বাংলা গল্প পড়ার অন্যতম ওয়েবসাইট - গল্প পড়ুন এবং গল্প বলুন

বিশেষ নোটিশঃ সুপ্রিয় গল্পেরঝুরিয়ান - আপনারা যে গল্প সাবমিট করবেন সেই গল্পের প্রথম লাইনে অবশ্যাই গল্পের আসল লেখকের নাম লেখা থাকতে হবে যেমন ~ লেখকের নামঃ আরিফ আজাদ , প্রথম লাইনে রাইটারের নাম না থাকলে গল্প পাবলিশ করা হবেনা

আপনাদের মতামত জানাতে আমাদের সাপোর্টে মেসেজ দিতে পারেন অথবা ফেসবুক পেজে মেসেজ দিতে পারেন , ধন্যবাদ

মসজিদ

"উপন্যাস" বিভাগে গল্পটি দিয়েছেন গল্পের ঝুরিয়ান রিয়াদুল ইসলাম রূপচাঁন (০ পয়েন্ট)

X শীত আসি আসি করছে। শীত আসার সময় পেরিয়ে গেছে। এবার এত দেরী করে আসছে কেন বোঝা যাচ্ছে না। শেষ জমানায় সব কিছু উলটা পালটা হবে। একি তারই আলামত! দক্ষিণের বাতাসটা ঠান্ডা হতে শুরু করেছে। বিকেল গড়িয়ে গেছে। পশ্চিমদিকের জারুল গাছটার আড়ালে গা ঢাকা দিয়েছে সুর্য। এখনো পাতার ফাঁকে ফাঁকে তার দ্যুতি ঝিলিক দিচ্ছে। বিকেলের বাতাসটা শালিকখালির পানিতে ভিজে আরো ঠান্ডা হয়ে বারেক গাজীর সাদা দাঁড়িতে শীতল পরশ বুলিয়ে গেল। শালিকখালি আগে নদী ছিল, এখন মৃতপ্রায় খাল। দাদী নানীদের মুখে শোনা যায়, খানেদের আমলে এই শালিকখালি নদীতে দিনের বেলা কামট কুমির সাঁতরে বেড়াত। খানেদের আমল বলতে তো পাকিস্তান পিরিয়ড। এত অল্পদিনে একটা নদী খাল হয়ে গেলো! বারেক গাজীর দৌলুজ ঘরে ছোটখাট একটা মিটিং বসেছে। গাজী বাড়ীর প্রায় সব পুরুষ মানুষ এখানে আজ উপস্থিত। বয়স্করা বারেক আলীর কাছ ঘেঁষে বসেছেন। বারেক গাজী, যৌবনে কি উচ্ছৃংখলটাই ছিল সে! এখানেই বসে সারা রাত ইয়ার দোস্তদের সাথে তাস খেলে, মদ খেয়ে মৌজ মাস্তি করে কাটিয়েছে। তার বাপ-মা বহুত চেষ্টা করেছে ছেলেকে শোধরাবার। বিয়ের পর বারেক গাজী বদলে গেল। সবাই বলতো বড় পয়মন্তি বউ। লক্ষী বউ। লক্ষী বউ বলতে শুনলে বারেকের দাদী খেঁকিয়ে উঠতো। ‘নক্ষী বউ কিরে হতভাগীর দল। হিঁদুগে সাথে কিয়ের তুলনা!’ সবাই চুপ করে যায়। লক্ষীর সাথে কোন মুসলিম নারীর নাম ব্যবহার করে উপমা দেয়া যায় তা নিয়েও চিন্তা ভাবনা করে কেউ কেউ। বউয়ের বাপের বাড়ির তিন গ্রাম পরে চান্নিরচকে। বউয়ের নাম নুরী। ঘরময় সে নুর ছড়িয়ে রেখেছে সারাক্ষন। বারেক ঘর সংসারের দিকে মনযোগ দিল। ভিন গাঁয়ের ইয়ার দোস্তদের সংখ্যা দিন দিন কমতে থাকল। আড়ালে আবডালে লোকে বারেককে স্ত্রীর গোলাম বলে কটাক্ষ করতে লাগলো। বদ বন্ধু দূরে সরে যাওয়ার পরে নিজ বংশের লোকেরা আসতে থাকল। বারেক আলী ভালো আলাপি মানুষ। বৈঠকি