বাংলা গল্প পড়ার অন্যতম ওয়েবসাইট - গল্প পড়ুন এবং গল্প বলুন

বিশেষ নোটিশঃ সুপ্রিয় গল্পেরঝুরিয়ান - আপনারা যে গল্প সাবমিট করবেন সেই গল্পের প্রথম লাইনে অবশ্যাই গল্পের আসল লেখকের নাম লেখা থাকতে হবে যেমন ~ লেখকের নামঃ আরিফ আজাদ , প্রথম লাইনে রাইটারের নাম না থাকলে গল্প পাবলিশ করা হবেনা

আপনাদের মতামত জানাতে আমাদের সাপোর্টে মেসেজ দিতে পারেন অথবা ফেসবুক পেজে মেসেজ দিতে পারেন , ধন্যবাদ

কবি

"ছোট গল্প" বিভাগে গল্পটি দিয়েছেন গল্পের ঝুরিয়ান রিয়েন সরকার (০ পয়েন্ট)

X কবি। -নাজিম-উদ-দৌলা। ============== একটা জোড়া প্রেমিক প্রেমিকা ভীষণ ঝগড়া করছে, তাদের কাছা কাছি কয়েকটা কাক কিছু একটা খুটে খুটে খাচ্ছে, একটু দূরে দুইটা টোকাই ছেলে কাগজ টোকাচ্ছে, আরও একটু দূরে দৃষ্টি গেলে দেখা যায় এক ভিখারিনী মহিলা গাছের নিচে বসে তার সন্তান কে খাওয়াচ্ছে। এই রকম টুকরো টুকরো অনেক দৃশ্য চোখে পড়ছে। আমি শুয়ে আছি সোহরাওয়ার্দি উদ্যানের ভেতর একটা বেঞ্চে। উদ্দেশ্যহীন ভাবে দেখছি আশে পাশে যা ঘটছে। প্রেমিক যুগল মাঝে মাঝে সন্দেহের চোখে আমার দিকে তাকাচ্ছে। আমার মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, মাথায় অযত্নে বেড়ে ওঠা বড় বড় চুল- হিরোইন খোর বা চোর ছ্যাঁচড় ভাবছে বোধহয়! পকেটের মোবাইলটা বেজে উঠল। বেজে উঠল বললে ভুল হবে, ভাইব্রেশন হল। বেশ লাগছে! মোবাইলের এই ভাইব্রেবেশন নামক ফাংশনটির তুলনা চলেনা! কেমন যেন একটা ভুপিকম্প ভুমিকম্প অনুভব হচ্ছে। আমি রিসিভ করছিনা, ইচ্ছে করেই করছিনা। জানি কে ফোন দিয়েছে। কানিজ!! নামটা মনে আসলেই সমস্ত অনুভুতিতে একটা ভাললাগার আবেশ ছড়িয়ে যায়। মেয়েটির সাথে পরিচয় হয়েছে বেশিদিন হয়নি। এরই মাঝে সে আমার অস্তিত্তের একটি অংশ হয়ে গেছে! গত তিনদিন ধরে প্রতিদিনই কমপক্ষে ২০ বার করে ফোন করেছে কানিজ। আমি রিসিভ করিনি। আসলে এই কয়দিন কারো কলই রিসিভ করিনা। ভাল লাগেনা কথা বলতে। মনটা খুব খারাপ হয়ে আছে। আমার মন খারাপ হওয়ার জন্য কোনও কারন লাগেনা। মাঝে মাঝে এমনিতেই মন খারাপ হয়ে যায়। কিন্তু এবারের মন খারাপ খারাপটা এমনি এমনি হয়নি। গত তিনদিন কানিজের বাবার কিছু কথা আমাকে আমার কাব্যের পৃথিবী থেকে তুলে এনে আছড়ে ফেলেছে বাস্তবতার গহীন সমুদ্রে। *** আমি যেতে চাইনি। কানিজ এক প্রকার জোর করেই আমাকে তার বাড়িতে নিয়ে গেল। তাদের এই প্রাসাদের মত বাড়িটা আগে বাইরে থেকে দেখেছি। এবার