বাংলা গল্প পড়ার অন্যতম ওয়েবসাইট - গল্প পড়ুন এবং গল্প বলুন

বিশেষ নোটিশঃ সুপ্রিয় গল্পেরঝুরিয়ান - আপনারা যে গল্প সাবমিট করবেন সেই গল্পের প্রথম লাইনে অবশ্যাই গল্পের আসল লেখকের নাম লেখা থাকতে হবে যেমন ~ লেখকের নামঃ আরিফ আজাদ , প্রথম লাইনে রাইটারের নাম না থাকলে গল্প পাবলিশ করা হবেনা

আপনাদের মতামত জানাতে আমাদের সাপোর্টে মেসেজ দিতে পারেন অথবা ফেসবুক পেজে মেসেজ দিতে পারেন , ধন্যবাদ

পারাপার --হিমু সিরিজের ৪নং উপন্যাস (চ্যাপ্টার ২)

"উপন্যাস" বিভাগে গল্পটি দিয়েছেন গল্পের ঝুরিয়ান রিয়েন সরকার (০ পয়েন্ট)

X ইয়াকুব আলী সাহেবের ম্যানেজার মইন খান আজ স্যুট পরেছেন। আজ তাঁকে আরো সুন্দর লাগছে। বয়স কম লাগছে। গলায় লাল রঙের টাই। লাল টাইয়ে ভদ্রলোককে খুব মানিয়েছে। যারা কোনোদিন টাই পরে না তারাও এই ভদ্রলোককে দেখলে টাইয়ের দরদাম করবে। স্লামালিকুম মইন সাহেব। ওয়ালাইকুম সালাম। আপনি কোত্থেকে?সেই যে গেলেন আর কোনো খোঁজখবর নেই—স্যার খোঁজ করেন, আমি কিছু বলতে পারি না। আপনার মেসের ঠিকানায় দুদিন লোক পাঠিয়েছি—আপনি তো ভাই মেসে থাকেন না। কোথায় থাকেন? ইয়াকুব সাহেবের শরীর কেমন? ব্লাড ক্যানসারের রোগী—তার আবার শরীর কেমন থাকবে? যতই দিন যাচ্ছে ততই খারাপ হচ্ছে। বাইরে থেকে রক্ত দেয়া হয়েছে। আয়রনের পরিমাণ বেড়ে যায়। চলুন দেখা যাক। এখন দেখা করতে পারবেন না। স্যার ঘুমাচ্ছেন। আমার ঘরে এসে বসুন, গল্প-গুজব করুন। ঘুম ভাঙলে স্যারের কাছে নিয়ে যাব। আমি ম্যানেজার সাহেবের রুমে ঢুকলাম। তিনি দরজা বন্ধ করে দিলেন, গোপন কথা কিছু বলবেন কি না কে জানে! হিমু সাহেব। জি। দুপুরে খেয়েছেন? জি না, খাই নি। ঠিক করে রেখেছি দুপুরে আমি এক বান্ধবীর বাসায খাব। ওর নাম রূপা। পুরানা পল্টনে থাকে। স্যারের সঙ্গে দেখা না করে তো যেতে পারবেন না। এখানেই বরঞ্চ খাবার ব্যবস্থা করি। চাইনিজ রেস্টুরেন্ট থেকে খাবার আনিয়ে দেই। জি না। রূপার ওখানে খাব ঠিক করে রেখেছি। ওখানেই যেতে হবে। কিছুই খাবেন না? না। আপনি গোপন কথা আমাকে কী বলতে চান বলে ফেলুন। আমি শুনছি। গোপন কথা বলতে চাই আপনাকে কে বলল? দরজা বন্ধ করা দেখে মনে হলো। ও আচ্ছা। না, গোপন কথা কিছু নেই, আপনি এমন কেউ না যার সঙ্গে গোপনে কথা বলতে হবে। তবে ইয়ে—কিছু জরুরি কথা অবশ্যি আছে। বলুন। আপনি বড় ধরনের একটা সমস্যা সৃষ্টি করেছেন। কী রকম? সিগারেট খাবেন? সিগারেট দেব? দিন। আমি সিগারেট ধরালাম। ম্যানেজার সাহেব সিগারেট খান না—অন্যকে বিলিয়ে বেড়ান। হিমু সাহেব। জি। আপনি একটা বড় ধরনের সমস্যার সৃষ্টি করেছেন। স্যারের কত বিশাল প্রপার্টি আপনি জানেন না। আমি কিছুটা জানি, পুরোটা না। প্রপার্টি ওয়ারিশান হচ্ছে উনার মেয়ে। স্যারের শরীরের অবস্থা যা তাতে এই প্রপার্টি সুষ্ঠ লেখাপড়া এখনই হয়ে যাওয়া উচিত। কিন্তু স্যার কিছুই করছেন না। আপনার জন্যেই করছেন না। আমার জন্যে করছেন না মানে? ওই যে স্যারের ধারণা হয়ে গেছে, নিষ্পাপ মানুষের রক্ত পেলে রোগ সারবে। এবং তাঁর বিশ্বাস হয়েছে একজন যোগাড় করে আনবেন—চেষ্টা করছি। যত চেষ্টাই করুন লাভ কিছু হবে না। নিষ্পাপ মানুষের রক্তে ব্লাড ক্যানসার সারে এই জাতীয় গাঁজাখুরিতে আপনি নিশ্চয়ই বিশ্বাস করেন না। নাকি করেন? কিছুটা করি। মিরাকল বলে একটা শব্দ ডিকশনারিতে আছে। আচ্ছা, আপনি তাহলে মিরাকলে বিশ্বাস করেন? হুঁ করি। আপনি মনে করেন যে, একজন নিষ্পাপ মানুষ আপনি ধরে আনতে পারবেন এবং স্যার সুস্থ হয়ে উঠবেন? আমি গম্ভীর ভঙ্গিতে বললাম, নিষ্পাপ লোক পাওয়াই মুশকিল। তবে চেষ্টায় আছি। দেখি কী হয়। হিমু সাহেব! আপনি কি বূঝতে পারছেন স্যারের এই বিশাল প্রপার্টির ওপর অনেক লোক নির্ভর করে আছে? সব প্রতিষ্ঠান যাতে ঠিকমতো চলতে পারে তার জন্যে বিলি ব্যবস্থা হওয়া দরকার। উনাকে বলে বিলি ব্যবস্থা করিয়ে রাখুন। উনি তার করবেন না। এইজন্যে আপনার কাছে আমাদের অনুরোধ—আপনি স্যারকে বুঝিয়ে বলবেন। কী বুঝিয়ে বলব? কিছু বুঝিয়ে বলতে হবে না। আপনি শুধু বলবেন যে, নিষ্পাপ মানুষ খুঁজে বের করার দ্বায়িত্ব নিতে আপনি অপরাগ। এতে আপনার লাভ হবে। কী লাভ হবে? মইন খান চুপ করে গেলেন। ভদ্রলোক আমার উপর যথেষ্ট বিরক্ত। একজন অবুঝ শিশুকে বোঝাতে গেলে আমারা যেমন বিরক্ত হই উনিও তেমনি হচ্ছেন। আমি গলার স্বর নামিয়ে বললাম, কী লাভ হবে বলুন? টাকা-পয়সা পাব? যদি চান পাবেন। কত টাকা চান আপনি? আপনার কত টাকা দিতে পারেন সেটা জানা থাকলে বা সেটা সম্পর্কে আমার একটা ধারণা থাকলে চাইতে সুবিধা হতো। ধরুন, আপনারা মনে মনে ঠিক করে রেখেছেন আমাকে এক কোটি টাকা দেবেন, আমি বোকার মতো চাইলাম এক হাজার টাকাট….. এক কোটি টাকা যে কত টাকা সে সম্পর্কে আপনার কি কোনো ধারণা আছে? এক এর পেছনে কটা শূ্ন্য বসালে এক কোটি টাকা হয় আপনি জানেন? রেগে যাচ্ছেন কেন? রাগছি না। আপনার বোকামি দেখে হাসছি। একজন অসুস্থ মানুষ মরতে বসেছে—আপনি তার এডভানটেজ নিচ্ছেন। আপনার লজ্জা হওয়া উচিত। আমি কি কোনো এডভানটেজ নিচ্ছি? অবশ্যই। এখনো নেন নি, কিন্তু নেবেন। এক বেকুবকে ধরে নিয়ে এসে বলবেন—এই নিন আপনার পুণ্যবান মানুষ। তার শরীর থেকে দুতিন ব্যাগ রক্ত নেয়া হবে এবং সেই রক্ত আপনি নিশ্চয় বিনামূল্যে দেবেন না। নিশ্চয় দাম নেবেন। নেবেন না? হ্যাঁ, নেব। কত নেবেন? পবিত্র রক্তের অনেক দাম মইন সাহেব। কত সেই দাম সেটাও শুনে রাখি। আরেকটা সিগারেট দিন। চা খাওয়ান, তারপর বলব। আর শুনুন ভাই, আপনি এত রাগ করছেন কেন? সম্পত্তি ভাগাভাগি হোক বা না হোক আপনার তো কিছু যায় আসে না। আপনি যেই ম্যানেজার আছেন সেই ম্যানেজারই