বিশেষ নোটিশঃ সুপ্রিয় গল্পেরঝুরিয়ান - আপনারা যে গল্প সাবমিট করবেন সেই গল্পের প্রথম লাইনে অবশ্যাই গল্পের আসল লেখকের নাম লেখা থাকতে হবে যেমন ~ লেখকের নামঃ আরিফ আজাদ , প্রথম লাইনে রাইটারের নাম না থাকলে গল্প পাবলিশ করা হবেনা
আপনাদের মতামত জানাতে আমাদের সাপোর্টে মেসেজ দিতে পারেন অথবা ফেসবুক পেজে মেসেজ দিতে পারেন , ধন্যবাদ
X
৭০
একসঙ্গে দেখতে পাচ্ছে। দৈর্ঘ্য-েপ্রস্থে সমান, তিন মাইলের বেশি
হবে তো কম নয়। সন্দেহ নেই এটা একটা বিস্ময়কর
ইঞ্জিনিয়ারিং। আধুনিক প্রযুক্তির এরকম একটা আবিষ্কার ভেঙে
ফেলতে ইচ্ছে করে না, কিন্তু জিনিসটা তৈরিই করা হয়েছে
মানুষের ক্ষতি করবার জন্যÑকাজেই এটাকে ভাঙতেই হবে।
ঝাঁক-ঝাঁক উজ্জ্বল তারা মাথার চারদিকে চক্কর দিচ্ছে, আর ওল্ডে
নীচে ধীরে ধীরে ঘুরছে পৃথিবীÑদু’দিক থেকেই চোখ ফেরানো
কঠিন মনে হলো।
পৃথিবীর দিকটাকে ‘নীচে’ ভাববার কোন যুক্তি নেই, যত্থি
সেভাবেই চিন্তা করতে অভ্যস্ত ও। তবে এখানে এসে পরিষ্কার
বুঝতে পারছে, পৃথিবী যেমন নীচে নয়, তেমনি তারাগুলোয় নয়
উপরে।
দিক সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার জন্য স্পেস স্টেশন অ্যাবি স্থির
একটা চিহ্ন হিসাবে সাহায্য করছে ওকে।
‘রানা, ওটা কীভাবে তুমি অকেজো করবে?’ সোলার ডিশটার
দিকে হাত তুলল সুরাইয়া। স্পেস স্টেশনের কোণ থেকে পরিষ্কার
দেখা যাচ্ছে ওটাকে।
প্রকাণ্ড থালা আকৃতির জ্বলন্ত সূর্যটা এক পলক দেখে নিয়ে
পিয়ানো ওয়ায়্যার দিয়ে বাঁধা ম্যাগনিফাইং গ−াসগুলোর দিকে
তাকাল রানা। গোটা ডিশ পৃথিবীর দিকে তাক করা। নীচে
তাকিয়ে বুঝবার চেষ্টা করল, বহু গুণ উত্তপ্ত করা রোদ পৃথিবীর
ঠিক কোথায় পাঠানো হচ্ছে।
বঙ্গোপসাগর চিনতে পারল রানা, চিনতে পারল হিমালয় আর
চীনের প্রাচীর।
তারপর শিউরে উঠল ও। সোলার গ−াস এই মুহূর্তে তাক করা
রয়েছে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার দিকে। অর্থাৎ ওল্ডে ইচ্ছে
ছিল, এবার ঢাকায় জ্বলবে আগুন।
গ−াভসের ভিতর মুঠো হয়ে গেল রানার হাত।
‘রানা! কী হলো তোমার?’ কাঁধে সুরাইয়ার স্পর্শ পেল রানা।
‘তোমাকে আমার হিপনোটাইজড্ মনে হচ্ছে।’
‘ও কিছু না। ওই কাঁচগুলো ভাঙতে হবে। এখনই।’
‘ওটাকে তুমি স্রেফ ঠেলে সরিয়ে দিলেই তো পারো,’ বুদ্ধি
দিল সুরাইয়া। ‘ওটার তো তেমন কিছু ওজন নেই।’
আইডিয়াটা মন্দ নয়! সুরাইয়া সত্যি কথাই বলেছে।
কক্ষপথে থাকবার সময় গ−াসগুলোর কোন ওজন নেই।
‘চেষ্টা করে দেখা যায়। তুমি আমাকে ম্যানুভারিং জেটটা
দাও।’
রানার হাতে একটা কার্বন ডাইঅক্সাইড গ্যাস বটল্ ধরিয়ে
দিল সুরাইয়া, গায়ে আটকানো একজোড়া জেট। চিমনি আকৃতির
নজল্ পরস্পরের উল্টোদিকে তাক করা। এক ঝলক কার্বন
ডাইঅক্সাইড বের করতে চাইলে জোড়া ট্রিগারে টান দিতে হবে।
ও যদি সরাসরি সামনে যেতে চায়, দুটো ট্রিগারকে একই মাত্রায়
পিছিয়ে আনতে হবে। কোন দিকে বাঁক নিতে চাইলে, সেদিকেরই
ট্রিগার উপরে তুলতে হবে। কোন একটা জেট যদি সম্পূর্ণ বন্ধ
হয়ে যায়, একশো আশি ডিগ্রি ঘুরে যাবে রানা। কিংবা, সঠিক
মুহূর্তে ট্রিগারটা অফ না করলে, ঘুরতেই থাকবে ও। পানির মত
সহজ।
তবে অভ্যস্ত হতে কিছুটা সময় লাগছে।
প্রথমবার চেষ্টা করতে গিয়ে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ঘন ঘন ডিগবাজি
খেল রানা, যেন সার্কাসের একজন অ্যাক্রোব্যাট। সাবধানতার
মার নেই, তাই আগেই স্পেস স্টেশনের গায়ে আটকানো একটা
রিঙে সেফটি লাইনটা শক্ত করে বেঁধে রেখে এসেছে।
নাইলন লাইনের শেষ মাথায় পৌঁছাতে কঠিন একটা টান
অনুভব করল, থামল, তারপর ধীরে ধীরে ফিরে আসতে শুরু
করল লাইনের পথ ধরে।
৭১
ঘন ঘন মাথা নেড়ে আচ্ছন্ন ভাবটা দূর করল রানা, তারপর
নরম হাতে ট্রিগারে টান দিল অন্যদিকে ফিরবার জন্য।
রহসন্ধা হলো, প্রতিবার সামান্য একটু গ্যাস রিলিজ করলেই
আকাক্সিক্ষত গতি পাওয়া যায়, অবিচ্ছিন্ন ধারার কোন প্রয়োজন
নেই।
রানার রেডিও জ্যান্ত হয়ে উঠল, শোনা গেল সুরাইয়ার
কণ্ঠ¯ল্ফ। ‘ধরা দিতে না চাওয়া মাছের মত অস্থির লাগছে
তোমাকে।’ হেসে উঠল সে। ‘লাইন গুটিয়ে টেনে নেব
জনাবকে?’
‘আরেকটু প্র্যাকটিস করতে দাও,’ বলল রানা। ‘এই
বোতলটা প্রায় খালি হয়ে এসেছে। ব্যাক আপ রেখেছ তো?’
‘স্টোর রুমে যতগুলো ছিল সব এখানে নিয়ে এসে রেখেছি,’
আশ্বস্ত করল সুরাইয়া, খোলা এয়ার লকের মুখে সাজানো খুদে বোতলগুলো ইঙ্গিতে দেখাল।
আরও পাঁচ মিনিট প্র্যাকটিস করবার পর রানা বলল, ‘এবার
ডিশটার কাছে যাব আমি।’
‘ভাল করে ভেবে দেখো। ওটা কিন্তু...কিন্তু অনেক দূরে। তা
ছাড়া, সেফটি লাইন ছাড়াই যেতে হবে তোমাকে। কোন ভুল হলে
শুধরাবার সুযোগ পাবে না, চিরকালের জন্যে ভেসে যাবে
মহাশূন্যে।’
‘ব্যাপারটা আসলে ঠিক তা নয়,’ বলল রানা। ‘পৃথিবীর
অরবিট বা কক্ষপথ ছেড়ে যাবার মত যথেষ্ট গতি আমি পাব না।’
তবে এ-কথা আর বলল না যে ঠাণ্ডায় জমাট বাঁধা একটা
স্যাটেলাইটে পরিণত হওয়ার আশঙ্কা আছে বটে। কিংবা, যদি কক্ষপথ ধরতে বা অর্জন করতে ব্যর্থ হয়, অ্যাটমসফিয়ারে পতন
ঘটবে ওর, উল্কা খসে পড়বার রাত্রিকালীন দৃশেশু অংশবিশেষে
পরিণত হবে।
‘মোটকথা যা করবে বুঝেশুনে কোরো,’ রেডিওতে বলল
সুরাইয়া। ‘তোমার কিছু হলে আমি একা হয়ে যাব। আর...এটা
পৃথিবী নয়।’
‘আমি বললে সেফটি লাইন টেনে নেবে তুমি,’ নির্দেশ দিল
রানা। ‘প্রথমে লাইনের শেষ মাথা পর্যন্ত যাব, পজিশন নেব,
তারপর তুমি ছেড়ে দিলে জেট বল্টহার করে রওনা হব। ঠিক
আছে?’
‘আমার নার্ভাস লাগছে, রানা। যা করার তাড়াতাড়ি করো।’
রানা আরও বেশি নার্ভাস। নিজেকে নিয়ে স্রেফ একটা জুয়া
খেলছে ও। তবে এর কোন বিকল্প নেই।
সামান্য এক ঝলক কার্বন ডাইঅক্সাইড বেরুতেই সেফটি
লাইন টান টান হয়ে উঠল। ধীরে ধীরে ঘুরল ও, ম্যানুভারিং জেট-
এর প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করল, তারপর শরীরটাকে পুরোপুরি স্থির রেখে
তাকাল দূরেÑম্যাগনিফাইং গ−াস দিয়ে তৈরি ডিশটার দিকে। ওটা
বিশাল।
‘লাইন টেনে নাও।’
‘সাবধানে, রানা।’
দুটো ট্রিগারই পিছন দিকে টেনে ধরল রানা। যেদিকে যেতে
চাইছে সেদিকে সাবলীল গতিতে এগোল শরীরটা। বাহ্, কী মজা,
এতটুকু পরিশ্রম করতে হচ্ছে না!
কোর্স ঠিক আছে, নিশ্চিত হওয়ার পর ঈঙ২-র মৃদু প্রবাহ
বন্ধ করে দিল রানা।
তবে দীর্ঘ প্রায় পাঁচ মিনিটের রুদ্ধশ্বাস যাত্রা ওর কপালে ঠাণ্ডা
ঘাম ছুটিয়ে দিল। ডিশটা এখনও কাছে চলে এসেছে বলে মনে
হচ্ছে না, অথচ স্পেস স্টেশন অ্যাবি ভীতিকর গতিতে ক্রমশ
পিছিয়ে অনেক দূরে সরে যাচ্ছে।
তারপরও সাহসে বুক বেঁধে নিজের কোর্স ধরে এগোচ্ছে
রানা।
ধীরে ধীরে, একটু একটু করে আকারে বড় হতে লাগল
৭২
মাকড়সার জালটা। ইতিমধ্যে স্পেস স্টেশন অ্যাবি স্রেফ একটা
বিন্দুতে পরিণত হয়েছে, রোদ প্রতিফলিত হওয়ায় জ্বলজ্বল করছে
বিন্দুটা। বিস্মিত হয়ে রানা ভাবল, কতটা পথ পাড়ি দিয়েছে ও?
যেতেই বা হবে আর কত দূর? রেফারেন্স পয়েন্ট না থাকায় সময়
আর দূরত্বের কোন হিসাব পাওয়া কঠিন এখানে।
কার্বন ডাইঅক্সাইড বোতলের নজল ঘুরিয়ে দুটো ট্রিগারই
টানল রানা। ওর এগোবার গতি কমে গেল। প্রকাণ্ড ডিশটা
আগের চেয়েও ধীর গতিতে এগিয়ে আসছে।
রানা ওটাকে ছাড়িয়ে যেতে চায় না। যত্থি জানে যে
সুরাইয়ার ভয় অমূলক, তবু মহাশূন্যে ভেসে যাওয়ার চিন্তাটা
মোটেও স্বস্তিকর লাগছে না।
ওর বুলেট আর ডেটোনেটর খুব সামান্যই ক্ষতি করতে
পেরেছে কাঁচগুলোর। একটা ম্যাগনিফাইং গ−াসে বুলেট লাগায়
সেটা মাকড়সার জাল হয়ে গেছে। অপর একটা গ−াস ভেঙে
গেলেও, পিয়ানো তারের সঙ্গে ঝুলে আছে টুকরোগুলো।
হঠাৎ একটা বিপল্ডে কথা খেলল রানার মাথায়। রোদ!
সূর্যের আলো! ম্যাগনিফাইং গ−াসে লেগে রশ্মিগুলো কোন পথ বা
কোণ ধরে পৃথিবীর দিকে ছুটছে, ওর জানা নেই। আকৃতি বা
কাঠামোটার সামনে ঠিক কোথায় প্রতিফলিত রোদ জড়ো হচ্ছে বা
ঘনীভূত হচ্ছে তাই বা কে জানে। কিন্তু ব্যাপারটা ঘটছে তো
বটেই। এই অদৃশশুশ্মির কারণে লোহা আর ইস্পাত তরল
মাখনের মত গড়িয়ে যায় পৃথিবীর বুকে। আর ধীর গতিতে
সম্ভবত ঠিক সেই ফোকাল পয়েন্টের দিকেই এগোচ্ছে ও।
উন্মত্তের মত খুঁজছে রানাÑফোকাল পয়েন্টটা কোথায় হতে
পারে। ও শুধু এইটুকু বুঝতে পারছে যে ম্যাগনিফাইং গ−াসগুলোর
সামনে দিয়ে ভেসে যাচ্ছে ওর শরীরটা। এখন যদি ভুল কোন
জায়গায় পৌঁছায়, চোখের পলকে বাষ্প হয়ে উড়ে যাবে।
এমনকী ভাগ্যগুণে ফোকাল পয়েন্ট এড়িয়ে যেতে পারলেও,
সোলার গ−াসের সামনে জড়ো হওয়া থারমাল রেডিয়েশন ওকে
পোড়া পোড়া করে ভেজে ফেলতে পারে।
ট্রিগার টেনে ইউ টার্ন নিল রানা, যত তাড়াতাড়ি পারা যায়
ডিশটার সামনে থেকে সরে আসতে চাইছে।
‘রানা, কথা বলো আমার সঙ্গে। সব ঠিক আছে তো? আমি
তোমাকে দেখতে পাচ্ছি না।’
‘ঠিক আছে সবÑএখন পর্যন্ত,’ বলল রানা। ‘তুমি জুবিলির
ক্যাপসুলে ফিরে গিয়ে আমাকে রেইডারে দেখতে পারো। ডিশের
মুখ ঘোরাতে চাই আমি, তুমি রেইডারে ওটার অবস্থান দেখে
পরামর্শ দিতে পারো।’
‘ঠিক আছে, রানা, তাই যাচ্ছি। জুবিলি এখনও ভিড়ে আছে,
কাজেই সেফটি লাইনের সাহাযেদ্দটায় পৌঁছাতে পারব আমি।’
‘গুড, তাই করো। গ্যাস বটলগুলো কিনারায় আটকে দেখতে
চাই ডিশটাকে নড়ানো যায় কিনা।’
‘সবগুলো নয়। ফেরার জনঞ্জন্তত গোটা দুয়েক সঙ্গে
রেখো,’ সতর্ক করল সুরাইয়া।
‘তা তো রাখবই।’
ক্যাপসুলে ফিরে যাচ্ছে সুরাইয়া, ফলে কয়েক মিনিট কথা
হলো না।
‘রেইডারে তোমার ইমেজ পাচ্ছি, রানা,’ খানিক পর আবার
তার কণ্ঠ¯ল্ফ ভেসে এল। জুবিলির ভিতর রয়েছে, তাই রেডিও
সিগন্যাল আগের চেয়ে দুর্বল। ‘কী করছ তুমি?’