ভিতরে ঢুকে আমি তো রীতিমত ভয় পেয়ে গেলাম। কানিজ আমাকে তাদের দামী ও সৌখিন আসবাবপত্র আর রুচিসম্মতভাবে সাজানো ড্রয়িং রুমে বসতে দিয়ে ভেতরে গেল। আমি ঘরের সিলিঙ থেকে ঝুলন্ত ঝাড়বাতি, দেয়ালের পেইন্টিংস আর সো-পিস গুলো মুগ্ধ চোখে দেখছিলাম। এমন সময় কানিজের বাবা আসলেন। ভদ্রলোকের নাম জামান আহমেদ। আগে কখনো দেখা হয়নি তার সাথে। বয়স ৬০ এর মত হবে। চেহারায় আর বেশ ভূষায় আছে আভিজাত্য আর জৌলুসের ছাপ। ভদ্রলোক আমার মুখোমুখি বসলেন। “তোমার নামই অর্ক?” “জি”। “তুমি কি কর?” ভারি কণ্ঠস্বরে প্রশ্ন করলেন। “সমাজকল্যাণে অনার্স করেছি। মাস্টার্সে ভর্তি হইনি”। “কেন?” “আমার আসলে লেখাপড়া আর ভাল লাগছিল না”। “চাকরির চেষ্টা করেছ?” জি... না! “চলে কি করে?” “এইত... জোড়া তালি দিয়ে চালাচ্ছি”। “বাসায় কে কে আছে?” “কেউ নেই। বাবা-মা অনেক আগেই মারা গেছেন। ছোট ভাইটা কানাডায় থাকে, বড় বোন আছে- বিয়ে হয়েছে, ময়মনসিংহে বাড়ি। আমি একটা মেসে থাকি”। “বাহ, বাহ, কানিজের পছন্দ তো দারুন"! বিরক্ত ভরা কণ্ঠে বললেন জামান সাহেব। আমি বলার কিছু না পেয়ে চুপ করে থাকলাম। “তো... তোমার কি করার ইচ্ছা আছে?” “এখনো ঠিক করিনি। আমি স্বাধীনচেতা। মুক্তবুদ্ধির চর্চা করতে পছন্দ করি। আসলে চাকরি করে আমার পোষাবে না”। কানিজের বাবা বিদ্রুপের ভঙ্গিতে একটু হাসলেন। “কানিজের মুখে শুনলাম তুমি ভাল কবিতা লেখ! পত্র পত্রিকায় প্রায়ই ছাপানো হয়”। “হ্যাঁ... একটু চেষ্টা করি আরকি”। “আমার সম্পর্কে তোমার ধারনা আছে তো? আমি শিল্পপতি। ঢাকায় ২-৩ টা বাড়ি আছে, ৪-৫ টা গাড়ি আছে এসব জান নিশ্চয়ই?” “হ্যাঁ জানি”। এবার সরাসরি আক্রমন করলেন জামান সাহেব। “এসব জেনেও কানিজের সাথে রিলেশন করলে কোন সাহসে?” আমি অপমানিত বোধ করলাম। “রিলেশন করার আগে এত কিছু দেখতে হয়, এটা জানা ছিলনা!” “বাজে কথা বলোনা ছেলে। তোমাদের মত ছেলেদের চিনতে আমার আর বাকি নেই। তুমি প্লান করেই কানিজের সাথে সম্পর্ক করেছ। কানিজ অবুঝ, উঠতি বয়স তার, চোখে রঙ্গিন স্বপ্ন। মিষ্টি মিষ্টি কথা আর কবিতা শুনিয়ে তাকে বসে আনতে খুব বেশি কষ্ট হয়নি তোমার! বড়লোকের মেয়েকে বিয়ে করে সারা জীবন পায়ের উপর পা তুলে বসে খাওয়ার ধান্দা!” রাগে আমার শরীরে যেন আগুন ধরে গেল। এই মুহূর্তে এখান থেকে বেড়িয়ে যেতে মন চাইছে। “তোমার গায়ের শার্ট টা তো দামী মনে হচ্ছে! নিশ্চয়ই কানিজ কিনে দিয়েছে?” আমি কথা বললাম না। কানিজের বাবা ঠিক