বাংলা গল্প পড়ার অন্যতম ওয়েবসাইট - গল্প পড়ুন এবং গল্প বলুন

বিশেষ নোটিশঃ সুপ্রিয় গল্পেরঝুরিয়ান - আপনারা যে গল্প সাবমিট করবেন সেই গল্পের প্রথম লাইনে অবশ্যাই গল্পের আসল লেখকের নাম লেখা থাকতে হবে যেমন ~ লেখকের নামঃ আরিফ আজাদ , প্রথম লাইনে রাইটারের নাম না থাকলে গল্প পাবলিশ করা হবেনা

আপনাদের মতামত জানাতে আমাদের সাপোর্টে মেসেজ দিতে পারেন অথবা ফেসবুক পেজে মেসেজ দিতে পারেন , ধন্যবাদ

wolf mountain5 শেষ পর্ব

"রহস্য" বিভাগে গল্পটি দিয়েছেন গল্পের ঝুরিয়ান মোহাম্মদ মাজেদ (০ পয়েন্ট)

X WOLF MOUNTAIN লেখক : জে. আর. পিন্টো ভাষান্তরে : সুপ্রিয়া বন্দ্যোপাধ্যায় পর্ব ৫ ওরা তিনজন গিয়ে উঠে বসল সেইন্ট ফোর্টের ভ্যানে। খর্বকায় বুড়ো মাইকেল বসল ওদের মাঝখানে। দুজন লম্বা মানুষের মাঝখানে বসায় মাইকেলকে দেখে মনে হতে লাগল যেন কোনো বাচ্চা ছেলে, তার অভিভাবকদের সঙ্গে বেড়াতে বেরোচ্ছে। গাড়ির পাইলট সিটে বসে সেইন্ট ফোর্ট সামনে একটা মানচিত্র খুলে বসল। "....জায়গাটা কোথায় হবে?" প্রশ্ন করল আশার গ্রীন। তিনজনেই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ম্যাপটাকে দেখছিল। "....এই সেই উলফ মাউন্টেন", ম্যাপের একটা জায়গায় নির্দেশ করে বলল মাইকেল। "....জায়গাটা দেখছি এখান থেকে অনেকটাই দূর", ম্যাপটাকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করতে করতে বলল সেইন্ট ফোর্ট। গ্রীন দেখল, মাইকেল এবং সেইন্ট ফোর্ট ম্যাপের যে জায়গাটাকে পয়েন্ট আউট করে আছে, সেই জায়গাটা হিসপ্যানিওলা উপত্যকার একেবারে মাঝখানে - যে পর্বতশ্রেণী হাইতি থেকে ডোমিনিকান রিপাবলিককে পৃথক করেছে, সেই পর্বতশ্রেণীর মাঝে একটা উপত্যকার মাঝখানে। সেইন্ট ফোর্টের মুখ একটু চিন্তাক্লিষ্ট দেখাল। বলল, "জায়গাটায় যাওয়া খুব একটা সহজ হবে না। ওখানে গাড়ি চলাচলের রাস্তাও পাব না। অনেকটা পাহাড়ে পথ অতিক্রম করতে হবে"। "....অন্য কোনও রাস্তা নেই?" জিজ্ঞেস করল গ্রীন। "...না, পাহাড়ে যাওয়ার এই একটাই রাস্তা"। ওদের কথাবার্তার মাঝে হঠাৎ বুড়ো মাইকেল আকাশের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলে উঠল, "ওই দ্যাখো, ঝড় আসছে!" গ্রীন জানলা দিয়ে বাইরে তাকাল। সত্যিই, এরই মধ্যে সারা আকাশ কখন যেন ঢেকে গিয়েছে ঘন কালো মেঘে। থমথম করছে প্রকৃতি। দূরে সবুজ পাহাড়টাকে দেখা যাচ্ছে যেন এক প্রকাণ্ড দৈত্য অন্য একটা জগত থেকে নিশ্চুপ লক্ষ্য করছে ওদের গাড়িটাকে। এদিকে, আকাশে ঝোড়ো মেঘগুলো ক্রমশ আরও পুঞ্জীভূত হচ্ছে। দিনের আলো প্রায় নিভে এসেছে। ওপরে জলভরা কালো মেঘ আর নিচে দূরে ওই প্রকাণ্ড পাহাড় - অজান্তেই গ্রীনের বুকের ভেতর কাঁপুনি ধরিয়ে দিল। ওর মনে হতে লাগল, যাওয়াটা কি ঠিক হচ্ছে? কোনও মহাবিপদ ওদের জন্য অপেক্ষা করে নেই তো? তবু জোর করে মনের সবটুকু সাহস এক করে বলল, "চলো, যাত্রা শুরু করা হোক"। "....দ্যাটস দ্য স্পিরিট! " হেসে খুশি হয়ে বলল বুড়ো মাইকেল। দ্বিরুক্তি না করে গাড়ির এঞ্জিন স্টার্ট করে দিল মাইকেল। গাড়ি চলতে লাগল। গ্রীন চুপচাপ বসে, জানলা দিয়ে বাইরে চেয়ে রয়েছে। মাথায় ঘুরছে হাজারো চিন্তা। ওদিকে মাইকেল রেডিও অন করে দিয়ে মনের সুখে একটার পর একটা চ্যানেল ঘুরিয়ে বিভিন্ন গান শুনতে ব্যস্ত। কোথাও আবার ফ্রেঞ্চ এবং ক্রিওল ভাষায় নিউজ হচ্ছে। একসময় ব্যাগের ভেতর হাত ঢুকিয়ে মাইকেল দুটো কেক বের করে আনল। গ্রীন এবং সেইন্ট ফোর্টের হাতে একটা করে কেক ধরিয়ে দিয়ে বলল, "খাও। শরীরে বল পাবে"। "....ধন্যবাদ। আপনি খাবেন না?" জানতে চাইল গ্রীন। "...না, আমার এই মূহুর্তে খিদে নেই; কিন্তু তোমাদের খাওয়া প্রয়োজন"। অগত্যা দুজনকেই মাইকেলের হাত থেকে কেক নিয়ে খেতে হলো। ওদের মনে এনার্জি আনার জন্য বিভিন্ন রকমারি গল্প করতে লাগল মাইকেল। কত জনপদ পেরিয়ে গেল। অবশ্য সবগুলিই ধ্বংসপ্রায়। পলিথিনের ত্রিপল দিয়ে তৈরি করা ঘরগুলো দেখে মনে মনে শঙ্কিত হলো গ্রীন। ঝড় এলে এদের কি অবস্থা হবে, তাই ভেবেই চিন্তিত হয়ে পড়ল ও। সারাটা পথ বকবক করতে করতে চলল মাইকেল। গ্রীন আলগা আলগাভাবে সেগুলো শুনছে, সেইন্ট ফোর্টের নজর সামনের পথের ওপর, মাঝেমাঝে শুধু 'হুঁ হ্যাঁ' করে যাচ্ছে মাইকেলের কথায়। একসময় জনবসতি শেষ হয়ে এলো। এখন ওরা যেখান দিয়ে যাচ্ছে, সেখানে আর কোনও লোকবসতি নেই। ধূ ধূ করছে চারদিক। "....হাইতিতে এসে ভেবেছিলাম, এখানে অনেক রেইন ফরেস্ট দেখতে পাব", বলল গ্রীন। "....মাটি দূষনের ফলে সব শেষ হয়ে গিয়েছে", নিরাশভাবে বলল মাইকেল, "এটাই এখন অভিশাপ এখানকার। বিশ্বে আমরা কফি উৎপাদক দেশ হিসেবে এক নম্বর ছিলাম। আমরা ছিলাম এই ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জের চোখের মণি। কিন্তু মানুষ নিজের স্বার্থে সমস্ত গাছপালা কেটে ফেলেছে। এখন এখানে মরুভূমি ছাড়া আর কিছুই দেখতে পাবে না। এখন যেটুকু ফরেস্ট বেঁচে আছে, সব এখন ডোমিনিকান রিপাবলিকে আছে"। কথাবার্তার মাঝেই গ্রীন অনুভব করল, ওদের ভ্যানটা সমতল রাস্তা ছেড়ে ধীরেধীরে পাহাড়ি চড়াই পথ ধরে ওপরে উঠছে। একসময় গাড়ি চলাচলের রাস্তা শেষ হয়ে এলো। শুরু হলো এবড়োখেবড়ো চড়াই পথ। জায়গায় জায়গায় গর্ত আর গাছের মোটা মোটা গুঁড়িতে ঠোকর খেয়ে ওদের গাড়িটা বেশ কয়েকবার লাফিয়ে উঠল। ফলে ভেতরে সবাই ঝাঁকুনি খেলো বেশ কয়েকবার। "....এখান থেকে আবার হাঁটা পথ ধরতে হবে", বলল সেইন্ট ফোর্ট। একটা সামান্য সমতল জায়গায় দেখে গাড়িটাকে সেখানে পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রি কোণ করে পার্ক করল ফোর্ট কিন্তু এঞ্জিন তখনো বন্ধ করেনি। গাড়ির জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে গ্রীন দেখতে লাগল আশপাশটা। দেখল, একটা পায়েচলা পথ জঙ্গলের মাঝখানের বুক চিরে ক্রমশ উঠে গিয়েছে ওপরে। চারদিকে শুধু গাছ আর গাছ! কত গাছ! আরও অনেক...অনেক উঁচুতে দেখা যাচ্ছে পাহাড়ের শিখরটা যেন প্রায় আকাশকে ছুঁয়ে ফেলেছে যেন। ঠিক এইসময় হঠাৎ শুরু হলো বৃষ্টি। একেবারে আচমকা। সঙ্গে সঙ্গে সবাই গাড়ির জানলার কাঁচ উঠিয়ে দিল। বৃষ্টির ফোঁটা শব্দ করে গাড়ির জানলার ওপর পড়ে গড়িয়ে পড়তে লাগল। সেইসঙ্গে মূহুর্মূহু বিদ্যুতের ঝলকানি আর কান ফাটানো বজ্রপাত। অজান্তেই ভয়ে মাইকেলকে আঁকড়ে ধরল গ্রীন। ওর উৎকন্ঠা আরও বেড়ে গিয়েছে। এর আগে কখনো সে ঝড়জলের মধ্যে জঙ্গলে থাকেনি। সেইন্ট ফোর্ট বলল, "আমাদের এখন এখানেই বসে অপেক্ষা করতে হবে"। "....কতক্ষণ এই দূর্যোগ থাকবে?" জানতে চাইল গ্রীন। "....ঠিক নেই। পাঁচ মিনিটও হতে পারে, পাঁচ দিনও হতে পারে", নির্বিকার মুখে বলল মাইকেল। "....যদি তাই হয়", বলল সেইন্ট ফোর্ট, "তাহলেও চিন্তার কিছু নেই। আমাদের সঙ্গে পর্যাপ্ত খাবার, জল, জ্বালানী, সবকিছুই রয়েছে। এমনকি কোকো'র পিস্তল, একটা হান্টিং নাইফ, একটা 'দা' আর অবশ্যই অতি অতি গুরুত্বপূর্ণ যেটা, সেই সিলভার নাইফ। " আশ্বস্ত হলো গ্রীন কিন্তু কোকো'র জন্য দুশ্চিন্তা ওর ক্রমশই বাড়ছে। বৃষ্টির তোড়ে জানলার বাইরে এখন সবকিছুই ঝাপসা দেখাচ্ছে। না দেখেও গ্রীন বেশ বুঝতে পারছে, কর্দমাক্ত হয়ে উঠেছে পাহাড়ি পথঘাট। কোনওকিছু দৃষ্টিগোচর না হওয়ায় গ্রীন ভেতরে ভেতরে আরও উৎকণ্ঠিত হয়ে পড়েছে। "....এখানেই তাহলে পার্ক করি গাড়িটাকে?" বলল সেইন্ট ফোর্ট। "...করো"। এঞ্জিন বন্ধ করার আগে গাড়িটাকে আরও এক বার ঘোরাতে গিয়েই হলো বিপত্তি। গাড়িটা হঠাৎ করেই ক্রমশ পেছন দিকে নেমে যেতে লাগল, অনেকটা স্লিপ খেয়ে পড়ে যাবার মতো"। "...সর্বনাশ!" মনে মনে স্বগতোক্তি করে উঠল সেইন্ট ফোর্ট। আপ্রাণ চেষ্টা করল, হুইল ঘুরিয়ে গাড়িটাকে ওপর দিকে নিয়ে যেতে কিন্তু বাগে আনতে পারল না। গাড়িটা ক্রমশ পাহাড়ি ঢালু পথ বেয়ে নিচের দিকে গড়াতে লাগল। ওদিকে গাড়ির ভেতর তিন তিনটে মানুষও নিজেদের মধ্যে পাক খেতে লাগল, রোলারের মতো। চিৎকার করে উঠল ওরা। গ্রীনের মনে হলো, সে যেন অন্ধকার কোনও সুড়ঙ্গে তলিয়ে যাচ্ছে। জ্ঞান হারাবার আগে শুধু বুঝতে পারল, ওদের গাড়িটা গড়াতে গড়াতে একটা জায়গায় এসে কোনোকিছুর গায়ে ঠেকে গিয়েছে। বাইরে থেকে কানে আসছে শুধু বৃষ্টির নিরবিচ্ছিন্ন একটানা শব্দ। ব্যস, তারপর ওর চোখের সামনে নেমে এলো গাঢ় অন্ধকার। চারদিকে কুয়াশা। প্রচণ্ড কুয়াশা। গ্রীন সেই কুয়াশার মাঝে হারিয়ে গিয়েছে। সে জানে, ওর আশেপাশেই কোথাও গা ঢাকা দিয়ে আছে সেই ভয়ঙ্কর অমানুষ'টা। কিন্তু কোথায় লুকিয়ে থাকতে পারে, প্রচণ্ড কুয়াশার কারণে কিছুই বুঝতে পারছে না ও। ও দৌড়তে শুরু করল। হঠাৎ খুব কাছেই কে যেন ডেকে উঠল - "আশার!" কে! কে ডাকল ওর নাম ধরে! "...কাম অন...আশার...জাগো, জাগো, চোখ খোলো", খুব কাছেই কেউ যেন ওকে উদ্দেশ্য করে এই কথাগুলো বলছে আর সেইসঙ্গে কেউ যেন ওকে ধরে ঝাঁকাচ্ছে। .....চোখ মেলল গ্রীন। সারা শরীরে তখনো অসহ্য একটা ব্যথা। ও দেখল, ভ্যানের একটা দরজা খোলা আর সেই খোলা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে সেইন্ট ফোর্ট ওকে ডাকছে। দরজার কাছেই ফ্রন্ট সিটের ওপর শুয়ে রয়েছে আশার গ্রীন। "....