বাংলা গল্প পড়ার অন্যতম ওয়েবসাইট - গল্প পড়ুন এবং গল্প বলুন

বিশেষ নোটিশঃ সুপ্রিয় গল্পেরঝুরিয়ান - আপনারা যে গল্প সাবমিট করবেন সেই গল্পের প্রথম লাইনে অবশ্যাই গল্পের আসল লেখকের নাম লেখা থাকতে হবে যেমন ~ লেখকের নামঃ আরিফ আজাদ , প্রথম লাইনে রাইটারের নাম না থাকলে গল্প পাবলিশ করা হবেনা

আপনাদের মতামত জানাতে আমাদের সাপোর্টে মেসেজ দিতে পারেন অথবা ফেসবুক পেজে মেসেজ দিতে পারেন , ধন্যবাদ

মানুষের ডেরায় স্বপ্নের খুঁটি

"যুদ্ধের গল্প" বিভাগে গল্পটি দিয়েছেন গল্পের ঝুরিয়ান রিয়েন সরকার (০ পয়েন্ট)

X মানুষের ডেরায় স্বপ্নের খুঁটি সেলিনা হোসেন ছোট ক্যানভাসটি নানা রঙে ভরিয়ে তুলছে আমিন উদ্দিন। গাছের নিচে বসে আঁকা ওর প্রিয় অভ্যাস। এমন একটি অভ্যাসের ভেতরে ঢোকার দিন-তারিখের হিসাব আমিনের মনে নেই। শুধু মনে আছে যুদ্ধ শেষে দেশে ফিরলে এমন একটি চিন্তা ওর ভেতরে ভোরের আলোর মতো ছড়ায়। ক্যানভাসের রঙের মধ্যে ফুটে থাকবে শহীদের মুখ। গ্রামের স্কুলে চাকরি করতে এসে এমন একটি ছায়াঘেরা জায়গা পেয়ে সিদ্ধান্তটি এমনই হয়েছিল। ও বুক ভরে বাতাস টেনে চারদিকে তাকায়। তখনো সূর্য ওঠেনি। বাতাসে শীতের মৃদু আমেজ। নিজেকেই বলে, দেখ কেমন মনোরম স্নিগ্ধতা। বড় করে শ্বাস টেনে এক ফুঁয়ে জীবনটা উড়িয়ে দিতে ইচ্ছা হচ্ছে। ক্যানভাসে নীল রঙের আঁচড় টেনে বলে, মৃত্যু আমার কাছে সৌন্দর্য। এই ক্যানভাসের উজ্জ্বল রঙের মতো। জলরঙে গড়িয়ে যায় আঁকাবাঁকা রেখা। ফুটে উঠতে থাকে একটি মুখের আদল। একদিন এ দেশে যুদ্ধ হয়েছিল। স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ। আমিন উদ্দিনের বয়স তখন তিরিশের কোঠায়। প্রাইমারি স্কুলে শিক্ষকতা করে আর মনের আনন্দে ছবি আঁকে। আমিনের ক্যানভাসে শহীদের মর্যাদায় ফুটে ওঠে সব মুখ। যেসব ছেলে-মেয়ের ছবি আঁকা শেখায়, তাদের কেউ কেউ জিজ্ঞেস করে, এত মানুষের মুখ আঁকেন কেন স্যার? আমিন উদ্দিন সোজা হয়ে বসে, বুক টান করে ওদের সামনে একজন মুক্তিযোদ্ধার প্রতিকৃতি হয়ে গর্বের সঙ্গে বলে—যাঁদের মুখ আঁকি তাঁরা সবাই স্বাধীনতার জন্য জীবন দিয়েছেন। আপনি সবাইকে চিনতেন, স্যার? শহীদদের চিনতে হয় না, সোনামাণিকরা। ৩০ লাখ শহীদের মুখ আমার বুকের ভেতর আছে। যাঁদের দেখিনি তাঁদেরও মুখ আঁকি। আমরাও আঁকব। আমরা যদি একটা বড় ফুল আঁকি, সেটা কি শহীদের মুখ হবে? পাশের জন সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ করে—ধুৎ, কেমন করে হবে? ফুল কি