ধরেছেন। শার্ট টা কানিজই আমাকে গিফট করেছে। জামান সাহেব উঠে দাড়ালেন। “আশা করি তোমার ও কানিজের ব্যাপারে আমার মতামত বুঝতে পেরেছ? আমি যাচ্ছি, তুমি কিন্তু চা না খেয়ে যাবেনা! আমি বাজি ধরে বলতে পারি এত দামী চা আগে কখনো খাওয়ার সৌভাগ্য তোমার হয়নি!” জামান সাহেব ড্রয়িং রুম থেকে বেড়িয়ে যেতেই আমি ঝট করে উঠে দাঁড়ালাম। রাগে আমার শরীর কাপছে। ৫ মিনিট বাদেই নিজেকে আবিস্কার করলাম মহাখালী ফ্লাই ওভারের ওপর! প্রচণ্ড রাগে কখন যে কানিজদের বাসা থেকে বেড়িয়ে এসেছি তা টেরই পাইনি! এর পর তিন দিন যাবত কানিজ ফোন দিয়েই যাচ্ছে। আমি রিসিভ করিনা। কি লাভ? জামান সাহেব তো চোখে আঙ্গুল দিয়ে আমাদের ব্যাবধানটা দেখিয়ে দিলেন! **** কানিজের সাথে আমার পরিচয়টা অনেকটা বাংলা সিনেমার কাহিনির মত। প্রায় মাস তিনেক আগের কথা। আমি তখন মতিঝিল এলাকায় গিয়েছিলাম একটা কাজে। শাপলা চত্বর হয়ে সিনেমা হলটার দিকে যাচ্ছি, এমন সময় চারিদিকে হই চই পরে গেল। কিছু বুঝে ওঠার আগেই দেখলাম একদল লোক লাঠি সোটা হাতে দৌরে এসে গাড়ি ভাংচুর শুরু করল। বুঝলাম শেয়ার বাজারের অবস্থা ভালনা, তাই শেয়ার হোল্ডাররা সবাই অতিষ্ঠ হয়ে রাস্তায় নেমেছে। সবাই যে যার মত পালাচ্ছে। আমিও নিরাপদ জায়গায় সরে যাওয়ার জন্য ছুট দিলাম। হঠাৎ খেয়াল হল এক কোনায় একটা মেয়ে জড়ো সরো হয়ে পড়ে আছে। সম্ভবত দৌর দিতে গিয়ে ধাক্কা খেয়ে পড়ে গিয়ে ব্যাথা পেয়েছে। আমি মেয়েটার কাছে দ্রুত এগিয়ে গেলাম। উঠিয়ে দাড় করানোর চেষ্টা করলাম। রাস্তায় পড়ে গিয়ে মাথায় আঘাত পেয়েছে, কপাল থেকে রক্ত ঝরছে। কাপছে হিস্ট্রিরিয়াগ্রস্ত রোগীদের মত। আমি একটা রিকসা ডেকে মেয়েটিকে উঠিয়ে দিলাম কিন্তু মেয়েটি আমার হাত ছাড়ল না। সম্ভবত প্রচণ্ড ভয় পেয়েছে। কি আর করা? আমাকেও রিক্সায় উঠতে হল। মেয়েটি খুব আহামরি গোছের সুন্দরী নয়, কিন্তু চেহারাটা ছিল ভারী মিষ্টি আর আকর্ষণীয়। একটা ফার্মেসির সামনে রিকসা থামালাম। তেমন কোনও ক্ষতি হয়নি। একটু ছিলে গেছে। কিন্তু মেয়েটি ভয় পেয়েছিল ভীষণ। কপালে ব্যান্ডেজ করা হল। মেয়েটি আমায় অনেক ধন্যবাদ দিল। কথায় কথায় জানতে পারলাম তার নাম কানিজ, একটা প্রাইভেট ভার্সিটিতে বিবিএ পড়ছে। মেয়েটি আমার কাছ থেকে আমার ফোন নম্বর রাখল। সেই রাতেই আমাকে সে কল দিল। অনেক কথা হল তার সাথে। পরদিন টিএসসি তে এসে আমার সাথে দেখা করল। এভাবে একদিন দুইদিন দেখা হল, ফোনে কথা হল। এক