বাংলা গল্প পড়ার অন্যতম ওয়েবসাইট - গল্প পড়ুন এবং গল্প বলুন

বিশেষ নোটিশঃ সুপ্রিয় গল্পেরঝুরিয়ান - আপনারা যে গল্প সাবমিট করবেন সেই গল্পের প্রথম লাইনে অবশ্যাই গল্পের আসল লেখকের নাম লেখা থাকতে হবে যেমন ~ লেখকের নামঃ আরিফ আজাদ , প্রথম লাইনে রাইটারের নাম না থাকলে গল্প পাবলিশ করা হবেনা

আপনাদের মতামত জানাতে আমাদের সাপোর্টে মেসেজ দিতে পারেন অথবা ফেসবুক পেজে মেসেজ দিতে পারেন , ধন্যবাদ

হাজেরা বিবি উপাখ্যান

"যুদ্ধের গল্প" বিভাগে গল্পটি দিয়েছেন গল্পের ঝুরিয়ান Muhaiminul Islam Khan (০ পয়েন্ট)

X খুলনা শহরের সুন্দরবন রোডের ‘বনফুল ভিলা’। পথ চলতেই দৃষ্টি কাড়ে সবার। শহরের এই অভিজাত এলাকায় এমন দৃষ্টিনন্দন ও বিশাল বাড়ি আর দ্বিতীয়টি নেই। যেন বাগানবাড়ি। গাছগাছালি, লতা-পাতায় ঘেরা বাড়িটির মাঝখানে লাল ইটের তিনতলা ভবন। পূর্বকোণে কাজের লোকদের থাকবার জন্য কয়েকখানা টিনের ঘর। সেগুলোতেও লাল রঙের প্রলেপ। বাড়ির মালিক রুবেল চৌধুরী অত্যন্ত ব্যস্ত মানুষ। ব্যবসায়িক কাজে ঢাকা ও চট্টগ্রামেই কাটে বেশিরভাগ সময়। কলকাতা, ব্যাংকক, সিঙ্গাপুরেও যায় প্রায়শই। অনেকেই তাকে নামে চেনে, দেখেছে কম লোকেই। বরং তার স্ত্রী শেফালী চৌধুরীর পরিচিতি ও খ্যাতি অনেক বেশি। তাদের এক ছেলে ও এক মেয়ে। দু’জনই পড়ে বিদেশে। শেফালীর পিছুটান নেই। সার্বক্ষণিক সোশ্যাল অ্যাক্টিভিস্ট। বিভিন্ন সভা-সেমিনারে বক্তৃতা দেয়। স্থানীয় সংবাদপত্রে তার ছবি ও সাক্ষাৎকার ছাপা হয়। যারা পত্র-পত্রিকা পড়ে, তারা তো বটে, যারা সে ধার ধারে না তারাও জেনে গেছে মুক্তিযুদ্ধে শেফালীর অবদানের কথা। সে একাত্তরে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দিয়েছে, টাকা-পয়সা দিয়েও সাহায্য করেছে। এ খবর স্বাধীনতা ও বিজয় দিবসে পত্র-পত্রিকায় ছাপা হয়েছে বহুবার। ধনাঢ্য ব্যক্তির স্ত্রী, বিখ্যাত সমাজসেবী হয়ে সে সবার সঙ্গে হেসে কথা বলে, মানুষের বিপদে সাহায্য-সহযোগিতার হাত বাড়ায়। তার উদ্যোগে তালতলী বস্তিতে স্থাপিত হয়েছে একটি স্কুল। দিনে শিশুরা পড়ে, রাতে সেখানে মেয়েদের শেখানো হয় বুটিক ছাপ ও সেলাইয়ের কাজ। শেফালীর আরেক শখ বাসায় পার্টি দেয়া। বিভিন্ন উপলক্ষে বাড়িতে প্রায়ই ভোজসভার আয়োজন করা হয়। কোনোটায় রুবেল চৌধুরী থাকে, কোনোটায় থাকতে পারে না। কিন্তু এতে অনুষ্ঠানের মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হয় না। শেফালীই সামলে নেয় সবকিছু। প্রতিবেশীরা বুঝতে পারে যে, বনফুল ভিলায় আজ কিছু