বাংলা গল্প পড়ার অন্যতম ওয়েবসাইট - গল্প পড়ুন এবং গল্প বলুন

বিশেষ নোটিশঃ সুপ্রিয় গল্পেরঝুরিয়ান - আপনারা যে গল্প সাবমিট করবেন সেই গল্পের প্রথম লাইনে অবশ্যাই গল্পের আসল লেখকের নাম লেখা থাকতে হবে যেমন ~ লেখকের নামঃ আরিফ আজাদ , প্রথম লাইনে রাইটারের নাম না থাকলে গল্প পাবলিশ করা হবেনা

আপনাদের মতামত জানাতে আমাদের সাপোর্টে মেসেজ দিতে পারেন অথবা ফেসবুক পেজে মেসেজ দিতে পারেন , ধন্যবাদ

অন্ধকারের গ্রহ পার্ট---9

"সাইন্স ফিকশন" বিভাগে গল্পটি দিয়েছেন গল্পের ঝুরিয়ান Takiyan (০ পয়েন্ট)

X By জাফর ইকবাল রায়ীনা গুড়ি মেরে স্কাউটশিপের কন্ট্রোল প্যানেলের কাছে গিয়ে টেনেহিঁচড়ে যোগাযোগ মডিউলটা খুলে আনে। আবার গুড়ি মেরে য়ুহার কাছে এসে যোগাযোগ মডিউলের কন্ট্রোল বোতামটি চেপে ধরে বলল, আগে দেখে নিই কোন ফ্রিকোয়েন্সি ব্যবহার করছে। রায়ীনা সঠিক ফ্রিকোয়েন্সি বের করে সেখানে তীব্র কিন্তু অর্থহীন সিগন্যাল পাঠাতেই হঠাৎ করে বাইরের গোলাগুলি বন্ধ হয়ে গেল। য়ুহা সাবধানে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখল স্কাউটশিপ ঘিরে ইতস্তত কিছু প্রাণী নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সেগুলো হঠাৎ করে আবার নড়ে উঠবে না ব্যাপারটা নিশ্চিত হবার পর য়ুহা আবার রায়ীনার দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি আসলেই অসাধারণ রায়ীনা! এর মাঝে অসাধারণের কিছু নেই। রায়ীনা একটু হেসে বলল, আমি যেটা করেছি সেটা হচ্ছে একেবারে প্রাগৈতিহাসিক একটা ব্যাপার। এই প্রাগৈতিহাসিক উপায়ে আমি যে এটা করতে পেরেছি সেটাই হচ্ছে রহস্য! য়ুহা জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকতে থাকতে বলল, আমরা এখন কী করব? স্কাউটশিপের ভেতরে থাকাটা বিপজ্জনক হয়ে যাচ্ছে! যে কোনো মুহূর্তে নতুন একটা ফ্রিকোয়েন্সিতে সিগন্যাল আসতে পারে। ফ্রিকোয়েন্সিটা এমনভাবে অদলবদল করতে পারে যে আমরা হয়তো আর তাল রাখতে পারব না। এই প্রাণী বল, মানুষ বল, মৃতদেহ বল–তারা নতুন করে আক্রমণ শুরু করতে পারে। বসে বসে গুলি খাওয়ার কোনো অর্থ নেই আমাদের বের হয়ে যাওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। ঠিকই বলেছ। সাথে যোগাযোগ মডিউলটা রাখি—আবার কাজে দেবে। একেবারে ম্যাজিকের মতো কাজে দেবে। রায়ীনা বলল, প্রয়োজন না হলে আমি এই প্রাণীগুলোর শত্রু হতে চাই। আমি শত্রু হয়ে দেখেছি। খুব কষ্ট। য়ুহা কোনো কথা না বলে রায়ীনার মুখের দিকে তাকালো। কমবয়সী একটা মেয়ে কিন্তু এর ভেতরেই তার জীবনে কত কিছু ঘটে গেছে। স্কাউটশিপকে ঘিরে থাকা প্রাণীগুলোকে দেখে য়ুহা এবং রায়ীনা হতবাক