সময় আমরা অজান্তেই পরস্পরের প্রেমে পড়ে গেলাম। *** মোবাইলটা ভাইব্রেশন হয়েই চলেছে। পকেট থেকে বের করে হাতে নিলাম। এই সেরেছে! কানিজের ফোন না। কল করেছে আমার বন্ধু হামিদ। রিসিভ করলাম, “হ্যালো”! “তোর হ্যালোর গুষ্টি কিলাই”; ওপাশ থেকে রাগি গলায় হামিদ বলল। “শালা! এতক্ষনে ফোন ধরলি?” মিথ্যে না বলে উপায় নেই। “কি করব দোস্ত? টের পাই নাই যে!” “এই কথা কইলে তো হইবনা! তোর শাস্তি আছে”। “কি শাস্তি দিবি বল”। “ফোনে কমু না, তুই এখনি আমার অফিসে চইলা আয়”। “এখনই? কেন? হঠাৎ জরুরি তলব?” “আছে একটা ঘটনা। তুই আয়, তারপর বলমু”। “আর কেউ আসছে?” “হ্যাঁ... আনোয়ার, কামাল সবাই আসছে। চার কাপ চা অর্ডার দিছি। চা ঠাণ্ডা হওয়ার আগেই চইলা আয়’। ‘আরে...আসতেছি। সমস্যা নাই, আমি ঠাণ্ডা চা খেতে পারি”। হামিদের অফিস আজিজ মার্কেটে। ছোট খাটো একটা ট্রাভেল এজেন্সি দিয়েছে সে। হেটে যেতে ১৫ মিনিটের বেশি লাগবেনা। আমি রওনা দিলাম। *** মারাত্মক অবাক হলাম! হামিদের অফিসে গিয়ে দেখি কানিজ বসে আছে। আমাকে দেখে হাসল। হামিদও দেখি দাত কেলিয়ে হাসছে! “কিছু মনে করিস না দোস্ত! আসলে কানিজ এসে এক প্যাকেট ব্যানসন ঘুস দিল, আমি আর মিথ্যে না বলে পারলাম না”। কানিজ বলল, “আরে... ওকে চিনেন না হামিদ ভাই? এক্ষুনি বলে বসবে একদমই অবাক হইনি, আমি জানি কানিজ এখানেই আছে!” আমি হাসলাম, “না, আমি সত্যিই অবাক হয়েছি। তুমি হঠাৎ এখানে?” “না এসে উপায় কি? তুমি তো ফোন ধরছ না! তাই বাধ্য হয়ে হামিদ ভাইকে ধরতে হল”। হামিদ বলল, “বস দোস্ত ! চায়ের অর্ডার দিছি”। *** হামিদের অফিস থেকে বেরিয়েছি আধাঘণ্টা আগে। এখন বসে আছি চারুকলার ভেতর। কানিজ বসে আছে আমার পাশে। সেই তখন থেকে আমার একটা হাত ধরে আছে। এক মুহূর্তের জন্য ছাড়ছেনা। “একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমি”। কানিজ বলল। “কি সিদ্ধান্ত?” “আমরা বিয়ে করব”। আমি শব্দ করে হাসলাম। “তোমার হাসি পাচ্ছে? আমি কিন্তু সিরিয়াস’। “হঠাৎ বিয়ের ভুত মাথায় চাপল কেন?” “হঠাৎ না, অনেক দিন আগে থেকেই ভাবছি। তোমাকে শক্ত করে আমার সাথে বাঁধতে হবে। যাতে তুমি এভাবে হঠাৎ হঠাৎ উধাও হয়ে যেতে না পার”। “তা না হয় হল। কিন্তু তারপর কি করবে?” “হুট করে বিয়ে করে বাবার সামনে গিয়ে দাঁড়াব”। “বাবা যদি মেনে না নেয়?” “তাহলে তোমার হাত ধরে বেরিয়ে আসব”। “আমার হাত ধরে? আমি তোমাকে রাখব কই? আমার নিজেরই তো থাকার যায়গা ঠিক নাই”। “দরকার