মানুষের মুখ! তাহলে আমি নদী আঁকব। আমি একটা পাকা ধানের শিষভরা ক্ষেত আঁকব। তার ওপর দিয়ে উড়ে যাবে বুলবুলির ঝাঁক। আমি আমাদের সবার মুখ আঁকব। একটা কাগজে ছোট ছোট করে সব ছেলে-মেয়ের মুখ। একজন গালে আঙুল ঠেকিয়ে ভাবুকের ভঙ্গিতে বলে, এই দেশের স্বাধীনতার জন্যই তো তাঁরা জীবন দিয়েছেন। এসব আঁকলেই শহীদদের আঁকা হবে। ছেলে-মেয়েরা নিজেরা নিজেরা কথা বলে, তখন আমিন উদ্দিন নিজের স্বপ্নের ভেতরে ডুবে যায়। স্বপ্নের ভুবন একটি যুদ্ধক্ষেত্র। যুদ্ধক্ষেত্রের মাঝ দিয়ে হেঁটে যায় ও। ওর সামনে ক্যানভাস নেই। হাতে অস্ত্র। চারপাশে ধ্বংস ও মৃত্যু। আছে বুকের ভেতরের বড় ইজেলে স্বাধীনতার বিচিত্র রং। রঙের কোনো সীমা-পরিসীমা নেই। চোখে দেখা রঙের বাইরেও অজস্র আলোর ফুলকি ঝলকায়। হেঁটে যেতে যেতে দেখা হয় প্যাট্রিক হেনরির সঙ্গে। আমিন হাসিমুখে স্বাগত জানিয়ে বলে, প্যাট্রিক হেনরি আপনি? হ্যাঁ, আমি। যুদ্ধক্ষেত্রে তোমাকে দেখতে এসেছি। স্বাধীনতার লড়াই সহজ কথা নয়। তুমি ইতিহাস ভালো করে জানো। আমি জানি, আপনি যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়া রাজ্যের শাসক ছিলেন। ব্রিটিশ উপনিবেশের শেকল ভাঙতে চেয়েছিলেন। সেইন্ট জর্জ চার্চের সমবেত মানুষের সামনে স্বাধীনতার ডাক দিয়েছিলেন। হ্যাঁ, সেদিন বলেছিলাম, আমাকে স্বাধীনতা দাও, নয়তো মৃত্যু। আপনি বলেছিলেন, জীবন কি এতই প্রিয়, আর শান্তি কি এতই মধুর যে শেকল আর দাসত্বের মূল্যে তাঁকে কিনতে হবে? আপনার এই লাইন পড়ে আমি বন্ধুদের বলতাম—না, জীবন এত ক্ষুদ্র নয়। জীবনের সীমানা বিশাল। তাকে রক্ত আর মৃত্যু দিয়ে স্বাধীনতার গৌরবে ভরে তুলতে হয়। আপনি যেদিন ভাষণ দিয়েছিলেন সেই তারিখটি আমার মনে আছে—২৩ মার্চ ১৭৭৫। তোমাদের শুরুটাও মার্চ মাসে। তোমাদের জীবনে ৭ মার্চ আছে। ঠিক বলেছ, প্রিয় বন্ধু প্যাট্রিক হেনরি। তুমি ইতিহাসের পাতায় চিরঞ্জীব থাকো। এই মুহূর্তে আমি তোমার পাশে আছি। ছায়ার মতো আছি। সাহসের সঙ্গে এগিয়ে যাও বন্ধু। তখনই শত্রুর গুলি এসে বিদ্ধ হয় মিজানুরের ঘাড়ে। ও পড়ে যায়। ওহ্, কী নিদারুণ সময় ছিল সেদিন। পড়ে যাওয়া মিজানুরের শরীর টপকে ছুটে গিয়েছিল ও। প্রবল উন্মাদনায় শত্রুর মোকাবেলা করেছিল। ওর বাহিনী পরাজিত করেছিল পাকিস্তানি সেনাদের। শত্রুর একজনও সেদিন জীবিত ফিরে যেতে পারেনি। অপারেশন শেষে মিজানুরের কাছে ছুটে এসেছিল ও। দেখছিল, মিজানুর তখনো কাতরাচ্ছে। জ্ঞান হারায়নি। ওকে দেখে হাত চেপে ধরে বলেছিল, তুই