হয়ে গেল–এগুলো মানুষেরই দেহ কিন্তু কোনোটাই পূর্ণাঙ্গ নয়। কারো হাত নেই, কারো পা নেই–কারো বুকের ভেতর বিশাল একটা গর্ত। দুটি মানুষের মাথারই অস্তিত্ব নেই। শুধু ধড়টি দাঁড়িয়ে আছে। কয়েকজনের মুখমণ্ডলের খানিকটা অংশ উড়ে গেছে, চোখের জায়গায় খালি কুটুরী। দেখে মনে হয় এই মূর্তিগুলোকে বুঝি সরাসরি নরক থেকে তুলে আনা হয়েছে। য়ুহা বুকের ভেতর আটকে থাকা একটা নিঃশ্বাস বের করে দিয়ে বলল, রায়ীনা, এখান থেকে চল। এই মূর্তিগুলো যদি হঠাৎ করে জীবন্ত হয়ে যায় তাহলে সেই দৃশ্যটা আমি সহ্য করতে পারব না। রায়ীনা মাথা নাড়ল, ঠিকই বলেছ, আমিও পারব না। সরাসরি নরক থেকে উঠে আসা কিছু দেহাবশেষকে স্থির অবস্থায় রেখে য়ুহা আর রাহীন সামনের দিকে এগিয়ে যায়। য়ুহা জিজ্ঞেস করল, আমরা এখন কোথায়? মনে আছে এই গ্রহ থেকে নির্দিষ্ট সময় পরপর একটা সিগন্যাল বের হচ্ছে? হ্যাঁ, তুমি বলেছিলে। আমরা গিয়ে দেখতে পারি সেটা কী রকম। কেন বের হচ্ছে, কীভাবে বের হচ্ছে। কোনো বিপদ হবে না তো? বিপদ তো হতেই পারে–রায়ীনা হাসার চেষ্টা করে বলল, কিন্তু বিপদ দেখে তুমি পিছিয়ে আস সে রকম কোনো প্রমাণ তো আমি পাইনি! য়ুহা শব্দ করে হেসে বলল, তুমি ঠিকই বলেছ! আমার নিজেরই বিশ্বাস হচ্ছে না—কিছুদিন আগেও আমি কখনো চিন্তা করিনি শব্দের পেছনে শব্দ বসিয়ে কবিতা লেখা ছাড়া আমি আর কিছু করতে পারি। কিন্তু দেখো আমি কত কী করেছি। রায়ীনা নরম গলায় বলল, তুমি আর কী কী করেছ আমি জানি —কিন্তু তুমি আমাকে একটা নতুন জীবন দিয়েছ। যদি সবকিছু ঠিক করে শেষ হয় আর আমি সত্যি সত্যি নিজের জীবনে ফিরে যেতে পারি সেটা হবে তোমার জন্যে। শুধুমাত্র তোমার জন্যে। আমি এমন কিছুই করিনি। আর আমরা যদি এই গ্রহ থেকে বের হতে না পারি, এখানে মারা পড়ি, এই গ্রহের কোনো একটা ভয়ঙ্কর প্রাণী আমাদের মৃতদেহটাকে ব্যবহার করে উৎকট নাটক করে তাহলে— তাহলে কী? তাহলে তুমি কিছু মনে করো না। তোমার সাথে আমি খুব কম সময় কাটিয়েছি, কিন্তু সময়টা ছিল চমৎকার! তোমাকে ধন্যবাদ রায়ীনা। মহাকাশের পোশাকের ভেতর থেকে একজন আরেকজনকে স্পর্শ করতে পারবে না জেনেও, য়ুহা হাত দিয়ে রায়ীনার কাধ স্পর্শ করল। গ্রহটার পাথরের ভেতর দিয়ে দুজনে নিঃশব্দে হাঁটতে থাকে। ছোট-বড় পাথর ছড়িয়ে আছে, উঁচু-নিচু পথ। পাথর থেকে এক ধরনের ঘোলাটে আলো বের হচ্ছে, কোথাও নিষ্প্রভ, কোথাও বেশ আলো। মাঝে মাঝে বিশাল খাদ, তার গভীরে কী আছে বাইরে থেকে বোঝা যায় না, জেট প্যাক ব্যবহার করে তারা সেই জায়গাগুলো উড়ে পার হয়ে যায়। জেট প্যাকের জ্বালানি খুব সীমিত, তাই সেগুলো তারা বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করছে, খুব