পড়লে গাছ তলায় থাকব”। আমি আবার হাসলাম, “বলা আর করাটা এক জিনিস না”। “আমার কাছে একই”। জোর দিয়ে বলল কানিজ। আমি হাসি চেপে থাকলাম। “ব্যাপারটা অবশ্য খারাপ হবেনা। আমি গাছ তলায় বসে থাকব। তুমি আমার পাশে বসে আমাকে নিয়ে কবিতা লিখবে”। “শুধু কবিতাতে পেট ভরবে? খাবার জোগাড় করতে হবেনা?” “ওসব নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবেনা। আমি তোমার চাকরির ব্যাপারে কথা বলে রেখেছি”। আমি অবাক হলাম। “কোথায়? কার সাথে?” “শহিদ ভাই। আমার কাজিন। তার একটা এক্সপোর্ট-ইমপোর্ট এর বিজনেস আছে”। “তুমি বললেই তিনি আমাকে চাকরি দিয়ে দেবেন?” “হ্যাঁ... এখানে একটা ব্যাপার আছে”। “কি?” “শহিদ ভাই আমার প্রেমে পরেছিলেন। এখনও পড়েই আছেন। আমি যখন কলেজে পড়ি তখন আমাকে প্রপোজ করেছিলেন”। “তারপর?” “তারপর আর কি? আমি রিফিউজ করেছি। আমার জন্য যে তুমি অপেক্ষা করছিলে!” *** সেদিন বিকেলেই কানিজের সাথে তার শহিদ ভাইয়ের অফিসে গেলাম। বিশাল সেই অফিস। হাই ফাই ডেকোরেশন। দেখা করার জন্য রিসিপশনে ৫ মিনিট অপেক্ষাও করতে হল। আমি ভেবেছিলাম শহিদ ভাই মানুষটা কাল মত, বেঁটে গোছের আর একটু বেশি বয়সি হবে। কিন্তু তাকে দেখে আমি বিষম খেয়ে গেলাম। দামী স্যুট টাই পড়া টগবগে আর স্বাস্থ্যবান যুবক। আমার চেয়ে বছর তিনেকের সিনিয়র হবে। রুমে ঢুকেই কানিজ বলে উঠল, “আরে... শহিদ ভাই যে! তুমিতো আগের চেয়ে আরও বেশি হ্যান্ডসাম হয়ে গেছ”! শহিদ সুন্দর করে হাসলেন, “থ্যাংকস কানিজ। বস তোমরা”। কানিজ আমার সাথে শহিদের পরিচয় করিয়ে দিল। শহিদ বললেন, “কানিজের মুখে আপনার কথা অনেক শুনেছি। আপনি নাকি দারুন কবিতা লিখেন”! আমি হাসলাম। “আমি অবশ্য কবিতা টবিতা তেমন বুঝিনা। বাবসায়ি মানুষ”! শহিদ বেল বাজিয়ে পিয়ন কে ডাকলেন। তিন কাপ কফি দিতে বললেন। আমি বললাম, “এই বয়সে এত বড় বিজনেস দাড় করালেন কিভাবে?” শহিদ সাহেব হাসলেন। “সে এক লম্বা কাহিনী। আর একদিন বলব”। “আর একদিন না হয় লম্বা করে বলবেন। আজ একটু খাটো করে বলেন!” শহিদ আমার রসিকতায় হাসলেন, “ভাইরে, আমার বাবা ছিলেন গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিব। কিন্তু আমি ইন্টারমিডিয়েট পাশ করার পরই বললেন, তোমার পথ তোমাকে নিজের যোগ্যতায় খুজে নিতে হবে। আমি কিন্তু স্বজন প্রীতি করে তোমার চাকরির ব্যাবস্থা করে দিবনা! তখন থেকেই আমার মাথায় চিন্তা ছিল-নিজে প্রতিষ্ঠিত হতে হবে। তারপর অনেক ঘাত প্রতিঘাত