থাকবেন। এমন তো না যে, আপনি ইয়াকুব আলি সাহেবের মেয়েকে বিয়ে করছেন। সম্পত্তি ভাগাভাগি করলে আপনার লাভ আছে। চুপ করুন। আচ্ছা চুপ করলাম। মাইন খান গম্ভীরমুখে বের হয়ে গেলেন। আমার জন্যে চা আনতে গেলেন, এ রকম মনে হলো না। আমি চেয়ারে পা তুলে আরাম করে বসলাম। মনে হচ্ছে অনেকক্ষণ একা একা বসে থাকতে হবে। ম্যানেজার সাহেব এখন আর আমাকে সঙ্গ দেবেন না। আশ্চার্য, ম্যানেজার সাহেব নিজেই ট্রে হাতে ঢুকলেন। নিন হিমু সাহেব, আপনার চা। খালি পেটে খাবেন না—মাখন মাখানো ক্রেকার আছে। ক্রেকার নিন। থ্যাংকস। এখন বলুন, পবিত্র রক্তের দাম কত ঠিক করে রেখেছেন? অনেক দাম। বুঝতে পারছি অনেক দাম। সেই অনেকটা কত? আমি শান্ত গলায় বললাম, সেটা পবিত্র রক্ত শরীরে নেবার আগে ইয়াকুব আলি সাহেবকে বলা হবে। আগে বলবেন না? উঁহুঁ। তবে পবিত্র রক্ত যখন পাওয়া যাবে তখন তাঁর সঙ্গে টার্মস এন্ড কন্ডিশান নিয়ে আলাপ করব। আপনি শুধু ধুরন্ধর না—মহাধুরন্ধর। আমি হাসলাম। ম্যানেজার সাহেব বললেন, চা খাওয়া হয়েছে? জি। তাহলে যান, স্যারের সঙ্গে দেখা করুন। স্যারের ঘুম ভেঙেছে। আরেকটা কথা, স্যারের পাশে স্যারের মেয়ে বসে আছে, কাজেই কথাবার্তা খুব সাবধানে বলবেন। এমন কিছুই বলবেন না যাতে ম্যাডাম আপসেট হন। উনাকে কি এখন ম্যাডাম ডাকেন, আগের বার আপা বলছিলেন। হ্যাঁ ডাকি। দয়া করে আপনিও ডাকবেন। উনার নাম কী? উনার নাম জানার আপনার দরকার নেই। ইয়াকুব আলি সাহেব লম্বা হয়ে শুয়ে আছেন। তাঁকে একটা সরলরেখার মতো দেখাচ্ছে। এই ক’দিনে শরীর মনে হয় আরো খারাপ করেছে। সব মানুষের ভেতর এক ধরনের জ্যেতি থাকে—সেই জ্যোতি এখন আর তাঁর মধ্যে নেই। তাঁর মাথার কাছে যে মেয়েটি বসে আছে তার সঙ্গে আমার আগেও দেখা হয়েছে। তবে আজ তাকে চেনা যাচ্ছে না। ওইদিন দেখেছিলাম খণ্ডিতরূপে, আজ পূর্ণরূপে দেখছি। মাথায় টাওয়েল বাঁধা নেই। তার মাথাভর্তি চুল ঢউয়ের মতো নেমে এসেছে। পানির রঙ কালো হলে কেমন দেখাত তা মেয়েটির চুল দেখেলে কিছুটা অনুমান করা যায়। আমি গভীর বিস্ময় নিয়ে তার চুলের দিকে তাকিয়ে আছি। ইয়াকুব সাহেব বললেন, বোসো হিমু। আমি বসলাম কিন্তু মেয়েটির চুল থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিতে পারলাম না। ইয়াকুব সাহেব বললেন, কাউকে পেয়েছ? জি পেয়েছি। বেশ কটা নাম পাওয়া গেছে। এখন স্ক্রিটিনি পর্যায়ে আছে। এদের ভেতর থেকে স্ক্রটিনি করে একজন সিলেক্ট করব। গুড। আপনি আরো কয়েকটা দিন ধৈর্য ধরুন। ধৈর্য ধরেই আছি। আপনার স্ত্রীকে কি স্বপ্নে আরো দেখেছেন? গতকালই দেখলাম। রাত তিনটার দিকে। কী বললেন? সেই আগের কথা বলল—পুণ্যবান মানুষের রক্ত। আমি তাকে বলেছি, খোঁজা হচ্ছে। শিগগিরই পাওয়া যাবে। আপনি উনাকে কেন বলেন না খুঁজে বের করে দিতে। ব্যাপারটা উনার জন্য নিশ্চয়ই সহজ। আমি ভেবেছিলাম তাকে বলব। তাকে আমার অনেক কিছুই জিজ্ঞেস করার আছে। আমি একটা খাতায় লিস্টি করে রেখেছি কী কী জিজ্ঞেস করব। মৃত্যুর পরের জগতটা কেমন? সেখানকার দুঃখ-বেদনা কেমন? কিছুই জিজ্ঞেস করা হয় না। আসলে বাস্তবের জগতটা মানুষের অধীন। স্বপ্নের জগৎ মানুষের অধীন না। স্বপ্নের জগতের নিয়ন্ত্রণ অন্য কারো হাতে… উনি খুব আগ্রহ নিয়ে কথা বলছেন। আমার উচিত তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকা। কিন্তু আমি বারবারই মেয়েটির চুলের দিকে তাকাচ্ছি। এত সুন্দর চুল কারোর থাকা উচিত নয়। এতে মানুষের দৃষ্টি তার চুলের দিকেই যাবে। তাকে কেউ ভালোমতো দেখবে না। হিমু। জি স্যার। তোমার মিশন শেষ হতে আর কতদিন লাগবে বলে মনে হয়? বেশি হলে এক সপ্তাহ। এই এক সপ্তাহ টিকে থাকলে হয়—শরীর দ্রুত খারাপ করছে। মৃত্যু শরীরের ভেতর ঢুকে পড়েছে। বিন্দু হয়ে ঢুকেছে। বিন্দু থেকে তৈরি হয়েছে বৃত্ত। সেই বৃত্ত এখন আমাকে ভেতরে ঢুকিয়ে নিতে শুরু করেছে। আসলে, আসলে… আসলে কী? ইয়াকুব আলি সাহেব ক্লান্ত গলায় বললেন, কী বলতে চাচ্ছিলাম ভুলে গেছি। স্যার, আমি কি এখন উঠব? আচ্ছা যাও। আমি ম্যানেজারকে বলে দিয়েছি, তোমার যা যা লাগবে ওকে বলবে। হি উইল টেক কেয়ার অব ইট। তোমার বোধহয় সার্বক্ষণিক একটা গাড়ি দরকার। আমি বলে দিচ্ছি… গাড়ির স্যার প্রয়োজন নেই। অবশ্যই প্রয়োজন আছে। কত জায়গায় যেতে হবে। মিতু মা, তুই হিমুর সঙ্গে যা। ম্যানেজারকে বলে দে। মিতু উঠে দাঁড়াল। এই মেয়েটার নাম তাহলে মিতু। বেশ সহজ নাম। আমি ভেবেছিলাম আরো কঠিন কোনো নাম হবে। প্রিয়ংবদা টাইপ কিছু। আমি এবং মিতু সিঁড়ি দিয়ে নামছি। মিতু আমার পাশে পাশে নামছে। সিঁড়ি দিয়ে ওঠা বা নামার সময় মেয়েরা কখনো পাশাপাশি হাঁটে না। তারা হয় আগে আগে যায়, নয়তো যায় পেছনে পেছনে। হিমু সাহেব! জি ম্যাডাম। মিতু থমকে দাঁড়িয়ে বলল, ম্যাডাম বলছেন কেন? ম্যানেজার সাহেব আপনাকে ম্যাডাম বলতে বলেছেন। তাছাড়া ম্যাডাম বলাটাই তো শোভা। আপনাকে মিতু ডাকলে আপনার নিশ্চয়ই ভালো লাগবে না। মিতু বলল, আমার চুলগুলো মনে হয় আপনার খুব পছন্দ হয়েছে। বারবার চুলের দিকে তাকাচ্ছিলেন। আপনার চুল খুব সুন্দর। হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখতে চান? ছুঁয়ে দেখতে চাইলে পারেন। কিছু কিছু সৌন্দর্য আছে যা অনুভব করতে হলে স্পর্শ করতে হয়। ছুঁয়ে দেখব? দেখুন। এতে আমার অস্বস্তিও লাগবে না কিংবা গা ঘিনঘিনও করবে না। কারণ এই চুল নকল চুল। আমি মাথায় উইগ পরেছি। আমি থমকে দাঁড়িয়ে গেলাম। নকল চুল হাত দিয়ে দেখার কোনো আগ্রহ বোধ করছি না। সুন্দর একটা মেয়ে, তার মাথার চুলও নিশ্চয়ই সুন্দর। সে নকল চুল পরেছে কেন? হিমু সাহেব। জি। ভূমিকম্প হয়েছিল