না বলেছিলি, আমাকে স্বাধীনতা দাও, নয় মৃত্যু। আজ স্বাধীনতার জন্য আমার সামনে মৃত্যু। তুই আমার মাকে খবরটা পৌঁছে দিস। বলিস, মা যেন দুঃখ না পায়। এ মৃত্যু গৌরবের। ওকে ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়ার পথে মারা যায় মিজানুর। এখনো থেমে থেমে কথা বলা মিজানুরের কণ্ঠস্বর কানে বাজে আমিনের। ও দুই হাতে মুখ ঢাকে। মাথা ঝাঁকায়। যেন দৃশ্যটি এই মুহূর্তে ওর সামনে, এই গাছতলায়। চারপাশে ভিড় করে আছে শিশুরা। আমিন উদ্দিন গাছের কাণ্ডে পিঠ ঠেকায়। প্যাট্রিক হেনরির কণ্ঠস্বর শুনতে পায় ও—বলেছি না, স্বাধীনতাযুদ্ধে অংশগ্রহণ না করার অর্থ দাসত্বকে মেনে নেওয়া। আমরা তেমন জাতি নই। আমাদের সামনে যুদ্ধ। আমরা তাকে বরণ করব। মরণের বরণডালায় রক্তের জীবন—আমিন উদ্দিন নিজেকেই কথা বলে টের পায়, ওরা আসছে। মাটিতে ওদের ছোট পায়ের মৃদু ধ্বনি। ও মুখ থেকে হাত সরায়। দেখতে পায়, কাগজ-রংতুলি নিয়ে ওরা আসছে। স্যার, আপনি মুখ ঢেকে রেখেছিলেন কেন? আমরা দূর থেকে আপনাকে এভাবে দেখেছি। স্যার, আপনার কি মন খারাপ? তোদের মতো ছেলে-মেয়েরা যার চারপাশে থাকে, তার কি মন খারাপ হয় রে? আমরা খুশি, আমরা খুশি। ওরা হাসতে হাসতে গাছতলা ভরিয়ে তোলে। কাগজ বিছিয়ে নিজেরা বসে। বলে, আজ আমরা আপনার ছবি আঁকব। কেন, আমাকে কেন? সবার বড় ১৩ বছরের সন্তু বলে, এটাও শহীদের মুখ হবে। শহীদের মুখের ছবি। ও, তাই, তাহলে আঁক। যেভাবে বসে আছি সেভাবে বসে থাকব? হ্যাঁ, থাকেন। আমাদের যে রকম খুশি সে রকম আঁকব। আঁকা হলে বুঝতে পারবেন, আপনার মুখটা আপনার না। তবে কার? তোদের কী মনে হয়? সেই মুখ একজন মুক্তিযোদ্ধার। মুক্তিযোদ্ধার! ঠিক আছে। লাখ লাখ মানুষ যুদ্ধ করেছে, তাদের কারো না কারো মুখের সঙ্গে মিলে যাবে। হ্যাঁ, যাবে যাবে। ছোটদের উত্ফুল্ল কণ্ঠ ধ্বনিত হয়। আমিন উদ্দিন আনন্দে চোখ বোজে। ভাবে, এ জীবন আনন্দের, এ জীবন উচ্ছ্বাসের। তাই কি? আবার ওর ভাবনায় ঢুকে যায় যুদ্ধক্ষেত্র। ওর সামনে এগিয়ে আসেন আব্রাহাম লিংকন। তিনি বলেছেন, স্বাধীনতার স্বপ্ন ছোট করে দেখতে নাই আমিন উদ্দিন। আপনি তো মাত্র ৩ মিনিটের একটি বক্তৃতা দিয়ে ইতিহাসের পাতায় উঠে এসেছেন। অব দ্য পিপল, বাই দ্য পিপল, ফর দ্য পিপল। হা-হা করে হাসেন তিনি। যুদ্ধক্ষেত্রের গোলাগুলির মধ্যে তাঁর হাসি অমলিন থাকে। গোলার শব্দ ম্লান করে দিয়ে সে হাসি ভরিয়ে তোলে মুক্তিযোদ্ধা আমিনের বুক। ও বলতে থাকে—ইতিহাস থেকে আমরা