পেরিয়ে এতদুর এলাম”। আমি শহিদের কথা শুনে অবাক হলাম। ভাল একজন হার্ড ওয়ার্কিং মানুষ। এই বয়সে এত বড় বিজনেসের মালিক! দেখতেও দারুন হ্যান্ডসাম! কানিজ কেন এই মানুষটাকে ছেড়ে আমাকে ভাল বাসল? শহিদ সাহেব বলছেন, “একটা জিনিস খেয়াল করেছ কানিজ?” “কি?” কানিজ বলল। “আমার পুরো অফিসের ইনটেরিওর কালার কিন্তু নীল! তোমার প্রিয় রং!” কানিজ হাসল, “তোমার গায়ের স্যুটও তো নীল রঙের!” “হ্যাঁ... শুধু রং টাই সব না, তোমার পছন্দের সব জিনিস দিয়েই সাজিয়েছি আমার অফিস”! কানিজ একটু বিব্রত বোধ করল। আমার দিকে তাকাল। আমি নির্বাক। কানিজ প্রসঙ্গ পাল্টানোর জন্য বলল, “তোমাকে একটা কথা বলেছিলাম। মনে আছে শহিদ ভাই?” “ওহ! ...হ্যাঁ। মনে আছে”; শহিদ ভাই আমার দিকে তাকালেন, “অর্ক সাহেব। আপনার চাকরির বাবস্থা আমি করে রেখেছি। ইভেন্ট ম্যানেজারের পোস্ট। আপাতত পঁচিশ হাজার টাকা স্যালারি পাবেন। যে কোনও দিন জয়েন করতে পারেন”। “জি...আমাকে একটু সময় দিন”; আমি বললাম। “যত খুশি সময় নিন। আমার দুয়ার আপনার জন্য সবসময় খোলা! কানিজের কথা তো আমি ফেলে দিতে পারিনা!” *** রাত গভীর হয়েছে। আমার চোখে ঘুম নেই। আমি এমনিতেই রাত জাগি। কিন্তু আজ রাত জাগার একটা কারন আছে! একটা চিন্তা আমাকে একটু্ও সুস্থির থাকতে দিচ্ছে না। কেন কানিজ আমাকে ভাল বাসল? যেখানে শহিদকে বিয়ে করলে তার জন্য উন্মুক্ত হবে অফুরন্ত সুখের দুয়ার, সেখানে আমার মত চালচুলোহীন ছন্নছাড়াকে বিয়ে করে কেন দুঃখকে আগলে নিতে চাইছে? প্রাচুর্যের মাঝে বড় হওয়া কানিজ কি পারবে আমার অভাবের ঘরে এসে মানিয়ে নিতে? শহিদ এখনো কানিজকে ভালবাসে। আমি কি পারব শহিদের এই দয়া করে দেয়া চাকরিটা করতে? সারাজীবন যে স্বাধীনতা উপভোগ করে এলাম তা বর্জন করে, আমি কি মেনে নিতে পারব এই পরাধীনতার শৃঙ্খল? প্রতিমুহূর্তে কি মনে হবেনা যে আমার যা কিছু সবই এই শহিদের দয়ার দান! অনেক ভাবনার শেষে একটা সমাধান উকি দিল মনে। ভোর ৫ টার দিকে ফোন দিলাম হামিদ কে। হামিদ রিসিভ করে তার স্বভাবসুলভ গালি দিল, “কোন শালায় রে?” *** ৫ বছর পর! এবারের বই মেলায় আমার ৩য় কবিতার বই “দহন” প্রকাশিত হয়েছে। বইটা পাঠকমহলে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। এই বইয়ের জন্য আমি সেরা কবি হিসেবে বাংলা একাডেমী পুরস্কার পেয়েছি। সেই উপলক্ষে আজ হামিদ তার অফিসে পার্টি ডেকেছে। আমাদের সব বন্ধুবান্ধবরা আসছে। আমিও যাচ্ছি। হামিদের অফিসে ছুকে