কি?" কোনওরকমে অস্ফুটে বলতে পারল গ্রীন, "কি হয়েছে?" কথা বলতেও কষ্ট হচ্ছে তার। "...আমাদের গাড়িটা অ্যাক্সিডেন্ট করেছে", বলল সেইন্ট ফোর্ট, "অল্পের জন্য বেঁচে গিয়েছি"। আস্তে আস্তে মাথাটা যেন পরিষ্কার হতে লাগল গ্রীনের। ধীরেধীরে সবকিছু মনে পড়তে লাগল ওর। আপনা থেকেই ওর হাতটা কপালের ওপর উঠে এলো। অনুভব করল,ওর কপালে ব্যান্ডেজ জড়ানো। পাশেই মাইকেল ওর ওপর ঝুঁকে দাঁড়িয়েছিল। বলল, "খুব সামান্যই আহত হয়েছে। ঘাবড়ানোর কিছু নেই"। মাইকেলের কথায় হাসল গ্রীন। সিটের ওপর উঠে বসতে বসতে বলল, "কথাটা বলা খুবই সহজ"। "....এগুলো ধরো", গ্রীনের দিকে দুটো ওষুধের বড়ি আর জলের বোতল এগিয়ে দিল সেইন্ট ফোর্ট। "...থ্যাঙ্কস", বলল গ্রীন, "এগুলোই এখন খুব দরকার"। অনেকক্ষণ পর যখন নিজেকে একটু সুস্থ মনে হলো, তখন গাড়ি থেকে নেমে এলো গ্রীন। আশেপাশে গ্রীন একবার চোখ বুলিয়ে নিল। দেখল, একটা বড়সড় গাছের গায়ে গাড়িটা এসে ঠেকে প্রায় কাত হয়ে আছে। ভেঙেচুরে গিয়েছে ওটা। ওপরে যেখানে প্রথম পার্ক করা হয়েছিল গাড়িটা, সেখান থেকে তিরিশ ফুট নিচে গড়িয়ে চলে এসেছিল ওদের গাড়িটা। চারদিকে গাছের ভাঙা ডালপালা ছড়িয়ে রয়েছে। বৃষ্টি থেমে গিয়েছে কিন্তু আকাশের মুখ এখনও ভার। "....কতক্ষণ হলো আমরা এখানে এইভাবে রয়েছি?" প্রশ্ন করল গ্রীন। "...তা প্রায় এক ঘন্টা হয়ে গিয়েছে", বলল সেইন্ট ফোর্ট, "তুমি ঘুমোচ্ছ দেখে আমরা ইচ্ছে করেই তোমায় জাগাইনি; কিন্তু এখন আমাদের এগোতে হবে। আর দেরী নয়"। গ্রীন একবার তাকাল প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত গাড়িটার দিকে। বলল, "এ গাড়ি তো এখন আর চলবে না"। "....অসুবিধে কি? আমরা হেঁটেই যাব"। "....আমরা কি এখন উলফ মাউন্টেনে উঠব? " "...না", জবাবে বলল সেইন্ট ফোর্ট, "এখন আর ওদিকে যাবার মতো পর্যাপ্ত সময় নেই আমাদের হাতে। এখনও অনেকটা পথ বাকি আর যেতে যেতেই অন্ধকার হয়ে যাবে। আমাদের রাতের মতো একটা মাথা গোঁজার মতো আশ্রয় খুঁজে নিতেই হবে"। "....শিট!" কাছেই একটা গাছের গুঁড়ির গায়ে সজোরে একটা ঘুঁষি মেরে বলল গ্রীন, "আমার তো ইচ্ছে করছে এখনই ওকে খুঁজে বের করে শেষ করে দিই"। "...সে সময় পরে পাবে", গাছের একটা ভাঙা ডাল ওর দিকে এগিয়ে দিতে দিতে বলল সেইন্ট ফোর্ট, "এখন চলো, দেখি রাতের মতো কোনও আশ্রয় মেলে কিনা"। আঁকাবাঁকা কর্দমাক্ত পাহাড়ি পথ ধরে নামতে লাগল ওরা। ভাঙা ডালটাকে সম্বল করে গ্রীন মাইকেল এবং সেইন্ট ফোর্টের সঙ্গে সঙ্গে এগোতে লাগল। গন্তব্য এখন ওদের পাহাড়ের নিচের দিকে। বৃষ্টিতে পথ এতই পিছল আর কাদাকাদা হয়ে উঠেছে যে এগোনই দুষ্কর। বার বার পা ডুবে যাচ্ছে তাল তাল কাদার ভেতর। "...আমরা এখন কোথায় যাচ্ছি?" জানতে চাইল গ্রীন। মাইকেল পাহাড়ের নিচে একটা দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে বলল, "ওইদিকে। ওখানেই রাত কাটাতে পারি আমরা"। "....ওখানে কি কোনও ছোটখাটো শহর আছে?" কাঁধ ঝাঁকাল মাইকেল। বলল, "গ্রাম, তবে থাকার জন্য কোনও অসুবিধে হবে না। ওরা সবাই আমাকে চেনে"। কথায় কথায় ওরা পাহাড়শ্রেণীর মাঝখানে একটা গিরিখাতে চলে এলো। একসময় সম্ভবত এখানে নদী প্রবাহিত হতো। এখানে জায়গাটাও কিছুটা সমতল। হাঁটাচলায় তাই আর কোনও অসুবিধে হবে না। "....একটু জলদি হাঁটার চেষ্টা করো", গ্রীনকে তাগাদা লাগাতে গিয়ে বলল সেইন্ট ফোর্ট, "অন্ধকার নেমে এলো বলে"। প্রায় এক ঘন্টা সেই উপত্যকা ধরে চলার পর তারা একটা পরিষ্কার সমতল জায়গায় এলো। অল্প দূরেই বিশাল একটা হ্রদ। আশপাশের জায়গাটা দেখে মনে হলো সম্ভবত কোনও ফার্মল্যান্ড। কাছেই, অল্প দূরত্বে হ্রদের তীরে একটা ছোট জীর্ণ ফার্মহাউজ দাঁড়িয়ে। অনেকটা পথ হাঁটার ফলে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল গ্রীন। হাতের মোটা ডালটার ওপর ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকল কিছুক্ষণ স্থির হয়ে। "...কোথায় আছি এখন আমরা?" জানতে চাইল গ্রীন। মাইকেল তখনিই কোনও উত্তর দিল না। কপালের খানিকটা চুলকালো চিন্তাক্লিষ্ট হয়ে। তাকে দেখে মনে হলো সে নিজেও যথেষ্ট সন্দিহান হয়ে উঠেছে জায়গাটার ব্যাপারে। খানিক কপাল চুলকে বলল, " মনে হচ্ছে, আমরা 'ল্যাক অ্যাজুই'তে এসে পড়েছি"। তারপর আঙুল দেখিয়ে দিগন্তের উঁচু উঁচু পর্বতশ্রেণির দিকে দেখাল। বলল, "ওইদিকে আছে ডোমিনিকান রিপাবলিক। " গ্রীন অবাক হয়ে পুরো অঞ্চলটাকে দেখতে লাগল। চারদিকে পাহাড় পরিবেষ্টিত ফার্মল্যান্ডের ওপর একখানি পুরনো ফার্মহাউজ আর সামনে সমুদ্রের মতো বিশাল হ্রদ। "....তুমি কি এই গ্রামের কথাই বলছিলে?" চারপাশে তাকাতে তাকাতে প্রশ্নটা বেরিয়ে এলো ওর মুখ দিয়ে। "...না", বলে চুপ করে রইল মাইকেল। গ্রীন ভাবল, জায়গাটার ব্যাপারে এবার হয়তো লোকটা আরও কিছু বলবে কিন্তু মাইকেল আর কোনও কথাই বলল না। তার মুখ দেখে মনে হলো সে যেন গভীরভাবে কিছু ভাবছে। "....তবে কি গ্রামটা এর কাছাকাছি? " "...না"। গ্রীন লক্ষ্য করল, মাইকেলের কপালের চামড়া কুঁচকে উঠেছে চিন্তার ভারে। "....তাহলে আমরা এখানে দাঁড়িয়ে আছি কেন? চলো, হাঁটা শুরু করি"..... গ্রীনের কথা শেষ হতে না হতেই হঠাৎ কোথা থেকে ভেসে এলো একটা ভয়ঙ্কর গর্জন! আবার সেই হাউলিং! ভীষণ চমকে উঠে গ্রীন সঙ্গে সঙ্গে জায়গাতেই জমে গেল। এখানে কোথা থেকে ভেসে এলো সেই হাউলিং! এই হাউলিং'এর ডাকই তো সে গত কয়েকদিন যাবত শুনে আসছে। যদিও শব্দটা শুনে মনে হলো, অনেক দূর থেকে আসছে গর্জনটা। মাইকেলের মুখে একটা নিশ্চিন্তির ভাব ফুটে উঠেছে কিন্তু ওদিকে সেইন্ট ফোর্টের মুখে ফুটে উঠেছে একটা আতঙ্কের ভাব। "....চলো, ওই ফার্মহাউজটায় গিয়েই শেল্টার নেওয়া যাক", বলল গ্রীন। কাঁধ ঝাঁকিয়ে সম্মতি দিল মাইকেল এবং সেইন্ট ফোর্ট দুজনেই। তিনজনেই পা চালিয়ে দিল ফার্মহাউজটার দিকে। ধান এবং খড় ছড়িয়ে থাকা ড্রাইভওয়েটা অতিক্রম করে ওরা ফার্মহাউজের দরজায় চলে এলো। বাইরে দূরে আবার শোনা গেল সেই হাউলিং। পাহাড়ে পাহাড়ে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে সেই গর্জন। ফার্মহাউজের দরজায় করাঘাত করল মাইকেল। ত্রিশ সেকেন্ড কেটে গেল কিন্তু ভেতর থেকে কোনো সাড়া এলো না। এবার সেইন্ট ফোর্ট এগিয়ে এসে করাঘাত করল দরজায়। "হ্যালো' বলে কাউকে সম্বোধন করল কিন্তু তবু কেউ সাড়া দিল না। কেউ দরজা খুলল না। গ্রীন কয়েকবার দরজার নব ঘুরিয়ে খোলার চেষ্টা করল দরজাটা কিন্তু দেখা গেল দরজাটা ভেতর থেকে বন্ধ। এবার কি মনে হতে পকেট থেকে একটা ক্রেডিট কার্ড বের করে দরজার একটা নির্দিষ্ট 'গ্যাপে' ছোঁয়াতেই ম্যাজিকের মতো খুলে গেল দরজাটা আর তারপরেই ভেতরে দেখা গেল তাকে। ওদের দিকে ডাবল ব্যারেল শটগান তাক করে দাঁড়িয়ে। হতভম্ব গ্রীন সঙ্গে সঙ্গে দু হাত মাথার দু'দিকে তুলে আত্মসমর্পণের ভঙ্গিতে বলল, "হেই ম্যান, মারবেন না দয়া করে। আমরা ডাকাত নই"। ঘাবড়ে গিয়েছিল মাইকেল এবং সেইন্ট ফোর্ট দুজনেই। ভেতরে এরকম একজন কাউকে দেখবে, স্বপ্নেও ভাবেনি ওরা। লোকটার বিশাল চেহারা, গালে চাপ চাপ দাড়ি, শরীর থেকে উৎকট নোংরা গন্ধ যেন সে নিজেই একটা চলমান টয়লেট। সেইন্ট ফোর্ট সঙ্গে সঙ্গে ক্রিওল ভাষায় অনেক কিছু বলতে শুরু করল লোকটিকে লক্ষ্য করে। বোধহয় ওকে বোঝাতে চাইল যে তাদের কোনো বদ অভিসন্ধি নেই। এতে এবার চিঁড়ে ভিজল। লোকটির হাতের উদ্যত শটগান ধীরেধীরে নেমে এলো। আগের সেই মারমুখী ভাবটাও ধীরেধীরে অবলুপ্ত হলো। সেইন্ট-ফোর্টের কাছে ইশারায় জানতে চাইল গ্রীন, " কি হলো? লোকটি কেন অমন করছিল?" সেইন্ট ফোর্ট তাকে জানাল, "ওর ভুডু'তে খুব ভয়। ও আমাদের ভুডু'দের দলের কেউ ভেবেছিল"। বাইরে আবার শোনা গেল সেই হাউলিংয়ের শব্দ। এবার মনে হলো শব্দটা আরও কাছে এগিয়ে এসেছে। একটা জিনিস গ্রীন লক্ষ্য করেছে, এই খামারবাড়িটায় কোনও ইলেকট্রিসিটি নেই। ঘরের ভেতর বেশ অন্ধকার। গ্রীন এগিয়ে গিয়ে বাইরের দরজাটা বন্ধ করে দিল। তাতে ভেতরের অন্ধকার আরও গাঢ় হয়ে উঠল। ঘরে একটাই চেয়ার ছিল, সেটাকেই দরজার কাছে টেনে নিয়ে এসে তার ওপর গ্যাঁট হয়ে বসল গ্রীন। সেইন্ট ফোর্ট এবং মাইকেল বসল নিচে মেঝেতে। গ্রীন চাপা গলায় ওদের সাবধান করতে গিয়ে বলল, "ওয়্যারউলফটা যদি ঘরে ঢোকার চেষ্টা করে তাহলে তুমিই প্রথমে ওকে গুলি করবে। একেবারে ওর মাথা লক্ষ্য করে। তারপর আমার হাতে এই সিলভার নাইফ তো রয়েছেই। শেষে দফারফা করব আমি ওটার"। সময় কাটতে লাগল নীরবে। নিরেট অন্ধকারের বুকের ভেতর একখানি মাত্র মোম জ্বালিয়ে ভূতের মতো বসে বসে অপেক্ষার প্রহর গুণছে চারটে প্রাণী। এখন আর বাইরে শোনা যাচ্ছে ওয়্যারউলফের ডাক। শুধু ঝিঁঝিঁপোকার একটানা ডাক কানে আসছে। কাছে হ্রদের পাড় থেকে ভেসে আসছে ব্যাঙের একটানা ঘ্যাঙরঘ্যাঙ ডাক। কেমন একটা দমচাপা ভূতুড়ে পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে এখানে। চেয়ারে বসে থাকতে থাকতে কখন যেন সামান্য তন্দ্রা নেমে এসেছিল গ্রীনের চোখে। তারপর একসময় ধড়মড় করে জেগে উঠতেই টের পেলো, কোথাও কিছু একটা গোলমাল হচ্ছে। জানলা দিয়ে তাকাতেই আরও টের পেলো, বাইরে বৃষ্টি থেমে গিয়েছে, মেঘের আড়াল থেকে বেরিয়ে এসেছে চাঁদ যার নির্মল রশ্মি এসে প্রবেশ করেছে ছোট্ট এই ঘরটার ভেতর। জেগে উঠে গ্রীন ঠিক বুঝতে পারল না, কি কারণে হঠাৎ ওর ঘুমটা ভাঙল। চাঁদের আলোয় আশেপাশে তো কিছুই নজরে পড়ছে না। তবে মনে হলো একটা শব্দে ওর ঘুমটা ভেঙে গিয়েছে। অথচ ঘরে-বাইরে কোথাও কোনও শব্দ নেই এখন। থেমে গিয়েছে ঝিঁঝিঁপোকার ডাক, থেমে গিয়েছে ব্যাঙের যাবতীয় কোরাস। শুধু একটা অকাট্য নৈঃশব্দ্যতা বিরাজ করছে সমগ্র প্রকৃতির বুকে। এই ধরনের নিস্তব্ধতা বড় ভয়ানক। পায়ের দিকে নজর পড়তে দেখল, মেঝেতে বসে বসে ঝিমোচ্ছে সেইন্ট ফোর্ট। ওকে আস্তে করে ধাক্কা দিয়ে জাগিয়ে দিল গ্রীন। ঘুমভাঙা চোখ নিয়ে উঠে বসল সেইন্ট ফোর্ট। বলল, "ক্ক...