ঠিকই। আগে আগে কীভাবে বললেন? আপনার টেকনিকটা কী? কোনো টেকনিক নেই। কিছু টেকনিক নিশ্চয়ই আছে। আমি সহজ গলায় বললাম, নিম্নশেণীর প্রাণী, যেমন ধরুন , কুকুর বেড়াল এরা ভূমিকম্পের ব্যাপার আগে আগে টের পায়। আমিও বোধহয় নিম্নশেণীর প্রাণী। মিতু কঠিন গলায় বলল, আমার নিজেরও তাই ধারণা। আমাকে প্রায় হতভম্ব করে মিতু নেমে যাচ্ছে। এবার সে যাচ্ছে আগে, আগে, আমি পেছনে পেছনে। মেয়েদের ধর্ম সে এখন পালন করছে। ম্যানেজার সাহেব চব্বিশ ঘণ্টার জন্যে একটা গাড়ির ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। এসি বসানো শেভ্রলেট। আগামী সাতদিন এই গাড়ি সারাক্ষণ আমার সঙ্গে থাকবে। গাড়ির ড্রাইভার আমার চেনা—তার গাড়ির ভেলভেটের সিটই আমি আগুন গিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছিলাম। সেই সেট কভারই বদলানো হয়েছে। পুরো গাড়ির সিট কভার বদলানো। ঝকঝকে কমলা রঙের সিট কভারে সুন্দর লাগছে। ড্রাইভার ভীতমুখে বলল, কোথায় যাব স্যার? যেদিকে ইচ্ছা চালাতে থাকুন। আমি যখন বলব, স্টপ, তখন শুধু থামবেন। যেদিকে মন চায় সেইদিকে চালাব? হুঁ। বিস্মিত এবং ভীত ড্রাইভার গাড়ি চালাতে শুরু করেছে। আমি গাড়ির সিটে গা এলিয়ে আরামে প্রায় ঘুমিয়ে পড়েছি। মনে হচ্ছে এই জীবনটা গাড়িতে গাড়িতে কাটিয়ে দিতে পারলে মন্দ হতো না। ড্রাইভার ঠিক স্বস্তি পাচ্ছে না। তাকে আপনি আপনি করে বলাতেও সে বোধহয় খানিকটা ভড়কে গেছে। বারবার মাথা ঘুরিয়ে পেছনে তাকাচ্ছে। ব্যাকভিউ মিরর খানিকক্ষণ নাড়াচাড়া করল। অর্থাৎ মিরর এমনভাবে সেট করল যেন ঘাড় না ঘুরিয়েই সে আমাকে দেখতে পায়। ড্রাইভার সাহেব! জি স্যার। আপনার নাম কী? আমার নাম স্যার ছামছু। ভালো। খুব সুন্দর নাম, সামছু হলে ভালো হতো তবে ছামছুও খারাপ না। আগের বার আপনার নাম জানা হয়নি। এবার জেনে নিলাম। স্যার, আমারে তুমি কইরা বলবেন। আর ড্রাইভার সাব বইল্যা লজ্জা দিবেন না । আর আফনের সাথে বিয়াদবি কিছু করলে মাফ দিয়া দিবেন। আচ্ছা ঠিক আছে, ছামছু। ভালোমতো চালাও। আমি একটু ঘুমিয়ে নিই। যে দেকি ইচ্ছা সেদিকে চালামু স্যার? হুঁ। খানাখন্দ এড়িয়ে চালাবে। ঘুমোচ্ছি তো, হঠাৎ ঝাঁকুনি খেলে ঘুম ভেঙে যাবে। জি আচ্ছা স্যার। ছামছু গাড়ি চালাচ্ছে। আমি ঘুমিয়ে পড়ার চেষ্টা করছি। ছামছু উদ্দেশ্যবিহীনভাবে গাড়ি চালাচ্ছে না। আমি জানি, সে এখন যাচ্ছে তার বাসার দিকে। বাসার খুব কাছাকাছি যাবার পর সে বলবে, এখন কোথায় যাব স্যার? তার আগে বলবে না। এই পৃথিবীতে মানুষের একমাত্র গন্তব্য তার ঘর। ছামছু মৃদু গলায় বলল, গান দিমু স্যার? তোমার নিজের গান শুনতে ইচ্ছা হলে দিতে পারো। আমার লাগবে না। আমি ঘুমিয়ে পড়লাম। ঘুম ভেঙে দেখি গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। ড্রাইভার ছামছু তার সিটে চুপচাপ বসা । আমাকে তাকাতে দেখেই সে বলল, এখন কোন দিকে যামু স্যার? আমি হাই তুলতে তুলতে বললাম, তোমার বাসা কি খুব কাছে? জি স্যার। সামনের গলির দুইটা বাড়ির পরে। তাহলে তুমি বরং এক কাজ করো—বাসা থেকে একটু ঘুরে আসো। ছেলেমেয়েদের দেখে আসো। ততক্ষণে আমি একটু ঘুমিয়ে নিই। ছামছু বিস্মিত চোখে তাকিয়ে আছে। এই পৃথিবীতে সবচে’সুন্দর জিনিস কী? মানুষের বিস্মিত চোখ। আমার ধারণা, সৃষ্টিকর্তা মানুষের বিস্মিত চোখ দেখতেই সবচে’ পছন্দ করেন, যে কারণে প্রতিনিয়ত মানুষকে বিস্মিত করার চেষ্টা তিনি চালিয়ে যান। যাদের তিনি অপছন্দ করেন তাদের কাছে থেকে বিস্মিত হবার ক্ষমতা কেড়ে নেন। তারা কিছুতেই বিস্মিত হয় না। সত্যি বাসায় যামু স্যার? হ্যাঁ যাও। ছামছু চলে গেছে। আমি আগের মতোই গা ছড়িয়ে শুয়ে আছি। তন্দ্রা তন্দ্রা ভাব। শরীর জুড়ে আলস্য। সন্ধ্যাবেলা রূপার কাছে যাবার ইচ্ছা ছিল। অনেকদিন রূপাকে দেখা হয় নি। বড় খালুর বাসায়ও যাওয়া দরকার। খুঁজে বের করা দরকার পুর্ত মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র অ্যাসিস্ট্যান্টকে, নাম হলো—মুনশি বদরুদ্দিন তালুকদার। অনেক কাজ। কিন্তু সব কাজ ছাপিয়ে ঘুমানোর কাজটাই আমার কাছে প্রধান বলে মনে হচ্ছে। এই গাড়ির জানালার কাচ মনে হয় রঙিন। বাইরের পৃথিবীটা অনেক বেশি সুন্দর লাগছে। চার-পাঁচটা ছেলেমেয়ে মজার কোনো খেলা খেলছে। কী একটা সাদা বলের মতো জিনিস একজন আরেকজনের গায়ে ছুড়ে ‍দিচ্ছে। যার গায়ে ছুড়ে দেয়া হচ্ছে সে আনন্দে চিৎকার করছে। যে ছুড়ে মারছে সেও আনন্দে চিৎকার করছে। কত আনন্দই না এই ভুবনে ছড়ানো। ভালোমতো তাকিয়ে দেখি গোল সাদামতো জিনিসটা একটা কুকুরছানা। সে এই বিচিত্রা খেলার কিছুই বুঝতে পারছে না। তার চোখ আতম্কে নীল হয়ে আছে। সে জেনে গেছে তার কপালে আছে অবধারিত মৃত্যু। সে অপেক্ষা করছে মৃত্যুর জন্যে। আমি হাত উঁচিয়ে ছেলেগুলোকে ডাকলাম, এই এই— ছেলেরা কঠিন মুখ করে এগোচ্ছে। কুকুরছানাটা একজনের হাতে। ছানাটার বুক কামারের হাপরের মত উঠানামা করছে। তোরা এই বাচ্চাটাকে আমার কাছে বিক্রি করবি ? না আচ্ছা তাহলে চলে যা। বিক্রি করলে আমি কিনব। না, বেচব না। তাহলে চলে যা। ছেলেরা চলে গেল। আমি দেখতে পাচ্ছি খেলা আর জমছে না। তারা গোল হয়ে আলাপ করছে। মনে হচ্ছে তাদের মধ্যে মতপার্থক্য দেখা দিয়েছে। একদল বিক্রি করতে চায়, একদল চায় না। একটা ছেলে এগিয়ে আসছে। তাকে মনে হয় নিগোসিয়েশনের জন্য পাঠানো হচ্ছে— কী রে, বিক্রি করবি ? হুঁ। চাস কত? পাঁচ শ’ টেকা। কমাবি না? না। দেখ কিছু কমানো যায় কিনা। দলের অন্যরাও এগিয়ে আসছে। আসন্ন ব্যবসায় সম্ভাবনায় তারা উল্লিসিত। সবার চোখ চকচক করছে। আমি বললাম, পাঁচশ’ টাকা এই কুকুরছানার দাম হয় না তাও হয়তো