একটা আছে। তারা শতাধিক হোমরা-চোমরার উপস্থিতি টের পায় রঙবেরঙের গাড়ির বহর দেখে। রাস্তায় কিছুটা যানজট দেখা দিয়েছে, কিন্তু শেফালী চৌধুরীর জন্য এতটুকু অসুবিধা মেনে নিতে কারও আপত্তি নেই। এবারের পার্টির উদ্দেশ্যে বিলাত থেকে মেমবউ ও দুই ছেলেমেয়ে নিয়ে তার দেবর সোহেল চৌধুরী এসেছে। ফি বছরই একবার সপরিবারে আসে সোহেল। মেম বিয়ে করলেও তার রয়েছে দেশের প্রতি প্রবল আকর্ষণ। নাড়ির যোগাযোগ। বউ ও দুই বাচ্চাকে বাংলা শিখিয়েছে। সোহেলের মেমবউয়ের মুখে বাংলা শুনে সবাই তাজ্জব বনে যায়। এবার সোহেলের আসার উদ্দেশ্য কেবল বেড়িয়ে যাওয়া নয়। খুলনায় ‘স্বাধীনতা মঞ্চ’ থেকে ৭১ জন মুক্তিযোদ্ধাকে সংবর্ধনা দেয়া হবে। তাদের একজন সোহেল। রয়েছে শেফালীও। সোহেল মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয়ার কারণেই শেফালীর মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে যোগাযোগ ঘটেছিল। তা না হলে একাত্তর নিয়ে তার গর্ব করার কিছুই থাকত না, জুটত না এমন সংবর্ধনাও। তাই শেফালীর আছে দেবরের প্রতি এক ধরনের কৃতজ্ঞতাবোধও। রুবেল দেবর-ভাবীর সুসম্পর্ক দেখে ঠাট্টা করে বলে, “রুবেল চৌধুরীর বউয়ের চেয়ে সোহেলের ভাবী হয়ে তুমি বেশি তৃপ্ত।” শহরের রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক, খ্যাতিমান মুক্তিযোদ্ধা, ব্যবসায়ী, শিল্পপতি, আমলাদের নিয়ে নৈশভোজের আয়োজন। অনুষ্ঠানে দুই বিখ্যাত শিল্পী গান গাইবে। চমক আছে আরও। যা অভ্যাগতরা সময়মতো জানতে পারবে। রুবেলের মেমবউ বিলেতে বসেই রবীন্দ্রসঙ্গীত শিখেছে- সেও গাইবে। গল্পের ফাঁকে ফাঁকে উঠে এসে হেঁশেলে ঢুকছে শেফালী। খোঁজ-খবর নিচ্ছে রান্নাবান্নার। হঠাৎ কাজের বুয়া হাজেরার দিকে তাকিয়ে তার চোখ ছানাবড়া। উত্তেজিত কণ্ঠে বলল, “কে তোমাকে মাংসে হাত লাগাতে বলেছে? তোমার হাতের খাবার কে খাবে, নিজের পরিচয় খেয়াল থাকে না?” কমলা বুয়া বলল, “আম্মাজান অপরাধ আমার হইছে, আমি ভুল কইরা কইছি।” আসলে হাজেরার কাজ ঘরদুয়ার ঝাঁট দেয়া, ধোয়ামোছা। হেঁশেলে ঢোকা সম্পূর্ণ নিষেধ। এর কারণ অন্য বুয়াদের কাছে গোপন নেই। পতিতাপল্লীতে যৌবন কাটিয়ে ষাটোর্ধ্ব বয়সে শেফালীর দয়ায় তার কাজ জুটেছে এ বাড়িতে। বাণীশান্তা পতিতালয়ের হাজেরা বৈরাগী। কাজ দেয়ার সময় শেফালী তার নামের বৈরাগী বাদ দিয়ে বলল, এখন থেকে তুমি হাজেরা বিবি। হাজেরার ব্যবহারে সবাই মুগ্ধ, তাই অন্য বুয়ারা তার পেছনের কথা প্রায়ই ভুলে যায়। কখনও কখনও তা মনে থাকে না শেফালী চৌধুরীরও। কিন্তু তাই