কি হয়েছে?" "...মনে হচ্ছে কোনও বিপদ আসছে আমাদের সামনে", চাপা আতঙ্কিত স্বরে বলল গ্রীন। কথাটা কানে যেতেই সেইন্ট ফোর্ট ওর হাতের রিভলভারটা বাগিয়ে ধরল দরজার দিকে। গ্রীন বলল, "দরজার দিকে চোখ রেখে বসে থাকো। সতর্ক থেকো"। দুজনেই এবার অতন্দ্র প্রহরীর মতো দরজার দিকে সতর্ক দৃষ্টি রেখে বসে রইল। এক মিনিট...দু মিনিট...ওঃ সে কি অসহ্য নীরবতা! কান যেন ঝালাপালা হয়ে যাচ্ছে সেই অকাট্য নৈঃশব্দ্যতায়। কম্পিত বুকে দুজনে দরজার দিকে চেয়ে বসে আছে। প্রতি মূহুর্তে ভয়, এই বুঝি আসে ওয়্যারউলফটা। দরজা ভেঙে পড়ে হুড়মুড় করে। ওয়্যারউলফ এলো। কিন্তু দরজা দিয়ে নয়, এলো ঘরের দেওয়াল ভেদ করে। হঠাৎ প্রচণ্ড এক ধাক্কায় ভেঙে পড়ল ঘরের কাঠের দেওয়ালটা। দুটো লাল আলোর বিন্দু যেন এক বিভীষিকা সৃষ্টি করল নরম সেই চাঁদের আলোর মাঝে। যদিও প্রস্তুত হয়েই ছিল ওরা কিন্তু তবু ঠিকসময় গুলি করতে পারল না ওরা। ততক্ষণে বিছানা ছেড়ে জেগে উঠে বসেছে সেই কৃষক লোকটি, ওর হাতের বন্দুক গর্জে উঠল। বন্দুকের শব্দে খামারবাড়িটা কেঁপে উঠল থরথর করে। ভয়ঙ্কর হাউলিং করে উঠল ওয়্যারউলফ। হিংস্র লাল চোখের দৃষ্টি গিয়ে পড়ল সেই কৃষকটির ওপর। বন্দুকের ধোঁয়ায় ঘর ভরে গিয়েছে। ওয়্যারউলফটাকে দেখে সেইন্ট ফোর্ট এমন জমে গিয়েছে যে ও ফায়ারিং করতেই ভুলে গেল। ওদিকে আরও একবার ফায়ারিং করল কৃষকটি কিন্তু মূহুর্তে সেই বন্দুকের গর্জনের রেশ চাপা পড়ে গেল একটা কাতর মরণ আর্তনাদে। কৃষকটির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে ততক্ষণে ওয়্যারউলফটি। লোকটির মরণ আর্তনাদ আর হিংস্র জান্তব গর্জন তখন মিলেমিশে একাকার। এদিকে, গ্রীনকে একহাতে জাপটে ধরে ঠকঠক করে কাঁপছে সেইন্ট ফোর্ট। দু চোখ বন্ধ করে রেখেছে আপ্রাণ। গ্রীন নিজেকে ততক্ষণে সামলে নিয়েছে। সে সেইন্ট ফোর্টের হাত ধরে এক হ্যাঁচকা টান মারল। সেই টানে সম্বিৎ ফিরে এলো সেইন্ট ফোর্টের। সেইসঙ্গে মাইকেলকেও হাত ধরে উঠিয়ে দাঁড় করাল। ওদের ইশারা করল, এখুনি এই ঘর থেকে বেরিয়ে পড়তে হবে। সেকেন্ডের ভগ্নাংশেরও কম সময়ে ওরা তিনজন ঘরের দেয়ালে সৃষ্ট বিশাল গর্তটা দিয়ে ঘরের বাইরে এসে পড়ল। তারপর দে ছুট। মাইকেল বলল, "চলো, সবাই হ্রদের দিকে চলো"। তিনজন পড়িমরি ছুটতে লাগল হ্রদের দিকে। "...ওখানে বোধহয় একটা বোট বাঁধা আছে", চেঁচিয়ে বলল মাইকেল, "গ্রীন, তোমার ছুরিটা দাও। নোঙরের দড়ি কেটে বোটটাকে জলে নামাতে হবে। ওয়্যারউলফটার ওদিকে মনে হয় খাওয়া শেষ হয়ে গিয়েছে"। গা রি-রি করে উঠল গ্রীনের। চকিতে পকেট থেকে ছুরিটা বের করে ছুঁড়ে দিল মাইকেলের হাতে। দড়ির ওপর ছুড়ি ঘষে ঘষে দড়িটা একসময় কেটে গেল। বোটটা ভেসে গেল জলে। এবার ওঠার পালা কিন্তু তার আগেই পেছন দিক থেকে ভেসে এলো রক্তহিম করা সেই গর্জন। ওয়্যারউলফটা বেরিয়ে এসেছে বাইরে। ওটার ওদিকের খাওয়া শেষ হয়ে গিয়েছে। সারা মুখ রক্তে মাখামাখি। সেই কৃষক লোকটির রক্ত। ওর হাত থেকে বাঁচা কার্যত অসম্ভব বুঝতে পেরে মাইকেল নিজেই এবার বাকি দুজনের প্রহরী হয়ে দাঁড়াল। ওর কাছেই ছিল সিলভার নাইফ'টা। রূপোর তৈরি সেই ছুরিটা। ওটা হাতে মহা আক্রোশে তেড়ে গেল নর-বৃকটার দিকে। এদিকে ওটাও মহা ক্রোধে ফোঁসফোঁস করতে করতে এগিয়ে এলো মাইকেলের দিকে। রূপোর ছুরিটা হাতে মাইকেল ঝাঁপিয়ে পড়ল অমানুষটার ওপর। সবেগে ছুরিটা গেঁথে দিতে গেল ওটার বুকে। আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে একটা ভয়াল গর্জন শোনা গেল কিন্তু সেই গর্জনে হিংস্রতার পাশাপাশি একই সঙ্গে মিশে ছিল একটা আর্তনাদ। যেন কোনো কুকুর আহত হয়ে কাতর গলায় ডেকে উঠল। কিন্তু তারপরেই....প্রকাণ্ড এক গর্জন করে ওটা লাফিয়ে পড়ল মাইকেলের ঘাড়ে। প্রবল আক্রোশে ছিন্নভিন্ন করে দিতে লাগল ওকে। অদূরে বোটের কাছে দাঁড়িয়ে মাইকেলের অন্তিম পরিণতি প্রত্যক্ষ করছিল গ্রীন আর সেইন্ট ফোর্ট। ফোর্ট এগিয়ে যাচ্ছিল মাইকেলকে সাহায্য করতে কিন্তু গ্রীন বাধা দিল। বলল, "আর বাধা দিয়ে লাভ নেই। যা হবার হয়ে গিয়েছে। এখন এসো, আমাদের বাঁচতে হবে"। ওয়্যারউলফটা ওদিকে মাইকেলকে খেতে ব্যস্ত, গ্রীন আর সেইন্ট ফোর্ট উঠে বসল বোটের ওপর। তারপর তাড়াতাড়ি বৈঠা চালিয়ে পাড় থেকে যতটা সম্ভব দূরে সরে যেতে লাগল। ধীরেধীরে চোখ মেলল আশার গ্রীন। প্রথমটায় ঠিক ঠাহর করতে পারল না কোথায় আছে। চোখ মেলে তাকিয়ে ওর মনে হলো ওর চোখের সামনে দুনিয়াটা যেন অল্প অল্প আন্দোলিত হচ্ছে। বাতাসে একটা ভিজে ভিজে ভাব। ও যেখানে শুয়ে আছে, ওর দেহের নিচে কাঠের মতো শক্ত কিছুর অস্তিত্ব টের পাচ্ছে ও। ধীরেধীরে একসময় সে বুঝতে পারল যে সে শুয়ে আছে একটা নৌকোর ওপর। কানে আসছে নৌকোর নিচে জলের ছলাৎছলাৎ শব্দ। ধীরেধীরে ঘাড়টা ঘুরিয়ে চারপাশে তাকিয়ে বুঝল তারা রয়েছে লেক অ্যাজুই'য়ের সেই হ্রদের একেবারে মাঝখানে। ঢেউয়ের স্রোতে আপন খেয়ালে ভেসে চলেছে ওদের নৌকো। কোথায় চলেছে ওরা জানে না। গ্রীন বুঝতে পারছে না, ডোমিনিকান রিপাবলিক থেকে ওরা কতটা দূরে আছে। সকাল হয়ে গিয়েছে এখন কিন্তু সূর্যের মুখ এখনও ঢাকা ধূসর মেঘে। পাটাতনের ওপর উঠে বসেছিল গ্রীন। পাশেই শুয়ে রয়েছে সেইন্ট ফোর্ট। ঘুমোচ্ছে। "...জেগে ওঠো", সেইন্ট ফোর্টের গায়ে মৃদু ধাক্কা দিয়ে বলল গ্রীন। গ্রীনের হাতের মৃদু ধাক্কায় চোখ মেলে তাকাল ও। ওরও প্রথমটায় গ্রীনের মতোই অবস্থা হলো। কোথায় আছে, সেটাই ঠাহর করতে পারল না। "....কোথায় আছি আমরা?" অস্ফুট স্বরে জিজ্ঞেস করল ও। "...হ্রদের মাঝখানে কোথাও আছি। ওয়্যারউলফ সাঁতার কাটতে পারে না, নইলে আমরা কেউই এতক্ষণে বেঁচে থাকতাম না"। হ্রদের মৃদু ছলাৎছলাৎ শব্দ ছাড়া আর কোথাও কোনও শব্দ নেই। নিজেকে খুব ক্লান্ত লাগছিল গ্রীনের। হ্রদের কিছুটা জল নিয়ে নিজের মুখেচোখে ঝাপটা দিল গ্রীন। লবণাক্ত স্বাদ জলের। "...আমরা এখন কোথায় চলেছি? " বিমূঢ়ের মতো প্রশ্ন করল সেইন্ট ফোর্ট। "....জানি না", বলল গ্রীন, "তবে এভাবেই আপাতত চলতে থাকুক"। একটু চুপ করে থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে গ্রীন বলল, "জানবে, আমরা এখন কেউই সুরক্ষিত নই। না আছে আমাদের কাছে সিলভার নাইফ, না-ই আছে কোনো বন্দুক"। সচকিত হয়ে গ্রীনের মুখের দিকে তাকাল সেইন্ট ফোর্ট। সত্যিই তো, এ কথা তো ওর মনেই ছিল না। সিলভার নাইফ - যেটা ওয়্যারউলফ নিধনের কাজে লাগত, সেটাই তো এখন ওদের কাছে নেই। ওটা নিয়েই তো মাইকেল ওয়্যারউলফটাকে মারতে গিয়েছিল, ওটা তার মানে ঘটনাস্থলেই রয়ে গিয়েছে। ওহ মাই গড! নিজের মনেই বলে উঠল সেইন্ট ফোর্ট। ওদের নৌকোটা স্রোতের টানে ধীরেধীরে পাড়ের দিকে এগিয়ে আসতে লাগল। যত এগোতে লাগল, ততই পাড়ের সবকিছু ধীরেধীরে দৃশ্যমান হতে লাগল গ্রীন এবং সেইন্ট ফোর্টের কাছে। গ্রীন অবাক হয়ে দেখল, ওরা আবার ধীরেধীরে লেক অ্যাজুই'য়ের দিকেই ফিরে এসেছে, যেখান থেকে গতরাতে দুজনে উঠেছিল নৌকোয়। পাড়ের গায়ে এসে নৌকোটা একসময় ঠেকে গেল। ওরা দেখল, কিছুটা দূরেই মাইকেলের আধখাওয়া দেহটা পড়ে আছে। বীভৎস! তাকানো যায় না সেদিকে। গ্রীন দ্রুত চোখ সরিয়ে নিল অন্যদিকে। বীভৎস মৃতদেহটাকে দেখেই ওর পেটের ভেতরে যেন মোচড় দিয়ে উঠছে। "....ওই দ্যাখো", হঠাৎ বলে উঠল সেইন্ট ফোর্ট, "রূপোর সেই ছুরিটা পড়ে আছে! " গ্রীন দেখল, সত্যিই মড়ির পাশে পড়ে রয়েছে সেই ছুরিটা, নিতান্ত অনাদরে, অবহেলায়। "...ছুরিটাকে হাতছাড়া করা ঠিক নয়", বলেই গ্রীন একরকম ছুটে গিয়ে মৃত মাইকেলের হাত থেকে ছুরিটা প্রায় ছোঁ মেরে তুলে নিয়ে নিজের পকেটে ঢুকিয়ে রাখল। "....মাইকেল'কে এভাবে ফেলে রেখে যাওয়া ঠিক হবে না আমাদের", বলল সেইন্ট ফোর্ট। "....ঠিকই বলছ", বলল গ্রীন, "ওই কৃষক লোকটির বডিটাকেও ফেলে রেখে যাওয়া ঠিক নয়। চলো, এদের দুজনকে আমরা এখানেই সমাধিস্থ করে যাই"। সেই পোড়ো ফার্মহাউজটার ভেতরে তখনো গত কালের সেই কৃষক লোকটির দেহাংশ। দু'দুটো লাশকে সমাধিস্থ করতে করতেই অনেকটা সময় কেটে গেল। খামারবাড়িতে মৃত কৃষকটির গাদা বন্দুকটার খোঁজে গিয়ে ঢুকল গ্রীন এবং সেইন্ট ফোর্ট; কিন্তু কোথাও সেটাকে পেলো না। "....