বিশেষ নোটিশঃ সুপ্রিয় গল্পেরঝুরিয়ান - আপনারা যে গল্প সাবমিট করবেন সেই গল্পের প্রথম লাইনে অবশ্যাই গল্পের আসল লেখকের নাম লেখা থাকতে হবে যেমন ~ লেখকের নামঃ আরিফ আজাদ , প্রথম লাইনে রাইটারের নাম না থাকলে গল্প পাবলিশ করা হবেনা
আপনাদের মতামত জানাতে আমাদের সাপোর্টে মেসেজ দিতে পারেন অথবা ফেসবুক পেজে মেসেজ দিতে পারেন , ধন্যবাদ
X
সিঙ্গেল_প্যারেন্ট
- ডাঃ শিরীন সাবিহা তন্বী
রোগীর সাথে তার মেয়ে এবং মেয়ে জামাই।কিন্তু রোগের থেকে অভিযোগের তীরটাই যেন বেশী মেয়ে আর তার স্বামীর এই খুব সাধারন দেখতে পৌঢ় নারীর প্রতি।
আমি খুব মমতা নিয়ে ওনার দিকে তাকালাম।আমার চোখে চোখ রাখতে পারল না।দেখতে স্বাভাবিক মনে হলেও দৃষ্টি বেশ উদভ্রান্ত।
এটা আমার বয়স্ক মানসিক রোগীদের জন্য একটা আশ্রয় বা আশ্রম বলা চলে।বাবা সাইকোলজির শিক্ষক ছিলেন।তার অতি আদরের ছোট বোনকে খুব কম বয়সে বিয়ে দেয়া হয়।কম বয়সেই জমজ বাচ্চার মা হতে গিয়ে প্রেগনেন্সীতে জটিলতা হয়।মৃত জমজ সন্তান প্রসবের পর মাত্র চৌদ্দ বছর বয়সে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ছোট ফুফী অত্যন্ত কষ্টকর জীবন কাটান এবং খুব মর্মান্তিকভাবে মারা যান।এই কারনেই বাবার সারাজীবনের স্বপ্ন তার একমাত্র মেয়ে সাইক্রিয়াটিষ্ট হবে।
আমি বাবার স্বপ্ন পূরন করেছি।তিনি আমার স্বপ্ন পূরন করেছেন।আমাকে ঘন সবুজে ঘেরা অসামান্য প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের মাঝে এই আশ্রমটি তৈরী করে দিয়ে গেছেন।
নার্স রোগীনির কক্ষ,বিছানা সব গুছিয়ে দিলেন।আমি তিন জনের কাছ থেকেই হিষ্ট্রি টা নিলাম।
আলেয়া বেগম।চাঁদের আলোর মতন রুপ তার।তের বছর বয়সে তার চাচাত ভাইয়ের সাথে মা আর চাচীর শখ পূরনে বড় আহ্লাদে তাদের বিয়ে।হাসি খেলা খুনসুটিতে জীবন কাটছিল।আড়াই বছর পরে কোল জুড়ে মেয়ে রাবু এল।খুশী যেন উপছে পরছিল আলেয়ার জীবনে।কিন্তু সে খুশি বেশীদিন টিকল কই।মেয়ের চার বছর বয়স।এলাকায় যাত্রা পালা এল।প্রথম রাতেই মা মেয়েকে নিয়ে যাত্রা দেখতে গেল মানুষটা।পরের ছয় দিন একাই গেল।সপ্তম দিনে সেই যে সাঝেঁর বেলা সেজেগুজে যাত্রা দেখতে গেল,আর ফিরল না।
রাত যায়,দিন যায়।চোখের জলে আলেয়া বুক ভাসায়।মানুষটা গান পাগল।তাই বলে ঘর সংসার,মেয়েকে ফেলে?আলেয়াকে ফেলে??এত প্রেম,এত ভালোবাসা সব মিথ্যে???
সত্য মিথ্যের দোলায় দুলতে দুলতে দিন যায় মাস যায়।অপেক্ষার প্রহর শেষ হয় না।হুজুর,দরবেশ,তেলপড়া,পানিপড়া,বাটি চালান কিছু বাকী রাখেনি আলেয়া।কেউ বলে যাত্রা পালার রমিছারে সাদী করছে।কেউ বলে শহরে গাড়ীর তলে পরে মরেছে।
কত নির্ঘুম রাত,কত চোখের পানি ফেলতে ফেলতে বছর কেটে যায়।মেয়ে বড় হয় ধীরে ধীরে।
মেয়ের সাত বছর বয়সের সময় বাপ বিয়ে ঠিক করে আলেয়ার।বেনারসী ও পরেছিল সে।বুকটার মধ্যে কু ডাকছিল খুব।কেমন যেন হু হু করা অনুভূতি।চোখের পানিতে সব ঝাপসা দেখাচ্ছিল।
রাবু দৌড়ে এসে আঁচল টেনে ধরল।আলেয়ার আর নতুন সংসার করা হলো না।
পরের জীবনটা খুব কঠিন ছিল।শ্বাশুড়ী ভালো চোখে দেখত না।জমি জমার ভাগ ঠিক মত দিত না।শ্বশুড় মরার পরে বাড়ী ভাগ হলো।মেয়ে বলে রাবুর কোন ভাগ নেই।আজ এর ঘরে কাল ওর ঘরে।এ ঘরের কাপড় ধুয়ে ও ঘরের মসলা বেটে সকলের মন যুগিয়ে তবে বেঁচে থাকা।
নিজেকে সকলের পদতলে ঠাঁই দিয়ে তবে মেয়েকে স্কুলে পড়াত সে।