কিনতাম, কিন্তু লেজটা কালো। কালো লেজের কুকুরের সাহস থাকে না। এইটা বিদেশী কুত্তা। কে বলল বিদেশী?? দেইখ্যা বোঝা যায়। দেখে বোঝা গেলেও এত দাম দিয়া কিনব না। কম কত নিবি? এক পয়সাও কম নাই। তোরা তো ব্যবসা ভালো শিখেছিস। আপনে কত দিবেন? আমি দশ টাকা দিতে পারি। দশ টাকার এক পয়সা বেশি হলেও নিব না। ছেলেগুলি মুখ চাওয়া-চাওয়ি করছে। কোথায় পাঁচ শ’ কোথায় দশ! তারা মনে হয় এত হতাশ এর আগে কখনো হয় নি। কী রে, দিবি দশ টাকায়? না। তাহলে চলে যা। দাঁড়িয়ে আছিস কেন? আমি চোখ বন্ধ করে আবার শুয়ে পড়লাম। আমি জানি এরা যাবে না। এরা দশ টাকাতেই কুকুরটা বিক্রি করবে। আমি একটা পশুর জীবন কিনব দশ টাকায়। কুকুরটা আমার পাশে বসে আছে। মাঝে মাঝে মাথা তুলে আমাকে দেখছে। পশুদের ভেতর কি কৃতজ্ঞতাবোধ আছে? থাকার কোনো কারণ নেই, কিন্তু এ এত নরম চোখে কেন আমাকে দেখছে? আমি বললাম, আয় আয়। সে লাফ দিয়ে আমার কোলে উঠল। কোলে উঠেই কুণ্ডলী পাকিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। তার অবচেতন মন বলছে, তার আর কোন ভয় নেই। কী সুন্দর এই কুকুরছানা! সাদা উলের বলের মতো। দেখলেই হাত দিয়ে ছুঁতে ইচ্ছা করে। সে বড় হবে পথে পথে। খাবারের আশায় হোটেলের চারপাশে ঘুরঘুর করবে। একদিন হোটেলের কোনো কর্মচারী তার গায়ে গরম মাড় ফেলে দেবে। অনেক অনেক শতাব্দী আগে এই পশু মানুষের সঙ্গে অরণ্য ছেড়ে চলে এসেছিল। আজ আর তার অরণ্যে ফিরে যাবার পথ নেই। তাকে আশ্রয়ের জন্যে অনুসন্ধান করে যেতে হবে। আধুনিক মানুষ সেই আশ্রয় আজ আর তাকে দেবে না। কুকুরের প্রয়োজন তার ফুরিয়ে গেছে। খেলার জন্যে আজ আর তার কুকুর-বেড়ালের প্রয়োজন নেই। তার আছে কম্পিউটার। স্যার কুত্তা কই পাইলেন? ড্রাইভার ফিরে এসেছে। পান খাচ্ছে। পানের রসে মুখ লাল। হাতে করে একটা পান সে আমার জন্যেও নিয়ে এসেছে। কুত্তা কই পাইলেন স্যার? কিনলাম। নেড়ি কুত্তা পয়সা দিয়া কিননের জিনিস না। দেখতে সুন্দর। দেখতে সুন্দর জিনিসের কোনো উবগার নাই। উচ্চশ্রেণীর ফিলসফি করে ড্রাইভার গাড়ি স্টার্ট দিল। খুশি খুশি গলায় বলল, স্যার কই যামু? সেক্রেটারিয়েটে চলো। দেখি মুনশি বদরুদ্দিনকে পাওয়া যায় কি না। সেক্রেটারিয়েটে ঢোকার আমার পাস নেই। তবে আজ পাস লাগবে না। এত দামি গাড়িকে কেউ আটকায় না। মুনশি বদরুদ্দিনকে আজো পাওয়া গেল না। তার মেয়ে অসুস্থ, সে নাকি মেয়েকে নিয়ে হাসপাতালে গেছে। আমি বললাম,এসেছি যখন চা খেয়ে যাই। ‍দু’কাপ চা আনানোর ব্যবস্থা করুন। আমার জন্যে এক কাপ, আমার কুকুরটার জন্যে এক কাপ। সেও চা খায়। অফিসের সব কটা লোক এমনভাবে তাকাচ্ছে যাতে মনে হয় এরা আজ আমাকে ছাড়বে না। দরজা বন্ধ করে শক্ত মার দেবে। মার দিলে দেবে—কী আর করা! আমি বেশ আরাম করেই বসলাম। আমার কালো কুকুরছানা। এর নাম একটা দেয়া দরকার। দুই অক্ষরের নাম। কুকুরের নাম দুই অক্ষরের বেশি হলে ভালো লাগে না। কই ভাই চায়ের কথা বলছেন? আমাকে অবাক করে দিয়ে একজন সত্যি সত্যি চায়ের কথা বলল। এরা আমাকে মারার সাহস পাচ্ছে না। মনে হয় কিছুটা ভয়ও পাচ্ছে। অসৎ মানুষ ভীরু প্রকৃতির হয়। চা এসেছে। শুধু চা না। চায়ের সঙ্গে বিসকিট। একজন একটা সিগারেটও বাড়িয়ে দিল। চা খেতে খেতে আজকের প্রোগাম ঠিক করে নিলাম—লালবাগ থানায় যাব। সেকেন্ড অফিসারকে পাওয়া যায় কিনা দেখব। ফার্মগেটে একলেমুর মিয়াকে খুঁজে বের করব। তার মেয়েটা কি ফিরে এসেছে? রূপার সঙ্গে কথা বলতে হবে। কথা বলব, নাকি চলে যাব তাদের বাড়িতে? লালবাগ থানার সেকেন্ড অফিসারকে পাওয়া গেল না। তিনি বদলি হয়ে গেছেন মুন্সীগঞ্জে। লালবাগ থানার ওসি সাহেব আমাকে চিনতে পারলেন। চিনতে না পারার কোনো কারণ নেই—তিনি তাঁর থানা হাজতে আমাকে এক সপ্তাহের মতো আটকে রেখিছিলেন। আমি ওসি সাহেবের দিকে তাকিয়ে মধুর ভঙ্গিতে বললাম, ঘুস ইদানীং কেমন আসছে স্যার? ওসি সাহেব কথায় রাগ করলেন না। বরং আনন্দিত গলায় বললেন, বসুন। আপনি আজকাল করছেন কী? কিছু করছি না। পবিত্র মানুষ খুঁজছি। আপনার সন্ধানে কোনো পবিত্র মানুষ আছে? পবিত্র মানুষ খোঁজার জন্যে তো ভাই পুলিশ ডিপার্টমেন্ট না। আমাদের কাজ অপবিত্র মানুষ নিয়ে। যদি কোনোদিন অপবিত্র মানুষের প্রয়োজন হয়, আসবেন। সন্ধান দেব। আপনার মাথায় দোষ এখনো সাড়ে নাই? আমি হাসলাম। বুঝলেন হিমু সাহেব, ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলে ওষুধপত্র খান। পীর-ফকিরের তাবিজ নেন। ব্রেইন পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গেলে বিপদে পড়বেন। মহা বিপদে পড়বেন। স্যার উঠি? আচ্ছা যান। আরেকটা উপদেশ শুনে যান—পুলিশ এভয়েড করে চলবেন। আমি আপনাকে চিনি বলে ছেড়ে দিচ্ছি—অন্যরা তো চিনবে না—মেরে ভর্তা বানিয়ে ফেলবে। টাকি মাছের ভর্তা। খেয়েছেন কখনো টাকি মাছের ভর্তা? জি খেয়েছি। খেতে ভালো না? অতি উপাদেয়। দুপুরে তেমন কোনো কাজ না থাকলে বসে থাকুন। টাকি মাছের ভর্তা দিয়ে ভাত খাবেন। স্ত্রীকে বলেছি টাকি মাছের ভর্তা করতে। মুরগি খেতে খেতে মুখে অরুচি হয়েছে? ওসি সাহেব তো হেসে উঠলেন। আমি উঠে পড়লাম। টাকি মাছের ভর্তা খাওয়ার সময় নেই। আমার ড্রাইভার ছামছু আকাশ থেকে পড়েছে। সে কল্পনাও করতে পারছে না আমি কী করে রাস্তায় একটা ফকিরের সঙ্গে বসে ভাত খাচ্ছি। ছামছুকে খেতে ডেকেছিলাম, সে ঘৃণার সঙ্গে প্রস্তাব প্রত্যাখান করে মুখ কালো করে গাড়িতে বসে আছে। একলেমুর মিয়ার মেয়েটা ফিরে এসেছে। সে খাচ্ছে আমাদের সাথে। মেয়েটা বিচিত্র ধরনের—ভাত ছাড়া আর কিছু খেতে পারে না। কপ কপ করে শুধু ভাত খায়। ভাতের উপর খানিকটা লবণ ছিটিয়ে দিতে হয়। আর কিছু লাগে না। একলেমুর মিয়া। জি ভাইজান? এই জীবনে পাপ কী কী করেছ? প্রত্যেক দিনেই তো পাপ করি ভাইজান। মাইনষের কাছে ভিক্ষা চাই…মাইনষে বিরক্ত হয়। মাইনষেরে বিরক্ত করা মহাপাপ। এই জাতীয় পাপের কথা বলছি না। বড় পাপ। পাপের কোনো বড় ছোট নাই। ছোট পাপ, বড় পাপ সবই সমান— তাই নাকি? জি। তার উপরে দুই কিসিমের পাপ আছে। মনের পাপে, আর শরীরের পাপ। ধরেন আমি একটা জিনিস ‍চুরি করলাম। এইটা হইল শরীরের পাপ। চুরি করছি ডান হাত দিয়া। আবার ধরেন মনে মনে ভাবলাম চুরি করব। এইটা মনের পাপ।