বেশি প্রয়োজন না হলে তারা জেট প্যাক ব্যবহার করছে না। সত্যিকারের বড় কোনো বিপদে হয়তো এই জেট প্যাক ব্যবহার করেই তারা নিজেদের রক্ষা করার চেষ্টা করবে। য়ুহা আগে কখনো জেট প্যাক ব্যবহার করেনি, রায়ীনা তাই তাকে ছোটখাটো নিয়মগুলো শিখিয়ে দিচ্ছে। অজানা অন্ধকার একটা কুৎসিত গ্রহে নিজের জীবন হাতে নিয়ে যদি এই জেট প্যাক ব্যবহার করতে না হতো তাহলে য়ুহা এই পুরো প্রক্রিয়াটা রীতিমতো উপভোগ করতে পারত। হেঁটে হেঁটে তারা যখন ক্লান্তির একেবারে শেষ সীমায় পৌঁছেছে তখন তারা দূরে একটা বিধ্বস্ত মহাকাশযান দেখতে পেল। মহাকাশযানের আকারটি দেখেই রায়ীনা বুঝতে পারে এটি ক্যাটাগরি তিন মহাকাশযান। আন্তঃগ্যালাক্টিক অভিযানে এগুলো ব্যবহার করা হয়, এই মহাকাশযানটি প্রায় একটা শহরের মতো এখানে কয়েকশ মহাকাশচারী থাকে। এই বীভৎস গ্রহে বিধ্বস্ত অবস্থায় পড়ে থাকা এই মহাকাশযানটি দেখে মনে হয় এটি বুঝি কোনো একটি পরাবাস্তব জগতের দৃশ্য। মহাকাশযানের কাছাকাছি এসে য়ুহা আর রায়ীনা বড় বড় কয়টা পাথরের আড়ালে নিজেদের আড়াল করে লুকিয়ে রইল। ভেতরে কী আছে তারা জানে না, হঠাৎ করে ভেতরে ঢুকে তারা বিপদে পড়তে চায় না, বাইরে থেকে আগে ব্যাপারটা ভালো করে বুঝতে চায়। বেশ অনেকক্ষণ নিঃশব্দে বসে থেকেও তারা মহাকাশযানের ভেতর যখন কোনো কিছু ঘটতে দেখল না, তখন তারা মহাকাশযানের ফাটল দিয়ে খুব সাবধানে ভেতরে ঢুকে গেল। ভেতরে বেশ অন্ধকার, হেলমেটের নিয়ন্ত্রণ বোতাম স্পর্শ করে চশমার কার্যকারিতা দশ ডিবি বাড়িয়ে নেয়ার পর মহাকাশযানের ভেতরটুকু স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ভেতরের দৃশ্য দেখে তারা দুজনেই একেবারে হতবুদ্ধি হয়ে পড়ে। বাইরে থেকে যে রকম অনুমান করেছিল–মহাকাশযানটি ঠিক সে রকম বিধ্বস্ত। যন্ত্রপাতি ভেঙে পড়ে আছে, দেয়ালে বড় বড় ফাটল, প্রচণ্ড উত্তাপে নানা অংশ গলে পুড়ে কদাকার হয়ে আছে—কিন্তু তাদের সেই দৃশ্যগুলো বিচলিত করেনি। তাদেরকে বিচলিত করেছে মহাকাশচারীদের মৃতদেহগুলো। মহাকাশযানের এখানে-সেখানে সেগুলো বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। সবগুলো যে নিচে পড়ে আছে তা নয়, কোনো কোনোটা উবু হয়ে বসে আছে এমন কী কোনো কোনোটা বিচিত্র ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। য়ুহা মাথা নেড়ে বলল, এটা আমার পছন্দ হচ্ছে না। একেবারেই পছন্দ হচ্ছে না। রায়ীনা জানতে চাইল, কোনটা তোমার একেবারেই পছন্দ হচ্ছে না? এই যে মৃতদেহগুলো দাঁড়িয়ে আছে, বসে আছে। এগুলো আমার একেবারেই পছন্দ হচ্ছে না। প্রথমত মৃতদেহ কেন আমাদের চোখের সামনে থাকবে? আর থাকতেই যদি