বাংলা গল্প পড়ার অন্যতম ওয়েবসাইট - গল্প পড়ুন এবং গল্প বলুন

বিশেষ নোটিশঃ সুপ্রিয় গল্পেরঝুরিয়ান - আপনারা যে গল্প সাবমিট করবেন সেই গল্পের প্রথম লাইনে অবশ্যাই গল্পের আসল লেখকের নাম লেখা থাকতে হবে যেমন ~ লেখকের নামঃ আরিফ আজাদ , প্রথম লাইনে রাইটারের নাম না থাকলে গল্প পাবলিশ করা হবেনা

আপনাদের মতামত জানাতে আমাদের সাপোর্টে মেসেজ দিতে পারেন অথবা ফেসবুক পেজে মেসেজ দিতে পারেন , ধন্যবাদ

" ষোল নম্বর ফটিক ঘোষ "(৪)

"উপন্যাস" বিভাগে গল্পটি দিয়েছেন গল্পের ঝুরিয়ান mim (০ পয়েন্ট)

X লেখক:শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় রাস্তায় এসে হাঁটতে হাঁটতে ফটিক বলল,“তোর কি দুর্জয় সাহস? ডাইনির ডেরায় কোন সাহসে ঢুকলি, যদি পাঁকে পুতে ফেলত বা গোরু ভেড়া করে দিত?” “ধুস! গোরু ভেড়া হতে যাব কেন? আমি একটা সাদা ঘোড়া হয়ে যাচ্ছিলাম। সেসব কথা পরে হবে। ওই দ্যাখ, অষ্টভুজার মন্দির।” ফটিক বলল, “ওখানে আর দাঁড়ানোর দরকার নেই। চল দৌড়ে পেরিয়ে যাই।” নিতাইয়ের এখন সাহস খুব বেড়ে গেছে। বলল, “পালাব কেন? সব দেখেশুনে নেওয়া ভাল, অভিজ্ঞতায় জ্ঞান বাড়ে।” অষ্টভুজার মন্দির হেসেখেলে এক-দেড়শো বছরের পুরনো হবে। চারদিকে মস্ত মস্ত বটগাছ। বটের ঝুরি নেমে জায়গাটা এই বিকেলবেলাতেও অন্ধকার করে রেখেছে। মন্দিরের চত্বরে ঢুকতেই তারা শুনতে পেল একটা গুরুগম্ভীর গলা মন্দিরের ভেতর থেকে বলছে, “মা! মা! নররক্ত চাই মা করালবদনী? নরবলি চাস মা? আজ অমাবস্যার রাতেই নরবলি দেব মা!” ফটিকের মুখ শুকিয়ে গেল। কাঁপা গলায় বলল, “শুনছিস?” নিতাই বলল, “শুনছি, কিন্তু ভয় খাস নে। লোকটাকে একটু বাজিয়ে দেখতে হবে।” এই বলে নিতাই হঠাৎ বিকট একটা হাঁক মারল, “ঠাকুরমশাই আছেন নাকি? ঠাকুরমশাই!” ভেতরে গুরুগম্ভীর গলাটা হঠাৎ থেমে গেল। একটু বাদে যে লোকটা মন্দির থেকে বেরিয়ে এল তাকে দেখে ফটিকের মুর্ছা যাওয়ার জোগাড়। ঘাড়ে গর্দানে বিশাল চেহারা, পরনে টকটকে লাল রক্তাম্বর, গলায় রুদ্রাক্ষের মালা, কপালে তেল সিঁদুরের ত্ৰিশূল আঁকা, চোখ দুখানা ভাঁটার মতো জ্বলছে। বজ্ৰগম্ভীর স্বরে লোকটা জিজ্ঞেস করল, “তোমরা কারা? কী চাও?’ নিতাই বেশ গলা তুলে বলে উঠল, “পেন্নাম হই ঠাকুরমশাই! তা অনেকদূর থেকে আসছি। শুনলুম এই অষ্টভুজার মন্দিরে নিয়মিত নরবলি হয়। সেই শুনেই আসা।” লোকটা বলল “অত চেঁচামেচি করার দরকার নেই। ওতে মায়ের বিশ্রামের ব্যাঘাত হয়।” নিতাই গলা একটুও না নামিয়ে ফের চেঁচিয়ে বলল, “বড় আশা করে এসেছি যে ঠাকুরমশাই। এসেই শুনতে পেলুম আপনি আজ রাতেই মায়ের সামনে নরবলি দেবেন। আমাদের ভাগ্যটা ভালই, কী বলেন?” লোকটা অস্বস্তি বোধ করে চারদিকে চেয়ে নিয়ে চাপা গলায় বলল, “তোমরা ভুল শুনেছ।” নিতাই দুঃখের গলায় বলল, “এঃহেঃ, এতবড় একটা ভুল খবর পেয়ে এতদূর এলাম। নরবলি দেখার যে খুব সাধ ছিল মশাই!” লোকটার চোখ হঠাৎ ঝিলিক দিয়ে উঠল, বজ্রনির্ঘোষে বলে উঠল, “দেখতে চাও?’ নিতাই কিছু বুঝে ওঠার আগেই হঠাৎ কোথা থেকে দুটো মুশকো লোক এসে দুদিক থেকে ধরে তাকে পেড়ে ফেলল। তারপর চোখের পলকে হাত দুটাে পিছমোড়া করে আর পা দুটােও বেঁধে তাকে হাড়িকাঠে উপুড় করে ফেলে গলার কাছে খিলটা আটকে দিল। জবরদস্ত লোকটা চেঁচাচ্ছিল, “ওরে তাড়াতাড়ি কর! তাড়াতাড়ি কর! সতীশ দারোগা এসে পড়বে।” দুটো মুশকো লোক, একজন দৌড়ে গিয়ে একটা ঢাক নিয়ে এসে ট্যাং ট্যাং করে বাজাতে লাগল, অন্যজন একখানা চকচকে খাঁড়া এনে বনবন করে ঘোরাতে ঘোরাতে “জয় মা, জয় মা অষ্টভুজা! জয় মা নৃমুণ্ড-মালিনী” বলে নিতাইয়ের চারদিকে লাফিয়ে লাফিয়ে ঘুরতে লাগল। ঠাকুরমশাই উচ্চস্বরে বলির মন্ত্র পড়ছেন আর মাঝে মাঝে বলে উঠছেন, “নররক্ত চাই মা? নরবলি চাই মা? তোর ইচ্ছেই পূর্ণ হোক।” মন্ত্র পড়া শেষ করে ঠাকুরমশাই বলে উঠলেন, “তাড়াতাড়ি কেটে ফেল বাবা, সতীশ দারোগা কখন হানা দেয় তার ঠিক নেই।” যে ঢাক বাজাচ্ছিল সে দৌড়ে গিয়ে একটা মাটির সরা এনে নিতাইয়ের মুখের নীচে পেতে দিল, বোধ হয় এতে করেই কাটা মুণ্ডুটা নিয়ে গিয়ে অষ্টভুজাকে ভোগ দেবে। দ্রিমি দ্রিমি করে ঢাক বাজতে লাগল। নিতাইয়ের মনে পড়ল, বলির সময়ে এরকম বাজনাই বাজে বটে। ভয়ে সে চোখ বুজে ফেলল। নাঃ, অষ্টভুজার মন্দিরের কাপালিককে চটানোটা বড্ড আহাম্মকিই হয়ে গেছে। ঠাকুরমশাই জলদগম্ভীর গলায় বলে উঠলেন, “জয় মা! এবার ঘ্যাচাং করে দাও হে গদাইচাঁদ।” “আজ্ঞে বাবা।” বলেই খাঁড়াটা ওপরে তুলল বলাই। খাঁড়াটা নেমেও এল বটে, তবে বেশ আস্তে। নিতাই ঘাড়ে একটু চিনচিনে ব্যথা টের পেল। তার গলা বেয়ে দুফোঁটা রক্তও পড়ল সরায়। ++++++++++++++++++++++++++++++++ লোকটা খাঁড়াটা ফেলে হাড়িকাঠের খিল খুলে দিয়ে গাত পায়ের বাঁধন আলগা করে নিতাইকে দাঁড় করিয়ে একগাল হেসে বলল, “তোর বড় ভাগ্য, মায়ের কাছে বলি হলি, তোর চৌদ্দ পুরুষ উদ্ধার পেয়ে গেল।” ঠাকুরমশাই সরাটা তুলে নিয়ে ভক্তিগদগদ গলায় “জয় মা, এই যে নররক্ত এনেছি মা, নে মা ... নে মা ....” বলতে বলতে মন্দিরে ঢুকে গেল। নিতাই ঘাড়ে হাত বুলিয়ে বলল, “বলি হয়ে গেলুম নাকি? কিন্তু ঘাড়টা তো আস্তই আছে।” বলাই একটু হেসে বলল, “এর বেশি বলি দেওয়ার কি উপায় আছে রে? সতীশ দারোগা নিয়ে গিয়ে ফাটকে পুরবে যে। তারপর ফাঁসিতে ঝোলাবে। আসলে বলি হত ঠাকুরমশাইয়ের পিতামহের আমলে। এখন যা হয় তাকে কী একটা বলে যেন, পতিক না পরীক কী যেন।” “প্রতীক নয় তো!” “হ্যাঁ হ্যাঁ, ওইটেই। বলিও হল, ঘাড়ও আস্ত রইল, মাও নররক্ত পেয়ে খুশি হয়ে গেলেন।” ঢাকি লোকটা একটু তুলোয় করে আয়োডিন এনে তার ঘাড়ের কাটা জায়গাটায় লাগিয়ে বলল, “এবার কেটে পড়ো তো বাপু, সতীশ দারোগা এসে পড়লে কিন্তু সবাইকে থানায় নিয়ে যাবে।” হতবুদ্ধি নিতাই তাড়াতাড়ি রওনা হল। বাঁশবনের মধ্যে ফটিকের সঙ্গে দেখা। ভয়ে কাঁপছে। “তুই যে বলি হলি? ভূত নোস তো।” “তাও বলতে পারিস।” “ওরে বাবা—” হঠাৎ একটা বাঁশের ডগা মটমট করে দুলে উঠল, ওপর