আড্ডায় সন্ধ্যাগুলো এখন এখানে মুখর থাকে। বলতে গেল বারেক গাজী এখন গাজী বাড়ীর মাথা। টাকা পয়সাও তার আর দশ জনের চেয়ে একটু বেশী আছে। বাপেও করেছে, সেও বাড়িয়ে তুলছে। দৌলুজ ঘরে উপস্থিত মুরুব্বীদের থমথমে মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছে ব্যাপারটা সিরিয়াস। অবশ্য প্রায়শই দেখা যায় মুরুব্বীরা কোন মিটিং-বৈঠকে গেলে কারণে অকারণে গম্ভীর হয়ে বসে থেকে ভারিক্কি আনার চেষ্টা করে। মুরুব্বীরা দেয়াল ঘেঁসে রাখা লম্বা বেঞ্চটায় বসেছে। বারেক গাজীর বাড়ীর রাখাল ছেলেটা সবাইকে এক প্রস্থ পান দিয়ে গেল। বেঞ্চির শেষ মাথায় এক খানা হাতলওয়ালা কাঠের চেয়ার। সেটাতে বসেছে বারেক গাজী। ভাবনার সাগরে ডুবে সে গম্ভীর মুখে দাঁড়িতে হাত বুলাচ্ছে। যৌবনের কালো দাঁড়ি এখন সাদা হয়ে এসেছে। ফিসফিস করে অনেকেই কথা বলছে। পেছনে বসা যুবকদের মধ্যে কিছুটা অস্থিরতা দেখা যাচ্ছে। আজ বিকেলে মান্দারডাঙ্গায় বসে আর তাস পেটানো হল না। মাছ চোরা তোবারেক একটু ঠোঁটকাটা স্বভাবের। নিজে কি করছে সেদিকে তার লক্ষ্য থাকে না কিন্তু অন্যের বেলায় তার উচিত কথা বলা চাইই চাই। কথা বলার সুযোগ থাকলে তো কথা নেই, না থাকলেও সে কথা বলে। এখন সুযোগ পেয়ে সে আর দেরী করল না। সোজা বারেক আলীর দিকে ফিরে বলল, “ ম্যাভাই, এইরাম কইরে চলতি দিলি তো হতিছে না। এট্টা কিছু না করলি এইবার কলাম আর হবে না। সরদার’রা পাইছে কি হ্যাঁ। উগে জাগায় মজিদ ঘর বানাইছে বুলে কি যন তন আমাগে সাতে এইরাম ব্যাভার করবে। এট্টা উচিত শিক্ষা দিতি হবে।” মজলিশে বসা প্রায় সবাই তোবারেকের কথায় মাথা নেড়ে সায় দিল। সমর্থন পেয়ে তোবারক আবারও কিছু বলতে যাচ্ছিলো এই সময় আইজুলের বাপ চিংড়ী মাছের মত লাফাতে লাগল। হাঁপানির ব্যারাম না থাকলে এখনি গিয়ে সে সরদার বাড়ির সবকটা জোয়ান মরদের মাথা তল্লা বাঁশ দিয়ে সাপ থেঁতলানোর মত থেঁতলে দিয়ে আসত। বারেক গাজী মানুষ চরিয়ে খাওয়া পাবলিক। বাপের রেখে যাওয়া জায়গা জমিতে সে সাধারণ গৃহস্থ্য জীবন অনায়াসে কাটাতে পারত। কিন্তু সুদের কারবারে সে এতটাই ফেঁপেছে যে আশপাশের দশ গ্রামের মানুষ তাকে তোঁয়াজ খাতির করে চলে। রাস্তায় বেরুলে সালাম দেয়। যদিও আড়ালে আবডালে এখনো মানুষ তাকে সুদখোর বলে গালি দেয়। তাতে বারেক গাজীর কিছু আসে যায় না। মানুষের স্বভাব ওইরকম। যার খায় তারই বাড়ির বাগানে হাগে। চতুর বারেক গাজী কৌশলে তার সুদখোর পরিচয় মুছে ফে্লার চেষ্টা করছে। সবাই জানে। সামনে বলতে সাহস করে না। সেই দিন আর