জানি, যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভানিয়ার গেটিসবার্গে মাত্র কয়েক দিনের গৃহযুদ্ধে আট হাজার লোক নিহত হয়েছিল। যুদ্ধের চার মাস পর তাদের স্মরণে নির্মিত হয়েছিল স্মৃতিসৌধ। তাদের স্মরণে আয়োজিত সভায় আপনি যে বক্তৃতা করেছিলেন তা গেটিসবার্গ অ্যাড্রেস নামে খ্যাত। আমি মনে করি, ইতিহাস জানা খুব জরুরি। বেঁচে থাকার জন্য স্বাধীনতার বিকল্প কিছু নেই। আব্রাহাম লিংকন, আপনি ইতিহাসের অমর মানুষ। স্বাধীন দেশে বাস করার যে ধারণা আপনি দিয়েছেন, তা গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের চেতনায় সোনার হরফ। আবার হা-হা হাসিতে ভরে যায় যুদ্ধক্ষেত্র। আমিন শুনতে পায় তাঁর কণ্ঠস্বর—জনগণের সরকার, জনগণের দ্বারা সরকার, জনগণের জন্য সরকার। আপনি আমাকে আশীর্বাদ করুন আব্রাহাম লিংকন। আমার প্রার্থনা, তোমরা যেন যুদ্ধে জয়ী হতে পারো। তোমাদের স্বাধীন দেশে প্রতিষ্ঠিত হবে জনগণের সরকার। তখন সিলেটের ধলই সীমান্তে মুন্সী রউফ তাঁর মেশিনগান থেকে অনবরত গোলা বর্ষণ করে যাচ্ছেন। পাকিস্তানি সেনারা নানা কৌশলে এগিয়ে আসছে। চারদিক ঘিরে ফেলেছে। মুন্সী রউফ অন্যদের বলছে, আমি গুলি চালিয়ে শয়তানদের দমিয়ে রাখছি। তোমরা পিছু হটে যাও। অন্যরা পিছু হটে যায়। মেশিনগান থেকে গুলিবর্ষণ করে শত্রুদের ছিন্নভিন্ন করে, কিন্তু একসময় ওদের গোলা এসে পড়ে মুন্সী রউফের ওপর। শহীদ হন তিনি। সে জন্যই নেলসন ম্যান্ডেলা বলেছিলেন, স্বাধীনতা অর্জনের কোনো সহজ পথ নেই। স্বাধীনতার দাবি রক্ত আর মৃত্যু। সে জীবন দেয় আপামর জনসাধারণ। আমিন উদ্দিন চোখ খুললে দেখতে পায় ছেলে-মেয়েরা তার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। আমিন সোজা হয়ে বসে। একজন ডাকে, স্যার। আমিন উদ্দিন ওর দিকে তাকায়। ও চিন্তা করতে চায় যে ও কত দিন ধরে এই ছেলে-মেয়েদের ছবি আঁকা শেখাচ্ছে। গত ১৫ বছরে অনেকে আঁকা শিখেছে। বড় হয়েছে। চলে গেছে অন্য কোথাও। কাজের খোঁজে শহরে গেছে কিংবা বিদেশে। কারো বিয়ে হয়ে চলে গেছে অন্য গ্রামে। বাবার বাড়িতে এলে ওর সঙ্গে দেখা করতে আসে। বলে, আমাদের গাঁয়ে আপনার মতো স্যার নাই। থাকলে আমার ছেলেটাকে ছবি আঁকা শেখাতাম, স্যার। ছোটবেলায় আপনার কাছে ছবি আঁকা শিখেছিলাম বলে আমি অনেক কিছু সুন্দর করে করতে পারি। আমিন ওদের স্বাধীনতাযুদ্ধের কথা শুনিয়েছে। এখন ওর সামনে একদল ছেলে-মেয়ে। এখন ওর সামনে সময় ১৮৬৩ সালের নয়। যখন আব্রাহাম লিংকন বলেছিলেন, আমাদের পূর্বপুরুষরা