হয় তাহলে কেন দাঁড়িয়ে থাকবে? রায়ীনা বলল, আমার কী মনে হয় জান? কী? এই মৃতদেহগুলো আসলে কাজকর্ম করছিল। ছোটাছুটি করছিল। হঠাৎ করে যে যেভাবে ছিল সেভাবে থেমে গেছে। সেজন্যে মনে হচ্ছে কেউ দাঁড়িয়ে আছে, কেউ বসে আছে। য়ুহা ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, হঠাৎ করে থেমে গেল কেন? জানি না। রায়ীনা মাথা নাড়ে, মনে হয় আমাদের জন্যে। আমরা মহাকাশযানের ভেতর ঢুকেছি সে জন্যে সবকিছু থামিয়ে দিয়েছে। মনে হয় বোঝার চেষ্টা করছে আমাদের মতলবটা কী! তার মানে মহাকাশের প্রাণীগুলো আমাদের দেখছে? নিশ্চয়ই দেখছে, আমাদের কি লুকিয়ে থাকা সম্ভব। যদি আমাদের দেখছে তাহলে ধরার জন্যে ছুটে আসছে না কেন? দুটি কারণ হতে পারে, এক: ছুটে আসবে, এক্ষুণি সবাই ছুটে আসবে। দুই: ছুটে আসার প্রয়োজন নেই। কারণ ছুটে গিয়ে আমাদের ধরে যেখানে আনার কথা আমরা সেখানেই বসে আছি! সর্বনাশ! য়ুহা বলল, তুমি না বলছিলে, আসলে এখানে কোনো মহাজাগতিক প্রাণী নেই। পুরোটাই হচ্ছে কোয়ান্টাম নেটওয়ার্ক। হ্যাঁ। আমার এখনো তা-ই মনে হয়। আমাদের জন্যে সেটা নিরাপদ। আমরা তাহলে আমাদের পরিচিত যন্ত্রপাতি, পরিচিত অস্ত্রপাতি, পরিচিত প্রযুক্তি দিয়েই নিজেদের টিকিয়ে রাখতে পারব। রায়ীনার কথা শেষ হওয়া মাত্রই হঠাৎ মহাকাশযানটা একটু দুলে ওঠে, সাথে সাথে অত্যন্ত বিচিত্র একটা ঘটনা ঘটল। মহাকাশযানের নানা জায়গায় বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা সবগুলো মৃতদেহ একসাথে নড়তে শুরু করল। দাঁড়িয়ে থাকা মৃতদেহগুলো সামনে ঝুঁকে পড়ে পা ঘষে ঘষে হাঁটতে থাকে। বসে থাকা মৃতদেহগুলো বসে থাকা অবস্থাতেই নিজেকে ঘষে ঘষে টেনে নিতে থাকে। কিছু মৃতদেহ হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে যায়। অনেকগুলো বুকে ঘষে ঘষে এগুতে থাকে। তারা হাতে ছোটখাটো যন্ত্রপাতি টেনে নিতে থাকে, সেগুলো এখানে-সেখানে বসাতে থাকে, যন্ত্রগুলো টানাটানি করতে থাকে–সব মিলিয়ে অন্ধকার মহাকাশযানের ভেতরে অত্যন্ত কর্মব্যস্ততার একটা দৃশ্য ফুটে ওঠে, কিন্তু সেই দৃশ্যটি এত অবাস্তব, এত অবিশ্বাস্য যে য়ুহা এবং রায়ীনা দুজনেই হতবাক হয়ে যায়। য়ুহা বলল, আমার দেখতে ভালো লাগছে না। রায়ীনা বলল, আমারও ভালো লাগছে না। চল, বাইরে গিয়ে অপেক্ষা করি। হ্যাঁ। আমার হিসেব যদি ঠিক হয়ে থাকে তাহলে আর কিছুক্ষণের মাঝেই আমাদের উদ্ধার করতে কেউ না কেউ চলে আসবে! যদি না আসে? আসবে। আমার দলের লোকগুলো অসাধারণ। রায়ীনা মহাকাশযান থেকে বের হওয়ার জন্যে ঘুরে গিয়ে বলল, একটু পরে তুমি নিজেই দেখবে। মহাকাশযানের ভেতর থেকে বের হতে গিয়ে রায়ীনা থমকে দাঁড়াল এবং