‘বটলগুলো ডিশের বিমে আটকাচ্ছি।’ অতিরিক্ত চারটে
বোতল রয়েছে রানার কাছে, প্রতিটি বিশ ফুট দূরত্ব রেখে
আটকাল। কয়েক মাইল বি¯তৃত বৃত্তাকার ডিশের তুলনায় অতি
তুচ্ছ আর তাৎপর্যহীন মনে হলো ওগুলোকে।
তারপর এক এক করে ট্রিগার টেনে গ্যাসের প্রবাহ মুক্ত করে
দিল রানা। ঠাণ্ডা গ্যাস রকেটের বেগে বেরিয়ে এল।
৭৩
কিছুই ঘটল না। ডিশটাকে ঠেলে দূরে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া
তো দূরের কথা, গ্যাসের প্রবাহ এক চুল নড়াতে পর্যন্ত পারল না
ওটাকে।
রানা বুঝতে পারল, একমাত্র সৌর ঝড় ছাড়া এই আকারের
একটা ডিশকে নড়ানো সম্ভব নয়। তাতে কয়েক মাস, এমনকী
কয়েক বছরও অপেক্ষা করতে হতে পারে।
এক সময় গ্যাসের প্রবাহ স্তিমিত হয়ে পড়ল, তারপর
পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেল।
‘তুমি ঠিক কী করছ জানি না। কিন্তু রেইডারে আমি কিছুই
ঘটতে দেখছি না। তারমানে কি কাজ হয়নি?’
‘না।’
‘তা হলে? এখন কী করবে তুমি?’ রানার হেডফোনে
সুরাইয়ার কণ্ঠ¯ল্ফ উদ্বিগ্ন শোনাল।
কাটব,’ বলল রানা। ‘তার কেটে একটা একটা করে আলাদা
করতে হবে প্রতিটা কাঁচ।’
‘কিন্তু এভাবে কি ওটাকে অকেজো করা সম্ভব?’ সুরাইয়ার
সুরে সংশয়। ‘হাজার হাজার কাঁচ, ক’টাই বা তুমি খুলতে
পারবে।’
‘দেখি,’ বলে ম্যানুভারিং জেট বল্টহার করে ডিশের কিনারা
হয়ে উল্টোদিকে চলে এল রানা। বেল্টে আটকানো লেদার পাউচ
থেকে একটা ওয়ায়্যার কাটার বের করে কাজ শুরু করল ও।
চারদিকের তার কেটে একটা ম্যাগনিফাইং গ−াস আলাদা করা
গেল সহজেই। কিন্তু তার কাটবার পরও কাঁচটা নিজের জায়গা
ছেড়ে নড়ল না।
মুহূর্তের জন্য বিভ্রান্তিতে পড়ল রানা। তারপর বুঝল এ রকম
কেন ঘটছে। ও মহাশূনেশুয়েছে, এটা খেয়ালের মধ্যে রেখে
কাজ করতে রাজি হচ্ছে না ওর মস্তিষ্ক। মাধ্যাকর্ষণ বা বাতাস
ছাড়া কাঁচগুলো যেখানে আছে সেখানেই থাকবে। আলগা কাঁচে
হালকা একটা ঠেলা দিল ও। ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছে সেটাÑরানা
সরল উল্টোদিকে।
আবার ম্যানুভারিং জেট বল্টহার করে আগের জায়গায় ফিরে
এল ও। এবার বুদ্ধি করে প্রতিবার একটা কাঁচের নয়, চার পাঁচটা
কাঁচের তার কাটল। তবে এভাবে বিচ্ছিন্ন করলেও ডিশটাকে
অকেজো করতে দিনের পর দিন হাড়ভাঙা খাটনি ল্ডকার। ওর
হিসাবে, শুধু আউটার রিঙেই তেরো হাজার ম্যাগনিফাইং গ−াস
রয়েছে। যপ্পিরে নেওয়া হয় একজোড়া গ−াসের মাঝখানে এক
ফুট করে ফাঁক রাখা হয়েছে, তা হলেও প্রায় ত্রিশ লাখ গ−াস
বিচ্ছিন্ন করতে হবে ওকে।
গোপনে সারলেও, কাজটা শেষ করতে ইজরায়েলিল্ডে সময়
লেগেছে তিন বছর। সেটাকে ধ্বংস করতে একজোড়া ওয়ায়্যার
কাটার যথেষ্ট নয়।
ডিশটার কিনারায় স্থির হয়ে ঝুলে থাকল রানা, হতাশা আর
রাগে প্রায় দিশেহারা। জিনিসটাকে ধ্বংস করবার কোন উপায়
নেই, এটা মেনে নিতে পারছে না ও। উপায় আবার না থাকে কী
করে!
‘রানা! রানা, সাড়া দাও। দিস ইজ আর্জেন্ট!’
‘কী ব্যাপার, সুরাইয়া?’
‘আমি একটা বি−প পাচ্ছি। পৃথিবীর বাঁকের ওদিক থেকে
আসছে। দেখে মনে হচ্ছে একটা স্পেস শিপ হতে পারে।’
বিপল্ডে আভাস পেয়ে রানার তলপেটের ভিতরটায় শিরশির
করে উঠল। ওকে বলে ত্থেয়ার ল্ডকার নেই কে থাকতে পারে
ওই স্পেস শিপে।
মেজর এবরান বারাইদি। কৈ মাছের জান লোকটার,
মহাশূন্যে উঠে আসছে রানার একটা বল্টস্থা করতে।
৭৪
চোদ্দ
‘জলদি, রানা, জলদি!’ অস্থির হয়ে উঠেছে সুরাইয়া।
কিন্তু ফিরে আসবার গতি মারাত্মক ঝুঁকি না নিয়ে দ্রুত
করবার কোন উপায় নেই রানার। কার্বন ডাইঅক্সাইডের একটাই
বোতল রয়েছে ওর কাছে। তাড়াহুড়ো বা অসতর্কতার কারণে ও
যদি স্পেস স্টেশন অ্যাবিকে ছাড়িয়ে এগিয়ে যায়, পরবর্তী এক
ঘণ্টার মধ্যে মারা যাবে। ওর এই ফিরে আসবার চেষ্টার মধ্যে কোন ভুল থাকা চলবে না।
নাহ্, এই প্রতিযোগিতায় জেতা সম্ভব নয়। সুরাইয়া যখন
সতর্ক করল ওকে, বারাইল্ডি ক্যাপসুলটাকে ছোট্ট একটা বিন্দুর
মত দেখাচ্ছিল। মনে হ্িচ্ছল মহাশূন্যে স্থির হয়ে আছে ও। ধীরে
ধীরে একটা পেনসিল ইরেজারের আকার পাচ্ছে ওটা। তারপর
একটা কয়েন। এক সময় ওটার গায়ের লাল হরফগুলোও দেখতে
পেল: শাটল থ্রি স্টার।
রানার দেখবার সুযোগ হয়নি, তবে ও যেভাবে বিস্ফোরক
বসিয়ে রেখে এসেছে, ইজরায়েলিল্ডে স্পেস সেন্টার বলতে
নাজাফিতে কিছু থাকবার কথা নয়। স্বভাবতই প্রশ্ন ওঠে, এই
শাটল থ্রি স্টার তা হলে উঠল কোত্থেকে?
এর উত্তর অবশঞ্জান্দাজ করা কঠিন কিছু নয়। নাজাফি
থেকে আইয়াম কতটুকুই বা দূরে, একটা হেলিকপ্টার এক-ষ্ণে
ঘণ্টার মধ্যে পৌঁছে যাবে। আগে থেকে সতর্ক করা হলে, একটা
শাটলকে মহাশূন্যে নিক্ষেপ করবার প্রস্তুতিও খুব দ্রুত সম্পন্ন করা
সম্ভব। যতই রটানো হোক আইয়ামে এয়ার ফোর্স বেইস তৈরি
করা হয়েছে, আসলে ওটাও একটা স্পেস সেন্টার।
অটোমেটিক ডকিং পদ্ধতি বারাইদিকে সাহায্য করল।
জুবিলির পাশে অনায়াসে ভিড়ল তার শাটল থ্রি স্টার।
রেইডার স্ক্রিনে শাটলটাকে দেখবার পর সুরাইয়া কথা বলছে
না। বুদ্ধি করে ভাগ্যিস স্পেস স্টেশন অ্যাবিতে ফিরে যায়নি সে,
তা হলে নির্ঘাত বারাইল্ডি হাতে বন্দি হতে হত। জুবিলিতে
লুকানোর মানে হলো, স্টেশনের বাইরে থাকছে ওরা, এই পজিশন
বারাইদিকে চমকে ত্থেয়ার বা বোকা বানাবার কাজে লাগতে
পারে।
জুবিলির কাছাকাছি চলে এসেছে রানা, এই সময় বটলের
গ্যাস শেষ হয়ে গেল। সেফটি লাইনটা ছুঁড়ে দিল সুরাইয়া, সেটা
ধরে ফেলল ও।
লাইন টানছে সুরাইয়া, সেই সঙ্গে নিজের উদ্বেগের কথা
জানাচ্ছে রেডিওতে। ইঙ্গিতে চুপ করতে বলল রানা
হ্যাচে, তার পাশে, গুটিসুটি মেরে বসল ও। রেডিও বন্ধ করে
কথা বলছে ওরা, ফলে বারাইদি কিছু শুনতে পাবে না।
‘কোথায় সে?’ জিজ্ঞেস করল রানা। ‘স্পেস স্টেশনে
ঢুকেছে?’
‘ঢুকেছে।’ ভয়ে বড় বড় হয়ে আছে সুরাইয়ার চোখ দুটো।
‘তার সঙ্গে আরও তিনজন লোক আছে। মেনিনকেও তারা মুক্ত
করবে। তারমানে ওল্ডে পাঁচজনের বিরুদ্ধে আমরা মাত্র দু’জন।’
সংখ্যাটাকে রানা বড় করে দেখছে না। বড় করে দেখছে
পজিশনটাকে। শত্র“রা ভাল পজিশনে রয়েছে। অক্সিজেন সহ
অন্যান্য সাপ−াই পাবে না ওরা। বারাইল্ডি কিছু না করলেও চলে,
স্পেস স্টেশনে চুপচাপ বসে থাকলেও জিতে যাবে।
নিজের অক্সিজেন লেভেল পরীক্ষা করল রানা। আর ত্রিশ
মিনিট চলবার মত অক্সিজেন আছে। সুরাইয়ার হেলমেটের
ভিতরটাও পরীক্ষা করল। ইন্ডিকেটর বলছে, তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ
৭৫
অক্সিজেন আছে তার।
‘রানা?’ রানার হেডফোনে গাধার ডাকের মত বারাইল্ডি গলা
ভেসে এল। ‘আমি জানি বিশ্বাসঘাতিনী ডাইনীটার সঙ্গে বাইরে
কোথাও আছ তুমি। হার মানো, হে। ধরা দাও।’
সুরাইয়া মুখ খুলতে যাচ্ছে দেখে মাথা নাড়ল রানা।
‘কোথায় তুমি, রানা? জানি বেশি দূরে কোথাও নও। সোলার
ডিশে নড়াচড়া ধরা পড়েছে। আমাল্ডে স্ট্রেইন গজ-এ দেখা
যাচ্ছে, একটা অংশকে ডিসটার্ব করা হয়েছে। ও কিছু না, রানা।
কুখ্যাত এমআর নাইন ব্যর্থ হয়েছে। তবে পরম শত্র“ও অকুণ্ঠচিত্তে
স্বীকার করছে, একমাত্র তুমি বলেই এতদূর আসতে পেরেছ।
‘হেরে গেছ তো কী হয়েছে, গোটা একটা সেনাবাহিনীকে
পরাজিত করবার কৃতিত্ব দাবি করতে পারো তুমি। তবে এবার
তোমাকে সারেন্ডার করতে হবে। কথা দিচ্ছি, প্রাণপণ চেষ্টা করব
তোমাকে যাতে ক্ষমা করে রাজনৈতিক আশ্রয় দেয়া হয়।’
‘কী করতে চাইছ, রানা?’ জিজ্ঞেস করল সুরাইয়া। ওল্ডে
হেলমেট জোড়া পরস্পরকে ছুঁয়ে আছে। রেডিওর সাহায্য নিচ্ছে
না, তাই কথা বলতে হচ্ছে চিৎকার করে।
‘প্রথম গুরুত্ব মিশনের,’ বলল রানা। ‘আগে সেলের ডিশটা
ধ্বংস করতে হবে। তা করতে গিয়ে যদি মারা পড়ি, পড়লাম।’
‘তোমার সঙ্গে আমি একমত,’ বলল সুরাইয়া। ‘কারণ মুখে
যাই বলুক বারাইদি কখনোই আমাল্ডেকে প্রাণ নিয়ে পৃথিবীতে
ফিরে যেতে দেবে না। কিন্তু অত বড় একটা কাঁচের ডিশ তুমি
ধ্বংস করবে কীভাবে?’
রানা কথা না বলে চিন্তা করছে: প্রচুর বিস্ফোরক থাকলে
কাজটা করা যেত। ছোটখাট বিস্ফোরণের সাহায্যে এই প্রকাণ্ড
জালের বড় কোন ক্ষতি করা সম্ভব নয়। কাজ হবে শুধু জালের
ঠিক মাঝখানটায় প্রচণ্ড বিস্ফোরণ ঘটাতে পারলে।
জুবিলির কথা ভাবল রানা। খেয়াযানের বেশির ভাগ ফুয়েল
খরচ হয়নি।
কক্ষপথে পৌঁছানোর জন্য একজোড়া বুস্টার থেকেই পাওয়া
গেছে বেশির ভাগ পাওয়ার সাপ−াই। জুবিলির ফুয়েল ট্যাংক
বলতে গেলে প্রায় ভর্তিই।
লিকুইড অক্সিজেন। হাইড্রাজিন। দুটো হলে মারাত্মক
বিস্ফোরক। হয়তো অ্যাটমিক বোমার মত ভয়ঙ্কর নয়, তবে
দৈর্ঘ্য-েপ্রস্থে তিন মাইল একটা কাঁচের ডিশ নিশ্চয়ই গুঁড়িয়ে
দেবে।
‘ফুয়েল লাইনগুলো বাইরে বের করতে হবে,’ সুরাইয়াকে
বলল রানা। ‘তোমার সাহায্য ল্ডকার। তাড়াতাড়ি! বারাইজ্ঝিামাল্ডে খুঁজতে বেরুবার আগেই কাজটা সেরে ফেলতে চাই।’
‘তোমার প−্যানটা কী বলো তো?’
রানা জবাব ত্থেয়ার ঝামেলায় গেল না। এক ধরনের জুয়া
খেলতে যাচ্ছে ও। হাতে আর কোন বিকল্প নেই।
ভাগ্য সামান্য হলেও অনুকূলে। ফুয়েল লাইনগুলো তামার
তৈরি, রুশ বা মার্কিন ক্যাপসুলে বল্টহার করা হয় স্টেইনলেস
স্টিলের। তামার হওয়ায় বাঁকিয়ে নতুন আকৃতি দিতে কোন
সমস্যা হলো না। লাইনগুলো বাইরে বের করে এনে স্পেস
ক্যাপসুলের গায়ে জড়াল রানা।
‘রানা, এখনও সময় আছে, ধরা দাও,’ রেডিওতে হুংকার
ছাড়ল মোসাদ এজেন্ট। ‘এতক্ষণে তোমার অক্সিজেন প্রায় শেষ
হয়ে এসেছে। মেজর মেনিনের সঙ্গে কথা হয়েছে আমার। স্টক-
এর হিসাব নিয়েছে সে।
‘ভুল করে সবগুলোই কার্বন ডাইঅক্সাইডের বোতল নিয়ে
গেছ তোমরা, একটাও অক্সিজেনের বোতল নাওনি। আর কতক্ষণ
শ্বাস নিতে পারবে? দশ মিনিট? পাঁচ?
‘আমি জানি, তোমরা ঘামছ। বাতাস ভারী লাগছে। এগুলোই
লক্ষণÑতোমাল্ডে অক্সিজেন শেষ হয়ে আসছে। একটু পর আচ্ছন্ন
৭৬
বোধ করবে। ধরা দাও, রানা। ভেতরে এসে আয়েশ করে খাওয়া
দাওয়া করো, শ্বাস নাও, ঘুমাও!’
‘রানা...’
‘না, সুরাইয়া, বারাইদি স্রেফ ভয় দেখাতে চাইছে। কাজটা
শেষ করবার মত যথেষ্ট অক্সিজেন আছে আমাল্ডে কাছে। চিন্তা
কোরো না...’
মুখে কথা বেধে যাচ্ছে। বল্টহারযোগঞ্জক্সিজেনের যে
সাপ−াই পাবে রানা তা দিয়ে আর পাঁচ মিনিটও চলবে না ওর।
একটু পরই ডাঙায় তোলা মাছের মত খাবি খাবে। সুটের ভিতর
দ্রুত বাড়ছে তাপমাত্রা। তবে সমস্ত অক্সিজেন নিঃশেষ হয়ে
যাওয়ার পরও পাঁচ মিনিট টিকে থাকবে ও। না কি তিন মিনিট?
ওর জানা নেই।
‘সব লাইন এখন বাইরে, রানা,’ বলল সুরাইয়া। ‘কিন্তু
তোমার উদ্দেশন্ধা আমি ঠিক বুঝতে পারছি না এখনও।’
‘অপেক্ষা করো, দেখতে পাবে, এসো, আরও সাহায্য লাগবেÑজুবিলিকে আমি অ্যাবি থেকে বের করে আনতে চাই।’
ডকিং-এ যেমন কোন সমস্যা হয়নি, আনডকিং-এও হলো
না। স্পেস স্টেশন অ্যাবির ভিতরকার কন্ট্রোলের উপর বারাইল্ডি
লোকেরা হয় নজর রাখছে না, কিংবা নজর রাখলেও সিস্টেমের
মধ্যে ম্যানুয়াল কন্ট্রোল বাতিল করার উপায় রাখা হয়নি।
ফুয়েল লাইন খুঁজে বের করবার জন্য কন্ট্রোল প্যানেলের
তলায় ঢুকতে হয়েছিল রানাকে, তখনই ওর দেখবার সুযোগ
হয়েছে ক্যাপসুলের ইঞ্জিন কীভাবে কাজ করে। একটা সেফটি
লাইন নিয়ে ক্যাপসুলের হ্যাচের ভিতর নামল ও।
ইঞ্জিনটাকে আধ সেকেন্ডের জন্য স্টার্ট দিতেই স্পেস স্টেশন
থেকে মুক্ত হয়ে বেরিয়ে এল জুবিলি। আরও আধ সেকেন্ডে
ওটাকে তাক করা হলো ডিশটার মধ্যবিন্দু বরাবর।
‘রানা,’ রেডিওতে আবার শোনা গেল বারাইল্ডি কণ্ঠ¯ল্ফ,
এবার খানিকটা উদ্বিগ্ন। ‘তুমি বোকামি করছ। কোনভাবেই
তোমরা আর পৃথিবীতে ফিরে যেতে পারবে না। আমরা জুবিলির
কন্ট্রোল নিজেল্ডে হাতে তুলে নেবÑক্র্যাশ করাব ওটাকে। ধরা
দাও। সারেন্ডার। এখনই!’
রেডিওর ভলিউম যতটা পারা যায় বাড়িয়ে দিয়ে রানা বলল,
‘তোমার জন্যে দুঃসংবাদ, বারাইদি। সোলার ডিশটা গুঁড়িয়ে
দিচ্ছি আমি। কোনভাবেই ঠেকাতে পারছ না।’
‘কেন তুমি বোকামি করবে, রানা? কেন? সুইসাইড করা
তোমার স্টাইল নয়। তুমি একজন প্রফেশনাল। নিয়ম কানুন
সবই তোমার জানা। আমরা দু’জন একই খেলায় আছি।
পরস্পরকে আমরা সমীহ করি।
‘এ-কাজ কোরো না, রানা। ফালতু জিèজায় রাখতে গিয়ে
নিজের জীবনটাকে খুইয়ো নাÑ’
‘ফালতু জিদ, না?’ তিক্ত হাসি ফুটল রানার ঠোঁটে।
ক্যাপসুলের রকেটগুলো অন করল ও। প্রকাণ্ড স্পেস ক্রাফট ধীরে
ধীরে রওনা হয়ে যেতে স্পেস স্টেশনে আটকানো সেফটি লাইন
টান টান হয়ে উঠল, রানা আর সুরাইয়াকে ঝাঁকি দিয়ে ছাড়িয়ে
নিল ক্যাপসুলের হ্যাচ থেকে।
জুবিলির গতি ক্রমশ বাড়ছে, গন্তব্য ম্যাগনিফাইং গ−াস দিয়ে
তৈরি প্রকাণ্ড ডিশটার মধ্যভাগ; এদিকে পিছনে পড়ে থাকল ওরা,
এখনও স্পেস স্টেশনের গায়ের সঙ্গে বাঁধা।
‘রানা!’
‘ঢিল ছোঁড়া হয়ে গেছে, বারাইদি,’ বলল রানা। রেডিওর
ভলিউম কমিয়ে ফেলেছে ও, মোসাদ এজেন্ট যাতে ধরে নেয় ওরা
ক্যাপসুলের ভিতরে আছে, এবং ক্যাপসুল দূরে সরে যাচ্ছে বলে
রেডিও সিগন্যাল দুর্বল লাগছে।
দেখতে দেখতে কাঁচের ডিশের ঠিক মাঝখানে পৌঁছে গেল
খেয়াযান জুবিলি। ওখানে তীব্র উত্তাপ লাগছে ক্যাপসুলের গায়ে।
৭৭
প্রচণ্ড তাপ সহ্য করবার উপযোগী করেই তৈরি করা হয়েছে
ওটাকে। তবে বাইরে বেরিয়ে থাকা ফুয়েল লাইনগুলোর সহ্য ক্ষমতা বেশি হওয়ার কোন কারণ নেই। ওগুলো গলে গেল।
ভিতর থেকে লিকুইড অক্সিজেন আর হাইড্রোজেন বেরিয়ে এল।
ফুয়েল ট্যাংক বিস্ফোরিত হওয়ার সময় অত্যুজ্জ্বল আলোর
ঝলক মুহূর্তের জনঞ্জন্ধ করে দিল রানাকে।
‘রানা!’ প্রায় আর্তনাল্ডে মত শোনাল বারাইল্ডি চিৎকার।
তবে ক্ষতি যা হওয়ার এরই মধ্যে হয়ে গেছে। ফুয়েল
ট্যাংকের বিধ্বংসী বিস্ফোরণ ডিশের তার ছিঁড়ে টুকরো টুকরো
করল আর কাঁচ ভেঙে গুঁড়িয়ে দিল। সাজানো ত্রিশ লাখ
ম্যাগনিফাইং গ−াসের সবগুলো ধ্বংস হয়নি, তবে খুব বেশি রক্ষাও
পায়নি।
বিস্ফোরণের উজ্জ্বলতা চোখে সয়ে আসতে ডিশটার ভাঙা,
দোমড়ানো-মোচড়ানো, বিধ্বস্ত চেহারাটাই শুধু ধরা পড়ল রানার
চোখে।
‘রানা, তুমি সৌরজগতের বাইরে চলে যাচ্ছ!’ চেঁচিয়ে উঠল
বারাইদি। ব্যাপারটা যেন সে বিশ্বাস করতে পারছে না।
খালি জুবিলির দিকে তাকাল রানা। বিস্ফোরণের ফলে
মারাত্মক ক্ষতি হয়েছে ওটারÑছন্দহীন, এলোমেলো ভঙ্গিতে পাক
খেতে খেতে দূরে সরে যাচ্ছে। তবে বারাইল্ডি ধারণা ভুল।
নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ক্যাপসুলটা ছুটে চলেছে সরাসরি সূর্যের দিকে।
জুবিলি পৃথিবীর কক্ষপথ ত্যাগ করবার জন্য প্রয়োজনীয়
ক্ষিপ্রতা অর্জন করেছে কিনা সন্দেহ আছে রানার। তবে শেষ
পর্যন্ত সূর্যের কক্ষপথে পৌঁছে চক্কর খেতে পারেÑনতুন একটা গ্রহ
হিসাবে সূর্যকে পুজো করবে।
‘বারাইদি,’ বলল রানা, রেডিওর ভলিউম একেবারে কমিয়ে
রেখেছে। ‘একটা সুসংবাদ দিই। ওটা শেষ।’
‘ওরে কুত্তা! তোমার খুশি হবার কিছু নেই। আমরা আরেকটা
ডিশ বানাব। এটা কোন ক্ষতিই না। তুমি হেরে গেছ। মর
শালাÑমর! মর! মর!’
‘আমি যদি হেরেই গিয়ে থাকি, তোমার এত জ্বলছে কেন?’
‘কারণ আমার একটা আশা তুমি পূরণ করতে দাওনি,’ বলল
মোসাদ এজেন্ট। ‘তোমাকে আমি নিজের হাতে খুন করতে
চেয়েছিলাম।’
রানার গায়ে সেঁটে এল সুরাইয়া, দু’জনেই স্পেস স্টেশনের
খোল ধরে ভেসে আছে। খেয়াযান জুবিলি ইতিমধ্যে দৃষ্টিসীমার
বাইরে চলে গেছে। অ্যাবির অত্যন্ত শক্তিশালী কোন
টেলিস্কোপেও ওটাকে এখন আর দেখতে পাওয়া যাবে কিনা
সন্দেহ।
‘এখন?’ চিৎকার করল সুরাইয়া, তার হেলমেট রানার
হেলমেটের সঙ্গে শক্তভাবে সেঁটে আছে।
‘অপেক্ষা।’
‘কী জন্যে, রানা?’
‘একটা সুযোগের।’ তবে টের পাচ্ছে রানা, অক্সিজেনের
অভাবে ধীরে ধীরে মৃতুশু দিকে এগোচ্ছে ও, সেটা ঠেকাতে হলে
সুযোগটা খুব তাড়াতাড়ি পেতে হবে ওকে।
আর মাত্র দু’মিনিট চলবার মত অক্সিজেন আছে। ফুয়েল
লাইন নাড়াচাড়া, বারাইল্ডি সঙ্গে বাক্য বিনিময়, সোলার ডিশকে
ধ্বংস হতে দেখে উত্তেজিত হওয়া ইত্যাদি প্রতিটি ব্যাপারে শক্তি
ব্যয় করতে হয়েছে ওকে, ফলে এখন তো মাসুল দিতে হবেই।
যতবার ওর হৃদ্পিণ্ড একটু জোরে চলেছে, ততবার একটু করে
বেশি খরচ হয়েছে অক্সিজেন।
এরই মধেশুক্তস্রোতে অক্সিজেন কমে আসবার প্রতিক্রিয়া
অনুভব করছে রানা। আচ্ছন্ন বোধ করছে ও, সেফটি লাইন ধরে
নির্জীব ভঙ্গিতে ঝুলে আছে। ওকে জ্যান্ত পুঁতে ফেলা হলেও
ফুসফুসে বোধ হয় এরকম যন্ত্রণা হত না।
৭৮
ওর কিছু করবার নেই। এখন শুধু অমোঘ নিয়তির জনঞ্জপেক্ষা।
পনেরো
‘কষ্ট পেয়ে মরো, রানা। ডাইনী উম্মে সুরাইয়াকে সঙ্গে নিয়ে
মরো। মরো মহাশূন্যে। মরো বাতাস ছাড়া, পায়ের নীচে গ্রহ
ছাড়া। এ-কথা জেনে মরো যে ইজরায়েলি ওই খেয়াযানটাই
তোমার কবর। সরাসরি জাহান্নামে যাও, রানা, সরাসরি
জাহান্নামে!’ প্রচণ্ড ক্রোধে দিশেহারা বারাইদি প্রলাপ বকছে।
রানা আর সুরাইয়ার হেলমেট এক হয়ে আছে, ওরা যাতে
রেডিও বল্টহার না করে কথা বলতে পারে।
‘ও যেন বুঝতে না পারে কোথায় আছি আমরা,’ বলল রানা।
কণ্ঠ¯ল্ফ দুর্বল হয়ে আসছে। কপালে জমা বিন্দু বিন্দু ঘাম ফোঁটায়
পরিণত হচ্ছে। শ্বাস টানবার সময় মনে হলো ফুসফুস যেন সিরিশ
কাগজ দিয়ে মুড়ে ফেলা হয়েছে। ওর এয়ার সাপ−াই দ্রুত ফুরিয়ে
আসছে, সেই সঙ্গে আয়ুও। ‘অপেক্ষা করো। ওল্ডেকে একটা
ভুল করতে দাও।’
‘রানা, তোমার অক্সিজেন প্রায় শেষ হয়ে গেছে। আমারটা
শেয়ার করো।’
স্কুবা ডাইভাররা এই কাজ হরদম করছে। কিন্তু ওরা তো
পানির তলায় নেই, এমনকী পৃথিবীতেও নেই। চোখ তুলে
উপরদিকে তাকাল রানা, পৃথিবীর গাঢ় নীল সাগরগুলোকে
পরিষ্কার চিনতে পারল। খুব বেশি দূরে নয়, মাত্র একশো বিশ
মাইল, তবে ওর জন্য কয়েক আলোকবর্ষ দূরে ।
‘না, সুরাইয়া, এখানে তা সম্ভব নয়। বিশ্রাম নাও। পিছনে
হেলান দিয়ে রিল্যাক্স করো,’ শেষ শব্দ দুটো নির্দেশের সুরে
বলল। ‘আমি ঠিক আছি। শুধু যদি...’