আমেরিকা মহাদেশ গড়েছিলেন। তাঁদের লক্ষ্য ছিল স্বাধীনতা ও জনগণের জীবনমানের সমতা। এই লক্ষ্য নিয়ে তাঁরা যুদ্ধ করেছিলেন। গৃহযুদ্ধে আমাদের শত শত মানুষ জীবন দিয়েছিল। মানুষই একটি দেশের শক্তি। তাদের পূর্ণ জীবনের অধিকার দিতে হবে। স্যার, আপনি দেখবেন না আপনাকে কিভাবে এঁকেছি? হ্যাঁ, দেখব তো। দাও। ওরা একটা একটা করে ওর সামনে কাগজ দিয়ে যায়। কাগজগুলো গুছিয়ে আমিন বলে, আজ তোমাদের ছুটি। কাল আমাদের স্কুল আছে। আপনি কি ক্লাসে স্বাধীনতার কথা পড়াবেন, স্যার? আপনি কত সুন্দর করে শহীদদের কথা বলেন। ঠিক আছে, আগামীকাল তোমাদের বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমানের গল্প শোনাব। সেই সঙ্গে নেলসন ম্যান্ডেলার। তিনি বলেছিলেন, স্বাধীনতা লাভ কঠিন। কোনো সহজ পথে স্বাধীনতা হয় না। ছেলে-মেয়েরা একসঙ্গে বলে, কোনো সহজ পথে স্বাধীনতা হয় না। এই কথাটা বলতে বলতে তোমরা বাড়ি চলে যাও। যদি আমরা গানের সুরের মতো টেনে টেনে বলি। বলো, সে তো আরো ভালো। ওরা চলে যেতে থাকে। দুজন ফিরে এসে বলে, আপনি বাড়ি যাবেন না, স্যার? তোমরা যাও। আমি একটু পরেই যাব। পরক্ষণে ভাবে, ওদের বাড়ি যেতে বলা সহজ। নিজেকে বলা সহজ নয়। ওরা চলে গেলে আমিন উদ্দিন নিজের ক্যানভাসের দিকে তাকায়। ওখানে কি সোহেলির মুখটা ফুটে ওঠে কখনো? যাকে ও স্বাধীনতার পরে কামালপুরের বাংকার থেকে উদ্ধার করেছিল। মেঘালয়ের সীমান্ত বর্ডারে বিধ্বস্ত সোহেলি ওকে জিজ্ঞেস করেছিল, আমি কোথায় যাব? আমিন উদ্দিন বলেছিল, আপনার বাড়িতে। উদ্ভ্রান্ত সোহেলি বলেছিল, মৃত্যু কি খুব কঠিন? আপনার রাইফেলে গুলি আছে? আমিন চুপ করে থাকলে সোহেলি আবার বলেছিল, একটি গুলি খরচ করুন আমার জন্য। আমি তো জানি আমার বাড়ি নেই, দেশও নেই। আমি কোথাও যাব না। আমিন গম্ভীর স্বরে বলেছিল, আপনাকে আমার বাড়িতে নিয়ে যাব। আপনার বাড়িতে? কে আছে? মা-বাবা, ভাই-বোন সবাই আছে। আমি বিয়ে করিনি। তারা আমাকে মানবে? মানবে না। আমি মানাব। আমি আপনাকে ভালোবাসা দেব। আপনি তো দেশের জন্য নিজের সব কিছুই দিয়েছেন। আপনিও যুদ্ধ করেছেন। যা কিছু ঘটেছে তার জন্য আপনার নিজের কোনো দায় নেই। দায় এই জাতির। সেদিন প্রবল কান্নায় ভেঙে পড়েছিল সোহেলি। আমিনের খুব ইচ্ছা হয়েছিল ওকে গভীর মমতায় বুকে জড়িয়ে ধরতে। কিন্তু চারপাশে লোক জমে যাওয়ায় সে কাজটি করা হয়নি। একজন ভারতীয় ক্যাপ্টেনকে অনুরোধ করে তার জিপে সোহেলিকে নিয়ে এসেছিল ময়মনসিংহে। ও কিছুতেই ওর বাড়ির ঠিকানা