কোথায় গেল বন্দুকটা?" আশ্চর্য হয়ে গেল গ্রীন। "...মনে হয় ওয়্যারউলফটা নিয়ে গেছে"। "....তাহলে ছুরিটা পড়ে রইল কেন?" "...ভুলে যাচ্ছ কেন, ওটা সিলভার তাই ছুঁতে পারেনি"। অত:পর হ্রদের জলে দুজনে ভালো করে স্নান সেরে উলফ মাউন্টেনে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে লাগল। সারাদিন ওদের কেটে গেল পাহাড়ে উঠতে। একসময় দিনের আলো মরে এলো। সৌভাগ্য, আজ আর ঝড়বৃষ্টির ভয় নেই। পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে জঙ্গলের ভেতর অনেক ছোট ছোট পরিত্যক্ত গ্রাম নজরে পড়ল ওদের। খড়ে ছাওয়া ঘরবাড়ি পড়ে রয়েছে কিন্তু কোথাও কোনও মানুষের দেখা নেই। যেন হঠাৎ করে মৃত্যু হানা দিয়ে সম্পূর্ণ জনশূন্য করে দিয়েছে এই গ্রামগুলোকে। সব ঘরবাড়ির দরজা বন্ধ। এই দিনের বেলাতেও। দুপুরের পর যখন প্রায় পাহাড়চূড়ার কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছে, তখন সেইন্ট ফোর্ট অদূরে একটা শৃঙ্গের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করল। শৃঙ্গটা একটা উপত্যকার সাথে যুক্ত। সেইন্ট ফোর্ট সেদিকে আঙুল দেখিয়ে বলে উঠল, "ওই...ওই হলো উলফ মাউন্টেন"। গোধূলি আলোয় ধূসর মেঘে ঢাকা শৃঙ্গটাকে দেখে গ্রীনের হৃদপিন্ড যেন বরফ হয়ে গেল। বলল, "তুমি কি শিওর, ওটাই উলফ মাউন্টেন?" "....যতদূর জানি, ওটাই উলফ মাউন্টেন"। "...বেশ, তবে তাড়াতাড়ি পা চালাও"। ফের পা চালিয়ে দিল ওরা। দিনের আলো থাকতে থাকতে ওরা সেখানে পৌঁছতে চায়। "...আমাদের কিন্তু দিনের আলো থাকতে থাকতেই ওকে খুঁজে হত্যা করতে হবে", বলল গ্রীন, "যতক্ষণ দিনের আলো আছে ততক্ষণ ও মানুষের রূপে থাকবে আর সেই অবস্থাতেই ওকে হত্যা করা সহজ হবে"। "....কিন্তু কিভাবে জানব আমরা ও কোথায়?" বলল সেইন্ট ফোর্ট, "এখানে কে আমাদের সন্ধান দেবে?" গ্রীন কিছু বলতে যাবার আগেই কিছুটা দূরেই ছোট একটা কলাবনের ভেতর একটা চালাঘর চোখে পড়ল ওর। সঙ্গে সঙ্গে উত্তেজনায় চকচক করে উঠল গ্রীনের চোখদুটো। কলাগাছে ঘেরা বলে এতক্ষণ ওদের নজরে পড়েনি। সেইন্ট ফোর্টকে উদ্দেশ্য করে গ্রীন বলল, "চলো, একবার ওখানে গিয়ে দেখা যাক, কেউ আছে কিনা। থাকলে সে হয়তো আমাদের একটা দিশা দেখাতে পারে"। চালাঘরের দরজার কাছে এলো গ্রীন। সাবধানে নক করল দরজায়। "হ্যালো" বলে সম্ভাষণ করল, ভেতরে যদি কেউ থাকে তো সে সাড়া দেবে। কিন্তু ভেতর থেকে কোনো উত্তর এলো না। "...কেউ আছেন ভেতরে?...নতুন জায়গা, ভারী মুশকিলে পড়েছি, একটু হেল্প করতে পারেন? " ফের বলে উঠল গ্রীন আর সঙ্গে সঙ্গে ওর কান কি একটা শব্দে উৎকর্ণ হয়ে উঠল। স্পষ্ট শুনতে পেলো, ঘরের ভেতর থেকে মেয়েলি গলায় একটা 'উঁ..উঁ..উঁ...উঁ..' শব্দ ভেসে আসছে। যেন কেউ কিছু বলতে চাইছে কিন্তু কোনও কারণে পারছে না। তাই সে অসহায়ভাবে ওইভাবে তার উপস্থিতি জানান দিচ্ছে। সেইন্ট ফোর্টের মুখের দিকে একবার তাকাল গ্রীন। লক্ষ্য করল, শব্দটা তার কানেও গেছে। সে'ও মনে মনে বেশ উৎকণ্ঠিত হয়ে পড়েছে। কি মনে হতে গ্রীন এবার দরজায় কাঁধ দিয়ে জোরে চাপ দিতে লাগল। পাতলা কাঠের দরজা, বেশীক্ষণ গ্রীনের দেহের চাপ সইতে পারল না। হুড়মুড় করে আলগা হয়ে খুলে গেল। তারপরেই ভেতরে যে দৃশ্য ওদের চোখে পড়ল, তার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিল না ওরা। দেখল, একটা চেয়ারের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে পিছমোড়া করে বেঁধে রাখা আছে কোকো'কে। এমনকি ওর মুখও কাপড় দিয়ে বাঁধা তাই বোধহয় এতক্ষণ সাড়া দিতে পারছিল না। ওদের দেখে কোকোর যেন আনন্দ আর ধরে না। উত্তেজনায় ওর শরীরটা প্রায় উঠে দাঁড়িয়ে পড়তে চাইছে চেয়ার ছেড়ে কিন্তু বাঁধন থাকায় সেটা সম্ভব হচ্ছে না। আর...আর ওর পেছনে দেওয়াল জুড়ে কার যেন একটা বিশাল প্রতিকৃতি। অসম্ভব রোগা একটা লোক, যার পরনে একটা 'tuxedo' ( নৈশভোজের সময় পরিধেয় জ্যাকেট), মাথায় একটা হ্যাট। লোকটি দাঁড়িয়ে আছে একটা সিমেট্রিতে। আর ওর চারপাশে ওকে ঘিরে আছে পাল পাল নেকড়ে। ছবিতেও নেকড়েগুলোর চোখ লাল আগুনের মতো জ্বলছে। অদ্ভুত, অসম্ভব দৃশ্যপট ছবিটার! ছবিটা গ্রীনকে অল্পক্ষণের জন্য হতভম্ব করে দিলেও পরক্ষণেই সে নিজেকে সামলে নিল। একরকম ছুটে এসে পকেট থেকে নাইফ'টা বের করে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা কোকো'র হাত পায়ের বাঁধন কেটে দিতে লাগল। "....কোকো!" বলেই একরকম ছুটে এলো সেইন্ট ফোর্ট, "আমরা তো ভেবেছিলাম, তুই বোধহয় এতক্ষণে...." বলেই প্রায় ডুকরে কেঁদে উঠল ফোর্ট। দাদা আর গ্রীনকে দেখে চোখের জল ধরে রাখতে পারছিল না কোকো। গ্রীন ততক্ষণে ওর বাঁধন খুলে দিয়েছে। ওকে আবেগে জড়িয়ে ধরে রইল অনেকক্ষণ। আবেগের ঘনঘটা একটু প্রশমিত হলে গ্রীন কোকো'কে জিজ্ঞেস করল , "ও কোথায়?" মাথা নাড়ল কোকো। বলল, "জানি না। গত রাতে আমাকে বলে গিয়েছিল যে ও তোমাকে হত্যা করতে যাচ্ছে। তারপর এখনও পর্যন্ত আর ফেরেনি"। সেইন্ট ফোর্ট বলল, "হতে পারে সম্ভবত গত রাতে মাইকেলের সিলভার ছুরির আঘাতে ও মারা গিয়েছে "। ফের মাথা নেড়ে অসম্মতি জানিয়ে কোকো বলল, "না, আজ ভোরের দিকে আমি ওর ডাক শুনেছি। হাউলিং করছিল। কিন্তু মনে হয়েছিল, ও যেন আহত কারণ ওর ডাকের মধ্যে একটা কাতর আর্তনাদের ভাব ছিল। ওর 'হাউলিং'টা ক্রমশ এগিয়ে আসছিল আমার এই ঘরের দিকে কিন্তু ভাগ্যিস তখন সূর্য উঠে গিয়েছিল তাই আর ও আসতে পারেনি এই ঘর পর্যন্ত"। কোকোর চোখের জল মুছিয়ে দিতে দিতে গ্রীন বলল, "তুমি এখন চলতে পারবে তো?" "...পারব মানে? না পারলেও চলতেই হবে আমায়"। "...তবে চলো"। একটা হাত গ্রীনের কাঁধে রেখে অন্য হাতটি সেইন্ট ফোর্টের কাঁধে রেখে ভর দিয়ে চলতে শুরু করল কোকো। এখন পাহাড় থেকে নিচে নামার পালা। পাহাড়ি পথ ধরে ক্রমশ নিচের দিকে নামতে লাগল ওরা। গ্রীন চাইছিল তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে নামতে কিন্তু কোকো'র জন্য ওরা তাড়াতাড়ি এগোতে পারছিল না। একসময় পাহাড়ের নিচে রাস্তায় নেমে এলো ওরা। এদিকওদিক তাকাতে লাগল গ্রীন যদি একটা যানবাহন নজরে পড়ে কোথাও কিন্তু কোনও বাহনই নজরে পড়ল না ওদের। চতুর্দিক একেবারে সুনসান, বিরান। এখনও পর্যন্ত এই অঞ্চলে কোকো ব্যতীত একটাও জীবন্ত মানুষ নজরে পড়েনি ওদের। কি শক্তিশালী ওই হেনরী লী ডায়াবেল! ভাবতে লাগল গ্রীন। ওয়্যারউলফের মধ্যযুগীয় কাহিনীগুলো বিশ্বাস করলে হেনরী ক্রিস্টোফার ছিল এক মায়াবী। কালাজাদু জানত। হেনরীর কতখানি ক্ষমতা আছে? ও কি ওদের কোথাও থেকে লক্ষ্য করছে? ও কি ওদের নিয়ে খেলা করছে - যেমন বিড়াল ইঁদুর নিয়ে খেলা করে? আকাশের দিকে চেয়ে গ্রীন দেখল, সূর্যটা ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে পাহাড়গুলোর পেছনে। একটু পরেই শুরু হবে অন্ধকার আর ভয়ের রাজত্ব। কোথাও একটা রাতের মতো আশ্রয় নিতেই হবে। নইলে এই অরণ্য আর পাহাড়ে রাত কাটানো মোটেও নিরাপদ নয়। আরও বেশ কিছুটা চলার পর ওরা একটা গ্রামের কাছাকাছি এলো। এই গ্রামটাও সেই আগের গ্রামগুলোর মতো। কোনও লোকজন নেই কোথাও। যে পরিত্যক্ত ঘরবাড়িগুলো আছে, এখানেই কোথাও একটা শেল্টার নিতে হবে কিন্তু এই খড় আর কাঠের দেওয়াল ওদের কতখানি নিরাপত্তা দিতে পারবে, তা নিয়ে ওর মনে ঘোর সংশয় আছে। বিশেষ করে গতরাতের অভিজ্ঞতা বলছে, ওয়্যারউলফের কাছে এসব ঘরবাড়ির আড়াল কোনও বাধাই নয়। মনের আশঙ্কাটা সে প্রকাশই করে ফেলল। সেইন্ট ফোর্ট বলল, "একটা কাজ করলে হয়, আমরা কেন না নৌকোয় রাতটা কাটিয়ে দিই? ওয়্যারউলফ তো সাঁতার কাটতে পারে না.."। প্রস্তাবটা গ্রীনেরও মনে ধরল। সত্যিই, লেকের কথা ওর মনেই ছিল না। বলল, "বেশ তবে জলদি চলো হ্রদের দিকে। আর একটু পরেই অন্ধকার নেমে এলেই হাজারটা বিপদের মুখে পড়ব আমরা"। আগের চেয়েও জোরে পা চালিয়ে দিল ওরা। নির্দিষ্ট একটা দিক ঠিক রেখে এগোতে লাগল। কিন্তু বহুক্ষণ কেটে গেলেও কোনও হ্রদ ওদের চোখে পড়ল না। "...তুমি কি শিওর, যে আমরা সঠিক পথে চলেছি?" প্রশ্ন করল গ্রীন, "পথ হারিয়ে অন্য পথে চলে আসিনি তো?" "...যতদূর মনে হয় আমরা সঠিক দিকেই এগোচ্ছি", আশ্বস্ত করে বলল সেইন্ট ফোর্ট। আরও বেশ কিছুক্ষণ চলার পর ওদে চোখের সামনে ভেসে উঠল সেই হ্রদটা। ততক্ষণে রাত নেমে এসেছে। আকাশে মেঘের আড়াল থেকে বেরিয়ে এসেছে চাঁদ। সেই চাঁদের আলোয় আদিগন্ত বিস্তৃত হ্রদের জল ঝিলমিল করছে। দৃশ্যটা অপূর্ব কিন্তু গ্রীন জানে এখন প্রাকৃতিক শোভা উপভোগ করার সময় নয়। জলদি নৌকোয় উঠে হ্রদের জলে ভেসে পড়তে হবে, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব হ্রদের মাঝখানে নিয়ে যেতে হবে নৌকোটাকে যাতে বিপদ ওদের নাগাল না পায়। কিন্তু লেকটা তখনো ওদের থেকে অনেকটাই দূরে এবং জলের কাছে যেতে ওদের প্রায় দৌড়তে হচ্ছিল। যখন হ্রদের প্রায় কাছাকাছি এসে পড়েছে ওরা, হঠাৎ একটা অস্ফুট চিৎকার করে থেমে গেল কোকো। "...কি হলো?" বলে উঠল গ্রীন এবং সেইন্ট ফোর্ট দুজনেই। "...