রানার শ্বাস-প্রশ্বাস আরও ধীরে বইছে। ওর মনে হচ্ছে গোটা
মহাবিশ্ব আসলে গরম একটা জায়গা। পৃথিবী অনেক দূরে, অথচ
সে-কথা ভেবে উদ্বেগ বোধ করছে না।
ধ্যান শুরু করেছে ও; অক্সিজেনের সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাওয়ার
পরও যাতে বেঁচে থাকতে পারে। অন্তত কিছুক্ষণ...যতক্ষণ পারা
যায়।
থাকল রানা বেঁচে। অক্সিজেন ফুরিয়ে গেছে এক মিনিট
আগে। পায়ের তলাটা কাঁপল। এয়ার লক ডোর খুলে গেছে।
দু’জন অ্যাস্ট্রনট বাইরে মাথা বের করল। বারাইল্ডি সঙ্গে পৃথিবী
থেকে এসেছে তারা। মাথা বের করে দেখছে মহামূলল্টান
হাতিয়ার সোলার ডিশের কতটুকু ক্ষতি হয়েছে।
ওর এই পজিশন থেকে কায়দামত হামলা করতে পারবে না
রানা। লোক দু’জনকে আরও একটু বেরিয়ে আসতে হবে।
হেলমেটের ভিতর হাঁপাচ্ছে রানা। নিঃশ্বাসের সঙ্গে যে কার্বন
ডাইঅক্সাইড বেরুচ্ছে, সেটাই শ্বাসের সঙ্গে ফুসফুসে ঢুকছে, ফলে
অক্সিজেনের অভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ছে দ্রুত। কপালের ঘাম
গড়িয়ে চোখে পড়ছে। তবু হাল না ছাড়বার প্রতিজ্ঞায় অটল
থাকল ও।
এবং তার ফলও ফলল।
অ্যাস্ট্রনটল্ডে একজন এয়ার লক থেকে বাইরে বেরিয়ে এসে
ঝুলে থাকল শূন্যে, রানার কাছ থেকে দূরত্ব পাঁচ ফুটেরও কম।
সেফটি লাইনটাকে একটা লূপ বা ফাঁস বানিয়ে ছুঁড়ে দিল
রানা। হেলমেট পরা মাথায় একেবারে নিখুঁতভাবে গলে গেল
সেটা। বন্দি করে তাকে স্টেশনের দিকে টেনে আনা হচ্ছে, সঙ্গে
৭৯
সঙ্গে এটা সে টেরও পেল না।
তার অক্সিজেন বটলটা নরম আঙুল দিয়ে নাড়াচাড়া করল
রানা। ভালভ থেকে কিছু অক্সিজেন লিক করল, সঙ্গে সঙ্গে নিরেট
বরফে পরিণত হলো তা, তবে বটলটা নিরাপদে খুলে নিতে পারল
ও।
অক্সিজেন সাপ−াই হঠাৎ বন্ধ হয়ে যেতে অ্যাস্ট্রনট টের পেল
কিছু একটা ঘটেছে। ঘুরতে যাচ্ছে সে। রানা তাকে লাথি মেরে
দূরে সরিয়ে দিল। তার আগে নিশ্চিত হয়ে নিয়েছে ওর সেফটি
লাইন বেরিয়ে এসেছে লোকটার গলা থেকে।
লোকটার লাইন টান টান হলো। ইতিমধ্যে নিজের স্পেস
সুটে অক্সিজেন বটলটা আটকে নিয়েছে রানা। উন্মত্তের মত হাত
পা ছুঁড়ছে ওর প্রতিপক্ষ, রানাকে ওর খালি বোতলটা ঝাঁকাতে
দেখছে।
হঠাৎ হাসল রানা। মাথায় একটা বুদ্ধি এসেছে। লক্ষ্যস্থির
করে খালি বোতলটা ছুঁড়ল ও।
ঘন ঘন ডিগবাজি খেয়ে ছুটল বোতল। ধাতব একটা বুলেট।
ঠিক জায়গাতেই লাগল, যাকে বলে ডিরেক্ট হিটÑলোকটার
প−াস্টিক ফেসপে−টে।
ফেসপে−ট ফেটে গেল। লোকটার সুটের ভিতর সামান্য যে
বাতাস ছিল, সশব্দে বেরিয়ে এল সদ্য তৈরি ফাঁক দিয়ে। গোটা
শরীরে খিঁচুনি উঠল, তবে মাত্র কয়েক সেকেন্ড পরই স্থির হয়ে
গেল সেÑমারা গেছে।
ফেসপে−টে ফাটল ধরায় সুটটা ডিকমপ্রেসড্ হয়ে গিয়েছিল।
শরীরের অভ্যন্তরীণ চাপÑপৃথিবীতে সী লেভেলের উপযোগীÑ
জোর খাটিয়ে সদ্য পাওয়া ভ্যাকিউম-এ বেরিয়ে এসেছে। লোকটা
মাইক্রোওয়েভ রেঞ্জে রাখা হট ডগ-এর মত ফেটে গেছে। পাক
খেতে খেতে পাশ কাটানোর সময় লাশের কোটর ছেড়ে বেরিয়ে
আসা পিচ্ছিল চোখ, রক্তাক্ত নাক আর কান দেখতে পেল রানা।
যা কিছু ঘটল, সবই একটা ভৌতিক নীরবতার ভিতর।
পায়ের তলায় আবার কাঁপন অনুভব করল রানা। ঘুরে
তাকাতেই দেখল দ্বিতীয় অ্যাস্ট্রনট সুরাইয়ার সঙ্গে ধস্তাধস্তি
করছে। তার প্রতিক্রিয়া দেরিতে হলেও, নিজের বিপদ্মা চিনতে
পারবার পর মরিয়া হয়ে উঠেছে। সুরাইয়ার সুটের এয়ার হোসটা
ধরবার চেষ্টা করছে সে।
সুটের সঙ্গে আটকানো সেফটি লাইনটা আবার ছুঁড়ল রানা।
এবার লূপ বানাবার সময় পায়নি। লোকটার মাথার ঠিক উপরে
রয়েছে রেডিওর অ্যান্টেনা, চাবুকের মত এক বাড়িতেই ভেঙে
গেল সেটা।
বারাইদি স্পেস স্টেশনের ভিতরে রয়েছে, তার সঙ্গে
লোকটার সমস্ত যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। এরকম একটা
ছোটখাট সাফল্যে তৃপ্ত হতে রাজি নয় রানা। ও কিছু করতে না
পারলে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে মারা যাবে সুরাইয়া।
নাইলন সেফটি লাইন এবার রানা লোকটার পা লক্ষ্য করে
ছুঁড়ল। পায়ে ওটা প্যাঁচ খাচ্ছে, টান মারল কষে। লোকটার
‘পতন’ ঘটল না, তবে তাকে ছাড়িয়ে আনা গেল। সেটাও ম›èলা চলে না।
নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ ফিরে পেয়ে ভাল কাজ দেখাল
সুরাইয়া। লোকটার পিছনে পৌঁছাল সে, দ্রুত হাত চালিয়ে তার
সেফটি লাইন খুলে দিল। থামল না, এরপর খপ্ করে কার্বন
ডাইঅক্সাইড ম্যানুভারিং জেট ধরে দিল এক টান।
সুরাইয়ার হাত থেকে বটলটা ছোঁ দিয়ে কেড়ে নিল রানা।
জেটটা লোকটার বুকে তাক করে দুটো ট্রিগারই টেনে ধরল ও।
শক্ত, নিরেট পালক আকৃতির বরফ রকেটের বেগে বেরিয়ে
এসে আঘাত করল তাকে, সরিয়ে দিল স্টেশন থেকে দূরে।
একজন অ্যাক্রব্যাট-এর মত ডিগবাজি খেতে খেতে কালো
মহাশূন্যে মিশে যাচ্ছে লোকটা। সঙ্গের অক্সিজেন বটলটা যদি
৮০
পুরোপুরি ভর্তিও থাকে, খুব বেশি হলে দু’ঘণ্টা বাঁচবে সে।
রানা জানে লোকটার মাথায় এখন কী সব চিন্তা চলছে।
ট্রেনিং পাওয়া অ্যাস্ট্রনট, স্পেস সম্পর্কে জানে, জানে তার এই
বিপদ্মা আসলে কী। দু’ঘণ্টা যèিাঁচেও, এই সময়ের মধ্যে কেউ তাকে উদ্ধার করতে আসবে না। এই দু’ঘণ্টা হবে ভয়ানক
যন্ত্রণাদায়ক।
হঠাৎ ক্ষিপ্র একটা নড়াচড়া লক্ষ করল রানা। এক ঝটকায়
নিজের ফেসপে−ট খুলে ফেলেছে লোকটা। অক্সিজেন আর
হিলিয়ামের ঘন সাদা মেঘ বেরিয়ে আসতে দেখা গেল, ঢেকে
ফেলছে শরীরটা।
সেই মেঘের ভিতর ঢুকে বাঁকা হয়ে গেল সূর্যরশ্মি, ফলে
মুহূর্তের জন্য একটা রঙধনু তৈরি হলো। তারপর দৃষ্টিসীমা থেকে
হারিয়ে গেল লোকটা।
তার ব্যক্তিগত অ্যাটমসফিয়ার-এর ক্ষণস্থায়ী নিঃসরণ খুল্ডেকেট ইঞ্জিনের মত কাজ করেছে; মহাশূনেশু গভীর প্রদেশে
ঠেলে দিয়েছে তাকে।
‘ওহ, রানা!’ প্রায় গুঙিয়ে উঠল সুরাইয়া। সে-ও দেখছিল।
‘কী ভয়ঙ্কর! এ সতিল্টড় করুণ মৃত্যু!’
জবাব ত্থেয়ার সময় পাওয়া গেল না, তার আগেই
হেডফোনে বারাইল্ডি কর্কশ হুংকার শুনতে পেল রানা। ‘বাইরে
ঘটছেটা কী? ম্যাগনিফাইং ডিশের কী অবস্থা? রিপোর্ট করো।’
ভলিউম কমানোই আছে, কণ্ঠস্বরে ভোঁতা ভাব এনে রানা
বিড়বিড় করল, ‘মেজর, ডিশের অবস্থা খুব খারাপ। খুবই
খারাপ।’
‘পুরোটা ভেঙে গেছে? মেরামত করা যাবে না?’ জিজ্ঞেস
করল বারাইদি, রানার কণ্ঠ¯ল্ফ চিনতে পারছে না।
‘নাহ, মেরামত করা সম্ভব বলে মনে হয় না। ভেতর দিকের
সবগুলো কাঁচ চুরমার হয়ে গেছে...’
‘তোমার আওয়াজ অস্পষ্ট, হেইডেন। রেডিওর ভলিউম
বাড়াও।’
‘স্টেশনের বাঁকে রয়েছি কি না,’ উপস্থিত বুদ্ধি খাটিয়ে বলল
রানা। রেডিওর ভলিউম আরও কমিয়ে দ্রুত রিপোর্ট দিয়ে যাচ্ছে।
ইতিমধ্যে এয়ার লকে ঢুকে রানার জনঞ্জপেক্ষা করছে
সুরাইয়া। ভিতরে ঢুকল রানা, সেফটি লাইন খুলে ভারী আউটার
ডোর বন্ধ করে দিল। সুরাইয়ার হেলমেটে নিজেরটা চেপে ধরে
বলল, ‘ইন্ডিকেটর লাইট দেখে ওরা সম্ভবত বুঝতে পারবে যে
এয়ার লক-এর আউটার ডোর বন্ধ হয়ে গেছে। কাজেই খুব দ্রুত
হামলা করতে হবে। রেডি?’
‘রেডি, রানা।’
স্টেশন-এর প্রেশার পেতে অনন্তকাল সময় লাগছে এয়ার
লকের। হেলমেট আর প্যাড লাগানো গ−াভস খুলে ফেলল রানা।
সুটটাও খুলতে পারলে খুশি হত, কিন্তু অত সময় পাওয়া যাবে
না। ও জানে, এরই মধেল্টারাইল্ডি মনে প্রশ্নটা দেখা দিয়েছে:
কাজ ফেলে তার লোকেরা ফিরে আসছে কেন?
ইনার ডোর খুলছে। ছোট্ট ফাঁক গলে ছুটল রানার শক্ত মুঠো,
এক ঘুসিতেই অ্যাস্ট্রনট মেনিনের চোয়ালের হাড় ভেঙে গেল,
পিছনে উড়ে গেল সে।
‘তাই তো বলি!’ আঁতকে উঠল বারাইদি, বুঝে ফেলেছে ওরা
তার লোকজন নয়।
রানার পাশের দেয়ালে একটা রাবার বুলেট লাগল। লম্বা হয়ে
শোবার ভঙ্গিতে শূন্যে স্থির হলো ও, তারপর দেয়ালে জোড়া পা
দিয়ে লাথি মারল। একটা বর্শার মত ছুটে ঘরের ভিতর ঢুকল
শরীরটা।
এক হাতে চোয়াল চেপে ধরে মেনিন সিধে হচ্ছে, বুকে রানার
দু’হাতের ধাক্কা খেয়ে আবার পিছন দিকে উড়ে গেল সে। এবার
দেয়ালে বাড়ি খেয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে।
৮১
দেয়ালে লেগে ফুটবলের মত ফিরে আসছে রানা, পা দুটো
শরীরের নীচে গুটিয়ে রেখেছে। এই সময় দেখতে পেল বিপদ্মা।
সরাসরি ওর দিকে অস্ত্র তাক করেছে বারাইদি। সিলিন্ডারের
পাশ থেকে ভারী বুলেট উঁকি দিতে দেখল রানা, বুঝতে পারল
ওগুলো রাবারের তৈরি নয়।
এ জীবন আর মৃত্যু নিয়ে খেলা।
বারাইদি জানে তার লক্ষ্য যè্যর্থি হয়, বুলেটটা দেয়াল
ফুঁড়ে বেরিয়ে গিয়ে স্পেস স্টেশনকে ভয়ানক ঝুঁকির মধ্যে ফেলে
দিতে পারে। ভিতরে অ্যাটমসফিয়ার বলে কিছু থাকবে না।
‘বোকার মত কিছু করতে যেয়ো না, রানা,’ শান্ত, একঘেয়ে
সুরে বলল সে; চিৎকার করলে বোধহয় এতটা ভয় লাগত না।
‘আমার লক্ষল্ট্যর্থ হতে পারে। তবে ফুটোটা মারাত্মক কিছু হবে
না। সেটা খুব তাড়াতাড়ি বন্ধের বল্টস্থাও করা আছে।’
তার দৃষ্টি পলকের জন্য বেলুনগুলোকে ছুঁয়ে এলÑসারকুলেশন
সিস্টেমের ফসল এয়ার কারেন্টে ভেসে বেড়াচ্ছে।
‘বেলুনগুলোর ভেতর সীল করার সরঞ্জাম আছে। ছোটখাট
ফুটো অনায়াসে বন্ধ করতে পারবে। কাজেই গুলি চালাতে কোন
সমস্যা নেই।’
অ্যাবির খোল ফুটো হয়ে গেলে তীব্র বেগে বাইরে বেরুতে
শুরু করবে অ্যাটমসফিয়ার, ফলে ফুটোটা টেনে নেবে
বেলুনগুলোকে।
রানাকে ইতস্তত করতে দেখে আবার বলল বারাইদি, ‘আমি
আমার সিদ্ধান্ত নিয়ে দ্বন্দ্বে পড়ে গেছি। নিজের হাতেই মারব
তোমাকে, ঠিক বুঝতে পারছি না কোথায়Ñএখানে, না কি
পৃথিবীতে? আমার বস্ চান তোমাকে আমি তেল আবিবে নিয়ে
গিয়ে দু’দিনের জন্যে ইন্টারোগেটরল্ডে হাতে ছেড়ে দিই।’
সুরাইয়াকে দেখবার আশায় ঘাড় ফেরাল রানা। আশা করছে
কিছু একটা ছুঁড়ে বা অন্য কোন ভাবে এক সেকেন্ডের জনল্টারাইল্ডি দৃষ্টি কাড়বে সে।
কিন্তু না, সুরাইয়া কোন সাহাযেঞ্জাসবে না। শূন্যে নিঃসাড়
ভেসে আছে সে, মাথাটা অদ্ভুত ভঙ্গিতে নড়বড় করছে।
রানার দৃষ্টি অনুসরণ করল বারাইদি। ‘ডাইনীটা মারা যায়নি।
রাবার বুলেটের আঘাতে স্রেফ জ্ঞান হারিয়েছে। ওজনহীনতার
কারণে ওরকম বাঁকা হয়ে আছে ঘাড়।’
সমস্ত দ্বিধা ঝেড়ে ফেলে রানা সিদ্ধান্ত নিল, বারাইল্ডি হাতে
বন্দি হওয়ার চেয়ে গুলি খাওয়ার ঝুঁকি নেবে। পা ছুঁড়ে রওনা
হতে যাবে, পিছন থেকে ওর ঘাড়ের উপর এসে পড়ল মেনিন।
এই মাত্র জ্ঞান ফিরে পেয়েছে সে, পিস্তলটা বের করে চেপে
ধরেছে রানার খুলিতে।
‘ভেরি গুড।’ প্রশংসা করল বারাইদি। ‘আবার ওল্ডেকে
স্টোরেজ রুমে রেখে এসো।’ রানার দিকে ফিরল সে। ‘এবার
আর পালাতে হচ্ছে না।’
অনিচ্ছাসত্ত্বেও স্পেস সুট খুলে ফেলতে বাধ্য হলো রানা।
পিস্তলের খোঁচা খেয়ে স্টোর রুমে ঢুকতে হলো আবার। ওর
পিছনে ঠেলে ত্থেয়া হলো সুরাইয়ার অজ্ঞান দেহ। ভারী ল্ডজা
বন্ধ হয়ে গেল বাইরে থেকে।
হঠাৎ করেই আইডিয়াটা মানসপটে উদয় হলো। এই কামরায়
প্রথমবার যখন ছিল রানা তখনই মনের গভীর অন্ধকার থেকে
উঠে আসবার চেষ্টা করছিল ওটা। ও এখন জানে কীভাবে
পালানো সম্ভব। ল্ডকার শুধু খানিকটা সময়।
৮২
ষোলো
‘আমি কোথায়?’ মাথাটা এদিক ওদিক দোলাচ্ছে সুরাইয়া, তার
লম্বা কালো চুল লম্বাটে মুখের চারপাশে ভেসে আছে। ‘ওহ!’