তার সাথে য়ুহাও থেমে গিয়ে একটা চাপা আর্তনাদের মতো শব্দ করল। মহাকাশযানের যে বিশাল ফাটল দিয়ে তারা ঢুকেছিল, সেই ফাটল দিয়েই তারা বের হয়ে যেতে চাইছিল। কিন্তু সেদিক দিয়ে একজন-দুজন নয় অসংখ্য মৃত মানুষ বিচিত্র ভঙ্গিতে দেহটাকে টেনে টেনে এসে হাজির হচ্ছে। য়ুহা ভয় পাওয়া গলায় বলল, এরা কী চায়? এখানে আসছে কেন? রায়ী নিচু গলায় বলল, জানি না। মৃতদেহগুলো গাদাগাদি করে তাদের দিকে এগিয়ে হাসতে থাকে, য়ুহা তখন চিল্কার করে বলল, কী চাও তোমরা? সরে যাও সামনে থেকে। দেহগুলো সরে যাবার কোনো লক্ষণ দেখলি না, বরং গাদাগাদি করে তারা আরও এক পা এগিয়ে এলো। মৃতদেগুলো প্রাণহীন চোখ দিয়ে তাদের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। সেই দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে থেকে য়ুহার বুক কেঁপে ওঠে। সে ভয় পাওয়া গলায় অস্ত্র উঁচিয়ে বলল, সরে যাও বলছি, তা না হলে কিন্তু গুলি করে দেব। প্রাণীগুলো সরে গেল না বরং আরো এক পা এগিয়ে এলো–এত কাছে। যে তারা ইচ্ছে করলে এখন এই য়ুহা আর রায়ীনাকে স্পর্শ করতে পারে। য়ুহা অস্ত্রটা ঝাকুনি দিয়ে বলল, গুলি করে দেব, দেব গুলি করে– প্রাণীগুলো আরো এক পা এগিয়ে এলো–য়ুহা তখন ট্রিগার টেনে ধরে। প্রচণ্ড বিস্ফোরণে মৃতদেহগুলোর হাত পা মাথা উড়ে যায়, ঠিক সেই অবস্থায় মৃতদেহগুলো আরো এক পা এগিয়ে এলো। রায়ীনা হাত দিয়ে য়ুহার হাত ধরে বলল, শুধু শুধু গুলি করে লাভ নেই। মৃত মানুষকে মারা যায় না— কিন্তু— কোনো কিন্তু নেই। পেছনে সরে যাও। য়ুহা আর রায়ীনা পেছনে সরে এলো। মৃতদেহগুলো তখন আরো একটু এগিয়ে আসে, এভাবে তাদের দুজনকে ঠেলে ঠেলে মৃতদেহগুলো তাদের একটা অন্ধকার গহ্বরের কাছে নিয়ে আসে। মৃতদেহগুলো তখন চারপাশ থেকে ঘিরে তাদের দুজনকে গহ্বারের মাঝে ঠেলে ফেলে দেয়ার চেষ্টা করল। য়ুহা আর রায়ীনা আতঙ্কিত হয়ে হাতের অস্ত্র দিয়ে গুলি করে প্রাণীগুলোকে সরানোর চেষ্টা করল, কিন্তু পারল না। মৃতদেহগুলো ঠেলে ঠেলে তাদের গহ্বরের মাঝে ফেলে দেয়। হা আর রায়ীনা অন্ধকার ঘরের ভেতর অদৃশ্য হয়ে যাবার শেষ মুহূর্তে বাইরে তাকিয়ে দেখে, যে প্রাণীগুলো এতক্ষণ তাদেরকে ঠেলে ঠেলে এনে গহ্বরের মাঝে ফেলে দিয়েছে হঠাৎ করে সেগুলো মূর্তির মতো স্থির হয়ে গেছে। কেউ আর এতটুকু নড়ছে না, হাত পা মাথাহীন ভয়ঙ্কর দেহগুলো যেটা যেখানে ছিল ঠিক সেখানে স্থির হয়ে আছে। দেখে মনে হচ্ছে তারা তাদের দায়িতু পালন করেছে। এখন আর তাদের কিছুই করার নেই। পিচ্ছিল আঠালো চটচটে এক ধরনের তরলের ভেতর দিয়ে দুজনে গড়িয়ে গড়িয়ে একটা ফাঁকা জায়গায় হাজির হলো। জায়গাটি বিচিত্র। এটি