চুরি না করলেও মনে মনে ভাবার কারণে পাপ হইল। এই পাপও কঠিন পাপ। তার মানে কি এই দাঁড়াচ্ছে যে নিষ্পাপ মানুষ পাওয়া যাবে না? দুই একজন আছে। তবে পাওয়া জটিল। তোমার সন্ধান আছে? আছে, আমার সন্ধানে একজন আছে। যদি দরকার হয় তাকে আমার কাছে এনে দিতে পারবে? একলেমুর মিয়া কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে বলল, পারমু। আপনে বললেই আইন্যা দিমু। গুড। আমি একলেমুর মিয়ার মেয়েটাকে বললাম, এই গাড়ি চড়বি? চড়মু। আয় আমার সঙ্গে । মেয়ে তৎক্ষণাৎ ভাতের থালা ফেলে উঠে এলো। গাড়ি দেখে তার চোখ কপালে উঠে গেল। এই গাড়ি আফনের? হুঁ। আপাতত আমার। যা ওঠ। বাপজানরে লইয়া উঠুম। আইজ আমি আর বাপজান গাড়িত কইরা ভিক্ষা করুম। এটা মন্দ না। আমি ছামছুকে বললাম, ছামছু গাড়িতে তেল আছে? জি স্যার আছে। এরা দুইজন আজ গাড়িতে করে ভিক্ষা করবে। তুমি এদের ভিক্ষা করতে নিয়ে যাও। ছামছু তাকিয়ে আছে। মনে হচ্ছে তার ছোটখাটো হার্ট অ্যাটাকের মতো হয়েছে। কপাল ঘামছে। সে ক্ষীণ গলায় বলল, গাড়িতে বইস্যা ভিক্ষা করব? হুঁ। গ্রামে আমি ফকিরদের ঘোড়ায় চড়ে ভিক্ষা করতে দেখেছি। ঘোড়ায় চড়ে যদি ভিক্ষা করা যায় গাড়িতেও করা যায়। রাত নটা পর্যন্ত তুমি এদের নিয়ে ঘুরবে, তারপর চলে আসবে আমাদের মেসের সামনে, ঠিক সামনে যে গ্রীন ফার্মেসি সেখানে। জি আচ্ছা স্যার। মুখ এরকম করে রেখেছ কেন ছামছু? আমার গাড়িতে বইস্যা ভিক্ষা করব, লোকে আমারে ধইরা মাইর দেয় কি না, এইটা নিয়া চিন্তিত আর কিছু না। চিন্তা করবে না। মনে সাহস রাখ ছামছু। জি আচ্ছা, সাহস রাখব। মুখ কালো করে ছামছু গাড়ি স্টার্ট দিল। ছোট মেয়েটা খিলখিল করে হাসছে। এত সুন্দর হাসি অনেক দিন শুনি নি। রূপা ঘুম-ঘুম গলায় বলল, হ্যালো। আমি বললাম,কেমন আছ রূপা? সে জবাব দিল না। চুপ করে রইল। আমি আবার বললাম, কেমন আছ রূপা? রূপার ছোট্ট একটা শ্বাস নেবার শব্দ শুনলাম। তারপর পরিষ্কার গলায় বলল, ভালো আছি। ঘুম-ঘুম গলায় কথা বলছ কেন? ঘুমোচ্ছিলাম। ঘুম ভেঙে টেলিফোন ধরছি, এই জন্যেই ঘুম-ঘুম গলায় কথা। আজ এত সকাল-সকাল শুয়ে পড়লে যে? মাত্র দশটা বাজে। আমার জ্বর, এই জন্যেই সকাল-সকাল শুয়ে পড়েছি। জ্বর! তাহলে কেন বললে, আমি ভালো আছি? ভুল হয়েছে, ক্ষমা করে দাও। আমি হেসে ফেললাম। রূপা হাসছে না। এমনিতে সে খুব হাসে। কিন্তু টেলিফোনে আমি তাকে কখনো হাসতে শুনি নি। রূপা! শুনছি। তোমার জন্যে একটা উপহার পাঠিয়েছি। কিছুক্ষণের মধ্যে আমার ড্রাইভার উপস্থিত হবে। তোমার ড্রাইভার মানে? কিছুদিনের জন্যে একটা গাড়ি এবং ড্রাইভার পেয়েছি। শুনে সুখী হলাম। উপহার পেয়ে আরো সুখী হবে। উপহারটা হলো একটা কুকুরছানা। তোমার কাছে আমি কি কুকুরছানা কোনোদিন চেয়েছি? না। তাহলে এই রাতদুপুরে কুকুরছানা পাঠাবার অর্থ কী? রূপা, তুমি কি রাগ করলে? না, রাগ করি নি, তার সঙ্গেই রাগ করা চলে যে রাগের অর্থ বোঝে। রাগ, অভিমান, ঘৃণা, ভালোবাসা এর কোনো মূল্য তোমার কাছে নেই। কাজেই আমি তোমার উপর রাগ করা ছেড়েছি। শুধু রাগ না, অভিমান ঘৃণা, ভালোবাসা কোনো কিছুই আর তোমার জন্যে নেই। তোমার জ্বর কি খুব বেশি? কেন,আমার কথাগুলো কি প্রলাপের মতো লাগছে? না। খুব স্বাভাবিক লাগছে, এই জন্যেই জিজ্ঞেস করছি। তোমার জ্বর কত? এক শ’ দুই পয়েন্ট ফাইভ। অনেক জ্বর। যাও শুয়ে থাক। আমি ‍শুয়েই আছি। কথা বলছি শুয়ে শুয়ে। আর কথা বলতে হবে না, বিশ্রাম করো। রূপা তীক্ষ্ণ গলায় বলল, আমার বিশ্রাম নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না। তুমি তোমার নিজের বিশ্রাম নিয়ে ভাবো। আজকাল কী করছ জানতে পারি? কিছুই করছি না। ঘুরে বেড়াচ্ছি বলতে পারো। মিথ্যা কথা বলছ কেন? আমি তো যতদূর জানি তুমি পবিত্র রক্ত খুঁজে বেড়াচ্ছ। ও আচ্ছা, হ্যাঁ, ঠিকিই বলেছ। পেয়েছ? উঁহুঁ। তবে পেয়ে যাব। তোমাকে একটা কথা বলি, খুব মন দিয়ে শোন—তুমি কোনো একজন ভালো সাইকিয়াট্রিস্টকে তোমার বিখ্যাত মাথাটা দেখাও। প্রয়োজন হলে শক ট্রিটমেন্ট করাও, নয়তো কিছুদিনের মধ্যেই দেখা যাবে পুরোপুরি দিগম্বর হয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছ এবং ট্রাফিক কনট্রোলের চেষ্টা করছ। তোমার জ্বর কদিন ধরে? এই তথ্য জানার তোমার কি কোনো প্রয়োজন আছে? না। তাহলে কেন জিজ্ঞেস করলে? কথার পিঠে কথা বলার জ্ন্য। কথার পিঠে কথা বলার জন্যে আর ব্যস্ত হতে হবে না। আমি টেলিফোন নামিয়ে রাখছি। এক সেকেন্ড। একটা জরুরি কথা তোমাকে বলা হয় নি। কথাটা হচ্ছে—কুকুরছানাটা একটা নাম আছে। আমিই নামটা দিয়েছি। তুমি যদি নতুন নাম দিতে চাও, দেবে। আর নতুন নাম খুঁজে না পেলে আমারটা রেখে দিতে পারো। বলব নামটা? বলো। মেয়ে কুকুর তো, কাজেই আমি নাম রেখেছি কঙ্কাবতী। আদর করে তুমি ওকে কঙ্কাও ডাকতে পার। কঙ্কা ডাকলেই সে কান খাড়া করে। রূপা খট করে টেলিফোন নামিয়ে রাখল। গ্রীন ফার্মেসির ছেলেটা বিরক্ত মুখে বলল, কথা শেষ হয়েছে? এতক্ষণ কেউ টেলিফোনে কথা বলে? কত জরুরি কল আসতে পারে….. আমি হাসলাম। ছেলেটি আরো বিরক্ত