আ..আমি যেন কিছু একটা দেখলাম!" থরথর করে কাঁপছে কোকো, ওর দু'চোখ বিস্ফারিত। স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে আছে একদিকে। গ্রীন লক্ষ্য করল, ওর দৃষ্টি সেই জীর্ণ ফার্মহাউজটার দিকে, যেখানে গতরাতের মতো আশ্রয় নিয়েছিল ও, সেইন্ট ফোর্ট আর মাইকেল। "...যা-ই দ্যাখো, এখন আমাদের থামবার সময় নয়", জোর গলায় বলে উঠল গ্রীন, "চলো ওই নৌকোটায় এখনি উঠে পড়ে নৌকো ছেড়ে দিতে হবে।" গ্রীনের কথাগুলো কোকোর কানে গেছে বলে মনে হলো না। সে তখনও ভয়ার্ত দৃষ্টিতে চেয়ে আছে ফার্মহাউজটার দিকে। থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে বলল, "আ...আ...আমি...যেন একটা গাঢ় কালো ছায়াকে এইমাত্র সরে যেতে দেখলাম"। "...ঠিক আছে", তাগাদা দিয়ে বলল গ্রীন, "কিন্তু এখানে থেমে যাওয়ার সময় নয়, অবিলম্বে হ্রদের জলে ভেসে না পড়তে পারলে আমাদের তিনজনেরই প্রাণসংশয় আছে".... গ্রীনের কথা শেষ না হতেই ভয়ঙ্কর একটা গর্জন ভেসে এলো খুব কাছ থেকেই। আর্তনাদ করে উঠল কোকো। কোকোর হাত ধরে হ্যাঁচকা টান মারল গ্রীন। ওকে নিয়ে ছুটতে লাগল হ্রদের দিকে। পিছিয়ে পড়েল সেইন্ট ফোর্ট। সে'ও ওদের অনুসরণ করে ছুটে আসতে লাগল। আর তখনিই এক ভয়ঙ্কর রক্তজল করা হুঙ্কার দিয়ে ওয়্যারউলফটা লাফিয়ে পড়ল সেইন্ট ফোর্টের ওপর। একটা আর্তচিৎকার শুধু বেরিয়ে এলো ওর মুখ দিয়ে। ফোর্টের মরণ আর্তনাদ আর ওয়্যারউলফের গর্জনে ঘুরে দাঁড়িয়েছিল গ্রীন। ফোর্টকে বিপন্ন দেখে ও আর স্থির থাকতে পারল না। পকেটে থাকা সিলভার ছুরিটা নিয়ে লাফিয়ে পড়ল অমানুষটার ওপর। আমূল গেঁথে দিতে গেল কিন্তু ওটার দেহের কঠিন মাংস ভেদ করে ছুরিটা বেশীদূর যেতে পারল না। কিন্তু তবু সিলভারের ছোঁয়ায় প্রচণ্ড আর্তনাদ করে উঠল জন্তুটা। প্রাণফাটা আর্তনাদ করতে করতে সেইন্ট ফোর্টকে ছেড়ে দিয়ে ছুটে পালিয়ে যেতে লাগল। কিন্তু সেইন্ট ফোর্ট ততক্ষণে আর বেঁচে ছিল না। গ্রীন বুঝল, এবার ওর আর কোকোর পালা। অবিলম্বে নৌকোয় গিয়ে উঠতে না পারলে ওদের ওপরেও বিপদ ঘনিয়ে আসবে। তাই সে আর দেরী না করে কোকোর হাত ধরে টানতে টানতে একরকম ছুটে চলল নৌকোর দিকে। ********************************************* ************ হ্রদের জলের ঢেউ এসে আঘাত করছে নৌকোর তলায়। অল্প অল্প ছলাৎছলাৎ শব্দ কানে আসছে। ক্ষয়িষ্ণু চাঁদের আলোয় বিশাল হ্রদের বুকে ভেসে বেড়াচ্ছে একমাত্র শুধু ওদের নৌকোটা। নৌকোর সওয়ারি একমাত্র দুজন - গ্রীন আর কোকো। বিষাদে, প্রিয়জন বিরহে দুজনেই কাতর। দুজনেরই মনের অবস্থা অবর্ণনীয়। দুজনেই এতটাই মুষড়ে পড়েছে যে কাঁদার শক্তিও হারিয়ে ফেলেছে। "...আমরা কি এখানে নিরাপদে? " একসময় নীরবতা ভেঙে বলে উঠল কোকো। "...তাই মনে করি", বলল গ্রীন, "সেইন্ট ফোর্ট বলেছিল, ওরা জলে সাঁতার কাটতে পারে না। তাই আমি মনে করি, আমরা এখানে যথেষ্ট নিরাপদ", সেইন্ট ফোর্টের কথা বলতে গিয়ে আপনা থেকেই কণ্ঠস্বর রুদ্ধ হয়ে এলো গ্রীনের। "....কিন্তু আমরা কুমীরের শিকারও তো হতে পারি", ভয় মাখানো চোখে হ্রদের জলের দিকে তাকিয়ে বলল কোকো। "...সে ঈশ্বরের হাতে ছেড়ে দাও", আবেগহীন গলায় বলল গ্রীন, "যদি আমাদের ভাগ্যে মৃত্যু থাকে তো থাকবে। কিছু করার নেই"। কোকো আর কিছু বলল না। চুপ করে বসে রইল। নৌকোর ওপর দুজনে দুজনের কাঁধে ভর দিয়ে বসে থাকতে থাকতে একসময় কখন যেন ঘুমিয়ে পড়ল ওরা। ভোরের দিকে একবার শুধু ঘুমটা ভেঙে গিয়েছিল হ্রদের তীর থেকে আসা ভয়ঙ্কর একটা হাউলিংয়ের শব্দে। ব্যস, তারপর আর কোনও শব্দ শোনা যায় নি। সকাল হয়ে এলো একসময়। সূর্য উঠে গিয়েছে অনেকক্ষণ। নৌকোর ওপর গ্রীন এবং কোকো দুজনেই শ্রান্তিতে,অবসাদে গভীর ঘুমে। ।। Emperor Henri Christophe।। গ্রীন জানে না, কতক্ষণ ঘুমিয়েছিল ও। একরাশ উৎকন্ঠা আর দুঃস্বপ্ন দেখে যখন হাঁসফাস করতে করতে ঘুমটা ভাঙল ওর তখন টের পেলো ওর বুকের ওপর কিছু যেন প্রবল আশ্লেষে খোঁচা দিচ্ছে। চোখ মেলে তাকিয়ে দেখল, ওদের নৌকোটা কখন যেন তীরে এসে ভিড়েছে। একটা ব্যারেল রাইফেলের নল ওর বুকের ওপর অনবরত খোঁচা দিচ্ছে। দুজন গাঁট্টাগোট্টা হাইতিয়ান কোকো এবং তার ওপর ঝুঁকে দাঁড়িয়ে। ওদেরই একজন শটগানের খোঁচা দিয়ে চলেছে গ্রীনের বুকে। ভীষণ চমকে উঠে ধড়মড় করে উঠে বসল গ্রীন। হাইতিয়ান লোকদুটোর দুজনের হাতেই সেমি-অটোমেটিক রাইফেল। ওদিকে, কোকো'ও জেগে গিয়েছে। কনুইয়ের ওপর ভর দিয়ে আধশোয়া অবস্থায় উঠে বসেছে ও। ওরও চোখেমুখে উৎকন্ঠা আর ভয়। একজন হাইতিয়ান গ্রীনের উরুতে একটা লাথি মেরে ক্রিওল ভাষায় কি যেন বলল যার একবর্ণও বুঝতে পারল না গ্রীন। ক্রিওল ভাষায় কিসব বলতে বলতে হাইতিয়ান দুটো গ্রীন এবং কোকো'কে ধরে হ্যাঁচড়াতে হ্যাঁচড়াতে নিয়ে যেতে চাইল। কোকো চিৎকার করে উঠল। গ্রীন ওদের ইশারায় বোঝাতে চাইল, ওরা যেখানে ওদের নিয়ে যেতে চায়, ওরা সেখানে নির্ভয়ে যাবে কিন্তু এইভাবে নয়। তারপর কোকো'র দিকে তাকিয়ে বলল, "চুপচাপ ওদের সঙ্গে চলো। দেখি, ওরা এরপর আমাদের কোথায় নিয়ে যায়"। হাইতিয়ান দুটো এরপর গ্রীনের পকেট হাতড়াতে লাগল। সিলভার নাইফ'টা খুঁজে পেতে বেশীক্ষণ লাগল না। ছুরিটা পকেট থেকে একরকম কেড়ে নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে লাগল ওরা। মুখে ফুটে উঠল কিরকম একটা দূর্বোধ্য হাসি। তারপর ফের গ্রীন আর কোকোর দিকে চেয়ে ফের ক্রিওল ভাষায় কিছু একটা বলে উঠল। কোকো ইংরেজিতে তর্জমা করে গ্রীনকে বলল, "ওরা আমাদের বলছে, হাতদুটো পেছনে করতে"। এরপর ওদের নির্দেশ মেনে ওরা তাই করল। হাইতিয়ান দুটো এইবার গ্রীন আর কোকোর হাতদুটো দড়ি দিয়ে শক্ত করে বেঁধে দিল। তারপর বলল, "আমাদের সঙ্গে চলো। কোনওরকম চালাকির চেষ্টা করবে না"। ক্রিওল ভাষায় বলা ওদের সাবধানবাণীটা ইংরেজিতে তর্জমা করে গ্রীনকে জানাল কোকো। কিছুটা দূরেই একটা জিপগাড়ি দাঁড়িয়ে ছিল। রজ্জুবদ্ধ গ্রীন এবং কোকো'কে নিয়ে এসে জিপের ব্যাকসিটে ওদের প্রায় ঠেলে ধাক্কিয়ে উঠিয়ে দিল। এরপর ওরা ওদের পা দুটোও শক্ত করে বেঁধে ফেলল। ব্যাকসিটে গা এলিয়ে দিয়ে মড়ার মতো চুপচাপ পড়ে রইল দুজনে। হাইতিয়ান দুটোর মধ্যে একজন ওদের দিকে রাইফেলের নল তুলে নিশানা করে ক্রিওল ভাষায় বলল, "যদি পালাবার কোনওরকম চেষ্টা করেছ, তো দুজনকেই মরতে হবে"। এবড়োখেবড়ো, অসমতল পাহাড়ি পথ ধরে খেলনাগাড়ির মতো লাফাতে লাফাতে ছুটে চলল ওদের জিপটা। সারাদিন ধরে চলল ওদের গাড়িটা। পাহাড় একসময় শেষ হয়ে এলো, শুরু হলো লোকালয়। আশেপাশে একটি দুটি জনপদের চিত্র ফুটে উঠতে লাগল। দেখা মিলল লোকজনেরও। গ্রীন আর কোকো দুজনেই হাত-পা বাঁধা অবস্থায় নিষ্পন্দ হয়ে পড়ে রইল গাড়ির ভেতর। চেঁচিয়ে সাহায্যের জন্য ডাকাডাকি করার চেষ্টাও করল না। যাতে এমনটা করলে দুজনকেই মরতে হবে। বিকেলের দিকে ওদের গাড়িটা আবার একটা খাড়াই পথ ধরে ওপরে উঠতে লাগল। এখানে জঙ্গল বেশ গভীর। যদিও আশেপাশে মানুষজনের বসতি চোখে পড়ছে। উলফ মাউন্টেনে কোথাও যেমন কোনও বসতি চোখে পড়েনি, বিরান ছিল চারদিক, কোথাও কোনও জীবনের সাড়া ছিল না; কিন্তু এখানে তা নয়। মহিলারা মাথায় কলাভর্তি ঝুড়ি চাপিয়ে পথের ধার দিয়ে চলেছে। রাস্তার আনাচেকানাচে উলঙ্গ ছোট ছোট শিশুরা খেলায় মেতেছে। ক্ষেতে চাষীরা সঙ্ঘবদ্ধ হয়ে কাজ করছে। এখানে জীবনের সাড়া আছে। কোকো গাড়ির জানলা দিয়ে আনমনাভাবে চেয়েছিল বাইরের দিকে। ওদের গাড়ির ওপাশের জানলার পাশে দেখা যাচ্ছে সুউচ্চ পাহাড়। হঠাৎ কোকো গাড়ির জানলার ওপর ঝুঁকে পড়ে গ্রীনকে উদ্দেশ্য করে বলল, "দ্যাখো, দ্যাখো!" গ্রীন ওর দৃষ্টি অনুসরণ করে তাকিয়ে দেখে, পাহাড়চূড়ার একেবারে কিনারে দাঁড়িয়ে আছে একটা ক্যাসল। একনজরে দেখেই বোঝা যাচ্ছে ক্যাসলটা বহু পুরনো। মধ্যযুগীয় ধাঁচে তৈরি ক্যাসলটার দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে কোকো হঠাৎ বলে উঠল, "দ্যাখো, ক্যাসলটাকে অনেকটা ড্রাকুলা ক্যাসলের মতো লাগছে!" তারপরই যেন জায়গাটাকে চিনতে পেরেছে এরকমভাবে বলল, "এরা আমাদের সিটাডেলে নিয়ে যাচ্ছে"। ওদের গাড়িটা পাহাড়ের যত উঁচুতে উঠছে, ক্যাসলটা ততই স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর দৃশ্যমান হচ্ছে। শেষমেশ ক্যাসলের পরিত্যক্ত পুরনো ফটকের সামনে এসে থামল ওদের জিপটা। গাড়ির এঞ্জিন বন্ধ করে হাইতিয়ান দুটো নেমে এসে ব্যাকসিটের কাছে এসে ওদের দুজনের পায়ের বাঁধন খুলে দিল। তারপর ওদের আদেশ করল, গাড়ি থেকে নেমে আসতে। ওরা বিনা বাক্যব্যয়ে ওদের আদেশ পালন করল। তবে ওদের হাতদুটো এখনও রজ্জুবদ্ধ অবস্থাতেই রইল। গ্রীন চেয়ে রইল সামনে সদম্ভে দাঁড়িয়ে থাকা ক্যাসলটার উঁচু চূড়াটার দিকে। প্রায় আকাশে গিয়ে ঠেকেছে ক্যাসলের মাথার গম্বুজটা। অন্য দেশ হলে এই ক্যাসলটা পর্যটকদের কাছে একটা বিশেষ দর্শনীয় স্থান হতো। হাইতিয়ান দুজনের একজন ওদের দিকে বন্দুক তুলে চড়া সুরে কি যেন বলল। ক্যাসলে সিঁড়ির সংখ্যা প্রচুর। সেই সিঁড়ি ধরে উঠতে লাগল দুজনে। সামনে-পেছনে একজন