রাবু মেট্রিক পাস করল,ইন্টার পাস করল।মেয়েটি দেখতে ভালো।আচার ব্যবহার ভালো।ওর এক মাষ্টার মহাশয়ের ভাগ্নে শহরে বীমা কোম্পানীতে চাকরী করে।তার জন্য প্রস্তাব আনলে বিয়ে হয়ে গেল।রাবু শহরে নিজেকে একটু গুছিয়ে নিয়েই মাকে নিয়ে এসেছে সংসারে।
কিন্তু বছর ঘুরতেই চির চেনা আলেয়া বেগমের মাঝ থেকে বেড়িয়ে এল এক অচেনা আলেয়া বেগম।
মেয়ের সুখ সে কিছুতেই সহ্য করতে পারছে না।রাবুকে তার স্বামী সোহাগ করলে,শাড়ী গয়না কিনে দিলে,বেড়াতে নিয়ে গেলে প্রচন্ড রাগ হয় আলেয়া বেগমের।রাগে ফুঁসতে থাকে সে।জিনিস পত্র ভাঙ্গে।ওরা দুজনে ঘরে গেলেই দরজায় আঁড়ি পাতে সে।হৈ চৈ করে ওদের শান্তি ভঙ্গ করে।
আলেয়া বেগমকে পাশে বসিয়ে জানতে চাইলাম,কেন এমন করেন?অস্বীকার করল না।খানিকটা ভাবলেশহীন দৃষ্টিতে কপালটা কুঁচকে বলল,আমার যে বড় কষ্ট হয়!রাগ হয় বড়!আমার যে যৌবন ছিল,স্বামী ছিল,সংসার ছিল।সব কেন নাই হইয়া গেল??কেন কেন??আমার হিংসা হয়।খুব হিংসা হয়।কারো সুখ সহ্যি হয় না।
স্তব্ধ হয়ে চেয়ে থাকলাম।দরজায় দাঁড়িয়ে থমকে গেলাম।সালু দাঁড়িয়ে।ও এই আশ্রমের প্রথম দিককার রোগী।সুস্থ হয়ে এখন এখানকার কর্মী।তিন বছর আগে প্রায় একি সমস্যা নিয়ে এসেছিল।ওর শ্বশুড় ওর স্বামীর দেড় বছরের সন্তান রেখে মারা যাওয়ার পর দেবরের সাথে ওর বিয়ে দিতে চায়।দেবরের বউ ছিল এক ছেলে ছিল।অশিক্ষিত বাচ্চা একটা মেয়ে নিজের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়েছে।তবু দেবর বউকে কষ্ট দেয়নি।আজ এত বছর পর মেয়ের ঘরের নাতনী স্কুলে পড়ে।
তখন তাকে অস্থিরতায় পেল।সে বিয়ে করতে চায়।স্বামী চায়।সংসার চায়।
আমার দেয়ালে মাথা কুটেছে সালু।কেন তার এই পাপের অনুভূতি হচ্ছে।
কম বয়সে বিধবা,সন্তানের দায়িত্ব সব মিলিয়ে কঠিন জীবন কাটিয়ে যখন একটু রিল্যাক্স,তখন মনের অন্ধ গলি বেয়ে না পাওয়ার হাহাকার।
সালু সব শুনেছে।সে এগিয়ে এসে আলেয়ার হাতটা ধরল।বুঝলাম এর যত্নের ভার সালুই নেবে।যে কষ্ট সে সয়েছে,চিকিৎসায় আস্তে আস্তে নিজেকে এই বয়স আর দুর্ঘটনার বাস্তবতার সাথে মানিয়ে নিয়েছে।সে কষ্ট লাঘবে তার থেকে আপন কে হবে?
সন্ধ্যের আলো জ্বলেছে মাত্র।রাবু এসেছে তার মায়ের থেকে বিদায় নিতে।মেয়েটির মন খারাপ।মা নিজের জীবন শেষ করে তার জীবন গড়েছে।আজ সে নিজের সুখের জন্য মাকে আশ্রমে রেখে যাচ্ছে।রাবু বিদায় নিয়ে ফিরলেই আলেয়া বেগম ওর আঁচলটা টেনে ধরল শিশুর মত।
আমি দরজায় দাঁড়িয়ে আলেয়ার হিষ্ট্রিটা মনে করলাম।তার বিয়ে ঠিক হবার দিনে রাবু এমনি করেই আঁচল টেনে ধরেছিল।আলেয়া আঁচলটা ছাড়িয়ে সুখের ঘর বাঁধতে পারেনি।সেই না পারার হাহাকার জমে জমে তার জীবনটাকে এতটাই বিষময় করে তুলেছে!আজ রাবু ঠিক ই আঁচল ছাড়িয়ে চলে গেল!
সিঙ্গেল প্যারেন্টিং খুব কষ্টের একটি বিষয়।বড়লোক বাবার দুলালী আমার মা,আমাকে ফেলে চলে গেলেন।বাবা একা অনেক কষ্ট করে আমাকে বড় করেছেন।অনেকদিন পর মৃত বাবাকে ভেবে আমার বুকের ভেতরটা হু হু করে উঠল।
অদূরে আশ্রমের পাশেই বাবার কবর।পাশে এসে দাঁড়াতেই আমার দু ফোঁটা অশ্রু কবরের মাটিতে গড়াল।
বুকের গভীর থেকে অস্ফুটে বেড়িয়ে এল,বাবা ভালোবাসি তোমাকে !!!
গল্পটির বিষয়ে মন্তব্য করুন
গল্পটির বিষয়ে মন্তব্য করতে আপনার একাউন্টে প্রবেশ করুন ... ধন্যবাদ... Login Now