হলো। আমি বললাম, ভাই, আরেকটা কল করতে হবে। ভয়ানক জরুরি । না করলেই নয়। কুড়ি মিনিটের বেশি এক সেকেন্ডও কথা বলব না। আপনি কি ঠাট্টা করছেন ? না, ঠাট্টা করছি না। আমি এখন দোকান বন্ধ করে বাসায় যাব। যাত্রাবাড়িতে থাকি, আর দেরি করলে বাস পাব না। বাসের জন্য চিন্তা করতে হবে না। আমার গাড়ি আছে। গাড়ি পৌঁছে দেবে। গাড়ি আছে ? অবশ্যই গাড়ি আছে। এসি বসানো গাড়ি। কেন এইসব চাল মারেন ? তার কথার জবাব দেয়ার আগেই গাড়ি এসে উপস্থিত হলো। গ্রীন ফার্মেসির ছেলে চোখ বড় বড় করে তাকাচ্ছে। আমি বললাম, ভাই, করব একটা টেলিফোন ? করুন। আরেকটা কথা বলে রাখি—এর মধ্যে যদি আপনার গাড়ির কখনো দরকার হয়—ছেলেমেয়ে নিয়ে চিড়িয়াখানায় যাবেন বা এই জাতীয় কিছু—তাহলে আমাকে বলবেন। গাড়ি এখন আর কোনো সমস্যা না। টেলিফোন করলাম বড় খালার বাসায়। বড় খালা টেলিফোন ধরলেন। বড় খালা, স্নামালিকুম। কে, হিমু ? জি। হারামজাদা, জুতিয়ে আমি তোর বিষদাঁত ভাঙব। কী হয়েছে খালা ? তোর এত বড় সাহস ! ফিচকেল কোথাকার! খালা,আমি কিছুই বুঝতে পারছি না বলে অস্বস্তি বোধ করছি—ব্যাপারটা কী? গালাগালি করার আগে ব্যাখ্যা করো কেন গালাগালি করছ। তুই কি এর মধ্যে তোর খালুর অফিসে গিয়েছিলি? হুঁ। অফিসে গিয়ে তাকে বলেছিস যে সে পুণ্যবান লোক? জি খালা। আমি একটা লিস্ট করেছি। লিস্টে তাঁর নাম আছে। তোর কথা শুনে ঐ গাধা পুণ্যবান সাজার চেষ্টা করছে। আমাদের এই বাড়ি সে এতিমখানা বানানোর জন্যে দিয়ে দিতে চায়। বলো কী! এত কষ্টের পয়সায় বাড়ি, এটা নাকি হবে এতিমখানা! এতিমখানা তার পাছা দিয়ে ঢুকায়ে দেব। খালা, প্লিজ, আরেকটু ভদ্র ভাষা ব্যবহার করো। হারামজাদা, ভদ্র ভাষা আবার কী রে? গাধা পুণ্যবান সাজে। উকিল-মোক্তার নিয়ে বাসায় উপস্থিত। আমি ভাবলাম কী না কী, পরে শুনি এই ব্যাপার। আমাকে ডেকে বলে—সুরমা, তুমি কিন্তু সাক্ষী। সাক্ষী আমি বুঝায়ে দিয়েছি। মারধর করেছ? ইয়ারকি করিস না হিমু। ইয়ারকি ভালো লাগছে না। খালুজানকে দাও। কথা বলি। ওকে দেব কোথেকে? ও কি বাসায় আছে? জুতিয়ে বের করে দিয়েছি না? স্যান্ডেল-পেটা করেছি। স্পঞ্জ স্যান্ডেল, না চামড়া? হারামজাদা, রসিকতা করিস না। তোকেও জুতা-পেটা করব। খালুজানকে কখন থেকে বের করলে? আজ? হ্যাঁ, সন্ধ্যাবেলা। উকিল-মোক্তার সব নিয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে ঘর থেকে বের হয়েছে। মোক্তার ব্যাটা ফাইল নিয়ে হুড়মুড় করে রাস্তায় গড়িয়ে পড়েছে। তুমি কি সত্যি সত্যি স্যান্ডেল-পেটা করেছ? অবশ্যই। রাখি খালা? শোন হিমু, গাধাটার সঙ্গে তোর যদি দেখা হয় তাহলে গাধাকে বলবি সে যেন আর ত্রিসীমানায় না আসে… জি আচ্ছা, আমি বলব। তবে বলার দরকার হবে বলে মনে হয় না। কত বড় সাহস! আমার জমি, আমার বাড়ি সে দান করে দিচ্ছে, আর আমাকে বলছে সাক্ষী হতে। মদ খেয়ে খেয়ে মাথার বারোটা বেজে গেছে সেই খেয়াল নেই। খুব খাচ্ছেন বুঝি? অফিসে গিয়েছিলি, কিছু টের পাস নি? রাত-দিন তো ওর উপরই আছে। গাধার চাকরিও চলে গেছে। বলো কী! অনেক আগেই যাওয়া উচিত ছিল। আমাকে টেলিফোন ছাড়তে হলো না। আপনা আপনি লাইন কেটে গেল। আমি ফ্যাকাসে ভঙ্গিতে হাসার চেষ্টা করলাম। ভালো যন্ত্রণায় পড়া গেছে। আমার ধারণা, মেসে ফিরে দেখব বড় খালু বসে আছেন। আমার ইনট্যুশন তাই বলছে। কিছুদিন পালিয়ে থাকার জন্যে আমার আস্তানা সর্বোত্তম। গ্রীন ফার্মেসির ছেলেটাকে গাড়িতে তুলে দিয়ে দু’প্যাকেট ডানহিল সিগারেট কিনলাম। বড় খালুর এই হচ্ছে ব্র্যান্ড। আমার ধারণা, মেসে পা দেয়ামাত্র বড় খালু বলবেন, হিমু, সিগারেট এনে দে। মেসে ফিরলাম। আমার ঘরের দরজা খোলা। ঘর অন্ধকার। খাটের উপর কেউ একজন শুয়ে আছে। আমি ঘরে ঢুকলাম। পাঞ্জাবির পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করতে করতে বললাম, বড় খালু, আপনার সিগারেট। ডানহিল। বড় খালু জড়ানো গলায় বললেন, থ্যাংকস। তোর এখানে দু-একদিন থাকব। অসুবিধা আছে? আমার কোনো অসুবিধা নেই। আপনি থাকতে পারবেন কিনা কে জানে। নিজের বাড়ি ছাড়া অন্য যে কোনো জায়গায় আমি থাকতে পারি। নিজের বাড়ি ছাড়া অন্য যে কোনো জায়গায়ই আমার স্বর্গ—দি হেভেন। কিছু খেয়েছেন? না। চলুন আমার সঙ্গে। হোটেলের খাবার খেতে অসুবিধা নেই তো? না। বড় খালুর উঠে দাঁড়িয়েছেন,তবে দাঁড়ানোর ভঙ্গি শিথিল। বোঝাই যাচ্ছে প্রচুর মদ্যপান করেছেন। মুখে থেকে ভকভক করে কুৎসিত গন্ধ আসছে। কথাবার্তা পুরো এলোমেলো। হিমু! জি। তোর এই মেসের ম্যানেজার এসেছিল। তোর নাকি আজই মেস ছেড়ে দেবার কথা? হুঁ। আমি রিকোয়েস্ট করে আর এক সপ্তাহ টাইম এক্সটেনশান করেছি। ভালো করেছেন। এক সপ্তাহ পর যদি বের করে দেয়, দুজন একসঙ্গেই বের হয়ে যাব। কী বলিস? সেটা মন্দ হবে না। শীতকাল হওয়ায় মুশকিল হয়েছে। গরমকাল হলে পার্কের বেঞ্চিতে আরাম ঘুমানো যেত। হুঁ। তুই শুধু হুঁ হাঁ করছিস কেন? কথা বল। বি হ্যাপি। বুঝলি হিমু, তোর এই মেসের লোকজন খুবই মাইডিয়ার। এক ভদ্রলোক তোর ঘরের তালা অনেক যন্ত্রাণা করে খুলে দিয়েছেন। একজন এসে তাস খেলার জন্যে ইনভাইট করলেন। ভালো তো। তোদের এখানে কাজের মেয়েটা যে আছে, কী যেন তার নাম? ময়নার মা? আরে ধুৎ! ময়না হলো তার মেয়ের নাম। ওর নিজের নাম কী? নাম জানি না খালু। মনে পড়েছে, ওর নাম হলো কইতরী। সুন্দর না নামটা? হ্যাঁ, সুন্দর। কইতরী আমাকে চা এনে দিল। অনেকক্ষণ গল্প করলাম কইতরীর সঙ্গে। অসাধারণ মহিলা। গরিব ঘরে জন্মেছে বলে সে হয়েছে ঝি। বড়লোকের ঘরে জন্মালে ইউনির্ভাসিটির অঙ্কের টিচার হতো…। বড় খালুকে হাত ধরে সিঁড়ি দিয়ে নামালাম। তিনি দেখি