আশ্চর্য রকম সমতল এবং চারপাশের দেয়ালগুলো দেখলে প্রাগৈতিহাসিক কারুকাজের কথা মনে পড়ে। য়ুহা এবং রায়ীনা উঠে দাঁড়াল, চটচটে আঠালো তরলে তারা মাখামাখি হয়ে আছে। য়হা ভয় পাওয়া গলায় বলল, আমরা কোথায়? রায়ীনা বলল, তুমি শুনে বিশ্বাস করবে কী না জানি না, কিন্তু আমার মনে হচ্ছে আমরা কোনো একটা প্রাণীর পেটের ভেতরে হাজির হয়েছি! পেটের ভেতরে? হ্যাঁ। য়ুহা ভয়ে ভয়ে চারদিকে তাকালো, চারপাশের অংশটুকুর তার পরিচিত কোনে কিছুর সাথে কোনো মিল নেই। সে তার জীবনে এ রকম বিচিত্র কিছু দেখেনি। রায়ীনা নিচু গলায় বলল, তুমি দেয়ালগুলো দেখো–কিছুক্ষণ থেকেই হেডফোনে একটা খসখসে চাপা শব্দ আসছিল য়ুহা তাই ভালো করে কথা শুনতে পেল না, সে জিজ্ঞেস করল, তুমি কী বলেছ? তুমি দেয়ালগুলো দেখ–সেগুলো নড়ছে। য়ুহা চারপাশের দেয়ালগুলোর দিকে তাকালো, সেগুলো শুধু নড়ছে না ধীরে ধীরে সেগুলোর আকার পাল্টে যাচ্ছে। দেখতে দেখতে সেখানে ছোট ছোট অসংখ্য বিন্দু বড় হতে শুরু করছে। য়ুহা তার অস্ত্রটি হাতে নিয়ে বলল, এটা জীবন্ত? রায়ীনার হেডফোনেও একটা কর্কশ শব্দ, সে তার মাঝে চিৎকার করে বলল, হ্যাঁ, মনে হয় এটা জীবন্ত। রায়ীনার কথা শেষ হবার সাথে সাথে য়ুহা তার হেডফোনে একটা যান্ত্রিক শব্দ শুনতে পেল, য়ুহা কথাটা পরিষ্কার বুঝতে পারল না, রায়ীনাকে জিজ্ঞেস করল, তুমি কী বলেছ? আবার প্রতিধ্বনির মতো একটা শব্দ হলো, তার ভেতরে রায়ীনা বলল, আমি কিছু বলিনি। তাহলে কে বলেছে? আবার ভোঁতা একটা শব্দ হলো। রায়ীনা চারদিক ঘুরে তাকালো, বলল, অন্য কেউ বলছে। অন্য কেউ? হ্যাঁ। কী বলছে? বুঝতে পারছি না। রায়ীনার কথা শেষ হবার আগেই খসখসে একটা শব্দ শোনা গেল, বুঝি বুঝি বুঝি… য়ুহা চমকে ওঠে, কে কথা বলে? প্রতিধ্বনির মতো একটা গমগমে আওয়াজ আসে, কে? কে? কে? রায়ীনা নিচু গলায় বলল, কেউ একজন আমাদের সাথে কথা বলতে চাইছে। য়ুহা বলল, কী বলছে? দুর্বোধ্য কিছু শব্দ শুনতে পেল তারা, সেই অর্থহীন শব্দগুলোর মাঝে শুধু মানুষ শব্দটা তারা বুঝতে পারে। য়ুহা বলল, হ্যাঁ। আমরা মানুষ। তোমরা কারা? মানুষ প্রতিধ্বনির মতো আবার শব্দ হয় মানুষ! সত্যি মানুষ! জীবন্ত মানুষ! মানুষ! হ্যাঁ। আমরা জীবন্ত মানুষ। তোমরা কারা? আমরা? আমরা? মানুষ না। মানুষ না। তোমরা মানুষ। আমরা মানুষ। আবার দুর্বোধ্য কিছু শব্দ শুনল, দ্রুত বিজাতীয় এক ধরনের ভাষার কথা বলতে থাকে তার মাঝে বুদ্ধিমত্তা, চেতনা, অনুভূতি এ রকম কয়েকটা শব্দ তারা বুঝতে পারল। রায়ীনা চারদিকে চোখ বুলাতে বুলাতে বলল, আমরা তোমাকে দেখতে চাই। দেখতে চাও? দেখতে চাও? হ্যাঁ। এই তো আমি। আমি। তুমি কি একা? একা। আমি একা। আমি