বলে সে মাংসের হাঁড়িতে হাত দেবে, তা কী করে মানা যায়! এবার রাগতস্বরে শেফালী বলল, “বেরিয়ে যাও, আর এ মুখো হবে না।” অভিনব কান্ড ঘটিয়ে বসল হাজেরা। সে চেঁচিয়ে বলতে লাগল, “আপনার ওই ভদ্দরনোক মেহমানের জনাপাঁচেককে আমি চিনি। একে একে নাম বলে ফেলল।” “যখন আমার যৈবন ছিল, তখন আমার ঘরে যাইয়া ওরা আমারে কুইরা কুইরা খাইছে, আর আজ হাঁড়িত হাত দিলি সব নাপাক হইব! ক্যান, ক্যান?” এভাবে কথা বলা হাজেরার স্বভাববিরুদ্ধ। তাকে এমনভাবে রাগতে দেখেনি কেউ। শেফালী বলল, “চুপ! আর একটি কথা বলবি না।” কমলা বুয়া হাজেরার হাত ধরে টেনে-হিঁচড়ে সরিয়ে দিল। এ ঘটনায় শেফালীর মাঝে মারাত্মক প্রতিক্রিয়া হলো, তা অতিথিদের চোখ এড়াল না। দুই-একজন বলল, “ভাবী এনিথিং রং?” অনুষ্ঠানে দুই শিল্পীর সঙ্গে মেমবউও রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইল। তবে শেফালীর ইচ্ছে ছিল একটু গলা মেলাবে, তা আর হলো না। হরেক রকম সুস্বাদু খাবারের খোশবু চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল। মেহমানরা শেফালীর রন্ধন বিদ্যার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে উঠল। শেফালী বারবার বলল, “এ তেমন কিছু না, সামান্য আয়োজন।” মধ্যরাত পর্যন্ত আড্ডা গড়াল। তারপর সবাই একে একে বিদায় নিল। সোহেল ও মেমবউ তাদের সম্মানে এমন অনুষ্ঠানের আয়োজন করায় দারুণ খুশি। তারাও ফুরফুরে মেজাজে ‘গুড নাইট’ বলে শুতে গেল। ব্যাংকক থেকে রুবেল ফোন করে খবর নিল। অতি সংক্ষেপে কথা বলে ফোন রেখে দিল শেফালী। বলল, “আমার বড্ড ঘুম আসছে, সকালে তোমাকে ফোন দেব।” কিন্তু শেফালীর চোখে ঘুম নেই। ঘরের মেঝেতে পাঁয়চারি করেই তার রাত কাটল। শেফালীর দেরি করে নাস্তা খাওয়ার অভ্যাস। সকাল ১০টায় চায়ের টেবিলে বসে হাজেরাকে ডাকল। পাথর মূর্তির মতো হাজেরা দাঁড়িয়ে। শেফালী বলল, “কাল তোমার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেছি।” “না আম্মাজান, কী যে কন। আমিই অন্যায় কইরা ফ্যালাইছি। আর এই মাসটা আইলে আমার মাথা ঠিক থাহে না।” “কোন মাস?” “এই যে, স্বাধীনতার মাস।” “কেন, এ মাসে কী হয়েছে তোমার?” “এই মাসে যহন সবাই আমোদ-ফুর্তি করে, তহন আমার মাথায় খুন চাইপ্যা যায়। মনে অয়, ওই নিশানডারে ছিঁইড়্যা ফ্যালাই, সবকিছু ভাইঙ্গা-চুইরা নষ্ট করে দেই।” “ছি! জাতীয় পতাকা নিয়ে এমন কথা বলো না। একাত্তরে কী হয়েছিল তোমার?” “স্বাধীনতা অনেকরে গাড়ি-বাড়ি, কত কী দেছে, আর আমার সব কাইড়্যা নেছে। আমারে বেশ্যা বানাইছে।” “কী বলো, পাকিস্তানি