আঁতকে উঠল সে। ‘আবার সেই স্টোর রুমে ফিরে এসেছি।’
‘চিন্তা কোরো না,’ অভয় দিল রানা। ‘এখান থেকে বেরুবার
উপায় আমার জানা আছে। ওল্ডে এই স্টেশনটাও আশা করি
ধ্বংস করতে পারব।’
‘কীভাবে?’ দুর্বল কণ্ঠে জানতে চাইল সুরাইয়া, প্রশ্নের সুরে
অবিশ্বাস।
‘কী কীভাবে?’
‘এখান থেকে বেরুবে, স্টেশন ধ্বংস করবে?’
‘তা হলে অনুমতি দাও,’ নাটুকে ভঙ্গিতে বলল রানা, ‘পারব
কি না একটা পরীক্ষা করে দেখাই।’ পকেট হাতড়ে একটা
দেশলাইয়ের বাক্স বের করল। ‘আগে বলো কী ঘটবে।’ একটা
কাঠি জ্বালবার প্রস্তুতি নিয়ে স্থির হয়ে আছে।
‘কেন, জ্বলবে ওটা।’
কাঠির মাথাটা ঘষল রানা, স্থিরভাবে ধরে রাখল। বারুদ বিস্ফোরিত হয়েছে, কাঠির শরীর পুড়ছে। তারপর ওর আঙুলে
আঁচ লাগতে আগুনটা নিভিয়ে ফেলল তাড়াতাড়ি।
‘এর মানে?’ জিজ্ঞেস করল সুরাইয়া।
‘এর মানে, দেশলাইটা আমি সরাসরি এয়ার ডাক্ট-এর সামনে
ধরেছিলাম। স্পেস স্টেশনের এয়ার সার্কুলেটিং সিস্টেম নিশ্চিত
করছে ওটার মধেল্টাতাস থাকবে। এবার দেখো।’
এক্সপেরিমেন্টটা রিপিট করল রানা, এবার ডাক্ট-এর মুখ নিজের
শরীর দিয়ে বন্ধ করে রাখল। কাঠির মাথায় আগুন জ্বলল, নিভু
নিভু হলো, তারপর নিভেও গেল।
‘এয়ার ডাক্ট থেকে অক্সিজেন আসছিল, কিন্তু সেটা আসার
পথ তুমি বন্ধ করে দিয়েছ?’ সন্দেহের সুরে জানতে চাইল
সুরাইয়া।
‘মোটেও না। আমি বাতাসের যে প্রবাহ বন্ধ করেছি সেটা
ওয়েস্ট প্রোডাক্টস বয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। কাঠিটা জ্বলার সময় অনেক
রকম বাজে বা ক্ষতিকর গ্যাস তৈরি করছিল। পৃথিবীতে এই
গ্যাসগুলো বাতাসের চেয়ে হালকা, তাই ওপরে উঠে যায়।
ওজনশূন্য পরিবেশে একটা আরেকটার চেয়ে হালকা, এরকম নয়;
প্রতিটি জিনিসের ওজন একইÑশূন্য। নষ্ট গ্যাস কাঠির মাথার
চারদিকে থেকে যায়, কাজেই অক্সিজেন ওখানে থাকতে পারে না,
ফলে নিভে যায় ওটা।’
আরেকটা কাঠি জ্বালল রানা, এবার ওটাকে ধীরে ধীরে
সরাচ্ছে। দেখা গেল উজ্জ্বল শিখার পিছু নিয়েছে গ্যাসগুলো।
‘এটা প্রথমবারের মতইÑমনে করো স্টেশনের সার্কুলেশন
সিস্টেম যে এয়ার কারেন্ট তৈরি করছে সেটায় ধরেছি কাঠিটা।’
‘বেশ, বুঝলামÑতো কী হলো?’
‘আমি তোমাকে দেখাবার চেষ্টা করছি যে কক্ষপথে বস্তুর
পুড়ে যাওয়াটা একটু অনশুকম। ফিজিক্সের নিয়মগুলো সব
একই থাকছে, কিন্তু ওগুলোর এনভায়রনমেন্ট আলাদা। তাতে
করে নতুন ফ্যাক্টর বেরিয়ে আসছে, যেগুলোর কথা পৃথিবীতে
সাধারণত আমরা চিন্তাই করি না।’
‘অর্থাৎ তুমি একটা দেশলাই জ্বালবে, তারপর বারাইদিকে
অবাক করার জনেঞ্জাবার ওটা নিভিয়ে ফেলবে?’
‘ওহ, অবিশ্বাসিনী! এসো, এই অ্যালুমিনিয়াম পে−টটা গুঁড়ো
করিÑমানে, তুমি আমাকে সাহায্য করো।’ একটা ফাইল নিল
রানা, তারপর অ্যালুমিনিয়ামের পে−টটাকে মিহি করে চাঁছতে শুরু
করল।
তবে কাজটা সহজ নয়। চাপের মধ্যে পড়ে পিছলে বেরিয়ে
৮৩
যেতে চাইছে পে−টটা, রানাও জিরো-গ্র্যাভিটিতে কাজ করে অভ্যস্ত
নয়। ভাঁজ করা বাঁ পা দিয়ে একটা থামকে জড়াল ও, কাজের
জায়গা ছেড়ে শরীর যাতে ভেসে যেতে না পারে।
‘কেন?’
‘কারণ এটাই আমাল্ডেকে এখান থেকে বের করে নিয়ে
যাবে। আসলে, যে-কোন জিনিসই তুমি গুঁড়ো করতে পারো,
মানে অ্যালুমিনিয়াম না হলেও চলবে। তবে যাই গুঁড়ো করো,
সেটা কিন্তু মিহি হওয়া চাই। ময়দার মত।’
‘এখানে তুমি ময়দা পাবে না।’
‘তা আমি জানি। বলতে চাইছি যে-কোন জিনিস গুঁড়ো
করতে পারো তুমি, তবে তা যেন ময়দার মত মিহি হয়। যত
মিহি হবে তত ভাল।’
ভুরু কোঁচকালেও, সুরাইয়াও হাত লাগাল কাজটায়। খানিক
পর উজ্জ্বল হলো তার চোখ-মুখ, বলল, ‘বুঝেছি! এগুলো জ্বলবে,
তারপর গোটা স্টেশনে আগুন ধরে যাবে। কিংবা বিষাক্ত বাষ্প
তৈরি হবে। কিন্তু...অ্যালুমিনিয়াম তো পোড়ে না। এ-ও পোড়ে
না,’ বলে বাক্স আর কড়িকাঠ থেকে সংগ্রহ করা কাঠের গুঁড়োর
একটা ¯তূপ শূন্যে ঝুলিয়ে রাখল।
‘চেষ্টা করে দেখো,’ বলল রানা, দেশলাইটা ছুঁড়ে দিল
সুরাইয়ার দিকে।
সুরাইয়া কী করে দেখছে রানা। কাঠের গুঁড়োগুলো জড়ো
করে খুদে একটা মেঘ তৈরি করল সে, হাতের চাপ দিয়ে একটা
আকৃতি দিল, স্থিরভাবে ঝুলিয়ে রাখল নিজের সামনে।
দেশলাইয়ের কাঠি জ্বালল, তারপর গুঁড়োগুলোর মাঝখানে ঢুকিয়ে
দিল জ্বলন্ত কাঠিটা। কয়েকবার নিভু নিভু হয়ে শিখাটা একেবারে
নিভেই গেল।
দেশলাইটা রানার দিকে ছুঁড়ে দিল সুরাইয়া। ‘কাজ হলো না,’
¤−ান সুরে বলল সে। ‘আমার কোন ধারণা নেই ঠিক কী তুমি
করতে চাও।’
‘আগে যা বলেছি তা তুমি মনে রাখোনি। ফিজিক্সের নিয়ম
পৃথিবীতে যা, এখানেও তাই, তবে ওজনহীনতার কারণে
অ্যাপি−কেশান বদলে যাবে। তোমার তৈরি ওই মেঘের কণা জ্বলে
ওঠার মত প্রয়োজনীয় অক্সিজেন পায়নি।’
‘এখন তা হলে কী হবে?’
‘এখন আমরা আরও অনেক বড় মেঘ তৈরি করার জন্যে প্রচুর
গুঁড়ো সংগ্রহ করব। তারপর নিজেই দেখতে পাবে কী হয়!’
রানার মনে হলো কয়েক ঘণ্টা ধরে হাড়ভাঙা পরিশ্রম করছে।
ইতিমধ্যে কয়েক কিলো অ্যালুমিনিয়াম পাউডার পেয়েছে ও।
সুরাইয়ার তৈরি কাঠের গুঁড়োর ¯তূপটা আকারে আরও বড়। সব
একটা ক্যানিস্টারে ভরে ল্ডজার পাশে রেখে দিল ও।
‘এখন অপেক্ষা,’ বলল রানা, পকেটে হাত চাপড়ে নিশ্চিত
হয়ে নিল দেশলাইটা জায়গামত আছে কি না।
‘এটাই সবচেয়ে কঠিন।’
‘তবে তৈরি থাকো। আমাল্ডেকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এয়ার
লকে ঢুকতে হবে, স্পেস সুটও পরতে হবে।’
‘কেন? আমরা কোথাও যাচ্ছি? তুমি বোধহয় ভুলে গেছ যে
আমাল্ডে ক্যাপসুল দূর মহাশূনেশু উদ্দেশে ছুটে চলেছে।’
‘আর তুমি ভুলে গেছ বাইরে আমাল্ডে জনেঞ্জারেকটা
ক্যাপসুল অপেক্ষা করছে। বারাইল্ডিটা। ওটা আমরা অনায়াসেই
নিতে পারি, প্রথমটা যেমন নাজাফি স্পেস সেন্টার থেকে
নিয়েছিলাম।’
‘তোমার তো দেখছি আত্মবিশ্বাসের কোন অভাব নেই, রানা।
তোমার মত হতে পারলে ভাল হত। কিন্তু আমার ধারণা এখানে
আমাল্ডে মরতে হবে। ওই লোক, বারাইদি...’
‘চিন্তা কোরো না,’ আবার অভয় দিল রানা। ‘এতে কাজ
৮৪
হবে।’
মনে হলো ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেটে যাচ্ছে। পরস্পরকে জড়িয়ে
ধরে রেখেছে ওরা। কে জানে বারাইদি কখন ওল্ডেকে এখান
থেকে বের করবার সিদ্ধান্ত নেবে।
নাজাফি স্পেস সেন্টারের কথা ভাবল রানা। বিস্ফোরণে
নিশ্চয়ই সব মাটির সঙ্গে মিশে গেছে।
‘রানা!’ হঠাৎ ফিসফিস করল সুরাইয়া, রানাকে আরও শক্ত
করে আঁকড়ে ধরল। ‘ওরা আসছে!’
সুরাইয়াকে এমনভাবে সরিয়ে দিল রানা, ভেসে স্টোর রুমের
পিছন দিকে চলে গেল সে। কাঠ, অ্যালুমিনিয়াম আর এটা-সেটা
নানা জিনিসের গুঁড়ো ভর্তি কন্টেইনারটাÑকোন ওজন নেইÑশক্ত
করে ধরে রেখেছে ও।
কামরার বাইরে থেকে ইজরায়েলি লোকটা ল্ডজার ছিটকিনি
খুলছে, কন্টেইনারের সমস্ত গুঁড়ো সরাসরি কবাট লক্ষ্য করে ছুঁড়ে
দিল রানা।
নিবিড় একটা স্রোতের মত দেখাচ্ছে, গতি মন্থর। ওগুলোর
ছোট ছোট প্রবাহ সৃষ্টি হতে দেখল রানাÑএয়ার ভেস্টগুলো থেকে
বেরুনো তাজা অক্সিজেনকে পাশ কাটাচ্ছে।
এতে করে মেঘের ভিতর দিকে আলোড়ন উঠল, কণাগুলো
চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে।
ল্ডজাটা যখন খুলল, ধুলোর মেঘকে তখন আর বাধা
ত্থেয়ার কোন উপায় নেই। অ্যাস্ট্রনটল্ডে একজন পাউডারের
ভিতরে অদৃশ্য হয়ে গেল।
‘আঁ-আঁ-আঁ!’ মেঘটা গ্রাস করবার সময় তার গলা চিরে
আর্তচিৎকার বেরিয়ে এল। দৃশন্ধা ঝাপসা, তবে দেখতে পেল
রানাÑঘন ঘন হাত ঝাপটাচ্ছে লোকটা, ছুটে পালাচ্ছে।
সুরাইয়াকে সংকেত দিল রানা। ভাসমান রাশি রাশি
পাউডারের পিছু নিয়েছে ও, বেরিয়ে যাচ্ছে কামরা ছেড়ে। এয়ার
সার্কুলেশন সিস্টেম ঘন মেঘটার নাগাল পেয়ে গেল, ফলে স্পেস
স্টেশন অ্যাবির মূল অংশে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ল ওগুলো।
চারদিকে চোখ বুলিয়ে কনসোলটা খুঁজে নিল রানা। হাই
ভোল্টেজ ট্র্যান্সফর্মারগুলো ওকে পথ দেখিয়ে কমিউনিকেশন রিগ-
এর কাছে নিয়ে এল। দেশলাইয়ের অবশিষ্ট কাঠি পাওয়ার রিলে-
র কনট্যাক্টগুলোর মাঝখানে গুঁজে দিল ও। ওই রিলেতে যদি পাওয়ার অ্যাপ−াই করা হয়, কাঠিগুলো জ্বলে উঠবে।
রানা আশা করছে কোন ইনকামিং মেসেজ নেই। অন্তত
আপাতত।
‘এয়ার লকে চলে যাও,’ হিসহিস করে সুরাইয়াকে বলল
রানা। ওল্ডে তৈরি পাউডার ঘন কুয়াশার পরদার মত স্পেস
স্টেশনের ভিতর সব কিছু ঢেকে ফেলেছে। ‘ওদিকের ওই দেয়াল
ধরে বাঁক ঘোরো, তা হলেই পৌঁছে যাবে এয়ার লকে। জলদি,
সুরাইয়া, জলদি! তোমাকে সুট পরতে হবে।’
‘আর তুমি?’
