ির সামনে আসতেই বুঝে গেলাম কদম ভারি হবার কারণটা! আমার বাবা-মা আর পৃথিবীতে নেই। কারা জানি খুব বিভৎস ভাবে খুন করে। সেদিন তাদের লাশ শুধু এক নজর দেখতে পেরেছিলাম। প্রচুর বিড় ছিল আর পুলিশ তাদের দেহের কাছে আমাকে যেকে দিচ্ছিল না। চিৎকার দিয়ে কেঁদে ছিলাম। কোনো কাজ হয়নি। ঘটনাস্থলে গোয়েন্দা প্রধান ছিলেন। উনার কাছে গিয়ে অনেক আকুতি মিনতি করেছিলাম। কিন্তু সেদিন তিনি পুরো আগন্তুকের ন্যায় আচরণ করেন। যেন আমায় চেননই না। সেদিন বাবার বলা একটা কথা আমার কানে বাজতে লাগে, বাবা মারা গেলে শুধু সন্তান তার বাবাকেই হারায় না বরং পুরো পৃথিবীর সকল আপন জনকেও হারায়। হুট করে আমি বাবার রুমে প্রবেশ করি। বাবার বন্দুকটা হাতে তুলে নেই। নাইনএমের বন্দুকের ভেতর চারটে বুলেট ছিল। লক্ষ্য ছিল গোয়েন্দা প্রধানের কপালের মাঝে গুলি করা। বাবা আমাকে বন্দুক চালানো শিখিয়ে ছিলেন। নির্ভয়ে বন্দুকটার ঢাল শক্ত হাতে চেপে ধরে রুম থেকে বেরিয়ে পরি।আমার হারানোর মতো কোনো আপনজন নেই। সুতরাং ভয়ও থাকবে না, এটাই স্বাভাবিক। বন্দুকটা গোয়েন্দা প্রধানের দিকে লক্ষ্য করে টার্গেট করি। তখনি আমাকে অনিশার বাবা বাঁধা দেন। তিনি বললেন, ‘আমার বিশ্বাস হচ্ছে না নিলয় আর নেই! আর তুমি এ কী করছ! এভাবে অস্ত্র হাতে তুলে নিবে না। তোমার বাবার খুনীদের অবশ্যই শাস্তি হবে।’ অনিশার বাবা হলেন আমার বাবার ছোট বেলার বন্ধু। তিনি আমাকে নানান ভাবে শান্তনা দিতে লাগলেন। আমাকে তাদের বাড়িতে নিয়ে যান। সেখানে দু’দিন ছিলাম। তৃতীয় দিন আঙ্কেল আমার চাচাকে সঙ্গে নিয়ে মর্গে যান। চাচা জান বাবা-মাকে দেখার সুযোগ করে দেন। ’’ নীল কিছুটা থামল। নীল পাশে বসে থাকা তার চাচাকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘চির কৃতজ্ঞ! ’ একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে নীল বলল, ‘লাশগুলো বিকৃত ছিল! পোস্টকৃত লাশ। বুঝেনই তো। বাবা-মায়ের মৃত দেহ দেখে বুকের ভেতরটা ফেটে যায়। বুকের ভেতর একটা তীব্র বজ্রপাত হয়। প্রতিশোধের বজ্রপাত! সিদ্ধান্ত নিই বাবা-মায়ের খুনীদের নিজ হাতে হত্যা করব। চাচার কাছ থেকে জানতে পারি হাতের কব্জি কেটে এবং কপালের মাঝ বরাবর গুলি করে বাবা-মাকে হত্যা করা হয়েছে।’ নীল ক্ষীণ গলায় বলল, ‘প্রতিশোধের আগুন নিয়ে ছয়টি মাস কেটে গেল। অনিশার সাথে ছোট বেলা থেকেই বন্ধুত্ব। সেই ছয় মাসে সে আমার অনেক কাছে চলে আসে। সে আমাকে নানান ভাবে শান্তনা, প্রেরণা সবটাই দিয়ে থাকে। কিন্তু ছয় মাস খুঁজেও আমি খুনীদের বের করতে সক্ষম হইনি। তবে এইটুকু বুঝেছিলাম গোয়েন্দা প্রধান এক নম্বর হারামজাদা। বাবা-মায়ের খুনের কেস