মিলিটারি কি তোমাকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল।” “না, না ওরা ধরে নাই। দেশের মানুষই আমার সব কাইড়্যা লইছে।” শেফালীর কৌতূহল বেড়ে যায়। বলে, “বলো তোমার সব কথা শুনব।” এর মধ্যে সোহেল ও তার মেমবউ ঘরে ঢুকল। একই সময় হাজির হলো ‘স্বাধীনতা মঞ্চে’র আহ্বায়ক নবীন হাসান ও আরও কয়েকজন। ওদের অ্যাপয়েনমেন্ট দেয়া ছিল আগেই। নবীন মুক্তিযুদ্ধের কমান্ডার আফাজউদ্দিন সরকারের পুত্র। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। সে ও তার বন্ধুরা মিলে গড়েছে ‘স্বাধীনতা মঞ্চ’। শেফালী বলল, “এবার আমরা হাজেরার একাত্তরের কাহিনী শুনবো, পরে অন্য কাজ।” ঘরে পিনপতন নিস্তব্ধতা। কথক হাজেরা বিবি। সবাই আজ শ্রোতা। হাজেরা বিবির মুখ থেকে অনর্গল কথারাশি পাখনা মেলতে লাগল। “তয় শোনেন, আজ আমি মনের সিন্দুক খুইল্যা আমার দুইখ্যের কথা কই। আমার স্বামী খুলনায় আনসারে চাকরি কইরত। মজিবর যহন স্বাধীনতার ডাক দিল, তহন সেও ঝাঁপাইয়া পইড়ল। নড়াইলের মালিগ্রামে আমি শ্বশুর বাড়িতে থাইকতাম। আমাগো সুখের সংসার। আমি ছিলাম শ্বশুর-শাশুড়ির আদরের বউ, আমাগো দুই মাইয়া পারুল আর চম্পা দাদা-দাদি, চাচা-চাচির চোখের মণি। যুদ্ধ শুরুর দিন দশেক পর একসাথে দুইখান চিঠি আইল। একখানে পারুলের বাপ লেখছে, “আমি মুক্তিযুদ্ধে গ্যালাম, স্বাধীনতা লইয়া ঘরে ফিরব। আর যদি যুদ্ধে মারা যাই, তা হইলে দুঃখ কইরো না। দেশের মানুষ তোমাগো ভরণপোষণের দায়িত্ব লইবে। আর আব্বা ও আমার ছোট ভাইরা তো আছে। আব্বা-মারে সালাম, ভাইবোন, পাড়া-পড়শিদের শ্রেণীমতো সালাম ও দোয়া কইরতে বলিবা। আর আমার জানের টুকরা পারুল আর চম্পারে ভালোবাসা ও আদর দিও।” পাশের বাড়ির হারুন, কলেজে পইড়ত। তারে দিয়া যহন চিঠি পড়াইতেছিলাম, তহন ও ঠাট্টা কইর‌্যা কয়, “ভাবী, ভাইজান তো আপনারে ভালোবাসার কথা কয় নাই।” আমি কইলাম, “মশকরা কইরো না। তোমার ভাই বেলেহাজ নাকি যে, চিঠিতে ভালোবাসার কথা কইব?” যে দুইজন লোক চিঠি নিয়া আইছিল, তারা উঠানে জলচকিতে বসা। আমি লোক দুটির দিকে চাইয়া দেহি, তাগো চোখে পানি। আমার মাথায় চক্কর দিল। হারুন দুই নম্বর চিঠি পইড়্যা কাইন্দা দিল, কমান্ডার সাব চিঠি দেছেন। লেখছেন, ভাবী সাব, আপনার স্বামী সুন্দরবনের কালিগ্রাম যুদ্ধে শহীদ হইছেন। জাতি তারে ভুইলবে না। আপনাদের সুখে-দুঃখে আমরা পাশে থাইকব। আমার মধ্যে কী আথালি-পাতালি শুরু হইল। তারপর দেহি, সবাই আমার মাথায় পানি ঢালতেছে। কাইন্দা কাইন্দা কাটাইলাম কিছুদিন। সকলে সান্ত্বনা দিল। শ্যাষম্যাষ মাইয়া দুইডার মুখের দিকে চাইয়া শোক চাপা দিলাম। স্বাধীনতার পর মুক্তিযোদ্ধারা আইল। কত কথা শোনাইল। কইল, বোন আপনার পাশে আমরা আছি। মজিবরের চিঠি পাইলাম, দুই হাজার টাকা দিছিল। শ্বশুরের হাতে দিলাম, ছেইল্যার শোকে শ্বশুর বিছানা লইল। কিছুদিন পরে বুইঝলাম, আমি শ্বশুর-শাশুড়ির আদরের বউ আর নাই। মেজো বউ ছোট বউর আদর বাইড়ল, তাদের সুয়ামিরা তো কামাই করে। মরার বউ তহন ওগো মাথার বোঝা। আমি দাঁত কামড়াইয়া পইড়্যা থাইকলাম। বছর না ঘুরতেই আমারে আলাদা কইরা দিল। কিন্তু জমি-ক্ষেতের ভাগ দিল না। ধলা হুজুর আইসা কইল, শরিয়া আইনে বাবা বাঁইচা থাকা অবস্থায় ছেইলা মইরলে তার সন্তানরা সম্পত্তির ভাগ পায় না। জমি নাই, জিরাত নাই- আমার পারুল-চম্পারে কী খাওয়াইব? প্রথমে আমার ভাইরা কিছু কিছু দিত। সেইডাও বন্ধ হইয়া গ্যাল। আমি মানষের বাড়ি বাড়ি গতর খাটাই। আল্লা আমারে গতরে রূপ দিয়া পাঠাইছিল, তাই কাল অইল। মরার বউ সবার ভাউজ অইল। ঠাট্টা-মশকরা মাইনা নিছিলাম, কিন্তু আমার ঘরের দরজায় টোকা দেয়া আরম্ভ হইল। সন্ধ্যা আইলেই বঁটি হাতে নিতাম। এতে কিছুডা কাজ হইল। কেউ আর হাত বাড়াইতে সাহস পাইল না। তয় মফিজ চেয়ারম্যানের ভয়ে অস্থির হইয়া পইড়লাম। সে ছিল শান্তি কমিটির লোক। আমারে দেখলে শহীদ মুক্তিযোদ্ধার বউ কইয়া ঠাট্টা করে, তার কাচারি ঘরে আইতে কয়। জিগায়, “স্বাধীনতা তোমারে কী দিছে? আমি তোমারে কষ্ট গুচাইয়া দিব, টাহা-পয়সা দিব। আমি কিছুই উত্তর-পশ্চিম করি না।” একদিন বৃষ্টির মধ্যে চেয়ারম্যানের বাড়ি থেইক্যা কাজ কইরা বাইর হইছি। আমারে দেইহা কইল, “শুইন্যা যাও, একখান কথা আছে।” কাচারি ঘরে আর কেউ নাই। ছেইল্যা-মাইয়া সব বাড়ির ভিতরে। রাইতে তারা বাইর অয় না। খালি চেয়ারম্যান কাচারিতে দরবার বসায়, আজ বিষ্টি দেইখা দরবার বসে নাই। চেয়ারম্যান একাই বইস্যা হুঁকা টানতেছে। কাজের লোক থাকে, দেখলাম তারাও নাই। আমি কইলাম, “কিসের কথা, এহন শুনব না।” কিন্তু ব্যাটা বিষ্টির ভিতর নাইম্যা আমারে টাইনা ঘরে উঠাইল। মাইয়া দুইটার জন্যি থালে কয় মুইড্যা ভাত নিছিলাম, তা পইড়্যা গ্যাল। আমারে নিয়া ঝাপ্টাঝাপ্টি শুরু কইরল। আমি সুযোগ বুইজা তারে ধাক্কা দিয়া দৌড়ে পালাইলাম। চেয়ারম্যানের বাড়িতে কাজ ছাইড়্যা দিলাম। এইছাড়া ইজ্জত বাঁচাইবার রাস্তা ছিল না। অন্য জায়গায়ও কাজ নাই। দেশে আকাল। মাইয়া দুইটার প্যাট নিলদাঁড়ায় লাইগা গ্যাছে। আমিও পড়ি কি মরি। আর থাকবো কোথা? ঘরের চাল দিয়া বিষ্টি পড়ে। বিষ্টি আইলে মাইয়া দুইডা লইয়া ভিইজ্যা