বলেনি। কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অতিথিশালায় ওকে রাখা হয়েছিল। রাতের অন্ধকারে ও পালিয়ে গিয়েছিল। পরদিন ওর লাশ পাওয়া গিয়েছিল ব্রহ্মপুত্র নদে। এখনো সোহেলির মুখ ওর ক্যানভাসের একটি বড় জায়গা। ও মনে করে সোহেলি শহীদ। স্বাধীনতার জন্য যা দেওয়ার তার সবটুকু দিয়েছে। কিছুই বাদ রাখেনি ও। সোহেলির মৃত্যু আমিনের ক্যানভাসে মৃত্যুর সৌন্দর্য। সেই দুপুরে ঘরে ফিরে ওর খুব মন খারাপ থাকে। কোনো কাজে মন বসে না। সোহেলিকে মনে রেখে ওর আর বিয়ে করা হয়নি। ষাট বছরের নিঃসঙ্গ জীবন কেটেছে স্কুলে পড়িয়ে, ছবি এঁকে, ছেলে-মেয়েদের ভালোবেসে। অনেক রাতে ক্যানভাসের সামনে বসলে ফুটে উঠতে থাকে ভিন্ন ছবি। যেন ক্যানভাসটি মিছিলের নগরী। হাজার হাজার মানুষ মুষ্টিবদ্ধ হাত নিয়ে এগিয়ে আসছে। বর্ণবাদী নির্যাতনের বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ আমেরিকার কৃষ্ণ-মানুষেরা। কৃষ্ণাঙ্গ নেতা মার্টিন লুথার কিং শান্তিপূর্ণ অহিংস আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ করছেন সাধারণ মানুষকে। বলছেন, আই হ্যাভ আ ড্রিম......। বব ডিলান আর জন বয়েজের বিপ্লবী গানের সুরে উত্তাল জনসমুদ্র। সময় ১৯৬৩। দিন ২৮ আগস্ট। তিনি বলেছিলেন, জনগণের অধিকার অর্জনের কথা। বলেছিলেন, আমি স্বপ্ন দেখি জন্মসূত্রে সব মানুষ সমান। মানুষকে মানুষের মর্যাদা দিতে হয়। সাদা আর কালো দিয়ে বৈষম্য করা অন্যায়। ক্যানভাস থেকে মাথা তুললে আমিনের মনে হয় ঘরজুড়ে আলো ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছেন মার্টিন লুথার কিং। দুই চোখে বিস্ময় ছড়িয়ে আমিন উদ্দিন বলে, আপনি? তোমাকে দেখতে এসেছি শিল্পী। বাংকার থেকে উঠে আসা মেয়েটিকে ভালোবাসা দিয়ে মানবতার ঘাটতিকে জয় করেছ শিল্পী। জানোই তো ম্যান্ডেলা বলেছিলেন, ‘স্বাধীনতা অর্জনের কোনো সহজ পথ নেই। ’ সোহেলিকে স্বাধীনতা অর্জনের কঠিন পথে যেতে হয়েছিল মার্টিন। হ্যাঁ, হয়েছিল। আমি জানি। যুদ্ধের এটাই নিয়ম। কৃষ্ণ মানুষের অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে আপনাকে প্রাণ দিতে হয়েছিল। এটা মৃত্যুর সৌন্দর্য। মার্টিন লুথার কিং মৃদু হেসে বলেন, তুমি ছেলে-মেয়েদের স্বাধীনতার কথা বলছ, এটি অনেক বড় কাজ। ঘরের অলো নিভে যায়। ও বুঝতে পারে লোডশেডিং। ঘরে কেউ কোথাও নেই। ক্যানভাসজুড়ে আঁকা হয়েছে একজন মানুষের রক্তাক্ত শরীর। তিনি কী আব্রাহাম লিংকন, নাকি মার্টিন লুথার