নেই। একটু মানিয়ে গুছিয়ে চলতে পারলে এক সময় ভূলে যাবে। বারেক গাজী তাই ভূল চাল দিতে চায় না। দাবার বড়ে সে সাবধানে নাড়ায়। ঘটনা অতি সামান্য। জুম্মাবারে ইমাম সাহেব খোতবা পড়ছিলেন মিম্বরে দাঁড়িয়ে। মসজিদ টা বেশ পুরাতন। ব্রিটিশ পিরিয়ডে বাপের দাদারা বানিয়েছিল। পাকা ভিটের উপর টালির ছাদ। মানুষজন তখন কম ছিল। মসজিদের ভিতর তিন কাঁতার মানুষ ধরত। সেই তিন কাঁতার মানুষই হত না। এক সারি আধ সারি লোক হত। তখনকার দিনে এই গ্রাম থেকে খুলনা টাউনে যেতে হত গহনার নৌকায় চড়ে। সঙ্গে করে দুই তিন দিনের চাল ডাল নিয়ে নিত হত। গ্রামের নাম ভাগবাহ। সুন্দরবনের কোলঘেঁষা প্রত্যন্ত এই গ্রাম সরল জীবনের এক বিমূর্ত প্রতিচ্ছবি। যুগ বদলে গেছে। যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ হয়েছে। এখন দিনে দিনেই খুলনায় গিয়ে ফিরে আসা সম্ভব। অষ্টাশির ঝড়ে মসজিদ ভেঙ্গে গেলে আবার নতুন করে তৈরী করা হয়। মসজিদের বারান্দা দেয়া হয়। বারান্দার পেছনের কাঁতারে বসে আইজুল তার সমবয়সীদের সাথে ফিসফিস করে কি একটা গল্প করছিল। নিশ্চই মজার কোন ব্যাপার। শ্রোতারা হেসে এ ওর গায়ে লুটিয়ে পড়ছে। সামনের কাতারে বসা মাঝবয়সীরা বিরক্ত হচ্ছে। কিন্তু তাদের যেন ভ্রুক্ষেপ নাই। খুতবার সময় কথা বলতে নেই। খুতবা শোনা ওয়াজিব। সরদার বাড়ির তোঁতলা আক্কাস একটু চ্যাঁতা স্বভাবের। সেই হঠাৎ ধমকে উঠল, “ওই বিয়াদব ছাওয়াল, ফুসুর ফাসুর বন্ধ করিস কলাম। নালি ঘাড় ধইরে মজিদ ঘরেত্তে চাইলে দিবানে কলাম।” কি গাজীদের ছেলের গলা ধাক্কা দেবে সরদার বাড়ির আকাইচ্ছা। গাজীদের কয়েকজন কথা পড়ার আগেই উঠে দাঁড়াল। কথা কাটাকাটি আর গালাগালিতে মসজিদ যেন হাটখোলা হয়ে গেল। হাতাহাতি হওয়ার উপক্রম। অন্যবংশের লোকেরা ধরে নিরস্ত করে। মুহূর্ত আগে এখানে শান্ত সমাহিত পরিবেশ ছিল। সবার আল্লাহ ভয় যেন কপ্পুরের মত উড়ে গেল। বারেক গাজী সবার দিকে এক পলক তাকিয়ে নিয়ে নিরবতা ভাঙলো, “মজিদ হোইল গিয়ে আল্লার ঘর। ইডা নে কাইজে ফ্যাসাদ কত্যি নেই। নবী রছুল বিজার হন মিয়া। আমাগে উচিত আলাদা এক খান মজিদ ঘর বানাইনে। কি কও তুমরা।” অতি উত্তম প্রস্তাব। এই বুদ্ধিই যেন এতক্ষন সব মুরুব্বির মাথায় ঘুরছিলো। সবাই রাজি। একবাক্যে রাজি। মসজিদ বানিয়ে নামাজ পড়া বহুত ছোয়াবের কাম। আল্লাহর নবী হিজরত করে মদীনা শরীফে গিয়ে মসজিদ বানিয়ে নামাজ পড়েন। মসজিদ তো বানানোই যায়, কিন্তু সমস্যা হলো জায়গা দেবে কে? বারেক গাজীই সমস্যার সমাধান করল। “আমার এই