চুবুচুবু হইয়া যাই। আমার তো সহায়-সম্পত্তি নাই। যাগো কিছু ছিল, আকাল তাগো ঘরেও ঢুকল। সবাইর অবস্থা বেগতিক। তখন দেহি গ্রামের বউঝিরা বাঁচার আশায় শহরে যাইতেছে। আমি চোখ বুঁইজা পারুল আর চম্পারে লইয়া দলের সাথে নিরুদ্দেশে বাইর অইলাম। ফরিদপুর শহরে গ্যালাম। শহর কী আগে দেহি নাই। এহানে আমার এক সম্পর্কে খালাতো ভাই থাইকত, আগে তার খোঁজ লইলাম। তারে পাইলাম না। কত গুরাগুরির পর এক মৌলবী গোছের লোকের বাড়িতে কাজ পাইলাম। সে আমার দুঃখের কথা শুইনা তার বাড়িতে মাইয়া দুইডারে লইয়া থাহার জায়গাও দিল। তার বউ ছিল না। পোলারা বাইরে চাকরি-বাকরি কইরত। আমি রান্নাবান্না কইরা দিতাম। বাড়ির সগল কাজই কইরতাম। তার কুদৃষ্টি পইড়ল। কইলাম, “আপনি বাপের বয়সী। আমি আপনারে সেই চোখে দেহি। কেডা শোনে?” এ্যাদ্দিন নিজেরে আগলায়া রাইখছিলাম, যে ইজ্জত নিয়া বড়াই কইরছিলাম। তা অ্যাক নিমেষেই খোয়াইলাম। সেদিন আমার ওপর কিয়ামতের গজব নাইমল। তা মনে কইরলে আমি বেহুঁশ হইয়া যাই। জান বাইর কইরা দেওয়ার কথা চিন্তা কইরছিলাম। কিন্তু মাইয়া দুইডার কথা বাইবা কিছুই কইরলাম না। পাথর হইয়া গ্যালাম, আল্লারে কইলাম, “তুমি ক্যানচক্ষু বুঁইজা আছো, তোমার কি কিছু করার নাই?” হাজেরা কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলতে লাগল শুধু। সেই কাজ ছাইড়্যা আবার পথে নামলাম। এইখানে-সেইখানে গুইরা এ্যাক বুড়ির গরে জায়গা অইল। একদিন পাশের ঘরে মতি মিয়া আমারে কাজ দেয়ার লোভ দিয়া রথখোলা বেশ্যাপাড়ার এক সর্দারণীর হাতে তুইল্যা দিল। সর্দারণী কইল, “তোমারে মাইয়ার মতো জানি, তুমি রান্নাবান্না কইরবা। তোমারে দিয়া ব্যবসা করাইব না।” কিন্তু ওই কি অয়? একদিন গুন্ডারা আইসা আমার ওপর আছর হইল। সেইডা সে সর্দ্দারণীর কৌশল ছিল। তা পরে বুইজাছি। সেই ঘটনার কয়েকদিনের মাথায় বেশ্যার খাতায় নাম লেখাইলাম। আপনারা আমারে গালি দ্যান, আমার মুহে থু থু জাড়েন, কিন্তু আমার উপায় ছিল না, কোনো উপায় ছিল না। এভাবেই সে বয়ান করে চলল ফরিদপুর থেকে গোয়ালন্দ, গোয়ালন্দ থেকে খুলনা বাণীশান্তা পতিতালয়ের অভিশপ্ত জীবনের মর্মস্পর্শী কাহিনী। মায়ের মতো পতিতাবৃত্তিতে নামতে বাধ্য হয় পারুলও। কেবল বুদ্ধি খাটিয়ে একজন মুদির দোকানদারের তত্ত্বাবধানে চম্পাকে এই জগৎ থেকে দূরে রেখেছে। এসএসসি পর্যন্ত পড়িয়ে বিয়ে দিয়েছে এক ট্রাক ড্রাইভারের সঙ্গে। সড়ক দুর্ঘটনায় মারাত্মক ভাবে আহত হয় চম্পার স্বামী মোবারক। সে এখন পঙ্গু। তাই চম্পার সংসারের খরচ দিতে হয় হাজেরা