কিং, নাকি বঙ্গবন্ধু? আমিন উদ্দিন চার্জার লাইট জ্বালিয়ে ঘরের আলো ফিরিয়ে আনে। ও জানে আজ ৭ মার্চ। ১৯৭১ নয়। ২০১৫। স্বাধীনতা যুদ্ধের সূচনা করেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি বলেছেন, আমরা পিছু তাকাব না, সোনার মানুষেরা। যেতে হবে অনেক দূর। ও বলেছিল, বঙ্গবন্ধু আমি আমিন। মায়ের এক ছেলে। মাকে একা রেখে যুদ্ধ করতে এসেছি। তিনি বলেছিলেন, আমাদের মায়েরা ঘরে ঘরে দুর্গ গড়েছেন। তাঁদের চোখে জল নেই। আগুন আছে। তোমরা এই আগুন নিয়ে লড়াইয়ের মাঝে বীর যোদ্ধা। আমাদের মেয়েরা বীর যোদ্ধা। যুদ্ধ সবার। হ্যাঁ, যুদ্ধ সবার। সোহেলি তোমার হাত ধরে আমি হেঁটে যাই যুদ্ধক্ষেত্রে। আমি বলব না, আই হ্যাভ আ ড্রিম। আমরা বলব, উই হ্যাভ আ ড্রিম। স্বপ্ন ছাড়া বেঁচে থাকা অর্থহীন সোহেলি। আমি এখনো স্বপ্ন দেখি। বঙ্গবন্ধু বলতেন, বাংলার দুঃখী মানুষকে আমি সবচেয়ে বেশি ভালোবাসি। ওরা আমাকে মারবে না। কিন্তু ওরাই তাঁকে মেরেছিল। বিশ্বাসঘাতকতার নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত। পরদিন অস্ট্রেলিয়ার অ্যাডিলেডের ক্রিকেট মাঠে ইংল্যান্ডকে হারিয়ে বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে উঠলে অধিনায়ক যখন নিজেদের বিজয়কে মুক্তিযোদ্ধাদের উৎসর্গ করেন, তখন আমিনের মনে হয় ও সোহেলির হাত ধরে হেঁটে যাচ্ছে। ওরা এখন অস্ট্রেলিয়ার পথে। আমিন সোহেলিকে বলছে, দেখো ওরা বাংলাদেশকে কোথায় উঠিয়েছে। একদম আকাশের কাছাকাছি। তোমার আমার যুদ্ধটা এ রকমই ছিল সোহেলি। আমরা পৃথিবীর মানচিত্রে একটি দেশ যুক্ত করেছি। ওরা আমাদের মনে করছে। তোমার-আমার যুদ্ধকে। চলো ওদের খেলার মাঠ থেকে ঘুরে আসি। মুক্তিযোদ্ধা সোহেলি তোমার হাতটা বাড়াও। আমি ধরি। আমিন উদ্দিনের কানে ভেসে আসে উল্লাসধ্বনি। ছেলে-মেয়েরা বাংলাদেশের পতাকা নিয়ে দৌড়াচ্ছে। দুই চোখ ভরে ওদের আনন্দ উপভোগ করে ও। নিজের দুহাত বুকের ওপর চেপে রাখে। শুনতে পায় বিশ্ব নেতাদের কণ্ঠস্বর। সবাই মিলে বলছেন, উই হ্যাভ আ ড্রিম........। আমিনের দুই চোখ জলে ভরে যায়। বাংকার থেকে বেরিয়ে আসা সোহেলি ওর সামনে। চারদিকে মুক্তিযোদ্ধাদের কণ্ঠে বিজয়ের ধ্বনি। ওর ক্যানভাসে বিমূর্ত একাত্তর।


এডিট ডিলিট প্রিন্ট করুন  অভিযোগ করুন     

গল্পটি পড়েছেন ২৫০ জন


এ জাতীয় গল্প

গল্পটির রেটিং দিনঃ-

গল্পটির বিষয়ে মন্তব্য করুন

  • গল্পটির বিষয়ে মন্তব্য করতে আপনার একাউন্টে প্রবেশ করুন ... ধন্যবাদ... Login Now