এক একবার হুমড়ি খেয়ে গায়ে পড়ে যাচ্ছেন। বেতাল অবস্থা। বড় খালু,বমি-টমি হবে না তো? তুই কি পাগল-টাগল হয়ে গেলি? আমি কি এ্যামেচার? আমি হলাম প্রফেশনাল পানকারী। আমার কিছুই হবে না। না হলেই ভালো। বুঝলি হিমু,ঐ কইতরী মেয়েটাকে আমার পছন্দ হয়েছে। I like him. Him না বড় খালু, her. ঠিকই বলেছিস, her, I like her, Exceptional lady. তাই নাকি? তোর খালাকে একটা শিক্ষা দেয়ার জন্যে কইতরীকে বিয়ে করে ফেললে কেমন হয়? তাহলে তোর খালা সমাজে মুখ দেখাতে পারবে না। উচিত শিক্ষা হবে। সবাই বলবে—ছিঃ ছিঃ! ঝি বিয়ে করে ফেলেছে। হো-হো-হো। হি-হি-হি। আপনার অবস্থা কাহিল বলে মনে হচ্ছে। তোর খালার অবস্থা তো কাহিল করে ফেলব। একেবারে কাহিলেস্ট করে দেব। কাহিল-কাহিলার –কাহিলেস্ট, তখন সে বুঝবে হাউ মেনি রাইস, হাউ মেনি পেডি। হি-হি-হি। আমি দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললাম। ভালো যন্ত্রণায় পড়া গেল। হিমু! জি। একটা কী যে জরুরি কথা তোকে বলা দরকার, মনে পড়ছে না। ফরগটেন। মনে পড়লে বলবেন। খুবই জরুরি ব্যাপার। এখানে দাঁড়া। দাঁড়ালে মনে পড়বে। মাতাল মানুষের কাছে সবই জরুরি। তারা অতি তুচ্ছ ব্যাপারকে আকাশে তোলে। আমি বড় খালুকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। তাঁর কিছু মনে পড়ছে না। দাঁড়িয়ে থাকলে মনে পড়বে না। বরং আমরা হাঁটি। হাঁটলে ব্রেইন ঝাঁকুনি খাবে, তাতে যদি মনে আসে। এটা মন্দ না। তাঁকে নিয়ে হোটেলে ঢোকার আগে কিছুক্ষণ হাঁটলাম। তিনি হাঁটার সময় ইচ্ছে করে বেশি বিশি মাথা ঝাঁকালেন—তাতেও লাভ হলো না। হোটেলে খেতে বসে তাঁর মনে পড়ে গেল। আনন্দিত গলায় বললেন, মনে পড়েছে। আলেয়া এসেছিল তোর কাছে। চিনেছিস তো? সম্পর্কে তোর খালা হয়। তার বোনের মেয়েটাকে নিয়ে এসেছিস—খুকি নাম। পরীর মতো মেয়ে। কী জন্যে এসেছিলেন? খুকির বড় মেয়েটাকে তারা খুঁজে পাচ্ছে না। দুদিন হলো বাসা থেকে উধাও। তোর কাছে এসেছে, তুই যদি কিছু বলতে পারিস? আমি কী করে বলব? আমিও সেই কথাই ওদের বললাম। আমি বললাম—হিমু বলবে কী করে? ও কি ডিটেকটিভ ব্রাঞ্চের লোক? আলেয়া কিছুতেই মানবে না। আলেয়ার ধারণা, তুই চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ ধ্যান করলেই বলতে পারবি মেয়েটা কোথায় আছে।হা-হা-হা। মেয়েটার নাম কি পলিন? হুঁ। তুই চিনিস নাকি? চিনি। ধ্যান করে বলতে পারবি মেয়েটা কোথায়? না। ধ্যান কী করে করতে হয় জানি না। খুব ইজি। আমি তোকে শিখিয়ে দেব। প্রথমে ঘরটা অন্ধকার করবি। তারপর পদ্মসান হয়ে বসবি। খালি গা। সবচে’ ভালো হয় সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে বসলে…চোখ পুরোপুরি বন্ধও না, খোলাও না…. বড় খালু খুব আগ্রহ নিয়ে ধ্যানের কৌশল বলছেন। আমি শুনছি। ধ্যান করলে সব পাওয়া যায় রে হিমু, সব পাওয়া যায়। ধ্যান কর। ধ্যান। ধ্যান করব। রেস্টুরেন্টে ধ্যান সম্ভব না। বাসায় ফিরেই করব। রেস্টুরেন্টেও সম্ভব। এই দ্যাখ আমি করছি। আমাকে দেখে শিখে নে। তিনি উঠে দাঁড়িয়ে চোখ বন্ধ করে ধ্যান করতে লাগলেন। এবং ত্রিশ সেকেন্ডের মাথায় কাটা তালাগাছের মতো মেঝেতে পড়ে গেলেন। উঠলেন না। ওঠার অবস্থা নেই। তিনি ঘুমিয়ে পড়েছেন। আকাশ মেঘলা হয়েছিল। শীতকালে আকাশে মেঘ মানায় না। শীতের আকাশে থাকবে ঝকঝকে রোদ। আমি হাইকোর্টের সামনের রাস্তা দিয়ে হাঁটছি। আকাশের দিকে তাকিয়ে হাঁটছি বলেই একজনের গায়ে হুমড়ি খেয়ে পড়লাম। আমি লজ্জিত হয়ে কিছু বলার আগেই তিনি বললেন, মাফ করে দিয়েছি। আকাশের দিকে তাকিয়ে যে মন-খারাপ ভাবটা হয়েছিল—ভদ্রলোকের এক কথায় সেই মন-খারাপ ভাব দূর হয়ে গেল। খানিক্ষণ তাঁর সঙ্গে গল্প করি। ভদ্রলোক আমাকে সেই সুযোগ ও দিলেন না। গম্ভীর গলায় বললেন, আমি অনেকক্ষণ থেকেই দেখছি আপনি আকাশের দিকে তাকিয়ে হাঁটছেন। সব ঠিকঠাক তো? জি, সব ঠিকঠাক। আমার বাবা রিটায়ার পর ঠিক আপনার মতো আকাশের দিকে তাকিয়ে হাঁটা অভ্যাস করলেন। ফুটপাতে হাঁটলেও একটা কথা ছিল—উনি রাস্তাও পার হতেন আকাশের দিকে তাকিয়ে। গত বৎসর রাস্তা পার হবার সময় অ্যাক্সিডেন্ট করেন। একটা ট্রাক এসে তাঁকে চ্যাপ্টা করে রেখে চলে যায়। অনেকদিন পর আবার আপনাকে দেখলাম আকাশের দিকে তাকিয়ে হাঁটতে। এই অভ্যাস দূর করুন। জি আচ্ছা, করব। পথ চলবেন চোখ খোলা রেখে। চোখ খোলা রাখলে মনের চোখ বন্ধ হয়ে যায়। মনের চোখ বন্ধ থাকাই ভালো। আপনাকে কে যেন ডাকছে। ওই দেখুন গাড়ি? আমি এগুলাম গাড়ির দিকে। গাড়িতে যিনি বসে আছে তাঁকে চিনতে পারছি না। বিদেশী মহিলা মনে হয়—তুরস্ক-টুরস্ক হবে। অস্বাভাবিক লম্বা টানা টানা চোখ। কাঁচা হলুদের মতো গায়ের রঙ। লালচে চুল। বোরকা পরা। তবে বোরকার ভেতর থেকে মুখ বের হয়ে আছে। কালো বোরকার কারণেই বোধহয় তরুণীকে এমন অস্বাভাবিক রূপবতী লাগছে। ভদ্রমহিলার সঙ্গে কোন ভাষায় কথা বলব? ইংরেজি? সর্বনাশ হয়েছে—মনে মনে বাংলা থেকে ইংরেজি অনুবাদ করে কথা বলা—শাস্তির মতো। হিমু সাহেব। ইয়েস ম্যাডাম। কী করছেন? কিছু করছি না। উঠে আসুন। আমি ড্রাইভারের পাশে বসতে গেলাম, ভদ্রমহিলা ইশারা করলেন তাঁর সঙ্গে বসতে। আপনি কি আমাকে চিনতে পারছেন না? আমি মিতু। আমার মুখ হাঁ হয়ে গেল। এই মেয়ে যে শুধু নিজের চেহারা পাল্টে ফেলেছে তাই না—গলার স্বরও পাল্টেছে। ভারি স্বর। ইংরেজিতে একেই বোধহয় বলে ‘হাসকি ভয়েস’। হিমু সাহেব! জি। আমি যে আপনার পেছনে স্পাই লাগিয়ে রেখেছি সেটা কি জানেন? জি না, জানি না। স্পাই আছে। স্পাইয়ের কাজ হচ্ছে—আপনার ক্রিয়াকর্ম লক্ষ রাখা এবং আমাকে রিপোর্ট করা। হুঁ করছে। মিতু মুখের উপর বোরকা ফেলে দিল। গাড়ি মিরপুরের রাস্তা ধরে উড়ে চলছে। ব্যস্ত রাস্তা। এমন ব্যস্ত রাস্তায় ঝড়ের গতিতে গাড়ি চালাতে সাহস লাগে। ড্রাইভারের মনে হয় সেই সাহসের কিঞ্চিৎ অভাব আছে। তার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম, ঘনঘন কাশছে। আমি বললাম, আমরা কোথায় যাচ্ছি? মিতু বলল, কোথাও যাচ্ছি না। ঘুরছি। অকারণে ঘোরার অভ্যাস শুধু আপনার থাকবে, অন্য কারোর থাকবে না এটা মনে করা ঠিক না। আপনার চেয়েও অনেক বিচিত্র মানুষ থাকতে পারে। অব্যশই পারে। আমার স্পাই আপনার সম্বন্ধে কী বলল জানতে চান? জি না। আমার কৌতূহল কম। আমার কৌতূহল কম না। আমার কৌতূহল অনেক বেশি—আমি এখন আপনার নাড়িনক্ষত্র জানি। হাসবেন না। আমি কি একটা সিগারেট ধরাতে পারি? পারেন। আমি সিগারেট ধরালাম।