ও পারুলকে। তবু তারা খুশি। চম্পা গেরস্ত ঘরের বউ। তার একটি ছেলে আছে। হাজেরা বলল- এই নাতিটাই এহন ওয়াজেদ বেপারীর বংশের বাত্তি। পারুলের ইচ্ছা আর কিছু টাকা জমলে এ ব্যবসা ছেড়ে দেবে। তারপর চম্পার ছেলেকে নিয়ে এক স্বাধীনতা দিবসে সবাই মিলে দেশের বাড়িতে হাজির হবে। জানান দেবে, আমরা শহীদের সন্তান। তাদের বাবার রক্তে এসেছে স্বাধীনতা। এমন স্বপ্ন বুকে নিয়ে পারুল এখনও মিটিয়ে চলেছে হরেকরকম খদ্দেরের বায়না। হাজেরা বিবি বুক চাপড়িয়ে বলল, “সেই সুযোগ কি কোনোদিন আইব? আমার নাতি কি কইতে পাইরব, তার নানা মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হইছে?” তাই তো কই স্বাধীনতার মাস আইলে আমি পাগল হইয়া যাই। যাগো স্বাধীনতার লাইগ্যা চার পয়সার ক্ষতি অয় নাই, স্বাধীনতা তাগো লাইগ্যা, আমাগো লাইগ্যা না। কারও মুখে কথা নেই। নবীন উঠে এসে হাজেরার পা স্পর্শ করল, তার দেখাদেখি স্বাধীনতা মঞ্চের সদস্যরা সবাই হাজেরা বিবির পদধূলি নিল। হাজেরার এক হাত ধরল শেফালী, আরেক হাত ধরল সোহেল। তাকে সোফায় বসাল। মেমবউ মুছে দিল তার চোখের জল। মনে হলো, নির্যাতিত নারীর করুণ উপাখ্যান ওদেরকে জাগিয়ে দিয়েছে। সবার বুকে তখন একাত্তরের স্পন্দন। হাজেরা বলল, “আপনারা আমার নাপাক শরীর ছুঁইয়েন না। পাপ অইব।” নবীন বলল, “মা! আপনি শহীদ বীরজায়া। যারা আপনাকে যোগ্য সম্মান না দিয়ে দূরে ঠেলে দিয়েছে, নিপীড়ন করেছে, তারাই পাপিষ্ঠ।” সোহেল বলল, “এই পাপের ভাগীদার আমরাও। আমরা শহীদ মুক্তিযোদ্ধার পরিজনের দায়িত্ব নিতে পারিনি। এই ব্যর্থতার গ্লানি আমরা কেউ এড়াতে পারি না।” নবীন বলল, “এবার সংবর্ধিতদের তালিকায় সবার ওপর থাকবে আমাদের জননী, শহীদজায়া হাজেরা বিবি।” সোহেল ও শেফালী এক সঙ্গে বলে উঠল, “অন্য কাউকে নয়, এবার ‘স্বাধীনতা মঞ্চ’ থেকে কেবল আমাদের বোন হাজেরা বিবিকেই সংবর্ধনা দাও।” হাজেরা বিবি বাকরুদ্ধ কণ্ঠে বলল, “না, আমি কিচ্ছু চাই না। আপনারা আজ আমারে একদিনের লাইগ্যা হইলেও পাশে বসাইছেন। ভদ্দর লোকের এই পোলাগুলা আমারে মা কইছে। এতকাল নিজেরে ছিনাল-মাগী বলেই জাইনা আসতেছি, আজ আমি আপনাগো বোন হইছি, পোলাগুলার মা হইছি। এইটাই আমার বড় পাওয়া, না আমি আর কিচ্ছু চাই না, কিচ্ছু চাই না।”


এডিট ডিলিট প্রিন্ট করুন  অভিযোগ করুন     

গল্পটি পড়েছেন ৫২৬ জন


এ জাতীয় গল্প

→ হাজেরা বিবি উপাখ্যান

গল্পটির রেটিং দিনঃ-

গল্পটির বিষয়ে মন্তব্য করুন

  • গল্পটির বিষয়ে মন্তব্য করতে আপনার একাউন্টে প্রবেশ করুন ... ধন্যবাদ... Login Now