দৌলুজ ঘর খান আমি মজিদের নামে ওয়াকফ কইরে দিলাম। উত্তর পাশে এট্টা পউর কাট্টি হবে। আস্তে আস্তে আমরা মজিদ ঘর খান পাকা কইর্যেদ ফ্যালবানে। আর হাশেম গাজীর ছাবালডা তো চাইর পারা কুরানের হাফেজ। সেইতি নামাজ পড়াক। কি কও তুমরা?” আরে বলার কি আছে। ঘাড় নেড়ে সবাই সম্মতি দেয়। সবাই খুব খুশি। মাগরিবের আজান শোনা যাচ্ছে সরদার বাড়ির মসজিদে। ওয়াজুদ্দি সরদার আজান দিচ্ছে। আজ সবাই মিলে মাগরিবের নামাজ পরল দহলিজ ঘরে। দহলিজ ঘরের নাম এক মিনিটেই পালটে হয়ে গেল ‘মজিদ ঘর’। বিকেলে সবাই জুতো পায়ে এই ঘরে বসে ছিলো। এখন এই ঘরে আর জুতো তোলা যাবে না। ফারুক গাজী জুতো জোড়া বাইরে নামিয়ে রাখলো। এরই মধ্যে সপ্তাহ খানেক কেটে গেছে। মাটিয়ালরা উত্তরপাশে পুকুর কাটছে। কাটা মাটি নিয়ে ফেলছে ওপাশের নিচু জায়গাটায়। সেদিনের সেই হাতলওয়ালা চেয়ারটা জারুল গাছটার নিচে পেতে বসে আছে বারেক গাজী। তার চোখ মসজিদ ঘরের দিকে। এক সময় মানুষ কত আড্ডা মেরেছে এখানে বসে, বিড়ি তামাক খেয়েছে, তাস পিটিয়েছে। আজ মানুষ চোখে মুখে একটা শ্রদ্ধা ভাব নিয়ে এখানে আসে। মিহি সুরে কথা বলে। দুনিয়াবী কথা বলতে গেলে প্রায় বলেই না। ওযু ছাড়া কেউ মসজিদে ঢোকে না। কারো ওযু ভেঙ্গে গেলে সাথে সাথে ওযু বানাতে বাড়ির পুকুর ঘাটে ছুটে যায়। আল্লাহর ভয়েই কি মানুষ এটা করে! তা কি করে হয়? আল্লাহ কি শুধু মসজিদ ঘরগুলোতে বসে থাকে? মানুষ যখন পৃথিবীর পথে পথে পাপ করে বেড়ায় তখন কি তার আল্লাহর কথা মনে থাকে না। নাকি মানুষের ভিতর একটা পূজারী মন থাকে যা মানুষকে সাকার কিছুর প্রতি বারবার টেনে নেয়। এই স্বভাবের কারনেই কি মানুষ গাছ, পাথর, প্রতিমাকে পুজা করে। বাবরী মসজিদের কথা মনে পড়ে গেল, বারেক আলী ভেবে পায় না, মানুষ কাকে শ্রদ্ধা করছে, মহান আল্লাহকে নাকি মসজিদ ঘরকে।


এডিট ডিলিট প্রিন্ট করুন  অভিযোগ করুন     

গল্পটি পড়েছেন ২৬০ জন


এ জাতীয় গল্প

→ মসজিদে সালাত আদায়
→ ২০১ গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদ
→ মহাসাগরে ভাসমান মসজিদ
→ রহস্যঘেরা জিন মসজিদ
→ একটি মসজিদে এক মৃত ব্যাক্তির জানাজা
→ ঝাউদিয়া শাহী মসজিদ
→ মসজিদ
→ একটি গীর্জা যেভাবে মসজিদে পরিণত হয়েছিল!
→ মক্কা শরীফের মাটি দিয়ে তৈরি যে মসজিদ
→ সর্ব প্রথম মসজিদের অজানা
→ মোল্লার দৌড়, মসজিদ পর্যন্ত

গল্পটির রেটিং দিনঃ-

গল্পটির বিষয়ে মন্তব্য করুন

  • গল্পটির বিষয়ে মন্তব্য করতে আপনার একাউন্টে প্রবেশ করুন ... ধন্যবাদ... Login Now