সুরাইয়ার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে রানা চিৎকার করে ডাকল,
‘বারাইদি?’ তার মত একজন বেপরোয়া শত্র“কে পিছনে রেখে
পালাবার কথা ভাবতে পারছে না ও। ‘কোথায় তুমি?’
ওর ওয়ালথারের টগ্ল্ পিছিয়ে আনবার ক্লিক আওয়াজটা
চিনতে পারল রানা, তারপর রিলিজ হলো, যাতে একটা শেলকে
সামনের ফায়ারিঙ চেম্বারে পৌঁছে ত্থেয়া যায়।
ধুলোর তৈরি পরদার আড়াল নিয়ে রানার সঙ্গে খেলছে
বারাইদি। খেলাটায় অংশ নেওয়ার আগে নিশ্চিত হয়ে নিল ও,
অবশিষ্ট পাউডার এয়ার কন্ডিশনিং ডাক্ট-এ পৌঁছেছে।
এর ফলে ধাতব মেঘ কয়েক ঘণ্টা সচল থাকবে।
ইজরায়েলিল্ডে এয়ার ফিলট্রেশন সিস্টেম যতই কাজের হোক,
ফিলটারগুলোকে এখন অনবরত পরিষ্কার করা একান্ত প্রয়োজন।
অ্যাস্ট্রনটরা আবার যখন তাজা বাতাসে শ্বাস গ্রহণের সুযোগ
৮৫
পাবে, তার অনেক আগেই সুরাইয়াকে নিয়ে এখান থেকে কেটে
পড়বে রানাÑকিংবা মারা যাবে।
‘তোমাকে আমি খুন করব, রানা,’ ধুলোর পরদার ওদিক
থেকে ভেসে এল মোসাদ এজেন্টের কণ্ঠ¯ল্ফ। ‘তুমি মারা যাবে
তোমার নিজের পিস্তলের গুলিতেই।’
সুরাইয়া যেদিকে গেছে তার উল্টোদিকে রওনা হলো রানা,
বারাইল্ডি কর্কশ কণ্ঠ¯ল্ফ অনুসরণ করছে। যদি সম্ভব হয়,
সুরাইয়ার কাছ থেকে ওল্ডেকে দূরে সরিয়ে রাখতে চায় ও।
সাবধানে এগোচ্ছে রানা, পায়ে নরম কিছু ঠেকলÑমোচড় খাচ্ছে।
অ্যাস্ট্রনটল্ডে একজন, যে লোকটা স্টোররুমের ল্ডজা খুলে
দিয়ে ধুলোর হামলা সহ্য করতে না পেরে পিছিয়ে এসেছিল।
মেঝেতে পড়ে থাকবার কারণটা অবশ্য বোঝা গেল নাÑহয়তো
গলার ভিতর পাউডার ঢোকায় অসুস্থ হয়ে পড়েছে। তার পেটে
একটা লাথি কষল রানা। লোকটা ওর পা জড়িয়ে ধরল। ডান
হাতটা ঝাঁকাতে তালুতে চলে এল ছুরিটা, ঘ্যাঁচ করে সেটা শত্র“র
নিরাবরণ গলায় ঢুকিয়ে দিল ও।
‘রানা!’ সুরাইয়ার কণ্ঠ¯ল্ফ ভেসে এল। ‘আমি রেডি।’
আপনমনে মাথা ঝাঁকাল রানা। সুরাইয়া নিশ্চয় ওর সুটটাও
রেডি করে রাখছে, ও যাতে এয়ার লকে পৌঁছেই ঝটপট পরে
নিতে পারে। তখন প্রতিটি সেকেন্ডের উপর নির্ভর করতে পারে
জীবন অথবা মৃত্যু। তবে তার আগে বারাইল্ডি বল্টস্থা না
করলেই নয়।
অ্যালুমিনিয়াম আর কাঠের মিহি গুঁড়ো স্পেস স্টেশন অ্যাবির
মেইন রুমের ভিতর দৃষ্টিসীমা নামিয়ে এনেছে প্রায় শূন্যে। স্থির
হয়ে কান পাতল রানা।
মেনিন ফিসফিস করে কী যেন বলছে। স্ফাতে স্ফাত চেপে হিস
হিস করে উঠল বারাইদি, কথা বলতে নিষেধ করল।
তার শ্-শ্-শ্-শব্দ লক্ষ্য করে লাফ দিল রানা, ছুরি ধরা হাতটা
সামনে বাড়িয়ে ধরেছে।
ছুরির ফলা মাংসের ভিতর জায়গা করে নিল। ব্যথায় গুঙিয়ে
উঠল বারাইদি, হাত থেকে ছুটে গেল ওয়ালথার। অস্পষ্টভাবে
দেখতে পেয়ে পিস্তলটার পিছু নিল রানা।
আলোড়িত ধাতব কণার ভিতর হাতড়াচ্ছে ও। ওয়ালথারটা
পেতেই শরীর মুচড়ে ওখান থেকে সরে আসবার চেষ্টা করল, ঘাড়
ফিরিয়ে তাকিয়ে আছে রুপালি মেঘের দিকে। পর পর দুটো গুলি
করল ও, বারাইজ্ঝিার মেনিনকে ব্যস্ত রাখবার জন্য। তারপর
রওনা হলো এয়ার লকের দিকে।
‘কী করব, মেজর?’ মেনিনের ক্লান্ত কণ্ঠ¯ল্ফ ভেসে এল। ‘এ-
সব আমরা বাতাস থেকে সরাব কীভাবে? ফিল্টারগুলো তো বুজে
যাচ্ছে।’
‘সিস্টেমটা বন্ধ করে দাও। তারপর একটা ম্যাগনেট নিয়ে
এসে বাতাস থেকে ধাতব পাউডার টেনে নাও।’
নিঃশব্দে হাসল রানা। নন-ম্যাগটেনিক বলেই অ্যালুমিনিয়াম
বল্টহর করেছে ও। বারাইদি যে বুদ্ধি আঁটছে তাতে কাজ হবে
না। কল্পনার চোখে মোসাদ এজেন্টকে ভাসমান মেঘের ভিতর
কুঁজো হয়ে থাকতে দেখল ও, আহত হাতটা আরেক হাত দিয়ে
চেপে ধরে আছে, রাগে আর হতাশায় দিশেহারা।
‘রানা,’ আবার সুরাইয়ার গলা ভেসে এল। ‘জলদি!’
এয়ার লকটা পেয়ে ভিতরে ঢুকল রানা। সুটের ভিতর পা
ঢোকাচ্ছে, ওদিকে হাত দিয়ে হুইল ঘুরিয়ে ইভ্যাকিউয়েশন
প্রক্রিয়াও শুরু করে দিয়েছে। সময়ের সঙ্গে প্রতিযোগিতা তুঙ্গে,
এতটুকু দেরিও মর্মান্তিক পরিণতি বয়ে আনতে পারে।
প্রেশার দ্রুত কমে আসছে। রানার মাথায় হেলমেটটা বসিয়ে
দিল সুরাইয়া। আর ঠিক তখনই আউটার ডোর খুলে গেল।
অনন্ত অসীম মহাশূন্য, অর্থাৎ স্পেস-এর দিকে তাকাল রানা।
‘বারাইল্ডি স্পেস ক্যাপসুলে,’ নির্দেশ দিল ও। ‘কুইক!
৮৬
পৃথিবীতে ওরা রেডিও মেসেজ পাঠাবার আগেই ওটায় আমাল্ডে
পৌঁছাতে হবে।’
‘আচ্ছা,’ বলল সুরাইয়া। ‘তুমি ভয় পাচ্ছ নাজাফি স্পেস
সেন্টারকে নির্দেশ দেবে বারাইদিÑক্যাপসুলের নিয়ন্ত্রণ যেন
নিজেল্ডে হাতে তুলে নেয় তারা?’
‘না। ওরা যেন রেডিও বল্টহার করতে না পারে, তার আগেই
এখান থেকে সরে যেতে হবে। দেশলাইয়ের সবগুলো কাঠি আমি
ওল্ডে রেডিও ইউনিটের হাই ভোল্টেজ রিলেতে রেখে এসেছি।’
‘কিন্তু...’ শুরু করল সুরাইয়া।
‘এখন আর কোন কথা নয়। আগে ক্যাপসুলে পৌঁছাই চলো,’
তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল রানা।
‘আ-আমি পারব না, রানা।’ ভয়ে শিউরে উঠল সুরাইয়া।
এয়ার লক ডোর-এর ভিতর দিকটা এমনভাবে আঁকড়ে ধরেছে,
যেন ওটার উপরই নির্ভর করছে তার বেঁচে থাকা বা না থাকাটা।
হেলমেটের ভিতর থেকে বিস্ফারিত চোখের দৃষ্টি লক আর বারাইল্ডি
স্পেসশিপের মাঝখানের ফাঁকটা ধরে প্রসারিত হলোÑলম্বা একটা
ডকিং ডিভাইসের সাহায্যে স্টেশনের সঙ্গে আটকানো ওটা।
স্পেস স্টেশন অ্যাবিতে প্রথম এসেছে খেয়াযান জুবিলি, ফলে
একমাত্র ডকিং বে দখল করে নিয়েছে সেটা। পরে এসে
অগজিলিয়ারি ডিভাইস বল্টহার করতে বাধ্য হয়েছে বারাইদি।
এখন মধল্টর্তী ফাঁকটা আতঙ্কিত করে তুলেছে সুরাইয়াকে।
‘এর আগে তুমি বাইরে বেরিয়েছ। এর মধ্যে ভয় পাওয়ার
সত্যি কিছু নেই,’ বলল বটে রানা, তবে বুঝতে পারছে সুরাইয়ার
ভয় সহজে দূর হওয়ার নয়। তাকে কী করতে হবে, এটা নিয়ে
চিন্তা-ভাবনা করবার প্রচুর সময় পেয়েছে সেÑফাঁকা স্পেস পার
হয়ে পৌঁছাতে হবে বারাইল্ডি শাটল থ্রি স্টারেÑফলে মনের
গভীরে দানা বেঁধেছে সত্যিকার ভয়।
হাতে যথেষ্ট সময় থাকলে ডকিং আর্ম ধরে ধীরে ধীরে দূরত্বটা
পার হতে বলা যেত সুরাইয়াকে, কিন্তু তা নেই। সময়মত থ্রি
স্টারে পৌঁছানোর একমাত্র উপায় হলো জাম্প করা। জাম্পটা
বিপজ্জনকই হবে, কারণ সঙ্গে নাইলনের সেফটি লাইন থাকবে না।
‘আগে বাইরে বেরিয়েছি সেফটি লাইন সহ। ওটা আমাকে
স্টেশনের সঙ্গে আটকে রেখেছিল। কিন্তু এখন শূন্যে লাফ দিয়ে
ভেসে যেতে হবে।’
‘মনে নেই, ডিশটার কাছে যাবার সময় আমার সঙ্গেও সেফটি
লাইন ছিল না?’ নরম সুরে অভয় ত্থেয়ার চেষ্টা করল রানা।
‘ব্যাপারটা হ্যাং গ−াইডিং-এর মত। পার্থক্য শুধু তোমার মুখে
বাতাসের ঝাপটা লাগবে না।
‘তুমি সম্পূর্ণ মুক্ত থাকবে, আর পতনের অনুভূতিটা এখন
যেটা অনুভব করছ তারচেয়ে আলাদা কিছু হবে না। এসো!’ চট
করে একবার পিছন দিকে তাকিয়ে ইনার লক ডোরটা দেখে নিল
ও, ভয় পাচ্ছে ষ্ণাম করে খুলে বাইরে বেরিয়ে আসবে মেজর
বারাইদি।
তা অবশ্য সম্ভব নয়। ওরা যতক্ষণ আউটার ডোর খুলে
রেখেছে, ইনার ডোর খুলবার সাহস হবে না তারÑস্পেস সুট পরা
না থাকলে।
প্রসঙ্গত আরেকটা কথা ভাবল রানা: ওর প−্যানটা কাজ করবে,
কঠিন পরিশ্রমে তৈরি পাউডার শুধু যজ্ঝ্যিাটমসফিয়ারে ভেসে
থাকে।
‘কিন্তু আমার নীচে নিরেট কিছু থাকবে না। পা দুটো
স্টেশনকে ছুঁয়ে আছে। লাফ দিলে কোথাও কিছু আর পাব না...’
বারাইদি হাই পাওয়ার রেডিও রিগ অন করলে কী ঘটবে,
চিন্তা করে শিউরে উঠল রানা। ‘সুরাইয়া, মন দিয়ে শোনো।
আমাল্ডে হাতে একদমই সময় নেই। গোটা স্টেশন বিস্ফোরিত
হতে যাচ্ছে।’
‘আরেকবার বলো।’
৮৭
‘স্টেশনের ভেতরে একটা টাইম বোমা আছে। এ রকম
একটা সময়ে ভয় পাওয়াটা বিলাসিতা। বাঁচতে হলে এই মুহূর্তে
এখান থেকে সরে যেতে হবে...’
‘থামো, পি−জ,’ বাধা দিল সুরাইয়া। ‘টাইম বোমা? কী বলছ?
তোমার সঙ্গে তো কোন বিস্ফোরকই ছিল না...’
রানা বুঝল, সুরাইয়ার সঙ্গে তর্ক করা বৃথা। পিছন থেকে
তাকে হঠাৎ ধাক্কা দিল ও।
সুটের রেডিও থেকে সুরাইয়ার তীক্ষè চিৎকার ভেসে এল।
দেরি না করে তাকে অনুসরণ করল রানা, এয়ার লক ডোরের
কিনারায় জোড়া পায়ের লাথি মেরে।
মারাত্মক ভুলটা উপলব্ধি করবার পর রানার শিরায় শিরায়
যেন বরফ জমতে শুরু করল। এ হলো মহাশূনেদ্দর
অনভিজ্ঞতার ফল। কীভাবে জাম্প করল যে লক্ষ্য থেকে এত দূরে
চলে এল ওরা?