মিতু বলল, আপনার এই বিচিত্র জীবনযাপনের উদ্দেশ্য কী? কোনো উদ্দেশ্য নেই। অল্প ক’দিনের জন্যে পৃথিবীতে এসেছি, নিজের মতো করে বাস করতে চাই। আপনি বিয়ে করেন নি? জি না। করবেন না? বুঝতে পারছি না। কাকে বিয়ে করবেন? রূপাকে? আমি আবারো হাসলাম। মিতু কঠিন গলায় বলল, হাসবেন না। প্রশ্ন জিজ্ঞেস করেছি, জবাব দিন। জানা থাকলে জবাব দিতাম। জবাব জানা নেই। আপনি দেশের বাইরে কখনো গিয়েছেন? জি না। যেতে চান? আমি চুপ করে রইলাম। মিতু বলল, চুপ করে থাকবেন না। এই প্রশ্নের জবাব নিশ্চয়ই আপনার জানা আছে—যদি যেতে চান আমাকে বলুন, আমি আপনাকে সারা পৃথিবী ঘুরিয়ে দেখাব। মরুভূমি দেখবেন—তুন্দ্রা অঞ্চল দেখবেন। শর্ত কী? কিসের শর্ত? অকারণে নিশ্চয়ই আপনি আমাকে এই সুযোগ দিচ্ছেন না। শর্ত নিশ্চয়ই আছে। সেই শর্তটা কী? আমারও ঘুরতে ইচ্ছে করে। একা একা ঘুরতে ভালো লাগে না। একজন সঙ্গী দরকার। পাহারাদার? পাহারাদার না, সঙ্গী। বন্ধু। আপনাকে আমার পছন্দ হয়েছে। আমার কোনো বন্ধু নেই। বাবার মৃত্যুর পর আমি একা হয়ে যাব। আপনার বাবা মারা যাবেন না—আমি পবিত্র মানুষ খুঁজে পেয়েছি। সেই পবিত্র মানুষটি কে? আছে একজন। সে কি রূপা? হ্যাঁ রূপা। কী করে ধরলেন? ইনট্যুশন ক্ষমতা শুধু যে আপনারই প্রবল। তাই তো দেখছি। আপনি একবার বলেছিলেন আপনার এক পরিচিত লোক আছে যে হারোনো মানুষের সন্ধান দিতে পারে। হ্যাঁ বলেছিলাম—চানখাঁরপুলে থাকে—করিম। তাঁর কাছে আমাকে নিয়ে চলুন তো। এখন যাবেন? হ্যাঁ এখন যাব। তার ক্ষমতা কী দেখব। যদি সে সত্যি কিছু পারে তাহলে… তাহলে কী? আমার একজন হারানো মানুষ আছে। তাকে খুঁজে পাওয়া যায় কি না দেখব। চলুন যাই। করিম তার ছাপড়ার ঘর থেকে বের হয়ে আনন্দে দাঁত বের করে ফেলল— আরে, হিমু ভাইজান আফনে? কেমন আছিস? ভালো আছি। আফনের দোয়। ব্যবসাপাতি কেমন হচ্ছে? ব্যবসা নাই বললেই হয়। কনটেকে একটা কাম করলাম—পুলা হারাইয়া গেছিল। পাঁচ হাজার টেকা কনটেক। বাইর কইরা দিলাম—এর পরে আর টেকা দেয় না। চইদ্দবার গেছি। কোনোবারে দেয় পঞ্চাশ, কোনোবারে কুড়ি… শেষে এমন গাইল দিছি—বলছি—হারামির বাচ্চা, তোর মারে আমি….. চুপ চুপ। ছরি ভাইজান, ছরি। মিসটেক হইছে—আপনের সাথে মেয়েছেলে আছে খিয়াল নাই। বোরকা পরা খালাম্মা—মাফ কইরা দিবেন। ছোটলোকের জাত—মুখের ভাষার নাই ঠিক…। আমি মিতুর দিকে তাকালাম। বোরকার ফাঁক দিয়ে একদৃষ্টিতে সে তাকিয়ে আছে করিমের দিকে। কিছুই বলছে না। আমি বললাম, একটা মেয়ে হারিয়ে গেছে। পলিন নাম। তার পেনসিল বক্সটা আমার সঙ্গে আছে। মেয়েটা কোথায় আছে বল। বাক্সটা দেন দেহি আমার হাতে। আমি পেনসিল বক্স তার হাতে দিলাম। বক্স হাতে নিয়েই করিম ফিরিয়ে দিয়ে বিরস গলায় বলল, হারাইছে কই! এই মেয়ে তার মার সাথেই আছে। মেয়ে ইশকুলে পড়ে। তার গালে পোড়া দাগ আছে। ভাইজান, ঠিক বলছি না? হ্যাঁ, ঠিক বলেছে। মিতু বলল, পেনসিল ব্ক্স হাতে নিয়েই বুঝে ফেললেন? জে। কীভাবে? কীভাবে এইটা তো খালাম্মা জানি না। আল্লাহপাক একটা ক্ষমতা দিছে। এই ক্ষমতা বেইচ্যা খাই। আমার একটা লোক খুঁজে দিতে পারবেন? জে পারব। অবশ্যই পারব। তয় খালাম্মা কনটেকে কাম করব। টেকা পুরাটা দিবেন এডভান্স। কাম করতে না পারলে গলায় ইটের মালা দিয়া কানে ধইরা শহরে চক্কর দেওয়াইবেন। করিমের এক কথা। যার খোঁজ চান—তার নাম দিবেন, ব্যবহারী জিনিস দিবেন। ছবি থাকলে ছবি দিবেন। বাকি আল্লাহর ইচ্ছা। আচ্ছা, আমি আসব। গাড়িতে উঠতে উঠতে বললাম, লোকটাকে কি আপনার বিশ্বাস হয়েছে? মিতু বলল, আপনার হয়? হ্যাঁ হয়। এই ক্ষমতা তার আছে। কীভাবে এই ক্ষমতা তার হয়েছে আমি জানি না। তবে হয়েছে। সে আপনার হারানো মানুষ খুঁজে দেবে। তবে…। তবে কী? যে হারিয়ে গেছে তাকে হারিয়ে যেতে দেয়াই ভালো। হারানো মানুষকে খুঁজে বের করতে নেই। মিতু বোধহয় কাঁদছে। বোরকায় মুখ ঢাকা বলে বুঝতে পারছি না। তবে বোরকার পরদা উঠিয়ে দিয়ে বলল, আপনি যদি আমার প্রস্তাবে রাজি থাকেন তাহলে আর হারানো মানুষ খুঁজব না। আপনি কি রাজি? আমি বললাম, না। না কেন? আপনার আকর্ষণী ক্ষমতা প্রবল। রূপার চেয়ে প্রবল। আমাকে এর বাইরে থাকতে হবে। কেন? আমার উপর এই হলো আদেশ। কার আদেশ? আমার বাবার। তিনি আমার নিয়তি নির্ধারণ করে দিয়েছেন। মিতু যাই। মিতু জবাব দিল না।


এডিট ডিলিট প্রিন্ট করুন  অভিযোগ করুন     

গল্পটি পড়েছেন ৬৪৮ জন


এ জাতীয় গল্প

→ পারাপার --হিমু সিরিজের ৪নং উপন্যাস (চ্যাপ্টার ৩) শেষ পর্ব
→ পারাপার --হিমু সিরিজের ৪নং উপন্যাস (চ্যাপ্টার ১)

গল্পটির রেটিং দিনঃ-

গল্পটির বিষয়ে মন্তব্য করুন

  • গল্পটির বিষয়ে মন্তব্য করতে আপনার একাউন্টে প্রবেশ করুন ... ধন্যবাদ... Login Now
  • shakil
    Guest ৭ বছর, ৪ মাস পুর্বে
    পারাপার টা এতদিন পড়ি পড়ি করে পড়া হয় নি থ্যাংকইউ