দেখলাম ও একাই বসে আছে। আর কেউ আসেনি। হামিদের মুখে কেমন যেন একটা থমথমে ভাব। “কি ব্যাপার হামিদ? বাকিরা কই?” “সবাই চইলা আসবে, তুই বস”। আমি বসলাম। “তোর চেহারা অমন লাগছে কেন? কি হয়েছে?” “কানিজ আসছিল”। আমি অবাক হলাম। “তারপর?” “তোকে দেয়ার জন্য আমাকে একটা চিঠি দিয়া গেছে”। “কই?” হামিদ ড্রয়ার খুলে একটা ভাজ করা কাগজ বের করল। “ আমি দুঃখিত, তুই আসার আগে চিঠিটা আমি পড়ছি”। আমি কিছু বললাম না। কাগজের ভাজ খুলে পড়তে শুরু করলাম। অর্ক! তোমাকে একটা জিনিস জানানোর জন্য এই চিঠিটি লিখছি। মুখে বলতে পারতাম। কিন্তু তোমার সাথে কথা বলার চিন্তা করতেও আমার ঘৃণা হয়! আগামিকাল আমার ৩য় বিবাহবার্ষিকী। এই উপলক্ষে আমার স্বামী শহিদ চৌধুরী আমাদের গুলশানের বাড়িতে ধুম ধাম করে পার্টির আয়োজন করেছে। গণ্য মান্য সব ব্যাক্তিরা আসবে এই পার্টিতে। ম্যারেজ ডে উপলক্ষে শহিদ আমাকে কি উপহার দিচ্ছে জান? একটা নীল রঙের গাড়ি! আমার প্রিয় রং! তুমি ভাবছ তোমাকে দাওয়াত দেয়ার জন্য আমি এই চিঠি লিখছি? কখনই নয়! আমি তোমাকে জানাতে চাই যে আমি কতটা সুখে আছি। ভাগ্যিস সেদিন হামিদ ভাই আমাকে সব সত্য কথা বলেছিলেন। নইলে তোমাকে আমি চিনতেই পারতাম না! হামিদ ভাইয়ের মত মানুষই হয়না। তিনি আমার জীবনটা ধ্বংস হওয়া থেকে বাচিয়েছেন। হামিদ ভাই প্রমান সহ আমাকে দেখিয়েছেন যে তুমি বড়লোকের মেয়েদের কবিতা শুনিয়ে শুনিয়ে পটাও, তারপর তাদের ব্লাকমেইল করে টাকা আত্মসাৎ কর। ছি! আমার ভাবতের লজ্জা হয়, তোমার মত একটা লোফারকে ভালবাসার মত বড় একটা ভুল আমি করেছিলাম! শুনলাম তুমি নাকি বাংলা একাডেমীর পুরস্কার পেয়েছ! সেরা কবি! ছিঃ আমার ভাবতেও অবাক লাগে তোমার মত একটা ভণ্ডকে কেমন করে পুরস্কৃত করা হয়? আমি যদি সমাজের সবার সামনে তোমার মুখোশ টা খুলে দিতে পারতাম! তোমাকে আমি ঘৃণা করি! ঘৃণা! ঘৃণা! ঘৃণা! পড়া শেষে চিঠিটা ভাজ করে পকেটে নিলাম। কষ্টের একটা দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে আসতে চাইছিল। অনেক কষ্টে সেটা আটকালাম। বুকের ভেতর কোথায় যেন ব্যাথা হচ্ছে! প্রচণ্ড ব্যাথা! “তোর খারাপ লাগছে না?” হামিদ বলল। “কেন খারাপ লাগবে?” আমি অন্যদিকে ফিরলাম। কে জানে? হয়ত চোখ ছল ছল করছে! হামিদকে সেটা দেখানো যাবেনা! “কারন তুই কানিজ কে অনেক ভালবাসিস অর্ক”! “কে বলেছে তোকে?” “কে বলছে?” হামিদ রেগে গেল। “বলছে তোর কবিতার বই! বলছে তোর গায়ের পাঞ্জাবী! আরে... তোর সব