করে সশস্ত্র হাইতিয়ান। ক্রমে প্রাসাদ প্রাচীরের একেবারে উঁচুতে উঠে এলো ওরা। গ্রীন বুঝতে পারছে না তখনো, এখানে ওদের এনে হাইতিয়ানগুলো কি করতে চায়। কি আছে এই ক্যাসলে তা-ও জানে না ও। কিন্তু ওপরে উঠে এসে বিশাল একটা ব্যাঙ্কোয়েট হল দেখতে পেল ওরা। সেই প্রশস্ত হলঘরটায় একটা বেদী, অনেক কাঠের স্তুপ, চার-চারটে ড্রাম আর দুটো বিশাল কাঠের চেয়ার। অবাক হয়ে চোখ গোল গোল করে হলঘরটাকে দেখছিল গ্রীন আর কোকো। পিঠে বন্দুকের নলের ধাতব স্পর্শ পেতেই ওরা ফের এগোতে লাগল। একেবারে প্রাচীরের কিনারে এসে পড়ল ওরা। কয়েকশ'ফুট নিচে চোখে পড়ছে হাজার হাজার একর জমি। ওদের পায়ের নিচেই। সিটাডল শহরটা এই পাহাড়ের গায়েই গড়ে উঠেছে। জমি থেকে দূর্গের উচ্চতা দেখে গ্রীনের মনে হলো, এখান থেকে একবার পড়লে শুধু পড়তেই থাকবে। কতক্ষণ পর যে ওদের শরীর জমির স্পর্শ পাবে, তার কোনও হিসেব নেই। হাইতিয়ানদুটো ওদের প্রাচীরের কিনার থেকে নিয়ে এলো ফের সেই হলঘরে। সিংহাসনের মতো দেখতে কাঠের চেয়ারদুটোয় ওদের বসিয়ে ফের ওদের বেঁধে ফেলল, চেয়ারের সাথে। এরা ওদের নিয়ে কি করতে চায়, তা কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছে না গ্রীন। ওদের জ্যান্ত খাওয়া হবে, নাকি এই চেয়ারের সাথে বেঁধেই পুড়িয়ে মারা হবে নাকি উঁচু থেকে ফেলে হত্যা করা হবে - ওদের সাথে ঠিক কি করা হবে তা কিছুতেই ও অনুমান করতে পারছে না। হাজাররকম কল্পনা ওর মনের মধ্যে এসে ভিড় করছে। সহসা কোথা থেকে আরও দুজন হাইতিয়ান এসে ওদের সাথে যোগ দিল। ওদেরও একইরকম গাঁট্টাগোট্টা চেহারা। সংখ্যায় এখন তারা চারজন। কারোর ঊর্দ্বাঙ্গে পোশাক নেই। ওরা চারজনে মিলিত হয়ে সেই বেদীটাকে সাজাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। যেন কোনও অনুষ্ঠানের আয়োজন করছে ওরা। গ্রীন বা কোকোর দিকে ওদের কারোর নজর নেই। গ্রীন দেখল, বেদীটাকে ওরা গ্যাসোলিন দিয়ে সিঞ্চন করছে। তারপর তাতে অগ্নিসংযোগ করল। গ্যাসোলিন সিক্ত কাঠের বেদীটা দপ করে জ্বলে উঠল সঙ্গে সঙ্গে। গ্রীন একবার অসহায়ভাবে পেছন দিকে তাকাবার চেষ্টা করল। কিন্তু এত উঁচু তলায় হলঘরে বসে ডুবন্ত সূর্যটা ছাড়া আর কোনওকিছুই দৃষ্টিগোচর হলো না। ঈশ্বর জানেন, এখন ওদের নিয়ে কি করা হবে। ভাবনার মাঝেই কোথা থেকে একটা পুরুষকন্ঠ ভেসে এলো, "...সিটাডলে আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি, মঁসিয়ে গ্রীন। সম্রাট হেনরী ক্রিস্টোফারের রাজত্বে আপনাদের দুজনকেই স্বাগত"। কণ্ঠস্বর অনুসরণ করে গ্রীন ফিরে তাকিয়ে দেখল, অল্প দূরেই দাঁড়িয়ে আছে হেনরী লী ডায়াবেল। আপাদমস্তক কালো পোশাকে আচ্ছাদিত। অনেকটা আলখাল্লার মতো। শুধু তার মুখ এবং হাতদুটি বেরিয়ে আছে। দেহের দু'পাশে আলগাভাবে ঝুলে আছে হাতদুটো। ধীরেধীরে প্রাচীরের কিনারের দিকে এগিয়ে গেল হেনরী লী ডায়াবেল। তাকাল নিচের দিকে। দৃপ্ত কন্ঠে বলতে লাগল, "নিচে যে শহরটাকে দেখছ, ওটা 'Cap-Haïtien', হাইতির দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর"। তারপর দূরে দিগন্তের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে বলল, "ওটা হলো কিউবা"। বলেই এবার সে ফিরল গ্রীনের দিকে। তারপর হাতদুটো দু'দিকে ছড়িয়ে বলতে লাগল "এই দূর্গ হলো হেনরী ক্রিস্টোফার যখন সম্রাট হন, সেইসময় এই দূর্গ নির্মাণ করেছিলেন। এই দূর্গ সম্পূর্ণ দূর্ভেদ্য"। একটু থেমে হেনরী চেয়ে রইল গ্রীনের দিকে। বোধহয় ওর মনোভাব বোঝার চেষ্টা করছে। গ্রীনও চেয়ে রইল তার দিকে, মুখে এখন তার টুঁ শব্দটি নেই। পরিস্থিতি কোন দিকে এগোয় এখন, সেটাই ও বুঝতে চাইছে এখন। "...ফরাসীরা আমাদের কখনো আর পুনর্দখল করতে পারেনি", ফের বলে উঠল গ্রীন, "আমরা হাইতিয়ানরাই একমাত্র জাতি, যারা দূর্ধর্ষ ফরাসীদের কবল থেকে মাতৃভূমিকে স্বাধীনতা এনে দিয়েছিলাম। গোটা বিশ্ব তাই এখনও আমাদের ঘৃণার চোখে দেখে। বিশ্বের বড় বড় জাতিগুলি এখনও চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে আমাদের ফের কব্জা করার কিন্তু এখনও পর্যন্ত সফল হয়নি। হেনরী ক্রিস্টোফার, জীন-জ্যাকোয়েস ডিসালিন এবং ডুভেলিয়ার্স - এঁদের জন্যই আমরা অতীতে দুর্ধর্ষ ফরাসীদের কবল থেকে ছিনিয়ে এনেছিলাম স্বাধীনতা। " হেনরী লী ডায়াবেলের কথাগুলো গ্রীন মন দিয়ে শুনছিল আর খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে লোকটাকে লক্ষ্য করছিল সে। ওর ইচ্ছে করছিল লোকটাকে এখনই শেষ করে দেয় কিন্তু উপায় নেই এখন। হাত-পা বাঁধা। হেনরীর দিকে চেয়ে সে বলল, "আমি দুঃখিত। তোমার পরনের ওই পোশাকটার জন্য আমি তোমার কথাগুলো ঠিক সিরিয়াসলি নিতে পারছি না"। মুচকি হাসল হেনরী লী ডায়াবেল। বলল, "ভালো। সাহসীদের আমি শ্রদ্ধা করি"। তারপর দৃপ্ত ভঙ্গিতে পায়ে পায়ে হেঁটে এসে দাঁড়াল সেই জ্বলন্ত বেদীটার কাছে। আগুনের আভায় লাল হয়ে উঠেছে ওর মুখ। গ্রীন বিস্ময়াবিষ্ট হয়ে ওকে লক্ষ্য করছিল। বলল, "তুমি কি জানো, সম্রাট ক্রিস্টোফার তাঁর সেনাবাহিনীর একটা পুরো ব্যাটেলিয়নকে এই জ্বলন্ত বেদীর ওপর দিয়ে হেঁটে যাবার আদেশ দিয়েছিলেন? তারপর...তারা রাজার নির্দেশ পালন করেছিল এবং মৃত্যু হয়েছিল তাদের সকলেরই। কিন্তু কেন তারা তা-ই করেছিল, তুমি জানো?" দুপাশে মাথা নাড়ল গ্রীন। জানে না। "....কারণ... রাজা ক্রিস্টোফার নিজে ছিলেন হাইতিয়ান এবং তাঁর সেনাবাহিনীও ছিল হাইতিয়ান। যুগ যুগ ধরে এই জাতি হাসতে হাসতে মৃত্যুকে বরণ করে নেয়। আমাদের সেই পাওয়ার আছে", বলতে বলতে উত্তেজিতভাবে দু-হাত ওপরে তুলল হেনরী লী ডায়াবেল। "...বুঝলাম", এবার বলল গ্রীন, "কিন্তু তুমি সেই অতীতের সম্রাট হেনরী ক্রিস্টোফারের নাম ব্যবহার করছ কেন? যাতে সামান্য হলেও বিখ্যাত হতে পারো? তোমার আসল নাম কি?" "....আমি তাঁর নাম ব্যবহার করছি না", হঠাৎ প্রশমিত হয়ে এলো হেনরীর উত্তেজিত কন্ঠস্বর। তারপর বলল, "সম্রাট হেনরী ক্রিস্টোফার কোনো সাধারণ মানুষ ছিলেন না। তিনি ছিলেন একটি নর-বৃক। হ্যাঁ, ওয়্যারউলফ। কেউ তাঁকে হত্যা করতে পারত না। তাঁকে যে হত্যা করতে পারে, সে হলো একমাত্র তিনি নিজে। যখন তাঁর ইচ্ছা হয়েছিল যে এবার তিনি মারা যাবেন তখন ব্যবহার করেছিলেন একমাত্র একটা সিলভার বুলেট" - বলতে বলতে রজ্জুবদ্ধ গ্রীন এবং কোকোর কাছে এগিয়ে এলো আজকের এই হেনরী। একটু চুপ করে থেকে ফের বলল, "কিন্তু মৃত্যুরও সাধ্য ছিল না হেনরীকে থামিয়ে দেবার। তাঁর আত্মা ছিল প্রবল শক্তিশালী তাই তিনি মৃত্যু থেকে আবার ফিরে এলেন। পুনর্জন্ম ঘটল তাঁর"। বলতে বলতে এতটাই উত্তেজিত হয়ে পড়েছিল হেনরী যে প্রায় গ্রীনের মুখের ওপর ঝুঁকে পড়েছে সে। দুটো জ্বলন্ত চোখ যেন বিদ্ধ করছে গ্রীনের চোখদুটোকে। কোনও মানুষের পক্ষে সে দৃষ্টি সহ্য করা অসম্ভব। চাপা হিসহিসে গলায় হেনরী বলল, "আমিই সেই হেনরী ক্রিস্টোফার। হ্যাঁ, আমি সম্রাট হেনরী ক্রিস্টোফার। আবার পুনরাবির্ভূত হয়েছি এই পৃথিবীতে। আর আজ রাতের পর থেকে আমি আবার এই হাইতি শাসন করতে শুরু করব"। অবিশ্বাসের হাসি হেসে উঠল গ্রীন। বলল, "কি আবোলতাবোল বলছ? এরকম অসম্ভব কথা একমাত্র পাগলাগারদের কোনও পাগলই বলতে পারে"। এবার সোজা হয়ে উঠে দাঁড়াল হেনরী। প্রচণ্ড ক্রোধে ঝকঝক করছে ওর চোখদুটো। বলল, "আজ রাতে তোমাদের দুজনের রক্ত-মাংস-মজ্জা খেয়েই আমি ফিরে পাব আমার সম্পূর্ণ শক্তি। তারপর আমিই হব পৃথিবীর একচ্ছত্র শাসক। দেখি, কার ক্ষমতা আমায় আটকায়?" গ্রীন দেখল, ওর কৌশল দারুণভাবে খাটছে। বিদ্রুপের হাসিটুকু অক্ষুণ্ণ রেখেই সে বলল, "আমি মানতে পারছি না। তুমি বলছ তুমিই সেই হেনরী ক্রিস্টোফার? বলছ, এসেছ তুমি পৃথিবী শাসন করতে? রক্ষা করবে নিজের হাইতিকে, শত্রুদের কবল থেকে? অথচ তুমি তাকিয়ে দ্যাখো, হাইতিয়ানদের কোথাও কোনও শত্রু নেই এখন। কারণ এদের থেকে এখন নেওয়ার মতো কিছুই নেই। এখন এরা গোটা বিশ্বের কাছে দয়ার পাত্র। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের শিকার এখানকার সকলেই। তাই এদের মতো তোমারও দয়া নেবার প্রয়োজন আছে"। দাঁতে দাঁত পিষল হেনরী। গ্রীনের ওপর সাপের মতো ক্রুদ্ধ চোখদুটো স্থির রেখে বলল, "তোমাকে আমি যে কি ভয়ানক যন্ত্রণা দিয়ে হত্যা করব, তুমি কল্পনায়ও আনতে পারছ না তা।" তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে গ্রীন বলল, "এসব ছেঁদো কথা সব দেশের শাসকরাই বলে। ওসবে এখন কেউ আর ভয় পায় না। মুখেই রাজা-উজীর মারে ওরা"। "...তুমি জানো, আমি কে?" এবার প্রায় চিৎকার করে উঠল হেনরী। "...জানি, তুমি একটা কুকুর। নিজের অশুভ উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্য নিজের আত্মাকে বিক্রি করে দিয়েছ"। নিদারুণ ক্রোধে বিস্ফারিত হয়ে উঠল হেনরীর চোখদুটো। ক্ষ্যাপা ষাঁড়ের মতো ফুঁসছে ও। এগিয়ে গেল কোকোর দিকে। চাপা হিসহিসে গলায় বলল, "এই মেয়েটাকে। এই মেয়েটাকে আমি মারব। আমেরিকান কুত্তাটা দেখবে, কিভাবে আমি ওর আদরের 'বুলবুলি'টাকে মেরে ফেলছি। তারপর একই অবস্থা ওরও করে ছাড়ব", বলতে বলতে কোকোর মুখের কাছে নিজের কুৎসিত একটা আঙুল নিয়ে গেলো হেনরী। ওর ঠোঁটের ওপর তর্জনী বোলাতে যাবে, হঠাৎ কোকো এমন একটা কান্ড করে বসল যার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিল না গ্রীন। সে হঠাৎ সজোরে একটা কামড় বসাল হেনরীর তর্জনীতে। লাফিয়ে উঠল হেনরী। ওর মুখ রাগে আরও লাল হয়ে উঠেছে। "...