বাংলা গল্প পড়ার অন্যতম ওয়েবসাইট - গল্প পড়ুন এবং গল্প বলুন

বিশেষ নোটিশঃ সুপ্রিয় গল্পেরঝুরিয়ান - আপনারা যে গল্প সাবমিট করবেন সেই গল্পের প্রথম লাইনে অবশ্যাই গল্পের আসল লেখকের নাম লেখা থাকতে হবে যেমন ~ লেখকের নামঃ আরিফ আজাদ , প্রথম লাইনে রাইটারের নাম না থাকলে গল্প পাবলিশ করা হবেনা

আপনাদের মতামত জানাতে আমাদের সাপোর্টে মেসেজ দিতে পারেন অথবা ফেসবুক পেজে মেসেজ দিতে পারেন , ধন্যবাদ

নেমেসিস

"গোয়েন্দা কাহিনি" বিভাগে গল্পটি দিয়েছেন গল্পের ঝুরিয়ান Shahriar Hasan (০ পয়েন্ট)

X #Nemesis লেখক:#শাহরিয়ার_হাছান পর্ব-১ “একজন স্বার্থক অপরাধী কে জানিস?’’ সায়েম একটু হাসল ।হেসে সে বলল, “মামুন,এসব আজগুবি প্রশ্ন কেনো করছিস? ’’ “আমার প্রশ্নের উত্তরটা কিন্তু আমি পাইনি ।’’ চেয়ারে বসতে বসতে বেশ গম্ভীর গলায় কথাটা বলল মামুন । সায়েম কয়েক সেকেণ্ড ভেবে বলল, “যখন অপরাধী অপরাধ করার পরেও ধরা খায় না।’’ মামুন সায়েমের কথা শুনে একটা মুচকি হাসি দিয়ে বলল,“ভুল!” সায়েম একটু নড়ে চড়ে বসলো। ভ্রু কুঁচকিয়ে মামুনের দিকে তাকিয়ে রইলো সায়েম। মামুন গম্ভীর স্বরে বলল, “যখন অপরাধী অপরাধ করার পরে ধরা তো পড়েই না, বরং তার বদলে অন্য কেউ অপরাধী প্রমাণিত হয় এবং সাজা প্রাপ্ত হয়। ’’ মামুনের রহস্যজনক কথায় সায়েম কিছুটা ভয় পেয়েছে ।সে চেয়ারে নড়ে চড়ে বসল । কপালে তার বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে । হাত দিয়ে সেগুলো মুছে ফেলল । একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ছেড়ে সায়েম বলল, “আসলে তুই আমায় কী বলতে চাচ্ছিস?আমি কিন্তু তোর কোনো কথার অর্থ বুঝতে পারছি না।’’ মামুন এক গাল হাসল । হেসে সে বলল, “আরে দোস্ত চিন্তার কিছু নেই । ভয় পাচ্ছিস না তো? আরে আমি একটা গল্পের বই পড়েছি, সেখান থেকেই এসব জেনেছি।’’ “গল্পের নাম কী?’’ “একটি নিখুঁত খুন।’’ “গল্পটা তোর মাথা খেয়েছে । তাই এসব আজগুবি কথা বলছিস ।’’ “আরে দোস্ত এসব বলার একটা কারণও আছে। সেই গল্পের মতো একটা পরিবেশ এখানেও তৈরি হয়েছে । পড়ন্ত বিকেল, খালি বাড়ি, বাগানে পাখির কিচিরমিচির শব্দ । নীরব শান্ত একটা পরিবেশ । খুন করার মোক্ষম সময় । বাগানে চুপচাপ লাশ পোঁতাও যাবে। বলতে গেলে খুন করার এক আদর্শ পরিবেশ । ঠিক গল্পের মতো ।’’ মামুনের এমন অদ্ভুত কথা শোনে সায়েমের গলা শুকিয়ে গেল । “মামুন পাগল হয়ে যায়নি তো? মামুন কী চাচ্ছে? সে কী তার খুনের নেশা মেটাতে আমায় খুন করবে? নাকি সে মজা করছে?’’ মনে মনে নিজেকে নিজে প্রশ্ন করল সায়েম। সায়েমের মগজে আশা দুঃচিন্তা পুরোপুরি চলে গেল যখন মামুন বলল, “আচ্ছা দোস্ত আজ অনেক আড্ডা দিয়েছি, তোর সাথে কাল দেখা হবে। ’’ মামুন চলে গেলো । সায়েম আর মামুন ছোট বেলার বন্ধু । একসাথেই তারা লেখাপড়া করেছে । মামুন ছুটির দিন সায়েমের বাড়িতে আড্ডা দিতে আসে। ছুটির দিন শুধু মাত্র শুক্রবার আর শনিবার।প্রতি শুক্রবারই মামুন সায়েমের বাড়িতে আসে। তবে আজ শুক্রবারের আড্ডার বিষয়বস্তু সারা জীবন তার স্মরণে থাকবে । মামুনের বলা প্রতিটা কথা তার মগজের ভেতর গেঁথে গেছে । মিনিট দশেক হলো মামুন চলে গেছে । কিন্তু সায়েম এখনো ভাবনায় বিভোর। মামুনের বলা কথাগুলো সে মগজের ভেতর বার বার নেড়ে চেড়ে বোঝার চেষ্টা করছে। ঘরের সদর দরজা ঠেলে কারো প্রবেশের শব্দ পেল সে । সায়েম রুম থেকে বেরিয়ে দেখল চাকর রতন বাড়িতে ঢুকেছে । রাতের খাবারের জন্যে কিছু বাজার সদাই করতে গেছিলেন তিনি। সায়েম আবার নিজ রুমে ফিরে গেল । তার বাবা-মা পৃথিবীতে নেই । মাস খানেক হলো তার মা মারা গেছেন । সেই শোক এখনো সে পুরোপুরি কাটিয়ে উঠতে পারেনি।আর তার বাবা আরো পাঁচ বছর পূর্বেই মারা গেছেন এক দুর্ঘটনার কবলে পড়ে। কেউ বলে পরিকল্পিত খুন তো কেউ বলে সাধারণ দুর্ঘটনা মাত্র । সায়েম তার এই দোতালা বাড়িতে চাকর রতন চাচার সঙ্গেই বসবাস করে । চাকরির সুবাদে শহরে থাকা, নইলে সে গ্রামে চলে যেত । ভাবনায় ছেদ পড়ল,যখন রতন চাচা বললেন, “বাবা তোমার চা। ’’ চেয়ারের পাশে থাকা টেবিলে চায়ের কাপ রেখে রতন চাচা চলে গেলেন। সায়েম টেবিলে রাখা চায়ের কাপ নিতে গিয়ে খেয়াল করলো একটা বই পড়ে আছে টেবিলে । বইটি যথাসম্ভব সে মামুনের হাতে দেখে ছিলো। হয়ত সে নিতে ভুলে গেছে । বইয়ের প্রচ্ছেদে বড় বড় অক্ষরে ইংরেজিতে লিখা Nemesis। সায়েম বিড় বিড় করে বলে ওঠে, “নেমেসিস!’’ নেমেসিস নাম দেখে বইটি পড়ার জন্যে কৌতুহল কাজ করতে লাগলো । সে ভাবল মামুনকে সামনের শুক্রবার বইটি ফিরত দিবে । ক্রিং ক্রিং শব্দে তার ফোন বেজে উঠল । ফোন ধরতেই ওপাশ থেকে মামুন বলে ওঠে, “আজই লাইব্রেরী থেকে নেমেসিস নামের বইটি নিয়েছি। কিন্তু ভুলবশত তোর টেবিলের উপর রেখেই চলে এসেছি । এখন বাসে আমি, ফিরত যাবার উপায়ও নেই । বইটি যত্নে রাখিস, আমি সামনের শুক্রবার তোর বাড়িতে আসলে নিয়ে যাবো ।’’ ফোন কেটে গেলো । সায়েমের মুখে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠল । যাক তার আশাটা পূরণ হয়েছে। বইয়ের প্রথম পৃষ্টায় নেমেসিস শব্দের অর্থটা তার চোখে পড়ল । নেমেসিস অর্থ যতটুকু অপরাধ ঠিক তার সমপরিমাণ শাস্তি, এক চুল কম বা বেশটিও নয় অর্থাৎ ন্যায্য বিচার, অন্যায়ের প্রতিশোধ । নেমেসিস শব্দটা বেশ রহস্য জনক। ড্রয়ারে বইটি রেখে সে চায়ের কাপে চুমুক দিলো। খোলা জানালা দিয়ে শীতল হাওয়া ঘরে প্রবেশ করছে। শীত যে ঘনিয়ে এসেছে তার আগাম আভাস দিচ্ছে এই শীতল বায়ু। কিছুটা ঠাণ্ডা লাগতেই সে ওঠে সিলিং ফ্যানটা বন্ধ করে দিলো। ফিলিং ফ্যানের ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দটাও ধীরেধীরে মিলিয়ে যেতে লাগল। পুরো ঘরে এখন পিনপতন নীরবতা বিরাজ করছে। টেবিলের পাশে থাকা চেয়ারে সে আবার গিয়ে বসল। চা পান শেষ কম্পিউটারে সে কিছু অফিসের কাজ কর্ম করতে লাগল। দেখতে দেখতে রাত আটটা পেরিয়ে গেল। কাজ শেষ করে রাতের খাবার খেয়ে বিছানায় সে গা এলিয়ে দিলো। ডান হাতে তার নেমেসিস নামক বইটি। শুয়ে শুয়ে পড়ার পরিকল্পনা তার। বইয়ের প্রথম পাতায় তথা গল্পের প্রথম বাক্যেটি ছিলো, “আজ আমি দুটো খুন করেছি । তাজ্জব বিষয় হলো যাদের আমি খুন করেছি তাদের কাউকেই আমি চিনি না। শুধু মাত্র আমার খুনের নেশা মেটাতে তাদের হত্যা করেছি আমি। পুরো জামা রক্তে লেপটে আছে। সামনে পড়ে আছে দুটো বিকৃত মৃত দেহ। তাদের হাত-পা জোড়া ও মাথা কেটে ফেলেছি আমি। মোট ছয় টুকরো করেছি তাদের। লাশগুলো ব্যাগে ভরে নিলাম। ব্যাগে ভরে টুকরো করা লাশ দুটো নদীতে ফেলে দিব; কেউ টেরও পাবে না।