বইয়ের প্রচ্ছদ নীল রঙের হয় কেন, তুই নীল রঙের পাঞ্জাবী পড়ে থাকিস কেন?” আমি মাথা নিচু করে থাকলাম। আমার তো সামর্থ্য নেই যে নীল রঙের গাড়ি কিনব, তাই বইয়ের প্রচ্ছদ নীল রঙের করি। “আমার দিকে তাকা অর্ক”! আমি তাকালাম হামিদের দিকে। হামিদ বলল, “তোর প্লান মত মিথ্যা বলছি আমি অর্ক! ফুলের মত নিষ্পাপ মেয়েটার কাছে মিথ্যা বলছি আমি। আল্লাহ তোকে কোনও দিন ক্ষমা করবেনা”। “আমি জানি”; নিস্প্রান কণ্ঠে বললাম আমি । “মাঝে মাঝে মনে হয়... মনে হয়... দৌড়ায় গিয়া সব সত্যি কথা বলে দেই”। “না... হামিদ! এটা করিস না! মেয়েটাকে সুখে থাকতে দে”। “সুখ! এইটাকে তুই সুখ বলিস? তুই কি মনে করিস তোকে হারিয়ে সে সুখে আছে? জানিস ও এখনো তোকে কতটা ভালবাসে?” আমি হাসার চেষ্টা করলাম, “হারিয়েছে আমাকে। কিন্তু পেয়েছে অনেক কিছু। আলিসান বাড়ি, দামী গাড়ি, হ্যান্ডসাম স্বামী আর কাড়ি কাড়ি টাকা! এসবের তুলনায় আমার ভালবাসা খুবই সামান্য! আমাকে পেতে চাইলে সারা জীবন দুঃখের সাগরে ভাসতে হবে”। হামিদ নাছোড়বান্দার মত বলল, “কানিজ না হয় অনেক কিছু পেয়েছে, কিন্তু তুই কি পেলি?” আমি হাসলাম, “আমি তো কিছু পেতে চাইনি! শুধু হারাতে চেয়েছি! হারানোর ব্যাথা নিয়ে জ্বলে পুড়ে নিঃশেষ হয়ে-আমি কবি হব! সত্যিকারের কবি”! (গল্পটার মুল থিম আমি আমার বন্ধু এবং সামহোয়্যারইন ব্লগের জনপ্রিয় ব্লগার আসিফ রেহমান এর লেখা বড় একটা উপন্যাস থেকে নিয়েছি। তার লেখা খুন গল্পটাতে ঐ উপন্যাসের আরও কিছু অংশ রয়েছে। সবার কাছে সময় পেলে পড়ে দেখার অনুরোধ রইল। )


এডিট ডিলিট প্রিন্ট করুন  অভিযোগ করুন     

গল্পটি পড়েছেন ২০২ জন


এ জাতীয় গল্প

→ আল্লার সাথে প্রেম করেছি (কবিতা)
→ কবি লিখলেন মেঘ
→ কবি ও কবিরাজ
→ তুষার কবিরের কবিতা
→ আশ্চর্য কবিতা
→ কবিরা গুনাহ পর্ব ৪ (৪নামাজে অবহেলা করা)
→ কবিরা গুনাহ পর্ব ২ (২) মানুষ হত্যা করা
→ কবিরা গুনাহ পর্ব ২ (১)আল্লাহর সাথে শিরক করা
→ কবিরা গুনাহ পর্ব (1)
→ ~গল্প-কবিতায় জিজেতে প্রিয়জন~[চতুর্থ পর্ব]
→ ~গল্প-কবিতায় জিজেতে প্রিয়জন~[তৃতীয় পর্ব]
→ ~গল্প-কবিতায় জিজেতে প্রিয়জন~[দ্বিতীয় পর্ব]
→ ~গল্প-কবিতায় জিজেতে প্রিয়জন~[প্রথম পর্ব]
→ কবিরাহ্ গুনাহ্
→ ~কবি vs প্রবাসী~[তৃতীয় ও শেষ পর্ব]

গল্পটির রেটিং দিনঃ-

গল্পটির বিষয়ে মন্তব্য করুন

  • গল্পটির বিষয়ে মন্তব্য করতে আপনার একাউন্টে প্রবেশ করুন ... ধন্যবাদ... Login Now