সুরাইয়াকে ধাক্কা ত্থেয়াটা ত্র“টিহীন হয়নি। রানা লাফও
দিয়েছে সুরাইয়াকে যতটুকু ধাক্কা দিয়েছে তারচেয়ে জোরে।
সুরাইয়ার চেয়ে ওর গতি বেশি হয়ে যাওয়ায় তাকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে
ও, দু’জনেই কয়েক গজ দূর থেকে পাশ কাটাচ্ছে থ্রি স্টারকে।
আতঙ্কের গলা টিপে ধরে সুরাইয়ার দিকে তাকাল রানা।
প−াস্টিক হেলমেটের ভিতর তার চোখ দুটো বন্ধ দেখল। কোমরটা
জড়িয়ে ধরে মেয়েটিকে নিজের দিকে টেনে নিল ও।
‘শোনো,’ দ্রুত বলল রানা। ‘আমার ভুল হয়েছে। দু’গজ দূর
থেকে ক্যাপসুলকে পাশ কাটিয়ে এসেছি আমরা।’
রানার আলিঙ্গনের ভিতর শরীরটা মুচড়ে তাকাল সুরাইয়া।
ওল্ডে পিছনে ধীরে ধীরে আকারে ছোট হয়ে যাচ্ছে
স্পেসক্রাফট থ্রি স্টার, পৃথিবীতে ফিরে যাওয়ার একমাত্র বাহন।
কোন সন্দেহ নেই যে ওল্ডে কপালও সেই অ্যাস্ট্রনটের মত
পুড়েছে, রানা যাকে স্টেশন থেকে বাইরে ছুঁড়ে দিয়েছিল।
অক্সিজেন শেষ না হওয়া পর্যন্ত ভেসে বেড়াবে ওরা, তারপর
ধীরে ধীরে দম বন্ধ হয়ে মারা যাবে। কিংবা, সেই লোকটার মত,
অনন্ত অসীম শূন্যতায় নিজেল্ডে ফেসপে−ট খুলে ফেলতে পারে,
মৃত্যুকে বরণ করে নিতে পারে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে।
সতেরো
‘কিন্তু আমরা তো স্টেশনে ফিরে যেতে পারি! আমাল্ডে সেফটি
লাইন...’ হঠাৎ মনে পড়ে যাওয়ায় সুরাইয়ার গলাটা ধীরে ধীরে
বুজে এলÑথ্রি স্টারের উদ্দেশে লাফ ত্থেয়ার জনদ্দল্ডে সেফটি
লাইন খুলে নিয়েছে রানা।
‘মহাশূন্যে সব কিছু অন্য নিয়মে ঘটে। আমরা বাইরের দিকে
যাচ্ছি, ঠিক যে ভেলোসিটিতে আমার পা দুটো আমাকে স্টেশন
থেকে লঞ্চ করেছিল।’
‘তারমানে আমরা মৃত, ধরে নেব?’ ¤−ান সুরে জিজ্ঞেস করল
সুরাইয়া। আশ্চর্য শান্ত লাগছে তাকে। মনে মনে তার প্রশংসা
করল রানা।
‘যতক্ষণ শ্বাস ততক্ষণ আশ,’ বিড়বিড় করল রানা। ভাবছে।
ম্যাগনিফাইং গ−াস দিয়ে তৈরি ডিশ আর অ্যাবি স্পেস স্টেশন
ধ্বংস করবার প−্যান দুটোকে ভালই বলতে হবে, নিজের পিঠ
চাপড়াবার মত। ঘাড় ফিরিয়ে স্টেশনের দিকে তাকাল ও, লম্বা
চকচকে ধাতব সিলিন্ডার এখনও অটুট। বারাইদি কী কারণে কে
জানে হাই ভোল্টেজ রেডিও রিগ অন করেনি। করলে
দেশলাইয়ের কাঠিগুলো জ্বলবে, তারপরইÑবুম!
৮৮
‘আমাল্ডে এখন একটা রকেট ল্ডকার,’ বলল সুরাইয়া। তার
দৃষ্টি মিছে আশায় নিজেল্ডে সুটে নেমে এল, বেল্টে যদি একটা
ঈড়২ ম্যানুভারিং জেট দেখতে পায়। থাকবার কথা নয়, কাজেই
নেই।
‘কী বললে তুমি?’
‘একটা রকেট। আমাল্ডে একটা রকেট ল্ডকার।’
‘আছে তো! ইস্, এত বোকা হলাম কী করে!’ সুটের নীচের
দিকে হাত লম্বা করল রানা। চেইন লাগানো একটা পকেট থেকে
ওয়ালথারটা বের করল।
জ্বলজ্বলে একটা নক্ষত্রের দিকে সরাসরি এগোচ্ছে ওরা।
হাতের পিস্তল তুলে সেটায় লক্ষ্যস্থির করে ট্রিগার টানল রানা।
কিছু ঘটছে বলে মনে হলো না। আবার গুলি করল রানা।
আবার। আবার। একে একে পাঁচটা গুলি করল, যেন বহু দূর
নক্ষত্রের গায়ে নিখুঁত একটা প্যাটার্ন তৈরি করতে পারবে।
‘কিছু ঘটছে না, রানা। কাজ হয়নি।’
রানা অনুভব করল, সুরাইয়া ওকে আরও শক্ত করে জড়িয়ে
ধরল। তবে ভুল হয়েছে তার। ওর প্রিয় অস্ত্র দায়িত্ব পালন
করেছে।
আরেকটা তারার দিকে তাকিয়ে রয়েছে রানাÑপৃথিবীর
অ্যাস্টমসফিয়ার-এর ঝাপসা কিনারায়। তারাটার ধারাল রশ্মি
সামান্য নড়ে যাচ্ছে ওল্ডে অবস্থান বদলের কারণে। খানিক পর,
এমনকী সুরাইয়াও বুঝতে পারল যে ওরা স্পেস স্টেশনের দিকে
ফিরে যাচ্ছে।
একটা বিপদ কাটতে না কাটতে আরেকটাকে নিয়ে মাথা
ঘামাতে হচ্ছে। রানা জানে না আদৌ এটাকে এড়াবার সময়
পাওয়া যাবে কি না।
সন্দেহ নেই নিজেল্ডেকে এতক্ষণে সামলে নিয়েছে বারাইজ্ঝিার মেনিন। পরবর্তী নির্দেশের জন্য যে-কোন মুহূর্তে পৃথিবীর
সঙ্গে যোগাযোগ করবে তারা। সেটা ঘটবার আগে থ্রি স্টারে চড়ে
দূরে সরে যেতে হবে ওল্ডেকে।
সময় পেরুচ্ছে যন্ত্রণাদায়ক অলস ভঙ্গিতে। ধীরে ধীরে ওল্ডে
দিকে এগিয়ে আসছে স্পেসক্রাফট থ্রি স্টার। মহাশূন্যে এই
ব্যাপারটা রানার খুব আশ্চর্য লাগে। গতি আন্দাজ করবার জন্য কোন রেফারেন্স পয়েন্ট না থাকায়, মনে হয় ওরা স্থির হয়ে আছে,
এগিয়ে আসছে থ্রি স্টারই।
তবে সময় মত ওটায় ওরা উঠতে পারলে এ-সবে কিছু আসে
যায় না। কোর্স সামানল্টদলাবার জনঞ্জারেকটা গুলি করল
রানা। এবার সরাসরি স্পেসক্রাফটের দিকে এগোচ্ছে।
প্রথমে নিজে ঢুকল রানা, তারপর খোলা হ্যাচে টেনে নিল
সুরাইয়াকে। খেয়াযান জুবিলির চেয়ে থ্রি স্টার আকারে বড়।
এটায় পাঁচজন অ্যাস্ট্রনটের বসবার বল্টস্থা আছে। প্যাসেঞ্জার
কমপার্টমেন্টের পিছনেই বড়সড় স্টোরেজ স্পেস। রানা ধারণা
করল, এটা একটা নতুন মডেল।
কন্ট্রোল প্যানেলের সামনে কাউচে বসল রানা। প্যানেল
পরীক্ষা করে একাধারে স্বস্তিবোধ করল, আবার দুশ্চিন্তাতেও
পড়ল।
থ্রি স্টারের প্যানেল ডিজাইন হুবহু জুবিলির মতই। জুবিলির
ফুয়েল লাইন খোঁজাখুঁজি আর ফায়ারিং সুইচ নাড়াচাড়া করে
কীভাবে ইঞ্জিন স্টার্ট দিতে হবে, তা রানার জানা হয়ে গেছেÑস্বস্তি
বোধ করবার এটাই কারণ।
আর দুশ্চিন্তায় পড়বার কারণ হলো, প্যানেলে সাংকেতিক
চিহ্ন বল্টহার করায় কীভাবে কোর্স বদলাতে হবে, পৃথিবীর
অ্যাটমসফিয়ারে রিএন্ট্রির পদ্ধতি, কীভাবে ল্যান্ড করবে ইত্যাদি কিছুই রানার জানা নেই।
তারপর দেখা গেল, আরও একটা ব্যাপার জানা নেই ওর,
ফলে ইঞ্জিন স্টার্ট নিলেও থ্রি স্টার নড়ছে নাÑডকিং আর্ম শক্ত
৮৯
করে ধরে রেখেছে ওটাকে।
‘এ আবার কী মুসিবত, রানা? লক না খুললে আমরা ছাড়া
পাব না।’
প্যানেলের সুইচগুলো এক এক করে অন-অফ করে দেখতে
পারে রানা, ভাগ্যক্রমে তালাটা যদি খুলে যায়। কিন্তু তাতে ঝুঁকি
আছে মারাত্মকÑথ্রি স্টার অচল বা অকেজো হয়ে যেতে পারে,
এমনকী বিস্ফোরিত হওয়াও বিচিত্র কিছু নয়।
আর যদি এমন হয় যে লকিং আর্ম শুধু স্পেস স্টেশন অ্যাবির
দিক থেকে অপারেট করা যায়, তা হলে মোসাদ এজেন্ট
বারাইল্ডি হাতে বন্দি হয়ে আছে ওল্ডে নিয়তি।
‘এটা জীবন-মরণ সমস্যা, সুরাইয়া। কাজেই জুয়া খেলতে
হয়।’ স্পেস সুটে ফিট করা রেডিও লিঙ্ক অন করল রানা, তারপর
ডাকল: ‘বারাইদি? আমি রানা। আমরা তোমার ক্যাপসুলের
ভেতর।’
‘আমি সুট পরেছি, রানা। এক মুহূর্তের জনেল্টাইরে বেরুব।
তুমি পালাতে পারবে না,’ বারাইল্ডি কণ্ঠ¯ল্ফ নিস্তেজ শোনাল
রানার কানে। সে-ও নিজের স্পেস সুটের রেডিও বল্টহার
করছে। মনে মনে অভিশাপ দিল রানা। ওর আশা পূরণ করবার
জনল্টারাইদিকে স্টেশনের হাই পাওয়ার রেডিওটা অন করতে
হবে।
‘ব্যাপারটা নিয়ে তুমি শুধু শুধু দুশ্চিন্তা করছ, বারাইদি।
আমরা এরইমধ্যে পৃথিবীর পথে রওনা হয়ে গেছি। আমি শুধু
তোমাকে গুডবাই জানাতে চাইছিলাম।’
‘থ্রি স্টারকে তুমি ল্যান্ড করাতে পারবে না,’ হিসহিস করে
বলল বারাইদি। ‘ওটা শুধু গ্রাউন্ড থেকে কন্ট্রোল করা যায়।’
‘ওরা জানবে কীভাবে যে থ্রি স্টার নিয়ে আমরা নামছি?’
হাসল রানা। ‘চেষ্টা করে দেখতে পারো, পৃথিবীর সঙ্গে তুমি
যোগাযোগ করতে পারবে নাÑস্টেশনের রেডিওটা আমি নষ্ট করে
দিয়ে এসেছি। বিদায়, বারাইদি।’
কাউচে হেলান দিল রানা। অপেক্ষা করছে। ভাবছে কখন
রেডিওটা পরীক্ষা করবে সে।
তারপর ব্যাপারটা ঘটল। নিঃশব্দ বিস্ফোরণে স্পেস স্টেশন
অ্যাবি টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে পড়ল। উড়ন্ত শ্র্যাপনেল ওল্ডে
স্পেসক্রাফট ফুটো করে দিতে পারে। তবে সে রকম কিছু ঘটল
না। ডকিং আর্মটা ভেঙে বেরিয়ে এল স্টেশন থেকে, সেটাকে
নিয়েই ছুটল থ্রি স্টার।
‘কী হলো রানা?’ স্পেস স্টেশন অ্যাবিকে চোখের সামনে
ধ্বংস হতে দেখছে সুরাইয়া, ভয়ে বিস্ফোরিত হয়ে উঠল চোখ
দুটো।
‘বাতাসে আমরা যে গুঁড়ো উড়িয়ে দিয়েছিলাম। অ্যালুমিনিয়াম
আর কাঠের গুঁড়ো। সব আগুন ধরে গেছে।’
‘কিন্তু মনে আছে, স্টোররুমে ওগুলোয় আমি আগুন ধরাতে
চেষ্টা করে পারিনি?
‘তোমার মনে আছে, আমি বলেছিলামÑতুমি এখনও পৃথিবীর
নিয়মে চিন্তা-ভাবনা করছ? এটা মহাশূন্য। ওজনহীনতা।’
‘অর্থাৎ?’
‘পৃথিবীতে সারাক্ষণ আমরা ধানকল চালাচ্ছি। ধানের ধুলো
বাতাসে ভেসে থাকে, আগুনের ফুলকি লাগলে ওগুলো জ্বলবে।
কিন্তু ধান নিজে জ্বলবে না।’
‘কেন?’
‘সবই জ্বলবে, সেটা যদি যথেষ্ট ছোট হয় এবং জ্বলার জন্য সহায়ক যথেষ্ট অক্সিজেন থাকে।’ এরপর রানা ব্যাখ্যা করল,
স্পেস স্টেশনের অ্যাটমসফিয়ারে গুঁড়োগুলো দুটো কারণে
ছেড়েছিল ওÑনিজেল্ডে পালানোটা আড়াল করতে আর স্পেস
স্টেশনটাকে ধ্বংস করতে।
দোমড়ানো-মোচড়ানো ধাতব আবর্জনা ছাড়া স্পেস স্টেশনের
৯০
আর কিছু অবশিষ্ট নেই। মাত্র কয়েক কিলোগ্রাম ধুলোর কাজ।
সম্ভব বলে বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে না, অথচ ওল্ডে চোখের
সামনেই ঘটেছে।
‘রানা, আমি অসুস্থবোধ করছি। হ্যাচ দিয়ে বাইরে তাকাও।’
‘উপরে’ তাকাল রানা, দেখল কী কারণে সুরাইয়া অসুস্থবোধ
করছে। বিস্ফোরণের ফলে থ্রি স্টার বাইরের দিকে ছিটকে
পড়েছিল, তারপর উন্মত্ত একটা ভঙ্গিতে ডিগবাজি আর পাক
খেতে শুরু করেছে। পৃথিবী এমন অদ্ভুত সব আকৃতি নিয়ে
বারবার পাশ কাটাচ্ছে, রানা নিজেও দৃষ্টিবিভ্রমের শিকার হলো।
সব ঠিকঠাক বুঝতে পারবার জন্য চোখ বন্ধ করে ঢোক গিলতে
হলো ওকে।
‘আমরা কঠিন বিপদেই পড়েছি, সুরাইয়া। আমার বসকে
একটা মেসেজ পাঠিয়েছিলাম ঠিকই, বিসিআই হয়তো উত্তর
কোরিয়ার অরবিটিং স্যাটেলাইটকে মেসেজ রিসিভ করবার জনেঞ্জনুরোধও করেছে,’ সুটের আরেকটা পকেট থেকে ঝরণা কলমটা
বের করল রানা, জানে না এত ছোট একটা রেডিও মহাশূনেঞ্জাদৌ কাজ করবে কিনা, ‘কিন্তু ওরা কী আমাল্ডেকে ল্যান্ড করার
ব্যাপারে সাহায্য করতে পারবে? প্যানেলে তো শুধু সাংকেতিক
চিহ্ন বল্টহার করা হয়েছেÑআমরা এগুলোর অর্থ না জানলে
বিসিআই জানবে কীভাবে?’