এজীবনেও কেউ বুঝতে পারবে না আসল খুনী কে! হাহাহা’’ বইয়ের প্রথম পৃষ্ঠা পড়ে সায়েমের মনে সন্দেহ উঁকি দিলো। কারণ লিখাগুলো সাধারণ বইয়ের মতো নয়। বইয়ের মোট পৃষ্ঠা সংখ্যা দেখে বোঝা যাচ্ছে বইটি বারো থেকে তেরো ফর্মার হতে পারে। কিন্তু অদ্ভুত বিষয়টা হলো বইয়ের লিখনী কোনো ছাপা লিখনী নয়। বরং একজন মানুষের হাতের লিখা! কালিগুলো লেপটে গেছে, পৃষ্ঠাগুলো হলদে হয়ে গেছে। অনেক পুরো বই। সায়েম প্রতি পৃষ্ঠা ভালো করে দেখতে লাগল। হাতের লেখার কিছু ভিন্ন ঘটেছে প্রতি বিশ পৃষ্ঠা অন্তর অন্তর। সে শুনেছিল সময়ের সাথে মানুষের হাতের লিখার কিছুটা পরিবর্তন ঘটে। কিছুক্ষণ বইটি দেখার পর সায়েম বইটি ছুড়ে ফেলে দিল। এটা কোনো বই নয়,বরং একজন মানুষের হাতে লিখা ডাইরী অর্থাৎ দৈনিক দিনলিপি। ডাইরীর প্রচ্ছেদে শুধু নেমেসিস লিখা,তাই পরের পৃষ্ঠার নেমেসিস নিয়ে কিছু ছাপা অক্ষরে লিখা ছিলো। সায়েমের মাথাটা ভারী হতে লাগল। একজন বিকৃত মস্তিস্কের খুনীর ডাইরী তার হাতে! খুনীটা কী আজ অব্দি ধরা পড়েছে? নাকি এখনো সে তার খুনের নেশা মেটাতে একের পর এক খুন করেই চলেছে? বিছানা থেকে নেমে মেঝেতে পড়ে থাকা ডাইরীটা সে তুলে নিলো। ডাইরীতে নিশ্চয়ই খুনীর সম্পর্কে কিছু তথ্য রয়েছে। হয়ত খুনীর পরিচয়ও রয়েছে। ডাইরীর শেষ কয়েক পৃষ্ঠায় সে চোখ বুলালো; ডাইরীর শেষ সাতটি পাতা খালি! খুনী ধরা পড়েছে কী না তা শেষ কয়েক পৃষ্ঠায় চোখ বুলিয়ে সে পেলো না। অবশ্য ধরা পড়লে আর ডাইরীতে লিখবেই বা কী করে? হয়ত পুরো ডাইরী পড়ে ধরা পড়া বা না পড়ার সম্ভাবনা অনুমান করা যাবে। কিংবা খুনীর পরিচয় জানা গেলে খুঁজে দেখলেই বোঝা যাবে। এখন পুরো ডাইরী পড়া ছাড়া আর কোনো উপায় এই মুহূর্তে তার মগজে আসছে না। নেমেসিস শব্দের অপব্যবহারের শাস্তি তো খুনীকে পেতেই হবে। ডাইরীটা নিয়ে সায়েম টেবিলের পাশে থাকা চেয়ারে গিয়ে বসল। পুরো ডাইরীটা আজ সে পড়েই শেষ করবে। টেবিলের উপর ডাইরীটা সে মেলে ধরল। দ্বিতীয় পৃষ্ঠার চোখ স্থির করল। ডাইরীর দ্বিতীয় পৃষ্ঠায় গাছের বেঁচে থাকার জন্যে প্রয়োজন কার্ব-ডাইঅক্সাইড। কিন্তু শুধু কার্বন-ডাইঅক্সাইড তাকে বাঁচিয়ে রাখতে যথেষ্ট নয়। মাটির নিচের পানি, সূর্যের আলোরও প্রয়োজন পড়ে। ঠিক তেমনি আমারও শুধু অক্সিজেন আর খাদ্যে পোষায় না। মানুষের রক্ত ও কাঁচা মাংসের গন্ধও প্রয়োজন। কেউ নেশা মেটাতে বিড়ি-সিগারেট টানে আবার কেউ মাদক সেবন করে। আর আমি আমার নেশা মেটাতে খুন করি। এই অব্দি সাতটি খুন করেছি আমি, ধরতে পাড়ল না কেউ। বরং অন্য কেউ আসামী প্রমাণিত হয়েছে। কালো কাপড়ে চোখ বাঁধা লেডি জাস্টিসের সত্য মিথ্যের দাঁড়িপাল্লা এদিক সেদিক করা ওতটা কঠিন কাজ নয়;কারণ আমি যে উকিল। চলবে…. পর্ব -২ এই তমসা রাতের হিমাংশুই আমার প্রতিটি খুনের এক মাত্র সাক্ষী। কিছুক্ষণ হিমাংশুর দিকে তাকিয়ে রইলাম। এই খুনের নেশা আমার কবে যে মিটবে! ডান হাতে একটা ধারালো ছুড়ি, ছোট্ট খাটো রুমের এক কোণে একটা খাট। খাটে গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন হয়ে আছে একজন মহিলা। বয়স চল্লিশের বেশি হবে। ধারালো ছুরিটা নিয়ে মহিলার দিকে ধীরু পায়ে এগিয়ে গেলাম। গলার কাছে ছুরি নিয়ে জোরে একটা টান দিলাম। মহিলাটা একটু কেঁপে উঠল, পরোক্ষণে ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে গেলো। রক্তে পুরো বিছানা ভেসে গেছে। ভেবে ছিলাম ধর্ষণ করব, কিন্তু জীর্ণ শীর্ণ দেহ দেখে সেই আকাঙ্ক্ষা আর জাগে নাই। যে জানালাটা কেটে ভেতরে ঢুকে ছিলাম সেই জানালা দিয়ে আবার বেরিয়ে আসলাম । হেঁটে গলি পেরিয়ে সড়কে আসলাম। সড়কের দু'পাশ পুরো ফাঁকা। আমার হাতে এখনো ছুরিটা আছে, ছুরিতে এখনো তাজা রক্ত লেগে আছে। সেখান থেকে ফোঁটায় ফোঁটায় রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। ডাইরীর দ্বিতীয় পৃষ্ঠা পড়ার পর সায়েম একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলল। বিড় বিড় করে সে বলে ওঠে, “ঠাণ্ডা মস্তিস্কের ভয়ানক এক খুনী।’’ গলাটা তার শুকিয়ে গেছে। ওঠে গিয়ে সে এক গ্লাস পানি পান করে আবার নিজ আসনে ফিরল। চোখ দুটো তার বুঝে আসছে ; প্রচুর ঘুম ধরেছে। ডাইরীটা বন্ধ করে চেয়ার ছেড়ে সে ওঠে দাঁড়াল। টেবিল ঘেঁষে থাকা জানালাটা দিয়ে ঠাণ্ডা হাওয়া রুমে প্রবেশ করছে। জানালা বন্ধ করতে হাত এগুতে গিয়ে সে থমকে দাঁড়াল। জানালার বাহিরে সড়কের ধারে ল্যাম্পপোস্টের নিচে একটা লোক দাঁড়িয়ে আছে। লোকটা মাটির দিকে তাকিয়ে এক মনে সিগারেট টেনেই যাচ্ছে। লোকটা অনেক কালো ল্যাম্পপোস্টের নিচে দাঁড়িয়ে থাকার পরও তার মুখ অস্পষ্ট। সায়েম সেদিকে এতটা গুরুত্ব না জানালা বন্ধু করে ঘুমিয়ে পড়ল। সকাল সকাল তার রুমের দরজা ধাক্কার তীব্র শব্দে ঘুম ভেঙে গেলো। সে বিরক্ত হয়ে রাগি মুখে দরজা খুলে এক হাঁক দিতে নিলো ; পরোক্ষণে সে থেমে গেলে। দরজার ওপাড়ে দাঁড়িয়ে আছে একজন পুলিশ। সায়েম নিজের ভেতর থাকা রাগের আর বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে পাড়ল না, মনের ভেতর দমিয়ে রাখল। লম্বা একটা সালাম মেরে সে বলল, “স্যার ভেতরে আসুন। ’’ টেবিলের পাশে থাকা চেয়ারে লোকটা বসে পড়ল। আরেকটা চেয়ার এনে সায়েম পুলিশ অফিসারের মুখোমুখি হয়ে বসে পড়ল। ভয়, উত্তেজনা, কৌতুহল সবটা কাজ করছে তার ভেতর। “একবার চোখের সামনে নিজের কৃত কর্মগুলো ভাসিয়ে তুললাম। নাহ! আমি তেমন কোনো বড় বড় পাপ কাজ তো করিনি যে জেলে যেতে হবে। ছোটো খাটো কয়েকটা মিথ্যে কথা শুধু বলেছি।’’ মনে মনে নিজেকে নিজেই বলল সায়েম। পুলিশ অফিসার একটা কাশি দিয়ে বলল, “মিস্টার সায়েম ভয়ের কোনো কারণ নেই। আপনাকে জেলে যেতে হবে না ; আমি তো শুধু আপনার সঙ্গে কিছু কথা বলতে এসেছি। আপনার কিছু সাহায্য দরকার। ’’ কিছুটা আস্থা পেয়ে সায়েম বেশ দৃঢ় গলায় বলল ওঠে, “হ্যাঁ, বলুন কী সাহায্য করতে পারি আপনার।’’ “কাল রাতে আপনার বাড়ি আশে পাশে কোনো অচেনা আগন্তুক দেখে ছিলেন?’’ “কই না তো! কিন্তু হঠাৎ এই প্রশ্ন কেনো? কী হয়েছে?’’ “কাল রাতে আপনার বাড়ি থেকে বেশ কয়েক মিটার দূরে একটা খুন হয়েছে। ’’ “খু….খুন! কী বলছেন কী?’’ কিছুটা ভয় পেয়ে বলল সায়েম। “হ্যাঁ খুন। ’’ সায়েম একটু ভেবে প্রশ্ন করল, “আচ্ছা লোকটা দেখতে কেমন ছিল?’’ “কুচকুচে কালো। উচ্চতা ছয় ফুটের কাছাকাছি।’’ “তা আপনি আমার কাছে কী চান?’’ “না,মানে যদি লোকটাকে আপনি দেখে থাকেন?এ একটু ইন্ভেস্টিকেশন।’’ কথার মাঝে রতন চাচা দু'কাপ চা নিয়ে হাজির হলো। সায়েম রতন চাচাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “চাচা আজ কী এলাকায় কোনো খুন হয়েছিল?’’ কথাটা বলেই সাথে সাথে সায়েম টেবিলের উপর থাকা ডাইরীটা সরিয়ে ফেলল। রতন চাচা ভ্রু কুঁচকিয়ে বলল, “কই না তো?আমি তো কোনো খুনের কথা শুনি নাই। ’’ মুহূর্তের ভেতর পুলিশের পোষাকে থাকা লোকটা রতন চাচা ধাক্কা মেরে সায়েমের গায়ের উপর ফেলে দিলো। এক মুহূর্তও দেরি না করে লোকটা দৌড়ে পালিয়ে গেলো। সায়েমের উপর থেকে রতন চাচা কোনো মতে ওঠে দাঁড়িয়ে গেলেন। কাঁপা গলায় তিনি বললেন, “বাবা সায়েম এসব কী হচ্ছে?’’ সায়েম গম্ভীর গলায় বলল, “নকল পুলিশ অফিসার ছিল সে। ভাগ্য ভালো আপনি সময় মতো এখানে এসে ছিলেন। শুরুতেই আমার সন্দেহ হয় যখন লোকটা টেবিলের পাশের চেয়ারে বসার পর বার বার ডাইরীতে হাত দিচ্ছিল। তখনিই মনে খটকা জাগে। যা-হোক চাচা ঘরে অচেনা কাউকে প্রবেশ করতে দিবেন না। হোক পুলিশ, দরজার খুলবেন না। ’’ রতন চাচা হ্যাঁ সূচক মাথা উপর থেকে নিচে নাড়ালেন। এরপর তিনি সেখান থেকে চলে গেলেন। “লোকটা কে ছিল? লোকটাই ডাইরীর খুনীই?কিন্তু খুনী হলে তো সে সোজা আমাকে রাতে আঁধারে হত্যা করেই ডাইরী নিয়ে যেতো। কিছু একটা গড় মেলে। প্রথমত ডাইরীটা লাইব্রেরীতে থাকা তারপর আজকের ঘটনা। কিছু তো রহস্য রয়েছে। পুলিশের কাছে এই ডাইরীটি দিয়ে দিব কী?’’ চেয়ারের বসে ভাবতে লাগলো সায়েম। আজকের নকল পুলিশ দেখে থানায় যাবার সাহসটা সে পেলো না। আবার সে ভয়ও পাচ্ছে পথে ঘাটে যদি তার উপর আক্রমণ হয়? একটা জিনিস সে বুঝতে পেরেছে তা হলো রাতে দেখা ল্যাম্পপোস্টের নিচে থাকা কালো ব্যক্তিটাও হয়ত নকল পুলিশ অফিসারের সাথে জড়িত। না হলে সে কী করে জেনেছে ল্যাম্পপোস্টের নিচে গভীর রাতে একটা কালো লোক ছিলো? সায়েম আরো একটা বিষয় লক্ষ্য করেছে ; তা হলো যদি ওই দুইজন লোক একই দলের হয়ে থাকে তাহলে কোনো ভাবেই তারা ডাইরীতে লিখা খুনী নয়। কারণ ডাইরীর সেই খুনী স্থির মনে খুন করে। আর সে উকিল, তার কথা হবে অন্য রকম। শক্তপোক্ত এবং যুক্তিযুক্ত। কিন্তু আজকের নকল পুলিশের ভেতর এমন কোনো গুণ ছিল না। নিশ্চয়ই এই ডাইরীর রহস্য অনেক গভীর। রহস্য উন্মোচন না কর অব্দি ক্ষান্ত হবে না সে। নানান দুঃচিন্তায় সকালটা কোনো মতে কেটে গেলো। দুপুরের আহার শেষে সায়েম মামুনকে ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করল, “আচ্ছা, তুই যে নেমেসিস বইটা রেখে গেছিলি সেটা কোথা থেকে কিনেছিলি?’’ “আচ্ছা আমি তোকে ঠিকানা পাঠাচ্ছি। ’’ মামুন মেসেজে সায়েমের ফোনে ঠিকানা পাঠিয়ে দিলো। সায়েম ঠিকানা দেখে বুঝতে পাড়ল তার বাড়ির দিকে আসার পথে লাইব্রেরীটা পড়ে। ছোটো খাটো লাইব্রেরী। সেও কয়েকবার সেখানে গিয়েছে। বিকেল বেলায় সায়েম কাঙ্ক্ষিত লাইব্রেরীর উদ্দেশ্যে বের হলো। লাইব্রেরীতে পৌঁছতে তার তেমন কোনো অসুবিধাই হয়নি। লাইব্রেরীয়ানের কাছে গিয়ে সায়েম বলল, “আপনাদের এখান থেকে এই বইটা আমার বন্ধু গতদিন নিয়েছে ; আমি বইটি ফিরত দিতে চাই। ’’ লাইব্রেরীয়ান নিচু সরে বলে ওঠে, “বইটি আমাদের এই লাইব্রেরীর নয়। আপনার কোথাও ভুল হচ্ছে। ’’ সায়েম অবাক হয়ে বলল, “কী বলছেন আপনি? গতদিন আমার বন্ধু এখান থেকেই বইটা নিয়েছিল। ’’ লাইব্রেরীয়ান সায়েমের হাতে থাকা বইটি তথা ডাইরীটি নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখে বলল, “না স্যার এটা আমাদের লাইব্রেরীর নয়। আপনিই বলুন এত পুরনো বই কেউ রাখে? আর তাছাড়া বইয়ের লিখাগুলো দেখে তো মনে হচ্ছে কারো হাতের লিখা ডাইরী এটি। এসব আমরা আমাদের লাইব্রেরীতে রাখি না, কারণ পুরনো বই, ডাইরী, দলিল এসব বর্তমানে আমাদের লাইব্রেরীতে চলে না। মানুষের চাহিদা দিন দিন পাল্টাচ্ছে। আপনার কোথাও ভুল হচ্ছে। আপনি এক কাজ করুন আপনার বন্ধুকে নিয়ে আসুন। ’’ চলবে… পর্ব-৩ হতাশ মনে লাইব্রেরী থেকে বেরিয়ে গেলো সায়েম। ফোন কলে ডায়েল করল মামুনের নম্বরে । তিনবার রিং হবার পর ফোল ধরল সে। ওপাশ থেকে ক্লান্ত গলায় মামুন বলল, “ভাইরে একটু ঘুমাতে দে। পরে আমি কাল দিব, রাখলাম ফোন। ’’ কথাটা বলে মামুন সায়েমকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই ফোন কেটে দিলো। সায়েম দ্বিতীয় বার আর ফোন দিলো না। সে জানে কিছুক্ষণের ভেতর মামুন নিজ থেকেই তাকে ফোন দিবে। দ্রুত পায়ে সে হেঁটে বাড়িতে ফিরে এলো। রাতে আনুমানিক তখন আটটা বাজে,মামুন তাকে ফোন দিয়েছে। ফোন ধরতেই মামুন ওপাশ থেকে কাঁপা গলায় বলে, “বাঁচা আমায়!’’ ফোন কেটে গেলো। সায়েম কয়েকবার মামুনের নম্বর কল দিলো। কিন্তু কেউ ধরেনি। সে চিন্তায় পড়ে গেলো;মামুনের কিছু হয়নি তো? প্রায় আধা ঘণ্টা পর সায়েমের দরজা কেউ কড়া নাড়ল। সায়েম দরজার কাছে গিয়ে ওপাশে থাকা ব্যক্তিকে উদ্দেশ্য করে প্রশ্ন করে, “কে আপনি?’’ বাহির থেকে গম্ভীর গলায় কেউ বলে ওঠে, “ডাইরীটা দিয়ে দিন সাহেব, বিনিময় আপনার বন্ধুকে নিয়ে যান।’’ সায়েম এবং রতন চাচা দুইজনই হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ ধীরে ধীরে প্রকট হতে লাগলো। এই যেন দরজা ভেঙে বাহিরে থাকা হিংস্র লোকটা ভেতরে ঢুকে পড়বে। সায়েম দ্রুত পায়ে ওপরের ঘরে গিয়ে ডাইরীটা নিয়ে নিলো। ডাইরীটা দেয়া ছাড়া আর কোনো পথ তার চোখে পড়ছে না। অপর দিকে রতন চাচা ফোন করে বসলেন পুলিশের কাছে। সায়েম দ্রুত পায়ে নিচে নেমে আসে। সাহস জুগিয়ে দরজা খুলে সে, বাহিরে দাঁড়িয়ে আছে সেই নকল পুলিশ অফিসার। সায়েম হাতে থাকা ডাইরী এক টানে সে নিয়ে নেয়। তারপর হাসতে হাসতে অন্ধকারে মিলিয়ে যায়। ভয়ের কারণে সায়েম মামুনের প্রসঙ্গও টানতে পারে নাই। সে মনে মনে ভাবতে লাগলো, “মামুনের কিছু হবে না তো? তারা কী মামুনকে ছেড়ে দিবে? না কী না?’’ নানান দুঃচিন্তা তাকে গিরে ধরল। কোনো মতে সে দরজার কাছ থেকে সরে গিয়ে একটা চেয়ারে গিয়ে বসল। মিনিট দুয়েক পর রতন চাচা বলে ওঠে, “বাবা সায়েম,আমি পুলিশকে খবর দিয়েছি ; কিছুক্ষণের ভেতর তারা চলে আসবে। চিন্তা করো না মামুনকে পুলিশ অতি শীঘ্রই খুঁজে বের করবে।’’ সায়েম কিছু বলল না, ভেজা চোখে রতন চাচার দিকে তাকিয়ে রইলো। ঠিক তখন পুলিশের গাড়ির শব্দ পায় তারা। রতন চাচা বাহিরে গিয়ে পুলিশদের সায়েম ঘর অব্দি নিয়ে আসে। মোট চারজন পুলিশ এসেছে। এদের ভেতর পুলিশ অফিসার সায়েমের মুখোমুখি হয়ে বললেন, “আপনার চাকরের মুখ থেকে যতদূর শুনলাম তাতে বোঝা যাচ্ছে সব রহস্য সেই ডাইরীকে ঘিরে। ডাইরীটা যেহেতু আপনি পড়েছেন সেহেতু আপনি নিশ্চয়ই অনুমান করতে পারবেন ডাইরীর ভেতর কী আছে?’’ সায়েম কিছুটা রেগে গিয়ে বলল, “সবাই শুধু ডাইরী ডাইরী করছে। মামুনকে খুঁজে বের করুন। তার নম্বর ট্রেস করে তাকে খুঁজে বের করুন।’’ হাত মুষ্টিবদ্ধ করে দাঁতে দাঁত লাগিয়ে কথাগুলো বলল সায়েম। রাগে তার শরীর ফেটে যাচ্ছে। একজন লোক নিখোঁজ সেদিকে কারো কোনো খেয়ালই নেই। শুধু সবাই ডাইরী ডাইরী করছে। পুলিশ অফিসার সায়েমকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “মিস্টার সায়েম, আপনি কিন্তু ভুলে যাচ্ছেন আমি একজন পুলিশ অফিসার। এনি ওয়ে, মামুনের নম্বর আমার সহকারীরা সংগ্রহ করেছে। আর আপনি মামুনের একটি ছবি দিলে আমাদের জন্যে উপকার হতো।’’ সায়েম ফোনের গ্যালারিতে গিয়ে তার সঙ্গে মামুনে একটা সেলফির ছবি পুলিশ অফিসারের দিকে এগিয়ে দিলেন। পুলিশ অফিসার ছবি দেখে একটা মুচকি হাসি হেসে বললেন, “পেয়ে গেছি আপনার বন্ধুকে।’’ ব্যাপক উত্তেজনায় সায়েম দাঁড়িয়ে গিয়ে বলল, “কোথায় সে?’’ “প্রায় পঁয়ত্রিশ মিনিট আগে একটা লোক ফোন দিয়ে বলে তার ঘরে নাকি কিছু অপরিচিত লোক ঢুকে পড়েছে। বাড়ির ঠিকানা দেয় সে। সেই অনুসারে তার বাড়িতে আমরা যাই এবং তাকে রক্তাক্ত অবস্থায় মেঝেতে পাই। বর্তমানে সে হাসপাতালে। তার বাড়ি থেকেই সোজা আপনার বাড়িতে এসেছি।’’ “ওহ আচ্ছা! তার মানে মামুন প্রথমে পুলিশের কাছে ফোন দেয় তারপর আমার কাছে। বুঝেছি মামুনকে পিটে তারপর ওই লোকটা আমার বাড়িতে আসে।’’ “লোকটার চেহারা মনে আছে ?’’ “হ্যাঁ! স্পষ্ট মনে আছে।’’ “তাহলে আপনি কাল বিকেলে থানায় চলে আসবেন। সেখানে স্কেচ আর্টিস্ট থাকে।স্কেচ বানাতে সাহায্য করতে পারবেন তো।’’ সায়েম মাথা উপর থেকে নিচে নেড়ে বলল, “হ্যাঁ, লোকটার স্কেচ অবশ্যই বানাতে সাহায্য করতে পারব।’’ পুলিশ অফিসার বসা থেকে ওঠে দাঁড়ালেন। “তাহলে এবার চলি। আপনার নিরাপত্তার জন্যে দুইজন পুলিশ রেখে গেলাম।’’ পুলিশ অফিসার যেতে নিলেন কিন্তু সায়েম বাঁধা দিয়ে বলল, “মামুন কোন হাসপাতালে রয়েছে?’’ “সদর হাসপাতলে রয়েছে। তবে আপনি কাল সকালে তার সঙ্গে দেখে করতে যান, এখন যাওয়া নিরাপদ মনে করছি না।’’ নিচু স্বরে হতাশ হয়ে সায়েম বলল, “আচ্ছা!’’ সকাল হতেই সায়েম দৌড়ে গেলো হাসপাতালে। মাথায় ব্যাণ্ডেজ রত অবস্থায় সে মামুনকে পেলো। মামুনের পাশে বসে সায়েম বলল, “ঠিক আছিস তুই?’’ মামুন ক্লান্ত স্বরে বলল, “আছি ভাই এখনো বেঁচে!’’ “আচ্ছা তোর উপর কারা হামলা করে? চেহারা দেখেছিস?’’ “নারে ভাই দেখিনি। আমি তো নিজেকে বাঁচাতে এদিক সেদিক ছুটে ছিলাম, ফলে ওদের চেহারা ভালো করে লক্ষ্য করতে পারিনি।’’ “ওরা ক'জন ছিল?’’ “দুই জন।’’ সায়েম মনে মনে নিজেকে বলল, “বুঝেছি কারা তারা।’’ মামুন একটু পর বলে ওঠে, “মানুষের মগজে যদি কি-বোর্ডের মতো ডিলিট বাটনটা থাকত, তাহলে আমি এখুনি গত রাতে ভয়ানক স্মৃতিটা মুছে দিতাম।’’ সায়েম মামুনের কাঁধে হাত দিয়ে বলল, “সব ঠিক হয়ে যাবে। চিন্তা করিস না।’’ বেশি কিছুক্ষণ মামুনের সঙ্গে থাকার পর সায়েম বাড়িতে ফিরে আসে। মামুনকে দুপুরের খাবার খাওয়িয়ে দিয়ে এসেছে সে। তবে খাবারটা হাসপাতাল থেকেই দেয়া হয়েছিল, বাহিরের খাবার মামুনকে খাওয়াতে তারা নিষেধ করেছেন। মামুন এখন ঘুমিয়ে আছে তাই সায়েম বাড়িতে ফিরে আসে। দুপুরের খাবার খেয়ে সে থানার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেলো। অন্য দিকে “কনগ্রাচুলেশন উকিল সাহেব এবারের কেসটাও আপনি জিতে গেলেন ।’’ জনাব শরিফুল ইসলামের দিকে ডান হাত এগিয়ে দিয়ে কথাটা বললেন মেহেরুন। একটা বাকা হাসি দিয়ে হ্যাণ্ডসেক করে সরিফুল ইসলাম বললেন, “সত্যের জয় সর্বদাই হয়।’’ চলবে….. পর্ব-৪ দ্রুত পায়ে কোর্ট থেকে বেরিয়ে গেলেন শরিফুল ইসলাম। তার পিছন পিছন মেহেরুনও। মেহেরুন শরিফুল সাহেবকে উদ্দেশ্য করে বলল, “এই বুড়ো বয়সেও এত জোর?’’ শরিফুল সাহেব বললেন, “এখন আর আগের মতো হাঁটতে পারি না। বয়স তো আমার ষাটের কাছাকাছি। তবুও বিধাতার অশেষ রহমতে হাঁটতে পারছি।’’ “জানেন আপনাকে যত দেখি তত অবাক হই। এত সুনিপুন ভাবে প্রতিটা কেস কিভাবে যে স্টাডি করেন কে জানে! প্রখর স্মৃতি শক্তির অধিকারী আপনি।’’ শরিফুল সাহেব এক গাল হাসল। হেসে তিনি বললেন, “এত সুনাম এই জীবনে প্রথম পেলাম।’’ মেহেরুন কিছু বলল না। একটা বাকা হাসি হাসল। শরিফুল সাহেব নিজ বাড়ির দিকে চলে গেলেন আর মেহেরুন তার বাড়ির দিকে। মনে মনে মেহেরুন নিজেকে নিজে বলছে, “কিছুটা একটা গণ্ডগোল আছে। শরিফুল সাহেব প্রতিটা কেস এমন ভাবে কোর্টে উপস্থাপনা করে যেন সে আগে থেকেই সবটা জানে। তার কাছে দেয়া তথ্য থেকেও সে যেন কিছুটা বেশি জানে।’’ কিছুক্ষণ পর মেহেরুন একটা কেসের ফাইল নেবার জন্যে থানায় যায়। স্কেচ আর্টিস্ট সায়েমকে প্রশ্ন করলেন, “নিশ্চিত তো এই সেই ব্যক্তি?’’ “শত ভাগ।’’ স্কেচ আর্টিস্ট পুলিশ অফিসারের নিকট স্কেচ হস্তান্তর করল। পুলিশ অফিসার স্কেচে থাকা ব্যক্তিটাকে খোঁজার নির্দেশ দিলেন। মেহেরুন পুলিশ অফিসারকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “অফিসার সাহেব তো দেখছি বেশ ব্যস্ত।’’ “ওহ! আপনি এসেছেন? দ্রুত আমার সঙ্গে আসুন।’’ মেহেরুন অফিসারের পিছু পিছু তার ডেস্কে এসো পৌঁছাল। ডেস্কের একটা ড্রয়ার থেকে অফিসার একটা হালকা নীল বর্ণের ফাইল মেহেরুনের দিকে এগিয়ে দিলেন। মেহেরুন ফাইলটা হাতে নিয়ে বলল, “লাশ মর্গে আছে তাই না?’’ “হ্যাঁ মর্গে আছে। তিনশত নয় নম্বর লাশ।’’ “আচ্ছা,আমি তাহলে চলি।’’ মেহেরুন থানা থেকে মর্গের উদ্দেশ্যে চলে গেলো। পুলিশ অফিসারের নিকট সায়েম এসে বলল, “স্যার,এখন আমি কী যেতে পারি?’’ “হ্যাঁ যান।’’ সায়েম থানা থেকে বের হয়ে হাসপাতালের উদ্দেশ্যে বের হলো।মামুন এখন বেশ সুস্থ। ডাক্তার বলেছেন কালকে বাড়িতে নেয়া যাবে। রাত তখন আনুমানিক ন'টা। মামুনকে ঘুম পাড়িয়ে সায়েম নিজ বাড়ির উদ্দেশ্য রওনা হলো। মাঝ পথে মাঠের দিক থেকে কারো চাপা আর্তনাদের শব্দে সে থমকে দাঁড়ালো। মাঠের দিক থেকে সে আবারও একটা চাপা আর্তনাদের শব্দ পেলো। পথের পাশে পড়ে থাকা একটা ইট নিয়ে সে মাঠের দিকে যেতে লাগলো। মাঠে বাঁধা অবস্থায় সে একটা লোককে দেখতে পেলো। লোকটাকে দু'জন লোক লাঠি দিয়ে মারছে। সায়েম চিৎকার দিয়ে হাতে থাকা ইটটা ছুড়ি মাড়ল। ইটটা সোজা লাঠি হাতের একটা লোকের মাথায় লাগল। লোকটা তীব্র এক চিৎকার দিয়ে মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ে। লাঠি হাতে অপর লোকটি সায়েমের দিকে এগিয়ে আসতে নেয়, ধপ করে সে পড়ে যায়। মাটিতে পড়ে থাকা লোকটা পা দিয়ে লাঠি হাতের লোকটার পায়ে আঘাত করেছে। যার ফলে সে পড়ে গেছে। হাত বাঁধা থাকা লোকটা লাফ দিয়ে ওঠে দাঁড়ায়। পিছনে দু'হাত তার বাঁধা। বসে সে হাত দুটো,দুই পায়ের নিচ দিয়ে সামনে নিয়ে আসলো। পড়ে থাকা ইটটা ক্ষিপ্র গতিতে কোনো মতে হাত থাকা রশির ভেতর ঢুকিয়ে দুই হাত দিয়ে চেপে ধরল। লাঠি থাকে থাকা একটা ব্যক্তির মাথায় পাঁচ থেকে ছয়টি আঘাত করে। তীব্র আর্তনাদ এরপর লোকটা নিস্তেজ। অপর লোকটা দৌড়ে পালিয়ে যায়। ইটটা ফেলে দিয়ে হাত বাঁধা লোকটা পৈশাচিক হাসি হাসতে লাগলো। সায়েম লোকটাকে চিনতে পেরেছে। কোনো মতে সে দৌড়ে পালিয়ে গেলো। লাঠি হাতে লোক দুটো নকল পুলিশ অফিসার এবং কালো বর্ণের সেই লোকটি। আর হাত বাঁধা লোকটা সেই খুনী। যার কারণে এত নিখুঁত এবং দ্রুত সে একটা ইট দিয়েই একজনকে খুন করে ফেলেছে। সায়েম দৌড়ে কোনো মতে নিজের বাড়িতে এসে পৌঁছাল। তার ভাবতেই অবাক লাগছে সে প্রকৃত খুনীকে কিছুক্ষণ আগে সাহায্য করেছে? অন্ধকারে খুনীর মুখটা সে দেখতে পায়নি। তার বুক এখনো কাঁপছে। মনে মনে সে ভাবছে, “একটা ইট দিয়ে এত ভয়ানক ভাবে কেউ খুন করতে পারে? লোকটা তাহলে কতটা ভয়ানক! হাদ বাঁধা অবস্থায় এত ক্ষিপ্র গতিতে খুন করতে পারে আর হাত খোলা থাকলে কী হতো?’’ সায়েম সারা রাত ঘুমাতে পাড়ল না। চোখের সামনে বার বকার সেই হত্যার দৃশ্য ভেসে ওঠছে। কোনো মতে রাতটা সে পার করে দিলো । পরের দিন সকালে ঘরের দরজায় কড়া নাড়লেন পুলিশ অফিসার। সায়েম পুলিশ অফিসারকে দেখে অবাক নয়নে তাকিয়ে রইলো। পুলিশ অফিসার নিজেই দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করলেন। পুলিশ অফিসার চেয়ারের বসলেন, চেয়ারের মুখোমুখি আরেকটা চেয়ার নিয়ে সায়েম বসে পড়ল। পুলিশ অফিসার একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, “কালকে যে লোকটার স্কেচ বানিয়ে ছিলেন সেই লোকটার লাশ পাওয়া গেছে। মুখটা পুরো থেতলে গেছে। পাশে ইট পেয়েছি। আর লাশটা পেয়েছি আপনার বাসা থেকে কিছুটা দূরে যে মাঠটা আছে সেখানে পেয়েছি। লাশ ময়নাতদন্তে পাঠিয়েছি, ইট থেকে আশা করি খুনীর হাতের ছাপ পেয়ে যাবো।’’ সায়েম একটু হাসল। তারপর সে বলল, “হাট হতে দুটো হাতের ছাপ পাবেন। একটা হকে একজন উকিলের আরেকটা হবে আমার।’’ “মনে কী?’’ সায়েম এরপর ডাইরীর দুই পৃষ্ঠা থেকে শুরু করে বিগত ক'দিনে ঘটে যাওয়া সব ঘটনা খুলে বলে। এমনকি গত রাতের ঘটনাও। সব কিছু শুনে পুলিশ অফিসার বললেন, “অনেক পুরনো দক্ষ খুনী। সমস্যা নেই আমি তাকে ধরেই ছাড়ব। তাকে তো আপনি অন্ধকারের কারণে দেখতে পারেননি কিন্তু লাঠি হাতের দ্বিতীয় লোকটা নিশ্চয়ই দেখেছে। তাকে ধরতে পাড়লেই হলো।’’ “হ্যাঁ। ’’ “আজ তাহলে চলি। ’’ চলবে…… পর্ব-৫ ঘণ্টাখানেক হলো,মামুনকে হাসপাতাল থেকে সায়েম নিজ বাড়িতে এনেছে। পথে সায়েম মামুনকে সব কিছু খুলে বলেছে। সায়েমের রুমে শুয়ে আছে মামুন। পাশে বসে আছে সায়েম। মামুন সায়েমকে উদ্দেশ্য করে বলল, “আচ্ছা আমি না একটা বিষয় বুঝতে পারছি না।’’ “কী?’’ “তুই যে বললি লাইব্রেরীয়ান বলেছে ডাইরীটা লাইব্রেরীতে ছিল না। কিন্তু এটা কী করে সম্ভব? আমি তো সেখান থেকেই এনেছি। লাইব্রেরীয়ান কেনো অস্বীকার করেছে? এতে তার কী লাভ?’’ সায়েম একটু ভেবে বলল, “আমি একটা বিষয় এখন বুঝে ওঠতে পারিনি;সেটা হলো ডাইরীটা লাইব্রেরীতে কে রাখল?’’ “সেই ব্যক্তিটাকে খুঁজতে পাড়লেই সকল রহস্য উদঘাটন হতো।’’ “কে জানে কে সে! পুলিশ তো চেষ্টা করছে দেখা যাক কী হয়।’’ মেহেরুন পুলিশ অফিসারকে উদ্দেশ্য করে বলল, “অফিসার সাহেব দেখি কোনো কেসের মায়াজালে ফেসে গেছেন।’’ কেসের ফাইল থেকে মুখ তুলে তাকালেন পুলিশ অফিসার। কপালে তার বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে আছে। রুমাল দিয়ে সেগুলো মুছে হাতের ইশারায় মেহেরুনকে ডেস্কের সামনে চেয়ারে বসতে বলল। পুলিশ অফিসার একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, “কেনো যে পুলিশ অফিসার হলাম! জীবনটা বেদনা। কেসের কোনো আড়া গাড়া বুঝতেছি না। এত প্যাঁচ! আবার কেস সমাধান না করতে অক্ষম হলে সাধারণ জনগণ বলবে পুলিশ খারাপ। ঘুষখোর! কিন্তু কে বুঝে সকল পুলিশ অফিসার তো আর খারাপ নয়।’’ “তা বুঝলাম। কিন্তু কোন কেসের মায়াজালে আবদ্ধ আপনি?’’ “আচ্ছা, সবটা বলছি মন দিয়ে শুনুন।’’ মিনিট খানেক পর সবটা শুনে মেহেরুন বলল, “লাইব্রেরীয়ানকে ধরেছেন?’’ “পুলিশ পাঠিয়ে ছিলাম কিন্তু লাইব্রেরীয়ানকে খুঁজে পাওয়া যায় নাই। তার বাড়িতে গিয়ে খুঁজে দেখা হয়েছে। বাড়িতে তালা দেয়া,পালিয়েছে সে।’’ “ওহ, হ্যাঁ আপনাকে তো এক বিষয়ে সম্পর্কে বলায় হয়নি। সায়েম যে খুনীকে রাতে ইট দিয়ে হত্যা করতে দেখে সেই ইটে দুটো আঙ্গুলের ছাপ পেয়েছি। একটি তো সায়েমের অপরটি খুনীর। আঙ্গুলের ছাপই এখন শেষ ভরসা।’’ “কিন্তু খুনী যেহেতু এর আগে ধরা পরে নাই, সেহেতু আমাদের খুনীদের রেকর্ডে থাকা আঙ্গুলের ছাপগুলোর সাথে মিলিয়ে কোনো ফায়দা নেই। এখন একটিই উপায় গণহারে এই কেসে সম্পৃক্ত সকলের আঙ্গুলের ছাপ মেলানো।’’ “না! খুনী এই কেসের সাথে সম্পৃক্ত কেউ নয়। খুনী একজন উকিল,সায়েম খুনীর লিখিত ডাইরী থেকে তথ্যটা জানতে পেরেছে।’’ “ওহ! বুঝেছি আমি। ডাইরী,ডাইরীর খুনী এবং ওদিন রাতে সায়েমের দেখা খুনী সবই একই সূত্রে গাঁথা।’’ পুলিশ অফিসার কিছুটা বিরক্ত হয়ে বললেন, “এত সময় লাগলো বুঝতে?মন কোথায় আপনার?’’ মেহেরুন কিছুটা ইতস্তত হয়ে বলল, “দুঃখিত!’’ পুলিশ অফিসার ওঠে দাঁড়াল। পকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে তাতে আগুন ধরাল। সিগারেটে দুটো টান দিয়ে মেহেরুনের দিকে ফিরে তিনি বললেন, “আচ্ছা, বয়স্ক অনেক উকিল তো আপনার চেনা তাই না? এদের মধ্যে কার উপর আপনার সন্দেহ হয়?’’ মেহেরুন আনমনা হয়ে বলল, “শরিফুল সাহেব।’’ “হঠাৎ উনার নামই কেনো সন্দেহের তালিকায় সবার উপরে এসেছে?’’ “জানি না! তবে লোকটা কেমন অদ্ভুত। আর প্রতিটি কেস যেভাবে জিতে যায় সন্দেহজনক। মনে হয় যেন তিনি আগে থেকেই সবটা জানেন।’’ “উনি অনেক বিজ্ঞ উকিল। উনাকে থানায় ডেকে তো আর আঙ্গুলের ছাপ নিতে পারি না। অসম্মান করা যাবে না।’’ বদ্ধ রুমে সিগারেটের ধোঁয়ায় এক শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। চেয়ারে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় থাকা লোকটার জ্ঞান ফিরেছে। মাথাটা কয়েকবার নাড়িয়ে সে চারিদিকটা দেখে নিলো। চোখ মুখে তার ভয়ের ছাপ স্পষ্ট। অতিরিক্ত সিগারেটের ধোঁয়ার প্রভাবে লোকটা কাশি দিতে শুরু করল। কাশতে কাশতে সে বলল, “এ… আমি কোথায়?আমায় এখানে কে এনেছে?কে আছে?’’ অন্ধকার রুমে শব্দের প্রতিধ্বনি শোনা গেলো। কারো কোনো সাড়া শব্দ পাওয়া যায়নি। রুমটা সম্পূর্ণ খালি। তাই সে নিজের চিৎকারের প্রতিধ্বনি শুনতে পেরেছে। রুমে পুরনো কাঠের দরজা খোলার ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দে ভয়ে সে কেঁপে ওঠে। “কে ওখানে?’’ কাঁপি ঠোঁটে কথাটা বলল লোকটা। দু'বার কেশে,অপরিচিত একটা কণ্ঠস্বর বলে ওঠে, “ভয় পাবার কিছু নেই। আমি ছুরির এক টানেই গলা কেটে দিব। বেশি কষ্ট দিব না। ’’ “কে….কে আপনি?আমি আপনার কী ক্ষতি করেছি?’’ “কোনো ক্ষতি করিস নাই। কিন্তু ভবিষ্যতে করতে পারিস, তাই আগেই তোর অন্তিম সংস্কার করে দিচ্ছি।’’ চেয়ারের বাঁধা লোকটা আচমকা ছুরির টান নিজের গলায় অনুভব করল। তীব্র এক চিৎকার তারপর পিন পতন নীরবতা। মেহেরুনের সঙ্গে ঘটনাস্থলে পৌঁছাল পুলিশ অফিসার। বদ্ধ রুমে পুলিশ অফিসার তার টিমকে নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করল। ভেতরে প্রবেশ করতেই ধোঁয়ার প্রভাব তাদের চোখ জোড়া জ্বলে লাগছে। কিছুক্ষণ পর ধোঁয়া সরাতেই পুলিশ অফিসার দেখলেন মাটিতে একটা কাটা মাথা পড়ে আছে। চেয়ারে বাঁধা অবস্থায় মাথা বিহীন একটা দেহ। মুখটা দেখে পুলিশ অফিসার শনাক্ত করতে পারে এটাই লাইব্রেরীয়ানের মৃত দেহ। পুলিশ অফিসার তার এক সহকারী থেকে খবর পেয়ে ছুটে আসে। সহকারীর কথা মতে সে লাইব্রেরীয়ানের খোঁজ করতে করতে এই অব্দি পৌঁছায়। পুলিশ অফিসারকে যখন ফোন করে ঠিকানাটা বলে ঠিক তখনই চিৎকারের শব্দ পায় সে। এরপর ভেতরে গিয়ে দেখে লাইব্রেরীয়ানের মাথা বিহীন নিথর দেহ। পুলিশ অফিসার তার সহকারীকে প্রশ্ন করলেন, “কাউকে রুম থেকে বেরিয়ে যেতে দেখো নাই?’’ “না স্যার।’’ পুলিশ অফিসার বিড় বিড় করে বললেন, “খুনী তুমি কে?’’ চলবে…. পর্ব-৬ লাশ ময়নাতদন্তে পাঠানোর নির্দেশ দিয়ে পুলিশ অফিসার ও মেহেরুন থানায় ফেরার উদ্দেশ্যে গাড়ি ওঠে। চলন্ত গাড়ির ভেতর আচমকা পুলিশ অফিসার হেসে ওঠে। মেহেরুন কিছু বিচলিত হয়ে প্রশ্ন করে, “স্যার,হাসছেন কেনো?’’ “খুনী ধরা পড়ে গেছে।’’ “কিহ!কখন?কিভাবে?’’ পুলিশ অফিসার তার ফোনটা বের করে একটা ভায়েজ রেকর্ডে গিয়ে একটা ভয়েজ ক্লিপ চালু করলেন। “স্যার,আমরা লাইব্রেরীয়ানকে খুঁজতে খুঁজতে একটা বাড়ির সামনে এসেছি। আমার সন্দেহ লাইব্রেরীয়ান ভেতর।’’ পুলিশ অফিসার প্রতিউত্তরে বলে, “তুমি ভেতরে গিয়ে দেখো।’’ “ওকে স্যার।’’ সেকেণ্ড দুয়েক নিস্তব্ধতা তারপর “স্যার একটা চিৎকারের শব্দ পেয়েছি। আপনি দ্রুত চলে আসুন, মনে হয় খুনী এখানেই।’’ পুলিশ অফিসার ভয়েজ ক্লিপটা বন্ধ করে বললেন, “কী বুঝলেন?’’ “আপনার আর আপনার সহকারীর কথোপকথন।’’ “ভালো করে লক্ষ্য করে দেখেছেন আমার যখন ঘরে প্রবেশ করি তখন রুমে প্রচুর ধোঁয়া ছিল। যার ফলে আমাদের চোখ জ্বলে।’’ “হ্যাঁ তো?’’ “এর মানে রুমের দরজা কখন খোলাই হয়নি। অর্থাৎ আমার সহকারী কখন বাড়ির ভেতরেই যায়নি।’’ “কিন্তু আপনার সহকারী তো রুমের….’’ কথাটা বলতে গিয়েও থেমে গেলো মেহেরুন। একটা টানা হাসি দিয়ে সে বলল, “বুঝেছি। সহকারী রূপী লোকটাই খুনী। সে রুমের ভেতর থেকে কখন বেরই হয়নি। যার ফলে রুমের ভেতর থাকা ধোঁয়া রয়ে যায়।’’ পুলিশ অফিসার একটু হাসল। হেসে সে বলল, “খুনী যত চালাকই হোক না কেনো একটা ভুল সর্বদাই করে ফেলে। না হলে এই জগতে কোনো দিনও কোনো খুনী ধরা পড়ত না।’’ “বুঝি নাই, আপনি খুনীকে না ধরে ছেড়ে কেনো দিলেন?’’ “তাকে বিজয়ের আনন্দ উপভোগ করার জন্যে ছেড়ে দিয়েছি। সে তো ভাব্বে সে বিজয়ী।’’ ফোনের গ্যালারিতে গিয়ে পুলিশ অফিসার সেই নকল সহকারীর ছবিটি মেহেরুনকে দেখিয়ে বলল, “জনাব শরিফুল সাহেবের সঙ্গে চেহারার অনেক মিল। পার্থক্য শরিফুল সাহেবের কোনো দাড়ি নেই, আর এই লোকটার দাড়ি আছে।’’ “হ্যাঁ,তাই তো!’’ “আমরা এখন এডিটরের কাছে যাচ্ছি। ছবি থেকে দাঁড়িগুলো কাটতে হবে তো।’’ মেহেরুন একটু হাসল। হেসে সে বলল, “হ্যাঁ, উকিল সাহেবকে সেইভ করার সময় হয়ে গেছে।’’ “স্যার আপনার বলা মতো ছবি হতে দাড়ি সরিয়ে দিয়েছি। দেখুন তো। ’’ পুলিশ অফিসার ছবিটি দেখে বলেন, “হুবহু শরিফুল সাহেব।’’ মেহেরুন পুলিশ অফিসারকে প্রশ্ন করল, “তাহলে বোয়াল মাছটাকে এখন কিভাবে ধরবেন?’’ “সম্মানের সহিত থানায় ডেকে। উনি যথাসম্ভব দু'দিন পর আমার কাছ থেকে একটা কেসের ফাইল পাবেন।’’ পুলিশ অফিসার নিজ ডেস্কে ফিরে এসে ফোনটা হাতে নিলেন। কল করলেন শরিফুল সাহেবের কাছে। একটা লম্বা সালাম দিয়ে পুলিশ অফিসার বললেন, “থানায় একটু আসতে পারবেন? ওই যে কেসের যে ফাইলটা তৈরি করার কথা ছিল সেটা আজই শেষ করতে পেরেছি। এখুনিই নিয়ে যান।’’ “আসছি। ’’ কল কাটতেই পুলিশ অফিসারের নিকট এক কনস্টেবল এসে বলল, “স্যার যে লোকটাকে আপনি ধরতে বলে ছিলেন তাকে আমরা ধরতে পেরেছি।’’ “কোন লোকটা?’’ “ওই যে স্যার সেদিন মাঠে যে লাশটা আমরা পাই তার সঙ্গে থাকা অপর ব্যক্তিকে।’’ “ওহ! আমি আসছি। ’’ জেল খানার ভেতর পুলিশ অফিসার ঢুকতেই জেলখানায় থাকা ছেলেটা বলে ওঠে, “উকিলের বাচ্চাটা আমার মাকে কয়েক বছর আগে খুন করেছিল। তাকে আমি কী করে ছাড়ি?’’ পুলিশ অফিসার ছেলেটার সামনে থাকা চেয়ারে বসে পড়লেন। এরপর তিনি বললেন, “তোমাকে ছেড়ে দেওয়া হবে। কারণ তুমি নির্দোষ, উকিল সাহেবকে কিছুক্ষণের ভেতর আমরা ধরতে চলেছি। তার কৃত কর্মের ফল তো সে পাবেই। তোমাকে কিছুক্ষণ থাকতে হবে। ডাইরীটা আমার নিকট হস্তান্তর করলে উপকৃত হ’তাম।’’ ছেলেটা পুলিশ অফিসারের নিকট ডাইরীটা দিয়ে দিল। ডাইরীটা নিয়ে পুলিশ অফিসার নিজ ডেস্কে ফিরে এলেন। ঘণ্টাখানেক পর শরিফুল সাহেব থানায় আসলেন। পুলিশ অফিসারের ডেস্কের সামনের চেয়ারে বসে আছেন তিনি। পুলিশ অফিসারের দেয়া ফাইলটা মনোযোগ সহকারে পড়ছেন তিনি। একটু রাগান্বিত হয়ে তিনি বললেন, “এসব কী হচ্ছে? এটা তো আমার কেসের ফাইল নয়।’’ পুলিশ অফিসার মৃদু হাসলেন। “কেনো স্যার কেসটা কী আপনার কাছে অপরিচিত নাকি?’’ “যা-হোক আমার কেসের ফাইলটা দিন।’’ “দিচ্ছি!’’ পুলিশ অফিসার দুটো ছবি শরিফুল সাহেবের দিকে এগিয়ে দিলেন। শরিফুল সাহেব ছবি দুটো দেখে পুলিশ অফিসারের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। একটি ছবি হলো যখন তিনি নকল সহকারী সাজে আর আরেকটি হলো সেই একই ছবি দাড়ি বিহীন। শরিফুল সাহেব একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, “তাহলে আমাদের সকল খুনের সমাপ্তি হলো? না না প্রমাণ ছাড়া তো আমাকে শাস্তি দিতে পারবেন না। কোনো প্রমাণ আছে?’’ “আপনার হাতে লিখিত ডাইরী খানা আমার কাছে রয়েছে। কোনো ফায়দা নেই। আপনি তো সেদিন মাঠে একজনকে হত্যা করেন আরেকজন রয়ে যায় তাকেও কিছুক্ষণ আগে ধরে ফেলেছি। জেল খানায় আছে মুলাকাত করবেন নাকি?’’ শরিফুল সাহেব কিছুক্ষণ ভাবলেন। ভেবে বললেন, “সায়েম কোথায়?’’ “তাকে দিয়ে আপনার কী কাজ?’’ “আমার শেষ ইচ্ছে আমার ডাইরীটা তার নিকট যেন হস্তান্তর করা হয়।আর এখন সে এখানে উপস্থিত থাকলে উপকৃত হ’তাম। তাকে কিছু জানানোর ছিল। ’’ “হবে না। ’’ “যদি আমার নিজ মুখে আমার সকল পাপের স্বীকারোক্তি চান তাহলে আমার ইচ্ছেগুলো মানতে হবে। ’’ পুলিশ অফিসার সায়েমকে থানায় আসতে বললেন। কিছুক্ষণের ভেতর সায়েম এসে পৌঁছাল। সায়েম পুলিশ অফিসারের পাশে বসে আছে। উকিল সাহেব তথা শরিফুল সাহেব সায়েমকে উদ্দেশ্য করে বলেন, “অনেক প্রশ্ন তোমার মাথায় লুকোচুরি খেলছে তাই না? ভাবলাম যখন নিজের পাপের শাস্তি পাবই তখন সবটা তোমায় বলেই যাই।’’ “কী বলবেন আমায়? নর পিশাচদের মতো আপনার দ্বারা করা খুনগুলোর বিবরণ?’’ শরিফুল সাহেব একটু হাসলেন। “নাহ! আমাকে বলতে দেও। আজ থেকে আরো অনেক বছর আগে আমি আমার প্রথম কেসটা হেরে যাই। সেই কেসে মূল অপরাধী ছাড়া পেয়ে যায়, সাজা পায় অন্য আরেকজন। কালো কাপড়ে ডাকা থাকে লেডি জাস্টিসের চোখ দুটো। সত্যকে মিথ্যা আর মিথ্যেকে সত্য করা যায়। তবে প্রবাদ বাক্য আছে যেমন কর্ম তেমন ফল। সেদিন সেই অপরাধীটা যখন ছাড়া পায় বেশ হতাশ হয়ে পড়ি। তাহলে কী মানুষ তার কর্ম ফল পাবে না? চিন্তা করলাম তার কর্ম ফল আমিই দিয়ে দিলে কেমন হয়?এরপর আমি সেই অপরাধীকে খুন করি। খুব ভালো লাগে। বোঝাতে পারব না আমার কত ভালো লাগে। এরপর নানান কেস স্টাডি করতাম যেসব কেসের প্রকৃত অপরাধী আমার মনে হতো ধরা পড়ে নাই, অপরাধী অন্য কেউ সেসকল ব্যক্তিদের আমি হত্যা করতে লাগি। এক সময় এই হত্যা লীলা নেশাতে পরিণত হয়। যখন কোনো অপরাধী না পাই তখন আমি সাধারণ, নিরীহ মানুষ হত্যা শুরু করি। কিন্তু হত্যা পর আমি সেগুলো ডাইরীতে লিখে রাখতাম। আমার ডাইরী পুরোটা পড়ে থাকলে বুঝতে প্রতিটা নিরীহ ব্যক্তির হত্যার বিবরণ। আমি অগণিত খুন করেছি। আমার নিজেরই মনে নেই কতগুলো করেছি। ’’ পুলিশ অফিসার বলে ওঠেন, “রেকর্ড ডান। আপনার বয়ান নেয়া হয়ে গেছে এবার জেল আপনার অপেক্ষা করছে। ’’ শরিফুল সাহেব বললেন, “সায়েম শোনো লাইব্রেরীতে ডাইরীটা আমিই রাখি। কারণ ডাইরীতে আর কয়েকটা পৃষ্ঠাই বাকি ছিল। আমি জানতাম এদিক আমি ধরা পড়ব আর আমার পাপের শাস্তিও পাবো। ডাইরীর শেষ পাতাগুলো তোমার পূর্ণ করতে হবে। কী লিখবে সেটা ডাইরীর প্রচ্ছদ বলে দিবে। ’’ কথাটা বলেই শরিফুল সাহেব আচমকা দাঁড়িয়ে গেলেন। হিংস্র হায়নার মতো সায়েমের দিকে তেড়ে আসতে চাইল। পুলিশ অফিসার এক ধাক্কা দিয়ে মেঝেতে ফেলে দিলেন। সাথে সাথে শরিফুল সাহেব কোমড়ে থাকা বন্দুকটা বের করে নিজের মাথায় গুলি করে দিলেন।’’ কিছুক্ষণ নিস্তব্ধতা। সব কিছুই ঘরের বাম পাশে এতক্ষণ ধরে চলা ক্যামেরাতে রেকর্ড হয়েছে। শরিফুল সাহেবের স্বীকারোক্তি থেকে শুরু করে সব কিছুই। শরিফুল সাহেব হঠাৎ সায়েমের দিকে কেনই বা তেড়ে গেলো আর কেনই বা নিজেকে নিজে গুলি করে মারলেন তা আজও রহস্য রয়েই গেলো। সেদিন ফেরার সময় পুলিশ অফিসারের কাছ থেকে সায়েম ডাইরীটা নিয়ে যায়। “চারটি মাস অতিবাহিত হয়ে গেলো এখন বুঝে ওঠতে পারিনি সেদিন খুনী আমায় ডাইরীতে কী লিখতে বলেছিল। প্রতিদিন রাতে ডাইরীটি নিয়ে বসি, কী লিখব ভাবতে থাকি কিন্তু লিখা আর হয়না। ’’ টেবিলের সাথে থাকা চেয়ারে বসে মনে মনে ভাবতে লাগলো সায়েম। ডাইরীর প্রচ্ছদ এর দিকে সে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। এখানে কিছুই নেই, শুধু বড় বড় অক্ষরে নেমেসিস লিখা। সায়েম বিড় বিড় করে কয়েকবার লিখাটি পড়ল, “নেমেসিস,নেমেসিস!’’ মুহূর্তের ভেতর সায়েমের মগজে যে বিদ্যুৎ খেলে গেল। সে দ্রুত ডাইরীর শেষের পাতাতে গিয়ে লিখা শুরু করল। ঘণ্টা খানেক লিখার পর সে এক বিজয়ী হাসি হেসে বলে, “নেমেসিস!’’ ডাইরীর শেষ কয়েক পৃষ্ঠায় সে বিগত কয়েক দিনে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো লিখেছে। শেষ পৃষ্ঠার নিচের দিকে সে লিখেছে, “যেমন কর্ম তেমন ফল। যে যতটুকু পাপ করে, সে ঠিক তার সমপরিমাণ শাস্তি পাবে। এক চুল এদিকও নয়, ওদিকও নয়।’’ ডাইরীর পৃষ্ঠার একদম শেষে সায়েম লিখেছেন ‘নেমেসিস’ সমাপ্ত…….