এক এবং একা। এই গ্রহে তুমি একা? আমি একা। আমি সব। আমি সব। তুমি কি এই মহাকাশযানগুলো ধ্বংস করেছ? ধ্বংস? ধ্বংস? হ্যাঁ। এই বিধ্বস্ত মহাকাশযানটা কি তুমি ধ্বংস করেছ? না। আমি করি নাই। য়ুহা লক্ষ করল দুর্বোধ্য একটা দুটো শব্দ দিয়ে কথা শুরু করলেও খুব দ্রুত এই প্রাণীটি অর্থবহ কথা বলতে শুরু করেছে। য়ুহা জিজ্ঞেস করল, তুমি কী চাও? আমি মানুষ বুঝতে চাই। গমগমে এক ধরনের কণ্ঠস্বরে মহাকাশের প্রাণীটি বলে, বিধ্বস্ত মহাকাশযানে কোনো জীবন্ত মানুষ নাই। আমি জীবন্ত মানুষ বুঝতে চাই। য়ুহা বলল, আমরা জীবন্ত মানুষ। আমি বুঝতে চাই। রায়ীনা বলল, আমরাও তোমাকে বুঝতে চাই। তুমি কেমন করে দেখ কেমন কথা বল আমরা বুঝতে চাই। তোমরা কেমন করে চিন্তা কর বুঝতে চাই। তোমরা আলাদা। তোমাদের কথা আলাদা। চিন্তা আলাদা। আমি এক। আমি একা। তুমি কেমন করে কথা বল? দেখ? শোন? স্পর্শ কর? আমি কথা বলি না। দেখি না। শুনি না। স্পর্শ করি না। আমি এক। আমি একক। রায়ীনা গলা উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করল, তুমি চিন্তা কর? আমি চিন্তা করি। তুমি কীভাবে চিন্তা কর? তোমরা যেভাবে চিন্তা কর আমি সেভাবে চিন্তা করি। তোমাদের সবার আলাদা আলাদা মস্তিষ্ক। আমার একটা মস্তিষ্ক। কোথায় তোমার মস্তিষ্ক? দেখতে চাই। এই গ্রহের ভেতরে বিশাল মস্তিষ্ক। গ্রহের ভেতরে? হ্যাঁ, এই গ্রহের ভেতরে বিশাল জায়গা জুড়ে আমার মস্তিষ্ক। আমার সেই মস্তিষ্ক আস্তে আস্তে বড় হচ্ছে। আমরা যে রকম হাঁটতে পারি। এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যেতে পারি তুমি সেটা পার না? না। আমার তার প্রয়োজন হয় না। আমার যেটা দরকার আমি সেটা আমার নিজের কাছে নিয়ে আসি। রায়ীনা নিঃশ্বাস বন্ধ করে বলল, আমাদেরকে যেভাবে এনেছ? হ্যাঁ। তোমাদেরকে যেভাবে এনেছি। কেন এনেছ আমাদের। আমি আগে শুধু মৃত মানুষ দেখেছি। শুধু মৃত মানুষ নিয়ে কাজ করেছি। আমি জীবন্ত মানুষ দেখতে চাই, তারা কেমন করে কাজ করে বুঝতে চাই। তুমি কী বুঝতে পেরেছ? আমি তাদের আরো গভীরভাবে দেখতে চাই। আরো গভীরভাবে বুঝতে চাই। আরো নিবিড়ভাবে দেখতে চাই, শরীরের প্রত্যেকটা কোষ দেখতে চাই, মস্তিষ্কের প্রত্যেকটা নিউরন দেখতে চাই য়ুহা ভয় পাওয়া গলায় বলল, কীভাবে দেখবে তুমি? খুলে খুলে। না য়ুহা চিৎকার করে বলল, আমি দেব না। কিছুতেই দেব না। দেব না? না। আমাদের ছেড়ে দাও। যেতে দাও।


এডিট ডিলিট প্রিন্ট করুন  অভিযোগ করুন     

গল্পটি পড়েছেন ৪০৪ জন


এ জাতীয় গল্প

গল্পটির রেটিং দিনঃ-

গল্পটির বিষয়ে মন্তব্য করুন

  • গল্পটির বিষয়ে মন্তব্য করতে আপনার একাউন্টে প্রবেশ করুন ... ধন্যবাদ... Login Now