তিনি বন্ধ করেন, সেই সাথে অনেক প্রমাণও মুছে দেন। আমি বেশ ভালো করেই বুঝতে পারি নিশ্চয়ই উনার কোনো কুকর্ম সম্পর্কে আমার বাবা জেনে যান এবং তা নিয়ে হয়তো রিপোর্ট লিখতে শুরু করেন। সেজন্যে বাবার ওপর হবার হামলাটা তিনি হতে দিলেন। গোয়েন্দাদের ক্ষতি করতে সব সময়ই অপরাধীরা ওত পেতে থাকে। বাবা-মায়ের হত্যার পেছনে গোয়েন্দা প্রধানের বড় সড় একটা হাত আছে সেটা আমি বুঝে যাই। ’ _ ‘সময়ের ছায়া তুমি কী করে হলে?’ প্রশ্ন করল ফারহান। _ ‘বলছি!’ ক্ষীণ গলায় বলল নীল। কিছুটা দম নিয়ে বলতে শুরু করল, ‘অনেক তথ্য প্রমাণ সংগ্রহ করার পর জানতে পারি বাবা-মাকে যারা হত্যা করেছিল তাদের সেদিনই কেউ একজন হত্যা করেছে। তবে হত্যাটা ঠিক সেই খুনীদের নিয়মে করা, যেভাবে আমি করতে চেয়ে ছিলাম। শুধু তাই নয়, চাচা জান থেকে জানতে পারি খুনী নাইনএমের বন্দুক ব্যবহার করেছে। অনেক কিছুই আমার সাথে মিলে যাচ্ছিল । বিষয়টা আমায় খুব ভাবায়। আরো কিছুদিন খুঁজাখুঁজির পর জানতে পারি খুনের সাথে গোয়েন্দা প্রধানের সম্পৃক্ততা রয়েছে। তখন খুব খুশি হই, একজনকে তো নিজ হাতে মারতে পারব। অনেকবার সুযোগ পেয়েছিলাম গোয়েন্দা প্রধানকে হত্যা করার। কিন্তু প্রতিবারই হাত কেঁপে যায়! কারণ এখন তো আমার আপনজন রয়েছে!’ অনিশার দিকে তাকিয়ে নীল বলল, ‘তাছাড়া কেউ একজন তো আমাকে নিয়ে হাজারো স্বপ্ন দেখছে। তাই অনেক বার সুযোগ পাবার পরও হত্যা করিনি। ছেড়ে দিই ভাগ্যের ওপর। তিন মাস পর আমার দেহের ভেতর অনেক পরিবর্তন আমি লক্ষ্য করি। একটি বছর আমি দৌঁড়েছি নানান প্রশিক্ষণও নিয়েছি। ধীরে ধীরে নিজের দেহের ওপর কেমন জানি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ পেতে লাগি। মনের ভেতর তখন একটা প্রশ্ন আসে, কেন? পৌরাণিক কিছু সত্য কাহিনীর উৎসগুলো পড়তে শুরু করি। কিছু নথি পত্র পাই এই সময়ের ছায়া নিয়ে। নিজের দেহকে সম্পূর্ণ রূপে নিয়ন্ত্রণ করার নানান প্রশিক্ষণ খুঁজে পাই। সেগুলো আমি করতে শুরু করি। ধীরে ধীরে শরীরের ওপর নিয়ন্ত্রণটা বাড়তে লাগে। আমি শিখে যাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কৌশলটি! যেটা হলো দেহের মধ্যে থাকা সম্পূর্ণ শক্তি দিয়ে আঘাত করার কৌশল। এক ঘুষিতে বিনা ব্যথা দেয়াল ভাঙা থেকে শুরু করে, শত টন ভারি বস্তুও তুলতে সক্ষম হই। কিন্তু সমস্যা ছিল গিয়ে শক্তি সম্পূর্ণ প্রয়োগ করার পর ক্লান্ত হয়ে পরতাম। জ্ঞান হারিয়ে ফেলতাম। কয়েকবার চর্চার পর শিখে যাই শক্তি প্রয়োগের পরেও কিভাবে ফিরত আনা যায়। সেগুলো অজানাই থাকুক। ’ _ ‘নথি, পত্রগুলো কী আছে?’ প্রশ্ন করলেন সাধু। _ ‘কবেই জ্বালিয়ে দিয়েছি।’ বলল নীল। একটু থেমে আবারও নীল বলতে শুরু করল, ‘ক্ষমতা পেলাম, পাঁচ জন ধর্ষককে খুন করে নিজের ক্ষমতা যাচাই করে নিলাম। এরপর শুরু করলাম পরিকল্পনা। কিভাবে গোয়েন্দা প্রধানকে কুকুরের মতো দৌড়াব তার পরিকল্পনা। পরিকল্পনা মাফিক অনেকগুলো খুন করে গোয়েন্দা প্রধানের চোখে আসি। গোয়েন্দা প্রধান জানতে আমি উনাকে পূর্বে অনেকবার হত্যা করতে চেয়েও করিনি। তিনি তার কিছু গুপ্তচরদের দিয়ে জানতে পারেন আমি এসব খুন করছি। তোমাদের সামনে তিনি দুধের শিশুর মতো আচরণ শুরু করেন। ভেতর ভেতর উনি সবটাই জানতে। পরিকল্পনা মাফিক সব কিছু হলো, আমি খুনও করতে লাগলাম। গোয়েন্দা প্রধানের চোখেও এসে পরলাম । তবে এর ভেতর লেখকদের এক মিলনায়তন থেকে জানতে পারি আমার শক্তির সীমাবদ্ধতা কতটুকু। সেদিন সারা রাত ভাবার পর বুঝতে পারি একদিন আমিই সময় ভ্রমণ করে অতীতে গিয়ে আমার বাবা-মায়ের খুনীদের হত্যা করব। কিন্তু আমি চিন্তায় পরে যাই, গোয়েন্দা প্রধানকে কে হত্যা করবে? আমি তো সরাসরি গিয়ে খুন করতে পারব না। সেদিন হাসপাতালে আপনাকে দেখে বুঝে যাই আপনিই খুন করবেন গোয়েন্দা প্রধানকে।’ নীল সাধুর দিকে আঙুল দিয়ে ইশারা করে কথাটা বলল। _ ‘আমার খুন করার স্টাইল, ন্যায় সবকিছু আপনাকে প্রভাবিত করছিল। বুঝে যাই যখন শুনবেন গোয়েন্দা প্রধান একজন অপরাধী তখন আপনি তাকে ছাড়বেন না। যেই ভাবা সেই কাজ আমি আমার পরিকল্পনা মাফিক সবকিছু করে যাই। আমার ক্ষমতা সম্পূর্ণ প্রয়োগ করে অতীতে ফিরে যাই, খুন করি আমার বাবা মায়ের খুনীদের।’ _ ‘তুমি চাইলে তো তোমার বাবা-মাকে খুন হবার হাত থেকে রক্ষা করতে পারবে তাই না? প্রশ্ন করলেন সাধু। _ ‘পারতাম !আপনারা হয়তো অনেকেই জানেন সময় ভ্রমণ করে অতীতে গিয়ে কোনো কিছু পরিবর্তন করলে তার ফলাফল অনেক রকমের হতে পারে। ভালোও হতে পারে খারাপও হতে পারে। এটা হলো তাদের না বাঁচানোর একটি করে। তবে এটি মূল কারণ নয়। মূল কারণ হলো এমনটি করলে আমি সময়ের ছায়া হ’তাম না আর আমার দ্বারা এতগুলো লোক ন্যায়ও পেত না, আর অপরাধীরাও অপরাধ করার সময় সময়ের ছায়ার কথা ভেবে থমকে দাঁড়াত না। তাই ক্ষমতা থাকার পরেও আমি বাঁচাইনি। তাছাড়া ভাগ্য! জন্ম মৃত্যু তো স্রষ্টার হাতে। তাদের বাঁচালেও হয়তো সেদিনই তারা কোনো না কোনো ভাবে মারা যেতো! ’ সাধু হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ালো। অনিশা নীলকে প্রশ্ন করল, ‘সাধুকে কী করে বাঁচালে?’ _ ‘কিভাবে আর? উনাকে যে গাড়িতে করে জেলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল সেই গাড়িটা পুরো ধুমড়ে মুচড়ে দিই। সবাই মারা যায়! শুধু সাধু ছাড়া। কারণ আমি সাধুকে আগেই গাড়ি থেকে বের করে ফেলি। আর গাড়িটাতে তো আগুন লেগে যায়, বিস্ফোরণ হয়। সবাই ভেবেছে সাধু মারা গেছে। সাধুর স্থানে একটা পোড়া লাশ সেখানে রেখে আসি। আর যদি জেনেও যায় সাধুর লাশ ওটা নয় তাতে কী? সাধুকে কেউ খুঁজবে না। আর খুঁজলেও পাবে না।’ _ ‘নীল আমায় বাঁচাল, তাছাড়া তার ন্যায় নীতি দেখে আগেই আমি মুগ্ধ, হয়ে গেলো আমাদের মাঝে বন্ধুত্ব। আর ফারহান তো শুরু থেকেই নীলের পক্ষেই ছিল। কেসের প্রতি তার যা গাফিলতি ছিল!’ হেসে বলল সাধু। _ ‘আমি শুধু নাম মাত্র আপনার সাথে সাথে সব খানে গিয়ে ছিলাম। কেসের প্রতি আমার মোটেও মনোযোগ ছিল না। আমি তো সব সময়ই চেয়ে ছিলাম নীল ধরা না পড়ুক ।’ ফারহান ভ্রু কুঁচকিয়ে বলল, ‘মিনিট দুয়েক ধরে মনে হচ্ছে দরজায় কেউ কড়া নাড়ছে!’ অনিশা বলল, ‘আমারও তো তাই মনে হচ্ছে।’ ফারহান হন্তদন্ত হয়ে দাঁড়িয়ে বলল, ‘ওহ! নো!’ ফারহান দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলে দিল। দরজার বাহিরে দাঁড়িয়ে আছে ফারহানের সহকর্মী নীলয় আহসান। নীলয় ফারহানের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আপনে মিয়া বহুত বদ!’ নীলয় ভেতরে প্রবেশ করল। নীল নীলয়ের দিকে তার হাত এগিয়ে দিলো। হস্তমেলন শেষে নীল বলল, ‘তোমার নাম নীলয় আর আমার নাম নীল! নামের বেশ মিল! ’ নীলয় মাথা নাড়ালো। সে বলল, ‘মনে হচ্ছে এখানে খোশগল্প হয়েছে!’ ফারহানের হাতে থাকা চায়ের কাপটি নীলয় নিজ হাতে নিলো। চায়ের কাপে একটি চুমুক দিয়ে বলল, ‘বাহ্! সেই হয়েছে তো! ওহ, হ্যাঁ। আমি বরাবরই চা প্রেমিক।’ ফারহান নীলয়ের কাঁধে হাত দিয়ে হেসে বলল, ‘হ্যাঁ, এই ব্যাটাই হলো নীলের দলের লোক ।কারণ নীলের মতো এও চা প্রেমিক। নীল ভাই শেষ পর্যন্ত তোমার দলে একজন তো পেলে।’ সবাই এক সাথে উচ্চস্বরে হাসি হাসল। মৃদু গলায় নীল বলল, ‘শুভ এক সমাপ্তি।’ নীলের কানের কাছে মুখ রেখে ফারহান বলল, ‘সমাপ্তি নয় বৎস। এখনো তো ত্রিশ খানা খুন তোমাকে করিতেই হইবে। আমি কিছু পিশাচদের লইয়া আসিয়াছি।’ _ ‘বাহ্! সাধুর শিষ্য ফারহানও দেখি সাধু হয়ে গেলো! ’ মুচকি হাসি হেসে বলল নীল। সমাপ্তি………..


এডিট ডিলিট প্রিন্ট করুন  অভিযোগ করুন     

গল্পটি পড়েছেন ১০২৮ জন


এ জাতীয় গল্প

গল্পটির রেটিং দিনঃ-

গল্পটির বিষয়ে মন্তব্য করুন

  • গল্পটির বিষয়ে মন্তব্য করতে আপনার একাউন্টে প্রবেশ করুন ... ধন্যবাদ... Login Now
  • Sayem Rabbi
    User ৪ বছর, ২ মাস পুর্বে
    Wow!! What a story!!!

  • Sayem Rabbi
    User ৪ বছর, ২ মাস পুর্বে
    Wow!! What a story!!!

  • Jubayer Ahmed
    Golpobuzz ৪ বছর, ২ মাস পুর্বে
    supper.