‘রানা, এ-সব কথা পরে ভেবো। আমার মাথা ঘুরছে...’
‘স্ফাড়াও, কেবিনটাকে প্রেশারাইজ করতে দাও।’ প্যানেলের
উপর দ্রুত বার কয়েক চোখ বুলাল রানা। একটা গজ চোখে
পড়ল, অ্যাটমাসফেরিক প্রেশার মাপে। এয়ার সিস্টেমের স্টপকক
খুলতে কাঁটাটা ধীরে ধীরে উপরে উঠতে শুরু করল। ফেসপে−ট
খুলে দেখো খানিকটা রিল্যাক্স হতে পারো কিনা।’
ইতস্তত একটা ভঙ্গিতে হেলমেট খুলল সুরাইয়া। শ্বাস নিতে
তার কোন সমস্যা হচ্ছে না।
কলমটা খুলল রানা। নিবের মাথায় লেগে থাকা সরু তারটা
টেনে লম্বা করলÑইঞ্চি দেড়েক লম্বা এরিয়াল। এরপর কলমের
নীচের অংশটা ধরে দু’বার মোচড়াল। নর্থ কোরিয়ান
স্যাটেলাইটের নাগাল পাবার জন্য যথেষ্ট ইলেকট্রিক্যাল পাওয়ার
তৈরি হলো।
টেলিগ্রাফিক কী অপারেট করে মেসেজ পাঠাচ্ছে রানা,
তাড়াতাড়ি সাড়া পাবার জন্য কোড নয়; সহজবোধল্টাংলা
বল্টহার করছে।
প্রায় কোন সময়ই লাগল না, এক মুহূর্ত পরই ঘরঘর করে
উঠল থ্রি স্টারের স্পিকার।
‘ফ্রিকোয়েন্সি বদলাও, মোড টোয়েনটি-থ্রিতে সেট করো,
রানা।’ পরিষ্কার বাংলায় বলা হলো কথাটা। গলার আওয়াজ চেনা
চেনা লাগলেও, যান্ত্রিক বলে চিনতে পারল না রানা।
তাড়াতাড়ি ফ্রিকোয়েন্সি বদলে রেডিও রিঅ্যাডজাস্ট করল ও।
তারপর আবার ভেসে এল সেই একই কণ্ঠ¯ল্ফ: বিধির কী
অপূর্ব বিধান, আল−াহর কী মধুর মহিমা! জীবনে অন্তত একবার
হলেও পরম শত্র“র সাহায্য নিয়ে প্রাণ বাঁচাতে হয় এসপিওনাজ
জগতের জীবিত কিংবদন্তি মাসুল্ডানাকে। কি, ঠিক বলিনি?’
‘কে...কবীর চৌধুরী?’ গলার আওয়াজ চিনতে পেরে রানার
বুকের রক্ত ছলকে উঠল। সর্বনাশ, শেষ পর্যন্ত বদ্ধ উন্মাদ্মার
হাতে পড়তে যাচ্ছে ও?
‘হ্যাঁ, কবীর চৌধুরীইÑসেই আদি এবং অকৃত্রিম কবীর
চৌধুরী। কিন্তু তুমি আমার প্রশ্নের জবাব দাওনি, রানা। অন্তত
স্বীকার করো যে বিপদে পড়েছ, তোমার সাহায্য ল্ডকার।’
‘বিপদে পড়েছি, জানি। কিন্তু এটা তুমি কোন্ আক্কেলে ধরে
নিলে যে এত থাকতে তোমার কাছে সাহায্য চাইব? আমি
বিসিআই-এর সঙ্গে যোগাযোগ করতে চাইছিলাম। ওল্ডে সাহায্য নিয়ে ঠিকই পৃথিবীতে ফিরে যেতে পারব...’
৯১
‘না, ওরা তোমাকে কোনই সাহায্য করতে পারবে না,’
রানাকে থামিয়ে দিয়ে বলল কবীর চৌধুরী। ‘কারণ তোমরা যে
ক্যাপসুলে রয়েছ, এই মডেলটা একদম নতুন। এটা সম্পর্কে
বিসিআই এক্সপার্টরা কিছুই জানে না। শুধু ওরা কেন, নাসার
ইঞ্জিনিয়াররা ছাড়া খুব কম লোকই জানে। আর জানি আমি।
কারণ, আমিই ডিজাইন করেছি মডেলটার। বিলিভ ইট অর নট,
নাসা আমার ডিজাইন চুরি করে নিজেল্ডে বলে চালাচ্ছে।’
মনে মনে দমে গেল রানা। থ্রি স্টারের ডিজাইন সত্যি যদি কবীর চৌধুরীর করা হয়ে থাকেÑসেটা অসম্ভব নয়Ñতা হলে খুব
কঠিন বিপদেই পড়েছে ও। আর কেউ যেহেতু ওকে সাহায্য করতে পারবে না, কবীর চৌধুরী নিশ্চয়ই ওকে নিয়ে ভারী নোংরা
কোনও খেলা খেলতে চাইছে।
সাহায্য করবার কথা বলে মোটা টাকা মুক্তিপণ চাইবে সে।
বিসিআই যদ্মিাকা দেয়, সেটা নিয়ে কেটে পড়বে। তার আগে,
রিএন্ট্রির সময়, থ্রি স্টারকে পৃথিবীর অ্যাটমসফিয়ারে সে ক্র্যাশ
করাতে পারে, কিংবা রিমোটের সাহায্যে থ্রি স্টারে লুকিয়ে রাখা
বোমাটা দিতে পারে ফাটিয়ে।
ক্ষীণ, তিক্ত হাসি ফুটল রানার ঠোঁটের কোণে। কবীর চৌধুরী
ওকে সাহায্য করতে চায় আর কুমিরের চোখে জলÑদুটো সমার্থক
বলে মনে হচ্ছে। ‘আসল কথাটা বলে ফেলো, কবীর চৌধুরী,’
বলল রানা। ‘কী চাও তুমি?’
‘কিচ্ছু না, রানা, বিশ্বাস করো, কিচ্ছু চাই না। এটা আমার
সাহায্য করতে চাওয়ার নিঃস্বার্থ প্রস্তাব। যদি জিজ্ঞেস করো কেন,
তা হলে সত্যি কথাটা বলতে হবে। কিন্তু সেটা এত তেতো যে
শুনতে তোমার ভাল লাগবে না, তাই বলছি না।’
‘তবু আমি শুনতে চাই,’ বলল রানা, গলায় শে−ষ।
‘সাহায্য করতে চাইছি এই জন্যে যে তা না হলে তুমি বাঁচবে
না। কথাটা বিশ্বাস কোরো। আল−াহ বাèের্তমান পরিস্থিতিতে
একমাত্র আমিই শুধু তোমাকে বাঁচাতে পারি।’
‘তোমার এ-সব বড়াই আমি শুনতে চাই না। কারও সাহায্য কেন আমার ল্ডকার, সেটা আগে বলো। আমি নিজে যদি কন্ট্রোল প্যানেল অপারেট করে বঙ্গোপসাগরে নামি, কে আমাকে
বাধা দেবে?’
‘সাবধান, রানা, সাবধান! ভুলেও সে রকম কিছু করতে যেয়ো
না। সাংকেতিক চিহ্নগুলোর অর্থ যে জানে না, তার জন্যে কন্ট্রোল
প্যানেলে হাত ছোঁয়ানো রীতিমত পাপÑআত্মহত্যার সামিল। থ্রি
স্টারে বোমা আছে, ওটা ফেটে যেতে পারে।’
বোমা জুবিলিতেও ছিল, ছিল অক্সিজেন বটলগুলোর কাছে,
অ্যাস্ট্রনটল্ডে নাগালের মধ্যে। কবীর চৌধুরীর সঙ্গে কথা শুরু
হবার পর থ্রি স্টারের সেই একই জায়গায় হাতড়েছে রানা, কিন্তু
কিছু পায়নি। ‘বোমা আছে? কোথায়?’ জিজ্ঞেস করল ও।
‘ভয় নেই, রানা। ইজরায়েলিরা ওই বোমা রিমোটের সাহায্যে ফাটাতে পারবে না,’ আশ্বাস ত্থেয়ার সুরে বলল কবীর চৌধুরী।
‘ওরা গ্রাউন্ড থেকে থ্রি স্টারকে নিয়ন্ত্রণও করতে পারবে না।
ওল্ডে কোন সিগন্যালই থ্রি স্টারে পৌঁছাবে না, ফ্রিকোয়েন্সি
এমনভাবে জ্যাম করে দিয়েছি।’
‘তুমি বোধহয় সত্যি কথাটা এখনই বলতে রাজি নও, তাই
না? তবে যদি ভেবে থাকো মুক্তিপণ বা কোন সুবিধে আদায়
করবে, ভুলে যাও...’
‘বিলিভ মি, ম্যান! এটা আমার নিঃস্বার্থ প্রস্তাব।’
‘এ আমি বিশ্বাস করি না।’
শুনে রানাকে অবাক করে দিয়ে হাসল কবীর চৌধুরী।
‘আসলে, এটাকে ঠিক প্রস্তাব বলা যায় না।’
‘মানে?’
‘মানে, এখানে তোমাকে কিছু বিবেচনা করতে বলা হচ্ছে না।
বলতে চাইছি, তুমি যজ্ঝিামার সাহায্য না চাও, তাও আমি
৯২
তোমাকে সাহায্য করব। হ্যাঁ, তোমার ইচ্ছের বিরুদ্ধেই, রানা।
কারণ তোমাকে বাঁচিয়ে রাখাটা আমার খুব ল্ডকার।’
‘আমাকে বাঁচিয়ে রাখাটা তোমার ল্ডকার?’ রানা ঠিক বুঝতে
পারছে না হাসবে না কাঁদবে।
‘কি জানো, রানাÑঅন সেকেন্ড থট, তোমাকে বাঁচাতে
চাওয়ার আমার এই ইচ্ছেটা নিঃস্বার্থও নয়। মনে হতে পারে আমি
আবেগের বশে কথাটা বলছি, কিন্তু তা সত্যি নয়Ñতুমি যেমন
আমাকে ছাড়া অসম্পূর্ণ, রানা, তেমনি আমিও তোমাকে ছাড়া
অসম্পূর্ণ।’
‘বলছিলে আমাকে সাহায্য করতে চাওয়ার পিছনে তোমার কী
যেন স্বার্থ আছে। কী সেটা?’ জানতে চাইল রানা।
‘এক কথায় বলি?’
‘বলো।’
গম্ভীর কণ্ঠে কবীর চৌধুরী বলল, ‘আমার জীবনের বড় একটা
মজা হলো তোমার উপকার করাÑতুমি মরে গেলে সেই মজা
থেকে আমি বঞ্চিত হব, তাই তুমি না চাইলেও তোমাকে আমি
বাঁচাব।’
রানা ভাবল, এ তো দেখছি সত্যি পাগল!
‘বোমাটা কোথায়?’ প্রসঙ্গটা ভোলেনি ও।
‘নতুন এই মডেলে বোমাটা এমন জায়গায় রাখা হয়েছে,
কষ্টসাধ্য স্পেস ওয়াকিং ছাড়া সেটার নাগাল পাবে না
অ্যাস্ট্রনটরাÑতার আগে সার্চ করে বের করতে হবে কোথায় ওটা
আছে। চিন্তা কোরো না, ওটা ফাটবে না।’
‘তো, স্বার্থপর বন্ধু, এখন আমাকে কী করতে হবে?’
‘কিছু না, শুধু কয়েকটা নির্দেশ ঠিক মত পালন করো,’ বলল
কবীর চৌধুরী। ‘কন্ট্রোল প্যানেলের বাঁ দিকে তাকাও। দেখো
একটা তার আছে, লাল-সাদা ডোরাকাটা। ওটা ছিঁড়ে জোড়া
লাগাও...’
কবীর চৌধুরীর প্রতিটি নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করে
যাচ্ছে রানা। দশ মিনিটও পার হয়নি, কন্ট্রোল প্যানেলে রানার
কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হলো।
‘রিএন্ট্রি নিয়ে কোন চিন্তা নেই,’ ওকে অভয় দিয়ে বলল
কবীর চৌধুরী। ‘আমার ইচ্ছে নয় পুড়ে ছাই হয়ে যাও তোমরা।
তবে আরও এক ঘণ্টা কক্ষপথে ঘোরো, তারপর নামিয়ে আনব।
ভাল কথা, বঙ্গোপসাগরেই নামছ তোমরা। সু›ল্ডবনের ধারে।’
‘আচ্ছা,’ হঠাৎ প্রশ্ন করল রানা, ‘তুমি জানলে কীভাবে
কোথায় আছি আমি? আমার বিপদ, এটাই বা কে বলল
তোমাকে?’
‘প্রশ্নটা বোকার মত হয়ে গেল না?’ হাসল কবীর চৌধুরী।
‘স্পেসে আমার যে একটা স্টেশন আছে, এটা তো একটা ওপেন
সিক্রেট। এই মুহূর্তে উত্তর কোরিয়ান একটা খেয়াযানে রয়েছি
আমি, রানা, তোমার...পঞ্চাশ মাইল পিছনে। শক্তিশালী
টেলিস্কোপে থ্রি স্টারকে আমি দেখতেও পাচ্ছি।’
এক ঘণ্টা পর রিএন্ট্রি। প্রচণ্ড ঝাঁকি খেলেও, কোন রকম
সমস্যা হলো না।
কবীর চৌধুরীর নির্দেশ মত কন্ট্রোল প্যানেল অপারেট করে
থ্রি স্টারকে অনায়াসে বঙ্গোপসাগরে নামিয়ে আনল রানা।
‘ওটা কী?’ হ্যাচ খুলে বাইরে মাথা বের করেই চেঁচিয়ে উঠল
সুরাইয়া।
তার পাশ থেকে মাথা তুলল রানাও। নোঙর ফেলা একটা
ত্রিশ ফুটি ইয়ট ঢেউয়ের দোলায় দুলছে।
‘কী সু›ল্ড! তোমার বন্ধুকে একটা ধনল্টাদ দেবে না?’
সুরাইয়ার কথায় যেন সংবিৎ ফিরে পেল রানা। খুদে রেডিওটা মুখের সামনে তুলে ডাকল ও, ‘চৌধুরী?’
অপরপ্রান্ত থেকে কোন সাড়া পাওয়া গেল না। অনেক আগেই
যোগাযোগ কেটে দিয়েছে পাগল বৈজ্ঞানিক।
৯৩
গভীর একটা দীর্ঘশ্বাস চাপল রানা। কবীর চৌধুরী সম্ভবত
ইচ্ছে করেই কৃতজ্ঞতা প্রকাশের সুযোগটা দিল না ওকে।
***
গল্পটির বিষয়ে মন্তব্য করুন
গল্পটির বিষয়ে মন্তব্য করতে আপনার একাউন্টে প্রবেশ করুন ... ধন্যবাদ... Login Now