কি, কেমন লাগল স্বাদটা?" পাশ থেকে টিপ্পনী কেটে বলে উঠল গ্রীন। মাত্রাছাড়া ক্রোধে অন্ধ হয়ে গিয়েছে হেনরী লী ডায়াবেল। সোজা হয়ে দাঁড়াল সে। তাকাল দূরে দিগন্তের দিকে। বাইরে সূর্য তখন পুরোপুরি অস্ত গিয়েছে। অন্ধকার ঘন হয়ে নেমে এসেছে চারদিকে। সেদিকে চেয়ে সহসা খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল হেনরী। গ্রীনদের দিকে তাকিয়ে চাপা ক্রুদ্ধস্বরে বলল, "তোদের মৃত্যুর সময় ঘনিয়ে এসেছে এইবার।" বলে বেদীর দিকে সদর্পে এগিয়ে গেল সে। ওর অনুচরগুলো যারা এতক্ষণ পাথরের মূর্তির মতো স্থির দাঁড়িয়েছিল, তারা ড্রাম বাজাতে শুরু করল। নির্দিষ্ট ছন্দে ড্রামগুলো বাজতে লাগল। বড় একটা কাঠের বাটির মতো দেখতে পাত্র কখন যেন উঠে এসেছে হেনরীর হাতে। বাটিটা হাতে নিয়ে সে স্থির দাঁড়িয়ে রয়েছে বেদীটার কাছে। সম্ভবত পাত্রটার মধ্যে কিছু একটা আছে। একসময় পরনের সমস্ত পরিধেয় খুলে ফেলল হেনরী। সম্পূর্ণ উলঙ্গ এখন সে। আগুনের আভায় চকচকে দেখাচ্ছে তার শরীর। ওর পিঠে দু'দুবার সিলভার ছুরির আঘাতে সৃষ্ট ক্ষতটাও স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে গ্রীন। ভয়ঙ্কর, কদর্য দেখাচ্ছে তার উলঙ্গ মূর্তি। ড্রামগুলো বেজেই চলেছে নাগাড়ে আর আগুনের বেদীর সামনে দাঁড়িয়ে অনবরত বিদঘুটে গলায় ক্রিওল ভাষায় মন্ত্রোচ্চারণ করে চলেছে। মন্ত্রোচ্চারণের এক পর্যায়ে বাটিতে রাখা তেলটা পুরো শরীরে মাখতে শুরু করল হেনরী লী ডায়াবেল। সারা শরীরে তেলটাকে মেখে নিল সে। ফলে তার দেহ আগুনের আভায় আরও চকচক করতে লাগল। তেল মাখা শেষ করার পর হেনরী সোজা হয়ে উঠে দাঁড়াল। দু-পাশে হাতদুটো ছড়িয়ে দিল, বুজে ফেলল চোখদুটো, তারপর আরও কঠিন গলায় মন্ত্রোচ্চারণ করতে লাগল। পেতলের মতো ঝকঝকে লাগছে এখন তার সারা দেহটা। একসময় শেষ হলো সেই অদ্ভুত গলায় মন্ত্রপাঠ। চোখদুটো বোজা অবস্থাতেই সামনের দিকে মাথাটাকে সামান্য নত করল সে, যেন অদৃশ্য কাউকে বাও করল। তারপর ঘুরে দাঁড়াল গ্রীন এবং কোকোর দিকে। চোখদুটো তখনও বন্ধ। এবার ধীরেধীরে চোখ মেলে চাইল সে। ওর চোখের দিকে চেয়ে বুকের ভেতরটা ধড়াস করে উঠল গ্রীন এবং কোকো - দুজনেরই। দুটো লাল রুবিপাথর যেন বসিয়ে দেওয়া হয়েছে হেনরীর চোখের কোটরে। একটা অশুভ দূর্বোধ্য হাসি খেলে গেল গ্রীনের ঠোঁটের কোণায়। মৃত্যুর হাসি। অশুভ, অমঙ্গলময় হাসি। নিজেকে এবার বড়ই বোকা আর অসহায় বোধ করতে লাগল গ্রীন। কেন যে এ দেশে এলো এই ভেবেই নিজেকে বার বার ধিক্কার দিতে ইচ্ছে করছিল ওর। গোঁয়ারের মতো যদি জেদ ধরে না থাকত তাহলে আজ হয়তো নিজের দেশে ভালোভাবে জীবন কাটাতে পারত। এখন তো সামনে মৃত্যু। মৃত্যুর আলিঙ্গন ছাড়া এখন ওর ভাগ্যে কিছুই জুটবে না। চোখের সামনে ভেসে উঠল কচি কচি ছেলে-মেয়েদুটোর অসহায় মুখ। তারা এখন জানেও না, তারা আর কোনওদিন বাবাকে দেখতে পাবে না। নিজের অজান্তেই কান্না এসে গেল গ্রীনের। গ্রীন এবং কোকোর হতভম্ব চোখের সামনেই ভয়াবহ রূপান্তর শুরু হলো হেনরীর দেহে। দেহটায় ভয়ানকভাবে খিঁচুনি শুরু হলো। দেহটা লম্বায় এবং চওড়ায় বেড়ে সামনের দিকে কিছুটা ঝুঁকে পড়ল। সর্বাঙ্গে গজিয়ে উঠল অসংখ্য বড় বড় লোম। মুখটা লম্বাটে হয়ে ঝুলে পড়ল। মূহুর্তে মানুষের মুখ থেকে পশুর মুখে রূপান্তরিত হলো। কানদুটো সূঁচালো হয়ে উঠল। চোয়ালটা আরও লম্বায় বেড়ে গিয়ে দাঁতগুলো বেরিয়ে এলো। ছুরির ফলার মতো ঝিকিয়ে ঝিকিয়ে উঠতে লাগল ওর দাঁতগুলো। কিছুক্ষণ আগে দেখা মানুষটা নিমেষে একটা হিংস্র অমানুষে পরিণত হলো। রূপান্তর শুরু হতেই ড্রাম বাদকের দল সবাই বিদায় নিয়েছিল ঘর থেকে। এখন ঘরে শুধু রজ্জুবদ্ধ গ্রীন এবং কোকো এবং ওদের সামনে দাঁড়িয়ে ওই মূর্তিমান বিভীষিকা। দূর্গ কাঁপিয়ে ভয়ঙ্কর হাউলিং করে উঠল অমানুষটা। বাইরে পাহাড়ের মাথাগুলো ছাড়িয়ে দূরে আরও দূরে ছড়িয়ে পড়ল ওর সেই ডাক। ভয়ঙ্কর সেই গর্জনে পুরো দূর্গটা কাঁপতে লাগল ভূমিকম্পের মতো। সঙ্গে সঙ্গে আশপাশের অঞ্চল থেকেও ভেসে এল আরও অনেকগুলো নেকড়ের ডাক। দলে দলে নেকড়ে বুঝি ছুটে আসছে এই দূর্গের দিকে। প্রমাদ গুণল মনে মনে গ্রীন। হেনরী শুধু নয়, এবার ওরা সবাই বুঝি ওকে ছিঁড়ে খেতে আসছে! হা ঈশ্বর! একা রামে রক্ষে নেই, সুগ্রীব দোসর! গোদের ওপর বিষফোঁড়া! ওরা যে হলঘরে ছিল, সেই ঘরের দরজা দিয়ে পালে পালে ঢুকতে লাগল হিংস্র নেকড়ের দল। গ্রীন এবং কোকো ভয়ার্ত চোখে দেখল, ওদের প্রত্যেকের মুখ লাল রক্তে রাঙানো, বুঝি আসার পথে কোনও না কোনও হতভাগ্যকে খেয়ে এসেছে। নেকড়েগুলো এসে ঘিরে ধরল ওয়্যারউলফরূপী হেনরী লী ডায়াবেলকে। এতগুলো নেকড়ে দেখে ক্ষণিকের জন্য হতভম্ব হয়ে গেল হেনরী। নেকড়েগুলো ঘিরে ফেলেছে ওকে ততক্ষণে। ক্রমশ ওটাকে কোণঠাসা করে ফেলতে লাগল। ওয়্যারউলফটা নিদারুণ ক্রোধে গর্জাতে লাগল। এতগুলো নেকড়ের ফাঁদে পড়ে কেমন যেন অসহায় দেখাতে লাগল ওটাকে। নেকড়ের পাল ওটাকে প্রায় ঠেলে নিয়ে চলল আগুনের দিকে। জ্বলন্ত বেদীর দিকে পিছোতে পিছোতে একসময় ওয়্যারউলফটা পড়ে গেল বেদীর গনগনে আগুনের মধ্যে। ছটফট করে উঠল ওটা। অসহ্য যন্ত্রণায় কাতরাতে লাগল। কিছুটা দূরে রজ্জুবদ্ধ অবস্থায় বসে গ্রীন এবং কোকো হতভম্ব হয়ে দেখতে লাগল সেই অদ্ভুত দৃশ্যটা। ওয়্যারউলফটা খাক হচ্ছে। পুড়ে খাক হয়ে যাচ্ছে। আকাশফাটানো আর্তনাদ করে চলেছে ওটা। পাঁঠাকাটার মতো ছটফট করছে ওটা। একসময় থেমে গেল ওটার যাবতীয় ছটফটানি। পড়ে রইল শুধু একটা কালো পোড়া নরকঙ্কাল। কাজ শেষ করে বিজয়ীর ভঙ্গিতে নেকড়েগুলো এবার একে একে সরে যেতে লাগল। আগের সেই হিংস্র ভাব আর নেই এখন ওদের মধ্যে। শত্রুর সমাপ্তি ঘটিয়ে শান্তমূর্তি ধারণ করেছে এখন ওরা। পুরো ব্যাপারটা এতই হতভম্ব করে দিয়েছে গ্রীন এবং কোকো দুজনকেই যে দুজনের মুখের ভাষাই হারিয়ে গিয়েছে। কেন নেকড়েগুলো এসে ওদের নিশ্চিত মৃত্যু থেকে উদ্ধার করল, কে পাঠিয়েছিল ওদের, সবকিছুই কেমন যেন রহস্যাবৃত রয়ে গেল ওদের কাছে। নিস্তব্ধ হলঘরে বসে শুধু দুজনে দুজনের দিকে মূক বিস্ময়াবিষ্ট চোখে চেয়ে রইল। কি এর ব্যাখ্যা হতে পারে, কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না দুজনের কেউই। ।। Les Loups Sans Cheveux ।। কিছুক্ষণের জন্য ওরা বোধহয় চেতনা হারিয়ে ফেলেছিল। সর্বপ্রথম চেতনা ফিরল গ্রীনের। চেতনা ফিরতেই অনুভব করল ওর ঘাড়ের পেছনে অসহ্য ব্যথা। শক্ত পাথুরে মেঝের ওপর ওর দেহটা এতক্ষণ পড়েছিল। চোখ মেলার পর আস্তে আস্তে সবকিছু মনে পড়তে লাগল ওর। ধীরেধীরে উঠে বসল গ্রীন। সামনে বেদীটা এখনও ধিকিধিকি জ্বলছে। ওদিকে উন্মুক্ত প্রাঙ্গনের বাইরে নজর পড়তে দেখল, বাইরে আকাশটা ক্রমশ ফর্সা হচ্ছে। ঊষার প্রথম পরশ লাগছে আকাশের গায়ে। পাশে কোকো'র দিকে তাকাল। কাঠের চেয়ারটার গায়ে ঠেকনো দিয়ে অচৈতন্য অবস্থায় পড়ে রয়েছে কোকো। "...কোকো?" ওর গায়ে মৃদু ধাক্কা দিতে দিতে ওর নাম ধরে ডাকতে লাগল গ্রীন। অনেকক্ষণ ডাকাডাকির পর একসময় সাড়া মিলল। ধীরেধীরে চোখ মেলল মেয়েটা। তবে ওকে দেখেই মনে হলো খুব অসুস্থ। এই ক'দিনে যেন একটা ঝড় বয়ে গেছে ওর ওপর দিয়ে। দু চোখের কোলে কালি পড়েছে। অসম্ভব পরিশ্রান্ত দেখাচ্ছে ওকে। নিজেও খুব একটা সুস্থ অনুভব করছে না গ্রীন। "....কেমন লাগছে শরীর?" প্রশ্ন করল গ্রীন। "....ভালো", ভাঙা ভাঙা শোনাল কোকো'র কণ্ঠস্বর। "...তোমাকে সহানুভূতি জানাবার ভাষা আমার নেই, কোকো", ভাঙা ভাঙা গলায় বলে উঠল গ্রীন। "....কেন?" "...সবকিছুর জন্য আমার খারাপ লাগছে। তোমাকে আমার কাজে জড়িয়ে ফেলার জন্য। সেইন্ট ফোর্টকে বাঁচাতে পারলাম না, ওইজন্যও আমার অনুশোচনা হচ্ছে। সারাজীবনেও আমি নিজেকে ক্ষমা করতে পারব না।" "...আমরা এখনো বেঁচে আছি তো?" বলল কোকো, "আমার মাথা এখন কোনও কাজ করছে না। তাই বুঝতে পারছি না, আমরা আদৌ বেঁচে আছি কিনা"। "....আমরা বেঁচেবর্তেই আছি", কোকোর হাতদুটো ধরে ওকে আশ্বস্ত করতে গিয়ে বলল গ্রীন, "মরেছে হেনরী লী ডায়াবেল। ও আর নেই। হাইতিতে আর কেউ কখনো মরবে না"। "...ক্ক...কি?" বিস্ময় ফুটে উঠল কোকোর গলায়, "ও...