এডিট ডিলিট প্রিন্ট করুন  অভিযোগ করুন     

গল্পটি পড়েছেন ৬৮৪ জন


এ জাতীয় গল্প

→ নিকোলা ও নেমেসিসের রাজপুত্র

গল্পটির রেটিং দিনঃ-

গল্পটির বিষয়ে মন্তব্য করুন

  • গল্পটির বিষয়ে মন্তব্য করতে আপনার একাউন্টে প্রবেশ করুন ... ধন্যবাদ... Login Now
  • Jubayer Ahmed
    Golpobuzz ৪ বছর পুর্বে
    Apu story ti shahriar vaiyar. Apni fb te vaiyar aro story porte paren. Shahriar Hasan Nil.

  • Shikha
    User ৪ বছর পুর্বে
    অসাধারণ। shahriar ভাইয়া গল্পটি কী আপনি নিজে লিখে লিখেছেন নাকি অন্য রাইটারের? খুব সুন্দর হয়েছে।প্রশ্নটি করায় কিছু মনে করবেন না।

  • Jubayer Ahmed
    Golpobuzz ৪ বছর, ৩ মাস পুর্বে
    Nice

  • Jubayer Ahmed
    Golpobuzz ৪ বছর, ৩ মাস পুর্বে
    Nice

  • Jubayer Ahmed
    Golpobuzz ৪ বছর, ৩ মাস পুর্বে
    Nice

  • Jubayer Ahmed
    Golpobuzz ৪ বছর, ৩ মাস পুর্বে
    Nice

  • Jubayer Ahmed
    Golpobuzz ৪ বছর, ৩ মাস পুর্বে
    Nice

  • Jubayer Ahmed
    Golpobuzz ৪ বছর, ৩ মাস পুর্বে
    Nice

  • Jubayer Ahmed
    Golpobuzz ৪ বছর, ৩ মাস পুর্বে
    Nice

  • Jubayer Ahmed
    Golpobuzz ৪ বছর, ৩ মাস পুর্বে
    Wow

  • Shahriar Hasan
    User ৪ বছর, ৩ মাস পুর্বে
    সবাইকে অসংখ্য ধন্যবাদ

  • K.M.Tafsirul Islam Rakib A.J
    User ৪ বছর, ৩ মাস পুর্বে
    ????????????

  • K.M.Tafsirul Islam Rakib A.J
    User ৪ বছর, ৩ মাস পুর্বে
    ????????????

  • Sayem Rabbi
    User ৪ বছর, ৩ মাস পুর্বে
    অসাধারণ গল্প

  • ◆ইশিকা ইশু◆
    User ৪ বছর, ৩ মাস পুর্বে
    নাহ। তবে খুনিটা ধরা পড়ে + খুনির রহস‍্য উদঘাটন হয়। gj

  • ◆ইশিকা ইশু◆
    User ৪ বছর, ৩ মাস পুর্বে
    পড়ো আপু। সেই একটা স্টোরি....gj

  • ◆ইশিকা ইশু◆
    User ৪ বছর, ৩ মাস পুর্বে
    gj জাস্ট অসাধারণ।

  • বকুল রায়
    Golpobuzz ৪ বছর, ৩ মাস পুর্বে
    সেই ছিল গল্পটা