থেকে কে একজন হেঁড়ে গলায় বলে উঠল, “কে রে, কোন ভূত ঢুকেছিস আমাদের বাঁশবনে?” দু'জনেই ভয়ে হিম হয়ে গেল। নিতাই কাঁপা গলায় কোনও রকমে বলল, “আমরা ভূতটুত নই, নিতান্তই মনিষ্যি।” বাঁশের ডগাটা আবার নড়ল। হেঁড়েগলা বলল, “অ, তুই তো একটু আগে অষ্টভুজার মন্দিরে বলি হলি।” “যে আজ্ঞে।” “তা তোর কপালটা ভাল, আমাদের কপাল তত ভাল ছিল না। ওই হরু ঠাকুরের ঠাকুর্দা বীরু কাপালিকের হাতে আমরা সত্যিই বলি হয়েছিলাম। সেই থেকে কবন্ধ হয়ে এই বাঁশবনে থানা গেড়েছি।” নিতাই সভয়ে জিজ্ঞেস করল, “হা-ডু-ডু খেলতে হবে নাকি? শুনেছি, আপনারা মানুষ পেলে হা-ডু-ডু খেলেন।” “সে খেলতুম রে। মনসাপোতার জয়নাথ পণ্ডিত আমাদের একটা দাবা আর খুঁটি কিনে দিয়েছে। খেলাটাও শিখে নিয়েছি। আহা, দাবার মতো খেলা নেই। হা-ডু-ডু আবার একটা খেলা? যা, তোরা, আমার মন্ত্রী এখন ঘোড়ার মুখে পড়েছে।” দুজনে হুড়মুড় করে বাঁশবনটা পেরিয়ে করালেশ্বরীর খালের ধারে এসে পড়ল। কিন্তু কোথায় খাল! শুকিয়ে একেবারে কাঠ হয়ে আছে। খালের ভেতর দিয়ে পায়েচলার রাস্তা। ফটিক হাঁফ ছেড়ে বলল, “যাক বাবা, দড়িতে ঝুলে পেরোতে তো হবে না।” সন্ধে হয়ে আসছে। ওপারেই দোগেছে। খালটা যখন প্রায় পেরিয়ে এসেছে তখন দেখা গেল একটা লোক উবু হয়ে বসে আছে। তার পায়ের কাছে অনেক গোদা গোদা টিকটিকি, লোকটা একটা খালুই থেকে চুনোমাছ বের করে টিকটিকিদের খাওয়াচ্ছে। আর তারাও মহানন্দে লাফিয়ে লাফিয়ে খাচ্ছে। দৃশ্যটা দেখে দাঁড়িয়ে গেল দু'জন। ফটিক বলল,“লোকটার বড্ড দয়ার শরীর, টিকটিকেদের মাছ খাওয়াচ্ছে দ্যাখ।” লোকটা মুখ তুলে বলল, “টিকটিকি নয় গো, টিকটিকি নয়।” “তবে?” “এরা সব হল করালেশ্বরীর বিখ্যাত কুমির। একসময়ে দশ বিশ হাত লম্বা ছিল। আস্ত আস্ত গোরু মোষ ছাগল কপাত কপাত করে গিলে ফেলত। তা করালেশ্বরীর খাল হেজেমজে গেল, আর কুমিরগুলোও না খেতে পেয়ে শুকিয়ে শুকিয়ে সব একটুখানি হয়ে গেল। তাদের বাচ্চাগুলোও ছোট ছোট হতে লাগল। তস্য বাচ্চাগুলো আরও ছোট হতে লাগল। হতে হতে এই দশা। “কুমির?” বলে ফটিক এক লাফে উঁচু ডাঙায় উঠে গেল। লোকটা বলল, “ভয় নেই গো, ওদের কি আর সেই দিন আছে? এখন চুনোমাছের চেয়ে বড় কিছু খেতেই পারে না। আর তা-ই বা ওদের দেয় কে বলো! এই আমারই একটু মায়া হয় বলে বিকেলের দিকে এসে খাইয়ে যাই।” নিতাই কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে দৃশ্যটা দেখে বলল,“মানে হচ্ছে এ হল কুমিরের বনসাই।” সন্ধে হয়ে আসছে বলে দু’জনে আর দাঁড়াল না। করালেশ্বরীর মরা খাত পেরিয়ে দোগেছের মাটিতে পা দিয়েই তারা বুঝল, এ এক বর্ধিষ্ণু গ্রাম। অনেক পাকা বাড়ি, বাঁধানো রাস্তা আর দোকানপাট দেখা যাচ্ছে।


এডিট ডিলিট প্রিন্ট করুন  অভিযোগ করুন     

গল্পটি পড়েছেন ৫৭২ জন


এ জাতীয় গল্প

গল্পটির রেটিং দিনঃ-

গল্পটির বিষয়ে মন্তব্য করুন

  • গল্পটির বিষয়ে মন্তব্য করতে আপনার একাউন্টে প্রবেশ করুন ... ধন্যবাদ... Login Now