ও মরে গেছে?!!! ঠিক বলছ তুমি?" মুখে কিছু না বলে সামনে ধিকিধিকি জ্বলা বেদীটার ওপর পড়ে থাকা আধপোড়া কঙ্কালটাকে দেখিয়ে দিল গ্রীন। এবার নিশ্চিন্ত হলো কোকো। বলল, "কিন্তু ও মরল কিভাবে? আর ওই নেকড়েগুলো? " কোকোর শেষ প্রশ্নের উত্তর এক ঘন্টা পর পাওয়া গেল। ততক্ষণে পাহাড়শ্রেণীর পেছন থেকে সূর্য উঠে গিয়েছে। আকাশেও আর মেঘ নেই। গ্রীন এবং কোকো চেষ্টা করতে লাগল একে অপরের দেহের বাঁধন খোলার। এইসময় সিঁড়িতে কাদের যেন পদশব্দ পাওয়া গেল। বেশ কয়েকজন লোক যেন দ্রুত পায়ে উঠে আসছে ওপরে। চার-চারজন মাঝবয়সী হাইতিয়ান লোক উঠে আসছে সিঁড়ি দিয়ে, এদিকেই। লোকগুলোর চেহারা দেখে ওদের খুব একটা গরীব বলে মনে হলো না, বরং অন্যদের চেয়ে বেশ একটু স্বচ্ছল বলেই মনে হলো। ওরা এসে দুজনের হাত-পায়ের বাঁধন খুলে দিতে লাগল। অনেকক্ষণ দড়ির শক্ত বাঁধনের মধ্যে থাকতে থাকতে ওদের গায়ে-গতরে ব্যথা হয়ে গিয়েছে। টনটন করছে হাত-পায়ের গাঁটগুলো। ম্যাসাজ করে নিতে লাগল গ্রীন নিজের হাত-পায়ের গাঁটগুলোয়। লোকগুলো সঙ্গে আনা জল ওদের খেতে দিল। "....যে নেকড়েগুলো এসে হেনরী লী ডায়াবেল'কে হত্যা করল, ওরা কি তোমরাই ছিলে?" লোকগুলোকে উদ্দেশ্য করে প্রশ্ন করল গ্রীন, "আমার জাস্ট মনে হলো তাই বলছি, কিছু মনে কোরো না? তোমরাই কি ওই 'লুপ-গ্যারোস' নামে ওই গোপন সংস্থার সদস্য?" দলের মধ্যে যে অপেক্ষাকৃত বয়স্ক, সে এবার একটু হেসে বলল, "আমরা হলাম Les Loups Sans Cheveux।" ক্রিওল ভাষা। কিন্তু তবু গ্রীন বুঝল, এটা অন্যরকম একটি ভুডু সংস্থা, যার কথা মাইকেলও বলত। "....ওই নেকড়েগুলো কি তোমরাই ছিলে?" মাথা নাড়ল বয়স্ক লোকটি। ততক্ষণে বন্ধনমুক্ত হয়ে গ্রীন নিজের পায়ে উঠে দাঁড়িয়েছে। কোকো'কেও সাহায্য করল উঠে দাঁড়াতে। তারপর অপেক্ষাকৃত বয়স্ক লোকটিকে উদ্দেশ্য করে জিজ্ঞেস করল, "এখন যেটা কোটি টাকার প্রশ্ন, সেটা হলো তোমরাই কি একদা ওই হেনরীকে 'লুপ-গ্যারো' বানিয়েছিলে? ভুডুবিদ্যা প্রয়োগ করে?" ক্রিওল ভাষায় 'লুপ-গ্যারো' কথাটির ইংরেজি অর্থ ওয়্যারউলফ। গ্রীনের প্রশ্নটায় বৃদ্ধ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে হতাশভাবে চেয়ে রইল নিচের দিকে। বলল, "জ্বি।" "...তার মানে এতদিন যা কিছু হয়েছে, সব তোমাদের জন্যই হয়েছে", বলতে বলতে সামান্য চড়ে গেল গ্রীনের কণ্ঠস্বর। কাঁধ ঝাঁকাল বৃদ্ধ। বলল, "বাইরে থেকে ব্যাপারটাকে ব্যাখ্যা করা যতখানি সহজ আসলে সেটা মোটেও তত সহজ নয়।" "...এতে আবার বোঝা না বোঝার কি আছে", বলল গ্রীন, "তোমরাই ওকে হিংস্র একটা অমানুষে পরিণত হতে সাহায্য করেছ - এ তো দিনের আলোর মতোই পরিষ্কার"। গ্রীনের কথার মাঝেই কোকো ওর একটা বাহু খামচে ধরল। বোধহয় ওকে নিরস্ত হতে ইঙ্গিত করল। মাথা নাড়ল বৃদ্ধ। বলল, "হেনরী ক্রিস্টোফার ছিল আমাদের সোসাইটির মেম্বার। তার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল তার নিজেরই কিছু লোক। যখন সে কারাগার থেকে মুক্ত হয়েছিল, সে চাইছিল প্রতিশোধ। শত্রুদের ওপর চরম প্রতিশোধ নিতে চাইছিল সে। প্রতিশোধস্পৃহা ওকে এতটাই উন্মত্ত করে তুলেছিল যে সে কিভাবে ওয়্যারউলফ হওয়া যায়, তার চেষ্টা চালাতে লাগল। আমাদের সোসাইটিতে এসে সে আমাদের ধরে বসল যে তাকে ওয়্যারউলফ বানিয়ে দিতে হবে"। "....আর তোমরা ওর কথায় ওকে তা-ই বানিয়ে দিলে?" বৃদ্ধ এই প্রথম রেগে গেল। বলল, "জায়গাটা হাইতি, ম্যান। তুমি এখানে কতদিনই বা রয়েছ? বড়জোর দু-সপ্তাহ! এখানে স্থায়ী সরকার বলে কিছু ছিল না। আইনের শাসন বলেও কিছু ছিল না। এখানে আমরাই আইন। নিজেদের আইন নিজেরাই তৈরি করি আমরা। আমরাই এখানে সরকার"। "....তাই তোমরা ওয়্যারউলফ তৈরি করলে? শত্রুকে শাস্তি দেবার জন্য? তাহলে হাইতির ওই টেন্ট সিটির বাচ্চারা কি দোষ করেছিল, যারা শিকার হয়েছিল ওই ওয়্যারউলফের? ওই অসহায় মানুষগুলোরই বা কি দোষ ছিল, যাদের অসহায়ভাবে আত্মসমর্পণ করতে হয়েছিল মৃত্যুর হাতে?" মাথা নাড়তে লাগল বৃদ্ধ। বলল, "আমরা ওকে আমাদের একজন করে নিয়েছিলাম। আমাদের সোসাইটিতে কিছু রুল আছে যা সকল মেম্বারকেই মেনে চলতে হয়। হেনরীও সেই নিয়ম মানবে বলে শপথ নিয়েছিল"। "....আমার মনে হচ্ছে, যেইমাত্র তোমরা ওকে ওয়্যারউলফ বানিয়ে দিয়েছিলে, ও যাবতীয় শপথ ভেঙে নিজের প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে বেরিয়ে গিয়েছিল, তোমাদের সোসাইটির নিয়মের তোয়াক্কা না করে...!" "....ঠিকই বলেছ, ইয়ংম্যান", একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো বৃদ্ধের বুক চিরে। "....আর আজ তোমাদের সময় হলো ওকে ধ্বংস করার?" "...না। ওকে হত্যা করার চেষ্টা আমরা আগেও করেছিলাম। আমাদের কিছু মেম্বার ওকে নেকড়ের রূপ ধরে হত্যা করতে গিয়েছিল কিন্তু তারা আর ফিরে আসেনি। হেনরী সবাইকে মেরে ফেলেছিল। আমরা দলবদ্ধ হতে লাগলাম। ওকে কোনো বদ্ধ জায়গায় একাকী পেয়ে ধ্বংস করা হবে - এই ছিল আমাদের অভিপ্রায়। আমরা তাই সুযোগের অপেক্ষায় ছিলাম। গতকাল আমরা সেই সুযোগ পেয়ে গেলাম। ঘরে জ্বলন্ত আগুন থাকায় আমাদের কাজ আরও সহজ হয়ে গিয়েছিল"। "....তাহলে এখন তোমরা কি করতে চাও?" খানিক চুপ থাকার পর জানতে চাইল গ্রীন, "এবার কি আমাদেরও হত্যা করবে? তোমাদের সোসাইটির সিক্রেট কি, আমি জানি"। দু'পাশে ঘন ঘন মাথা নাড়ল বৃদ্ধ। বলল, "না। অবশ্যই না। এখন তোমরা যদি আমেরিকা ফিরে যেতে চাও তো স্বচ্ছন্দে যেতে পারো। আমাদের ওয়্যারউলফ ধরে নিয়ে যত খুশি কাগজে লেখালেখি করো, আমাদের কিছু যায় আসে না; কারণ আমরা জানি কেউ তোমাদের কথা বিশ্বাস করবে না"। "....একমাত্র হাইতিয়ান যারা, তারাই আমার কথা বিশ্বাস করবে", বলল গ্রীন। হাসল বৃদ্ধ। বলল, "ওরা এসব এমনিতেই বিশ্বাস করে। হাইতিতে আমাদের সংগঠনের কথা, ওয়্যারউলফের কাহিনী সবাই জানে, বিশ্বাস করে এবং আগামীদিনেও করবে "। "....কিন্তু এখানে যতজন আজ পর্যন্ত মারা গিয়েছে, তাদের সবার মৃত্যুর পেছনে যে তোমরাই দায়ী, এ কথা তো তোমরা অস্বীকার করতে পারো না। নিরীহ ওই মানুষদের মধ্যে আমার কিছু পরিচিত জনও ছিল"। "...জানি", শান্ত গলায় বলল বৃদ্ধ, "কিন্তু আমি মনে করি আমরা সুবিচার দিয়ে দিয়েছি"। "....কিন্তু এতে তো ওই মারা যাওয়া অসহায় নিরীহ লোকগুলো ফিরে আসবে না", ব্যঙ্গ ঝরে পড়ল গ্রীনের গলায়। কোকো'কে দেখিয়ে বলল, "এই যে দেখছ, এই মেয়েটি নিজের আত্মীয়কে হারিয়েছে। ওর কাজিন ব্রাদার মারা গিয়েছে ওয়্যারউলফের হাতে। বলো, ও কি ওর দাদাকে আর কোনওদিন ফিরে পাবে?" হাইতিয়ান লোকগুলোর চোখ এবার চকচক করে উঠল। কেমন যেন হিংস্র ভাব ফুটে উঠল ওদের চোখেমুখে। আসলে ওদের সর্বময় কর্তাকে কেউ এভাবে চ্যালেঞ্জ করে কথা বলবে, ওরা ভাবতে পারছে না। ওদের একজন বলল, "আপনাকে আমরা সাধ্যমত বুঝিয়েছি। এর ওপরেও যদি আপনি গোঁ ধরে বসে থাকেন এবং এইভাবে চ্যালেঞ্জ করেন তাহলে কোনওকিছু ঘটে গেলে আমরা দায়ী থাকব না। ভালোয় ভালোয় এবার ফিরে যান। নইলে আপনারাও বিপন্ন হবেন আমাদের হাতে। আমরা ওয়্যারউলফ নই, সাধারণ রোমহীন নেকড়ের রূপ ধারণ করি প্রয়োজনে, তবু আপনি আমাদের হাতে এখনিই বিপদে পড়তে পারেন"। গ্রীন বুঝল, এবার এরা সত্যি সত্যিই হিংস্র হয়ে উঠছে। পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে যেতে বেশী দেরী নেই। কোকোর দিকে ফিরে বলল, "চলো, চলে যাই এখান থেকে"। সিঁড়ি দিয়ে ওরা সবে নেমেছে, পেছন থেকে কানে এলো, ওদের একজনের কণ্ঠস্বর। সম্ভবত সেই বৃদ্ধটিই বলল, "আপনাদের যাত্রা শুভ হোক"। হোটেল অলফনসোয় ফিরে এসেছে ওরা। কোকো ইতিমধ্যে সেইন্ট ফোর্টের পরিবার অর্থাৎ জ্যাঠা-জ্যেঠীর সাথে দেখা করে জানিয়েছে সেইন্ট ফোর্টের মর্মান্তিক মৃত্যু সংবাদ। এ'ও জানিয়েছে, ফোর্টের দেহ কোথাও পাওয়া যায় নি। এদিকে গ্রীন ভিডিও কলিংয়ের সাহায্যে তার অফিসের বস গ্যারি সিমোন্সের সাথে কথা বলে তাকে জানিয়েছে - ১) সে এখনও বেঁচে আছে। ২) এই ক'দিন সে নরকে ছিল। ৩) না - আসল ঘটনা সে কিছুতেই জানাতে পারবে না, বরং এটা বললেই বিশ্বাসযোগ্য শোনাবে যে তাকে কিডন্যাপ করা হয়েছিল। ৪) সে খুব শীঘ্রই একটা স্টোরি কভার করবে আর ৫) সবশেষে জানিয়েছে, এখানে আসতে তার বস যে তাকে বারবার বারণ করছিল, তা মান্য করলেই বোধহয় ভালো হতো। আসল কারণ সে কোনওদিন তার সংবাদপত্রে লিখে প্রকাশ করতে পারবে না কিন্তু একটা দারুণ স্টোরি লিখে বই প্রকাশ করতে পারবে। নিউ জার্সি ফিরে যাবার দিন কয়েক আগে থেকে ফ্লাইটের টিকিট বুক করে রেখেছে গ্রীন। এই ক'দিন সে হাইতি আর পোর্ট অফ প্রিন্সটাকে ভালো করে ঘুরে ঘুরে দেখে নিচ্ছে। রোজ সকালে আর বিকেলে কোকো নিজের গাড়িতে করে ওকে সমুদ্রের কিনারে বেড়ায় নিয়ে যায়। পাড়ে দাঁড়িয়ে দুজনে উপভোগ করে সূর্যোদয় আর সূর্যাস্তের দৃশ্য। জলে মাঝেমাঝে লাফিয়ে ওঠে রঙিন মাছের দল। ভারী ভালো লাগে গ্রীনের। ওদিকে, কোকো'রও ফ্লোরিডায় ফেরার দিন এগিয়ে আসছে। আবার তার পড়াশোনা শুরু হবার কথা। দুজনের দুজনের কাছ থেকে বিদায় নেবার সময় হয়ে আসছে দ্রুত। গ্রীনও এবার ফিরে যাবে নিউ জার্সিতে তার ছেলেমেয়েদের কাছে। কতদিন ওদের দেখা হয়নি। ওদের দেখার জন্যই মনটা উতলা হয়ে রয়েছে ওর। তবে আর চিন্তা নেই, খুব শীগগির, খুব শিগগীরই সন্তানদের সাথে ওর দেখা হবে। (সমাপ্ত) copy ☺☺☺☺


এডিট ডিলিট প্রিন্ট করুন  অভিযোগ করুন     

গল্পটি পড়েছেন ৪০৫ জন


এ জাতীয় গল্প

গল্পটির রেটিং দিনঃ-

গল্পটির বিষয়ে মন্তব্য করুন

  • গল্পটির বিষয়ে মন্তব্য করতে আপনার একাউন্টে প্রবেশ করুন ... ধন্যবাদ... Login Now